শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন, আমি তাঁর পিঠের ছায়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, “গুরুজী, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“তিক্ত বাঁশ মন্দিরে।”
সন্ন্যাসী চুয়ে খোং হেঁটে গিয়ে একটু দাঁড়ালেন, তিনি দুই হাতের তালু কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে এক সাথে জড়ো করে আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন কিছুক্ষণ।
সব শেষে আমি শুনতে পেলাম তাঁর অস্পষ্ট কন্ঠস্বর, “তিক্ত বাঁশ বনের ভিতরে আছে, তিক্ত বাঁশের মন্দির, তিক্ত বাঁশ পাহাড়ে আছে তিক্ত বাঁশের বন!”
চোখ ভরা অশ্রু ধারা নেমে আসছে আমার দুই গাল বেয়ে। আমি জানি, ঠিক এই সময়ে, এই স্থানে, এই পরিবেশে আমার আচরণ ও অবয়ব মোটেও মানানসই নয়!
কিন্তু আমি তো হচ্ছি সিয়ে রাজ্যের রাজা, আমার তো ক্ষমতা আছে, আমার যা মন চায় আমি তাই করবো! আমার কাঁদতে ইচ্ছা করলে, আমি কাঁদবো!
তাতে আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেনের কি আসে যায়? আমি কাঁদলে উনি কেনো আমাকে বকা দিবেন?

আমি চোখের পানি মুছতে মুছতে বিলাস কেন্দ্র প্রাসাদের দিকে চললাম। ঐ নপুংসক বালক ভৃত্যরা আগের মতোই হাঁটু গেড়ে দুই হাত মাটিতে ঠেকিয়ে মাথা নীচু করে অভিবাদনের ভঙ্গিতে বসে আছে, এরা যেন একেক জন একেকটা কাঠের খুঁটি। ওদের মধ্যে কেউ কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে মাথা তুলে আমার অশ্রু ভেজা মুখটা দেখছে।

এই বর্ষণ মুখর রাতে আমি আবার দেখলাম এক দুঃস্বপ্ন! স্বপ্নের মধ্যে দেখলাম এক দল সাদা রঙের ছোট ছোট ভূত আমার খাটের চার পাশে দাঁড়িয়ে হু হু করে কাঁদছে! ওদের দেহগুলো অনেকটা কাপড় দিয়ে তৈরী পুতুলের মতো, মুখগুলো যেন হুবহু আমার খুবই চেনা জানা প্রাসাদের কয়েক জন! তাদের মধ্যে একজনের মুখটা ইয়াং ফুরেনের মুখ, যাকে জীবন্ত অবস্থায় কবর দেয়া হয়েছিলো।

আরেক জন দেখতে হুবহু তাই নিয়াং এর মতো, যার হাতের দশটা আঙ্গুল আর মুখের জিহ্বাটা কেটে ফেলা হয়েছে। আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম, আমার শরীর বেয়ে নামলো একটা ঠান্ডা ঘামের ধারা। স্বপ্নের ঘোর কাটার পর আমি শুনতে পেলাম জানালার বাইরে বৃষ্টির শব্দ, যা তখনও পরছিল, শেষ হয়নি। আমি যেন আগের মতোই দেখতে পাচ্ছি আরাম কেদারার উপরে রাখা কারুকাজ খোচিত লেপের উপর দ্রুত ছুটাছুটি করা ছোট ছোট সাদা রঙের ভূতগুলোর ছায়া। আমি খুব জোড়ে সশব্দে আরাম কেদারার গদীর উপর বাড়ি মারলাম। আরাম কেদারার নীচে তন্দ্রায় নিমঘ্ন প্রাসাদ দাসীরা একে একে উঠে গেলো, সবাই এসে জমায়েত হলো আমার পাশে। ওরা সবাই হয়ে পরেছে হতবিহ্বল! বাক রুদ্ধ হতবাক হয়ে একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। এক জন দাসী দু’হাতে তুলে এনেছে চিলমচিটা।

