শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : জ্বালানি কাঠ বোঝাই কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি প্রাসাদের পিছনের দরজা দিয়ে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে ভিতরে এসেছে। জ্বালানি কাঠের খন্ডগুলো বয়ে আনা গাড়িগুলো থেকে নামিয়ে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। পুরো রাজ প্রাসাদটাই যেন আসন্ন শীত কালকে মোকাবেলার প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত।
বছরের একাদশ মাসের কোন একটা দিনে আমার কাছে থাকা সর্বশেষ কালো পাখাওয়ালা ঝিঁঝি পোকাটা নীরবে নিভৃতে মরে গেলো।
আমার মনে হচ্ছে এই ঘটনাটা আমাকে নিক্ষেপ করছে হতাশার মধ্যে, যেটা থাকবে বছরের পুরো সময়টা জুড়ে!

আমি প্রাসাদ তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দিলাম মরে যাওয়া ঝিঁঝি পোকাগুলোকে একত্রে করে একটা চমত্কার দুই স্তরের কফিনের মতো কাঠের বাক্সে ভরার জন্য। এটা হবে আমার দেয়া, আমার ভালোবাসার জীবন্ত আত্মাগুলোর জন্য প্রস্তুত করা শবাধার। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ওদেরকে শুদ্ধাচার অনুশীলন গৃহের আঙ্গিনায় সমাহিত করার।
আমি প্রাসাদ তত্ত¡াবধায়কে আঙ্গিনার সদর ফটক বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিলাম। তারপর, আমি এবং ইয়েন লাঙ বাগানে একটা ছোট গুহার মতো গর্ত খুঁড়লাম।
আমরা যখন এক সাথে ঝিঁঝি পোকাগুলোর শবাধারটা ঐ গুহার মধ্যে সমাহিত করে গুহার মুখটা কাদা মাটি দিয়ে বন্ধ করছিলাম, ঠিক তখন একে বারেই অপ্রত্যাশিতভাবে বাগানের সীমানা দেয়ালের একটা গোল ফোকরের মধ্যে সুন সিন পাগলার মুখটা দৃশ্যমান হলো, যেটা দেখে ইয়েন লাঙ ভয়ে চিত্কার করে উঠলো।

“ভয় পেয়ো না, সে হচ্ছে একটা পাগল!”, আমি ইয়েন লাঙ-কে বললাম, “ওকে পাত্তা দিও না, আমরা আমাদের কাজ করতে থাকি।
শুধুমাত্র হুয়াং ফু ফুরেন যেন আমাদের না দেখে, উনি ছাড়া যে কেউ আমাদের দেখুক না কেনো, ভয় পাওয়ার কোনই কারণ নেই!”
“সে তো আমাকে দেখলে ঢিল ছুঁড়ে মারে, আমার দিকে ঘৃণা ভরে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকায়।”, ইয়েন লাঙ ছুটে এসে নিজেকে আড়াল করে আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বিপন্ন স্বরে বললো, “আমি তো ওকে চিনি না, ও কেনে সব সময় আমার দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকায়?”
আমি মাথা তুলে তাকালাম, পাগলা সুন সিনের চোখ দু’টোয় আছে বিষাদ আর শোকের ছায়া! আমি সীমানা দেয়ালের ফোকরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি বললাম, “সুন সিন, তুমি তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও। আমার একে বারেই পছন্দ হচ্ছে না, তোমার এই দেয়ালের ফোকর দিয়ে চুপিচুপি তাকিয়ে থাকার কাজটা?”
আমার এই তীব্র তিরস্কার মাখা কন্ঠস্বর বোধ হয় সুন সিন শুনতে পায়নি। সে হঠাত করেই ফোকরের পাশে দেয়ালের গায়ে মাথা ঠুকান শুরু করলো বার বার! মাথা ঠোকার শব্দ খানিকটা প্রতিধ্বনিও হচ্ছিলো। আমি বিরক্ত হয়ে চিত্কার করে উঠলাম, “সুন সিন, তুমি কি করছো? তুমি কি বাঁচতে চাও না?”, সুন সিন ওর হাস্যকর দেয়ালে মাথা ঠুকার কাজটা বন্ধ করলো। তারপর, সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দিলো এক হাঁচি, এরপর সে বরাবরের মতোই বললো,
“ঘনিয়ে আসছে সিয়ে রাজ্যের বিপর্যয়!”
আমার পিছনে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা ইয়েন লাঙ বললো, “জাঁহাপনা, ও কি বলছে?”

“ওর কথায় কান দিও না, ও একটা পাগল! সে ঘুরে ফিরে একটা কথাই বলতে পারে!”, আমি বললাম, “তুমি কি চাও, আমি ওকে চলে যেতে বলি? সে কারো কথা শুনে না, কিন্তু আমার কথা শুনে!”
“সে তো অবশ্যই আপনার কথা শুনবে, জাঁহাপনা!”, ইয়েন লাঙ বিস্ময় ভরা চোখে লুকিয়ে আঁড়াল থেকে সুন সিনের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, জাঁহাপনা! কেনো ওর মতো একটা পাগলকে রাজ প্রাসাদে থাকতে দিয়েছেন!”
“সে কিন্তু আগে পাগল ছিলো না! কোন এক যুদ্ধের সময় সে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার পিতামহের জীবন রক্ষা করেছিলো। ও যত বড় অপরাধই করুক না কেনো, ওকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা যাবে না! এমন একটা ফরমান নিজের হাতে লিখে দিয়ে গেছেন সিয়ে রাজ্যের পঞ্চম রাজা! সেই জন্য সে যত পাগলামিই করুক না কেনো, কেউ-ই ওকে ঘাটায় না!”, সুন সিন সম্পর্কিত এই তথ্যটা আমি ইয়েন লাঙ-কে জানালাম।
প্রাসাদের অনেক অদ্ভুত জটিল দুর্বোধ্য বিষয়গুলো সম্পর্কে ওর সাথে গল্প করতে আমার খুব ভালো লাগছে!

সব শেষে আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, “তোমার কি মনে হয় না, এই লোকটা অন্য যে কোন কারো চেয়ে বেশি মজার মানুষ?”
“আমি জানি না! আমি খুব ছোট বেলা থেকেই পাগলদের ভয় পাই!”, ইয়েন লাঙ ভয় মাখা গলায় বললো!
“যাই হোক, যেহেতু তুমি ওকে ভয় পাও, আমি বরং ওকে চলে যেতে বলি। আমি একটা গাছের চিকন ডাল ভেঙ্গে দেয়ালের ফোঁকরের কাছে গিয়ে, ঐ ডালটা দিয়ে সুন সিনের নাকে দিলাম একটা খোঁচা! আমি সুন সিনের উদ্দেশ্যে বললাম, “তুমি যাও! তুমি তোমার অমরত্বের ওষুধ তৈরীর চুলার কাছে যাও!”
যেমনটি ভেবে ছিলাম, তাই-ই হলো, সুন সিন আমার কথা মান্য করে দেয়ালের ফোঁকর ছেড়ে চলে গেলো। যেতে যেতে সে চিত্কার করে বললো, “নপুংসক দাস পাচ্ছে রাজার অতিরিক্ত স্নেহ! ধেয়ে আসছে সিয়ে রাজ্যের বিপর্যয় কাল!”
রাজ দরবার চলার সময় আমি আমার পছন্দের মানুষদের কাছাকাছি থাকতে পারি না, এই সময় চার পাশে ঘিরে থাকে চার মন্ত্রণালয়ের চার মন্ত্রী; এদের মধ্যে আছেন : ধর্মীয় আচার বিষয়ক মন্ত্রী, জনপ্রশাসন বিষয়ক মন্ত্রী, যুদ্ধ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, দন্ড এবং শাস্তি বিষয়ক মন্ত্রী!
বিলাস কেন্দ্র প্রাসাদের সামনে স্থাপন করা পাথরের বেদীর প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে থাকেন প্রধানমন্ত্রী ফং আও। মন্ত্রীদের পিছনে থাকেন উচ্চ রাজ কর্মচারীর মর্যাদা নির্দেশক বিশেষ টুপি পরিহিত সামরিক ও বেসামরিক আমলাগণ।