“আমার তো পেশাব ধরেনি। তোমরা তাড়াতাড়ি আমার বিছানার উপরের ভূতগুলো তাড়িয়ে দাও।”, আমি জোড়ে বিছানা চাপড়িয়ে চিত্কার করে দাসীদের বললাম, “তোমরা বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তাড়াতাড়ি হাত লাগাও, ভূতদের বিদায় করো!”
“ভূত নেই! জাঁহাপনা, ওটা তো চাঁদের আলো!”, একজন দাসী বললো।
“জাঁহাপনা, ওটা হচ্ছে প্রাসাদের লন্ঠনের ছায়া!”, আরেক জন দাসী বললো।

“বোকার হদ্দ কোথাকার, তোমরা সবাই অন্ধ হয়ে গেছো! তোমরা কি কেউই দেখতে পাচ্ছো না? এই যে সাদা ভূতগুলো আমার পায়ের রানের উপর দিয়ে ছুটাছুটি করছে!”, ওদের বকা দিতে দিতে আমি আরাম কেদারা থেকে লাফিয়ে নামলাম। আমি বললাম, “তোমরা চুয়ে খোংকে খুঁজে নিয়ে আসো, তাঁকে বলো, এই সাদা ভূতগুলোর সবগুলোকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে।”

“জাঁহাপনা, চুয়ে খোং গুরুজী তো আজই প্রাসাদ ছেড়ে চলে গেছেন।”, প্রাসাদ দাসীরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো সমস্বরে। তারা আবারও বিছানার উপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করলো সাদা ছোট ছোট ভূতগুলোকে, কিন্তু কিছুই তাদের নজরে আসলো না!
আমি হঠাত করেই সংবিত ফিরে পেলাম, আমি মনে করতে পারলাম এই বর্ষণ মুখর রাতে সন্ন্যাসী চুয়ে খোং ইতিমধ্যেই বেড়িয়ে বেড়িয়ে গেছেন জলজ ঘাসের দেশের তিক্ত বাঁশ মন্দিরের পথে। আমার কাছ থেকে ভূত আর দানবগুলোকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি আর আসবেন না!

‘চুয়ে খোংএর চলে যাওয়া, শীঘ্রই বয়ে আনছে সিয়ে রাজ্যের বিপর্যয়!’, আমার মাথায় হঠাত করেই আসলো বুড়ো পাগলা সুন সিনের এর আওরানো অদ্ভুত ভবিষ্যত বাণীটা!
আমার মনে হচ্ছে, আমার প্রতি প্রচন্ড অবিচার করা হয়েছে, আমার খুবই রাগ হচ্ছে! আশে পাশের প্রাসাদ দাসীরা সবাই খুবই ক্লান্ত, ওদের চোখে আসছে ঘুম। ওদের সবার হতবিহ্বল দৃষ্টি আমাকে করছে আরো রাগান্বিত, আরও বিরক্ত। আমি প্রাসাদ দাসীর হাতে থাকা চিলমচিটা টান দিয়ে ছিনিয়ে নিলাম, তারপর খুব জোড়ে সেটাকে ছুঁড়ে মারলাম মেঝেতে। এই বর্ষণ মুখর রাতে মেঝের টালি ফেটে যাওয়ার অস্বাভাবিক শব্দও যেন পরিষ্কার একটা সুর-ধ্বনি তৈরী করলো! প্রাসাদ দাসীরা সবাই ভয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে আমাকে প্রণিপাত করলো একবার!

“চিলমচিটা ভেঙ্গে গেছে! সিয়ে দেশের বিপর্যয়ও ধেয়ে আসছে!”, আমি বুড়ো সুন সিনের গলার স্বর অনুকরণ করে প্রাসাদ দাসীদের উদ্দেশ্যে বললাম, “আমি দেখতে পাচ্ছি সাদা রঙের ছোট ছোট ভূতগুলো! ওগুলোর সাথেই, ধেয়ে আসছে, সিয়ে রাজ্যের বিপর্যয়!”
আরাম কেদারার উপর চলে আসা ছোট ছোট সাদা রঙের ভূতগুলোর উত্পাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমি নিয়ম ভেঙ্গে দু’জন প্রাসাদ দাসীকে রাতে আমার দু’পাশে ঘুমাতে আদেশ দিলাম, এ ছাড়াও দু’জন দাসীকে হুকুম দিলাম, খাটের নীচে বসে বহু তারের বীণা বাজিয়ে যাত্রার পালা গান গাইতে।