কখনও কখনও রাজ দরবারে আসেন সিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত আঞ্চলিক শাসন কর্তা বা সুবাদারগণ রাজ-সাক্ষাতের জন্য। এদের পোশাকে সুঁই-সুতার কারুকাজে খোচিত থাকে কালো রঙের ছোট আকারের চিতা বাঘের মুখ। আমি জানি এরা সবাই আমার জ্ঞাতি জন, পূর্ববর্তী রাজাদের উত্তরাধিকারীগণ। এদের ধমনীতেও বইছে সিয়ে রাজ বংশের রাজ রক্ত। নানা কারণে ওরা সিয়ে রাজ্যের রাজ সিংহাসনে বসতে পারেননি। সিয়ে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এদেরকে নিয়োগ দিয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক শাসন কর্তা হিসেবে, যেমন উত্তর অঞ্চলে আছেন উত্তর জেলার সুবাদার দক্ষিণ অঞ্চলে আছেন দক্ষিণ জেলার সুবাদার, পূর্ব অঞ্চলে আছেন পূর্ব জেলার সুবাদার, পশ্চিম অঞ্চলে আছেন পশ্চিম জেলার সুবাদার, উত্তর পূর্ব অঞ্চলে আছেন উত্তর-পূর্ব জেলার সুবাদার, দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে আছেন দক্ষিণ-পশ্চিম জেলার সুবাদার, দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের জন্য আছেন দক্ষিণ-পূর্ব জেলার সুবাদার এবং উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের জন্য আছেন উত্তর-পশ্চিম জেলার সুবাদার।
সুবাদারদের মধ্যে কেউ কেউ আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, তাঁদের মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে। তাঁদেরকেও বিলাস কেন্দ্র প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে আমাকে সম্মান ও অভিবাদন জানাতে হচ্ছে।

যদিও তাঁদের কেউ-ই খুশি মনে এই কাজটা করছেন না! আসলে তাঁদের তো কোন গত্যন্তর নেই, রাজকীয় শিষ্ঠাচার অনুযায়ী তাঁরা এই কাজটি করতে বাধ্য হচ্ছেন!
কোন একবার আমি শুনতে পেয়েছিলাম, কোন এক অঞ্চলের সুবাদার মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করার সময় একটা পাদ দিয়ে ফেলেছিলেন! আমি নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে উচ্চ স্বরে হেসে উঠেছিলাম। আমি ঠিক বুঝতে পারি নাই পাদটা দিয়ে ছিলেন কে? তিনি কি পূর্ব জেলার সুবাদার না কি দক্ষিণ-পূর্ব জেলার সুবাদার! তবে যেটা হয়েছিলো, হাসতে হাসতে আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো! প্রাসাদ সেবকরা দ্রুত ছুটে এসে আমার কোমর আর পিঠে হালকা আঘাত করে আমাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছিলো।

ঐ আঞ্চলিক সুবাদার খুব বিব্রত বোধ করছিলেন, লজ্জায় তাঁর মুখ মণ্ডল লাল হয়ে উঠেছিলো, একটু পরে তিনি আবার দিলেন একটা পাদ! এবার আমি হাসতে হাসতে হয়ে গেলাম প্রায় বেহুঁশ! আমি বসেছিলাম সিংহাসনে, হাসির দমকে সামনে পিছনে ডানে বামে দুলে উঠলাম! লক্ষ্য করলাম হুয়াং ফু ফুরেন, তাঁর হাতের লাঠিটা খানিকটা উঁচু করে তুলে একটু দুলিয়ে নিয়ে ঐ আঞ্চলিক সুবাদারের নুয়ে থাকা নিতম্বে হালকা করে একটা বাড়ি মারলেন। ঐ দুর্ভাগা আঞ্চলিক সুবাদার তাঁর গায়ের পোশাক টেনেটুনে ঠিক করে ক্ষমা চাচ্ছিলেন বার বার, তিনি তোতলামির জড়তা নিয়ে হুয়াং ফু ফুরেনের দিকে তাকিয়ে নিজের ভুলের কথা বলছিলেন। তিনি বললেন, “সিয়ে রাজ্যের রাজ দর্শনের আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দেয়ার জন্য আমি তারা ভরা অন্ধকার রাতে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে তিন শ’ লি-র পথ অতিক্রম করেছি। রাস্তায় পেয়েছি শীতের বাতাসের ঝাপটা, এরপর পথে সরাইখানায় খেয়েছি দু’টো খাসির রান, তাই পেটের বাতাস চেপে রাখতে পারি নাই!”
ওনার ব্যাখা হুয়াং ফু ফুরেনকে আরও রাগান্বিত করলো, তিনি হাতের লাঠিটা আবার তুলে নিয়ে বেশ জোড়ে একটা বাড়ি দিলেন ঐ সুবাদারের পশ্চত দেশে। হুয়াং ফু ফুরেন তীরষ্কারের স্বরে বললেন, “রাজ-দর্শনে এসে কোন হাস্যকর কাজ করা যায় না। তুমি কোন সাহসে এ রকম সময় পাদ মেরেছো?”

স্মরণাতীতকালে ওটাই ছিলো সবচেয়ে মজাদার রাজ-দর্শন অনুষ্ঠান! কিন্তু আফসোস, ও রকম ঘটনা ঘটেছিলো মাত্র এক বারই! হুয়াং ফু ফুরেন এবং ফং আও ও তাঁর মন্ত্রীদের মধ্যে যুদ্ধ নীতি, সৈনিকদের বেতন, জমির খাজনা এ সব নানা বিধ এক ঘেয়ে বিষয়ে আলোচনা শুনার চেয়ে ঐ সুবাদারের পাদের শব্দ শুনা আমার কাছে ছিলো বেশি মজাদার ব্যাপার!
বিলাস কেন্দ্র প্রাসাদের নীচে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের হাতে আসা সম্রাটকে উদ্দেশ্য করে প্রেরণ করা আমলাদের কাজের বিবরণ, বিভিন্ন চিঠি, অভিবাদন বার্তা আর উপহারসমূহ, পত্র ও উপহার নিরীক্ষকের হাত ঘুরে আসে আমার সামনে। আমার দৃষ্টিতে এ সব বার্তা, বিবরণ আর চিঠি নিরস আবর্জনা মতো, সাহিত্যের বিচারে কিছু নিম্ন মানের শব্দ চয়ন সম্বলিত বাণী বৈ অন্য কিছু নয়!

এ ধরনের অভিবাদন কিংবা অভিনন্দন বার্তা আমার কাছে একেবারেই ভালো লাগে না। আমি লক্ষ্য করেছি, হুয়াং ফু ফুরেনও এগুলো পছন্দ করেন না! কিন্তু তবুও তিনি পত্র নিরীক্ষককে ঐ বার্তাগুলো সবার সামনে জোড়ে পাঠ করার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন।
কোন একবার পত্র নিরীক্ষক উচ্চ স্বরে পড়ছিলো যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান সচিব লি ইউ-র পাঠানো বার্তার বিবরণ। ঐ কার্য বিবরণীতে বলা হয়েছে যে, পশ্চিম অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় বহিঃশত্রুর অনুপ্রবেশ ঘটছে খুব ঘন ঘন। ওরা আমাদের সীমানার ভিতরে ঢুকে আক্রমণ চলাচ্ছে, রক্তপাত ঘটাচ্ছে। পরিস্থিতি বিপজ্জনক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এরই মধ্যে এগারো বার খন্ড যুদ্ধ হয়েছে।
বার্তায় আশা প্রকাশ করে বলা হয়েছে যে সিয়ে দেশের সম্রাট নিজে এসে সীমান্ত এলাকা দেখে যাবেন। আর তা হলে সীমান্ত প্রহরারত সৈনিকরা পাবে উত্সাহ ও উদ্দীপনা, বারবে ওদের মনোবল।

এই প্রথম বারের মতো আমি শুনতে পেলাম কোন আমলার পাঠানো কার্যবিবরণী যাতে সরাসরি আমার সম্পৃক্ততা আছে। আমি সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হুয়াং ফু ফুরেনের মুখের দিকে তাকালাম। কিন্তু উনি আমার চোখের দিকে তাকালেন না।
হুয়াং ফু ফুরেন খুব অল্প সময়ের জন্য বিড় বিড় করে কি যেন বললেন, যা শোনা গেলো না। এর পর তিনি ঘুরে বসলেন প্রধানমন্ত্রী ফং আও এর দিকে মুখ করে, তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন প্রধানমন্ত্রীর অভিমত।
ফং আও, ওনার সাদা হয়ে যাওয়া গোঁফের উপর হাত বুলিয়ে নিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “পশ্চিম সীমান্তে শত্রুদের ঘন ঘন ডাকাতের মতো হানা দেওয়া সিয়ে দেশের জন্য একটা দীর্ঘস্থায়ী অপ্রকাশ্য বিপদ। যদি সীমান্ত রক্ষীরা এক ধাক্কায় ফং হুয়াং গিরিপথের বাইরে শত্রæ ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়, তবে সিয়ে দেশের অর্ধেকের বেশি আয়তনের এলাকা পাবে নিরাপত্তা আর সুরক্ষার নিশ্চয়তা! সৈনিকদের মনোবল কোনভাবেই ক্ষুন্ন করা যাবে না। সিয়ে সম্রাটের অবশ্যই পশ্চিম সীমান্ত পরিদর্শনে যাওয়া দরকার।”

ফং আও আরও কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। তিনি কায়দা করে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন। তারপর হঠাত্ করেই কেশে কেশে গলা পরিষ্কার করা শুরু করলেন। হুয়াং ফু ফুরেন খুব বিরক্ত হলেন, বিরক্তির বহিঃপ্রকাশে তাঁর চোখের ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হলো। তিনি অধৈর্য হয়ে তিন বার তাঁর হাতের লাঠিটা দিয়ে মেঝেতে ঠক ঠক করে ঠুকলেন।

“কথা বলার সময় তো তো কোরো না! আমি তোমাকে বলতে বলছি, তুমি অন্য কারো মুখের দিকে চেয়ে কথা বোলো না।”, হুয়াং ফু ফুরেনের কন্ঠস্বরের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে ছিলো ক্রোধের অভিব্যক্তি। তিনি বললেন, “ফং আও, তুমি বলে যাও, থেমে যেও না।”
ফং আও একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমি একটা বিষয়ে খুব উদ্বিগ্ন, সিয়ে দেশের সম্রাট এখনও বয়সে খুবই তরুণ। যেতে হবে প্রায় পাঁচ শত লি দূরত্বের পথ, যাত্রা পথে আছে তুষার আর দমকা বাতাসের ঝাপটা। ভ্রমণটা হবে খুব পরিশ্রম সাধ্য আর কষ্টকর। আমার ভয় হচ্ছে, এই কষ্টকর যাত্রায় সিয়ে সম্রাটের শরীর খারাপ হয়ে যেতে পারে, অপ্রত্যাশিত হীমেল বাতাসের মধ্যে চলার সময় ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।”

হুয়াং ফু ফুরেনের ঠোঁটে একটা শীতল দুর্বোধ্য হাসির ভাব ফুটে উঠলো, যেটা তাঁর অবয়বে সচরাচর দেখা যায় না। তিনি বললেন, “তোমার বক্তব্যের তাত্পর্য আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমি তোমাকে বলছি, সিয়ে দেশের সম্রাট অল্প কালের জন্য সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে গেলে, যাওয়ার পথে কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনাই ঘটবে না, রাজ প্রাসাদের ভিতরেও ঘটবে না কোন অনভিপ্রেত কাজ, আমি অর্থাত এই বুড়ো মানুষটা সিয়ে রাজ প্রাসাদকে সামাল দিতে পারবো, মন্ত্রীবৃন্দ নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন!”
তাদের মধ্যকার দুর্বোধ্য আলোচনার কিছুই আমি বুঝতে পারি না। যা কি না আমার মনের মধ্যে তৈরী করে হতাশা আর ক্ষোভ। তারা যখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে একটা শুভ দিন ও ক্ষণ গননা করে ঠিক করে, আমাকে রওয়ানা দিতে হবে, যেতে হবে সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে, তাদের কথা শুনে হঠাত করেই আমি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলাম, উচ্চ স্বরে বললাম, “আমি যাবো না!”
আমার দাদী আমার কথা শুনে খানিকটা হতবাক হয়ে গেলেন! আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “তোমার কি হয়েছে?”, তিনি আরও বললেন, “ক্রীড়াচ্ছলে কোন কথা বলা, সম্রাটের মুখে শোভা পায় না। মুখে যা আসে রাজ সভায় বসে কোন বিবেচনা ছাড়া তা প্রকাশ করা ঠিক না।”

“তোমরা আমাকে যেতে বলছো, তাই আমি যাবো না। যদি তোমরা আমাকে না যেতে বলো, তা হলে আমি যাবো!”, আমি আরও বললাম, “তোমরা যা বলবে, আমি করবো ঠিক তার উল্টা কাজ!”
আমার অভিব্যক্তি দেখে এবং আমার কথা শুনে তারা সবাই একে বারে বোকা বনে গেলেন, তাকিয়ে রইলেন আমার চেহারার দিকে। একটা অপদস্ত ভাব ফুটে উঠলো হুয়াং ফু ফুরেনের চেহারার মধ্যে। তিনি প্রধানমন্ত্রী ফং আও এর উদ্দেশ্যে বললেন, “সম্রাট এখনও পরিণত বয়সে পৌঁছায়নি? সে কথা বলছে খেলার ছলে। প্রধানমন্ত্রীর এই সময় সম্রাটের কথাকে গুরুত্ব দেয়া ঠিক হবে না।”

আমি খুবই রাগান্বিত হয়েছি। বার বার আমাকে সম্বোধন করা হচ্ছে সিয়ে দেশের সার্বভৌম সম্রাট বলে, কিন্তু সব কিছুই সংগঠিত হচ্ছে, কার্যকরী হচ্ছে আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেনের হুকুমে, এটা কি একটা প্রকাশ্য মশকরা নয়? হুয়াং ফু ফুরেন নিজেকে জাহির করেন একজন স্নেহময় প্রজ্ঞাবান মানুষ হিসেবে। আর বাস্তবে এই বৃদ্ধা হচ্ছেন একজন জটিল ব্যক্তিত্বের দুর্বোধ্য মানুষ! আমি আর কারো সাথেই কোন রাগারাগি করতে চাচ্ছি না।
আমার ইচ্ছা করছে জামা কাপড় খুলে নগ্ন হয়ে বিলাস কেন্দ্র প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে। আর এমনটা ভেবেই পিছনে দাঁড়ানো প্রাসাদ ভৃত্যর উদ্দেশ্যে বললাম, “আমার জন্য পায়খানার গামলাটা নিয়ে এসো, আমার পায়খানা করতে ইচ্ছা করছে! তোমাদের যদি অপছন্দ হয় তাহলে তোমরা একটু দূরে গিয়ে বসতে পারো।”
এ কথাগুলো আমি ইচ্ছা করে হুয়াং ফু ফুরেন-কে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম। তাঁকে ধোঁকা দিতে চাইলাম। তিনি রাগত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে মুখটা ঘুরিয়ে অন্য দিকে সরে বসলেন। একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হজম করে তিনি খুব বড় একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন, যার শব্দ আমি শুনতে পেলাম। এরপর হাতের লাঠিটা মেঝেতে ঠুকে তিন বার ঠক ঠক আওয়াজ করে তিনি বললেন, “সম্রাটের শরীরটা বিশেষ ভালো নেই। একটু আগে ভাগেই রাজ দরবারের কার্যক্রম শেষ করতে হচ্ছে আজ!”

পুরো রাজ প্রাসাদে আমার পশ্চিম সীমান্ত পরিদর্শনের ব্যাপারটা নিয়ে শুরু হলো বেশ গুঞ্জন। আমার মাতা মং ফুরেন বিশেষ ভাবে উদ্বিগ্ন হলেন। তাঁর কাছে মনে হলো গোটা ব্যপারটাই হচ্ছে একটা চক্রান্ত। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, এই ভেবে যে আমি প্রাসাদ ত্যাগ করা মাত্র যে কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটবে। ওদের সবারই একটা লোভী দৃষ্টি আছে সিংহাসনটার প্রতি।
তিনি আমাকে বললেন, “ওরা নানা ভাবে গোপনে গোপনে রাতের অন্ধকারে তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।”, আমার মাতা কাঁদতে কাঁদতে আমার উদ্দেশ্যে বললেন, “তুমি অবশ্যই খুব সতর্ক থেকো। যারা তোমার সফর সঙ্গী হবে, তারা যেন অবশ্যই বিশ্বস্ত ও নির্ভর যোগ্য মানুষ হয়। তোমার ভাই তুয়ান ওয়েন যেন তোমার সফর সঙ্গী না হয়, কোন অপরিচিত লোককেও সাথে নিও না।” (চলবে)