সাদা ভূতগুলো ধীরে ধীরে পালিয়ে যাওয়ার পর, বাইরের বাগান থেকে আসা বৃষ্টির শব্দও গেলো মিলিয়ে! বারান্দার ছাদের প্রসারিত অংশ থেকে চুইয়ে পরা বৃষ্টির পানি যা পরছিলো কলা পাতাগুলোর উপর, তাও ক্ষীণ হয়ে এসেছে, পরছে টপ টপ করে।
প্রাসাদ দাসীদের ব্যবহার করা প্রসাধনীর সুবাস আমি পাচ্ছিলাম, আর একই সাথে আমার নাকে আসছিলো জানালার বাইরে থেকে আসা পঁচে যাওয়া লতাপাতা আর মরে যাওয়া ঝিঁঝি পোকাগুলোর পঁচা-গলা দেহের দুর্গন্ধ! আর এটাই যেন সেই আদিকাল থেকে রয়ে যাওয়া সিয়ে প্রাসাদের দীর্ঘশ্বাস!
এটা ছিল আমার রাজকীয় কর্ম জীবনের একেবারে প্রথম দিকের একটা গহীন অন্ধকার রাত্রি!

আমার সেবার কাজে নিয়োজিত আটজন প্রাসাদ দাসীর স্থলাভিষিক্ত হলো আটজন নপুংসক খোজা দাস। এটা ঘটলো হুয়াং ফু ফুরেনের নির্দেশে।

তিনি, আলোচনা করার সুযোগ নেই এমন কন্ঠস্বরে আমার সাথে কথা বললেন, “তুমি পছন্দ করো বা না করো, এই প্রাসাদ দাসীদের অবশ্যই শুদ্ধাচার অনুশীলন গৃহ ছেড়ে চলে যেতে হবে।”, তিনি বললেন যে, সিয়ে দেশের ভূতপূর্ব সব রাজাদের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম প্রযোজ্য ছিলো, রাজার বয়ঃসন্ধি কাল সমাগত হলে, রাজার সেবায় নিয়োজিত প্রাসাদ দাসীদের স্থলাভিষিক্ত হবে নপুংসক খোজা দাসরা।
আর এটাই না কি রাজ প্রাসাদের চিরায়ত রীতি নীতি! হুয়াং ফু ফুরেন এমন কথা বলার পর আমার আর কোন উপায় থাকলো না অন্য কিছু ভাববার।
শুদ্ধাচার অনুশীলন গৃহের আটজন প্রাসাদ দাসী অশ্রুসিক্ত নয়নে আমার কাছ থেকে বিদায় নিলো।

প্রত্যেকটা মেয়েই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে। আমারও খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু আমার তো কোন উপায় নেই! একজন প্রাসাদ দাসী বললো, “আজকের দিনের পরে আপনার সাথে বোধ হয় আর দেখা হবে না। আমার খুব ইচ্ছা করছে আপনার পা স্পর্শ করতে, পা দু’খানি টিপে দিতে, আপনার পা দু’টি স্পর্শ করার সুযোগ পাওয়া তো আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের, আর এই সৌভাগ্য ছায়ার মতো থাকবে আমার সারাটা জীবন কালে।”
আমি পায়ের মৌজা খুলে পা দু’টো উঁচু করে ধরলাম মেয়েটির সামনে, ওর গরম অশ্রুজলের কয়েক ফোঁটা ঝরে পরলো আমার পায়ের উপর।
বাকি সাতটি মেয়ে ওকে অনুসরণ করে আমার খুব কাছাকাছি এসে বসলো।
পা টিপে দেয়ার এই আচার-অনুষ্ঠান চললো অনেক ক্ষণ ধরে, পুনরাবৃত্তি ঘটলো কয়েক বার। এরই মধ্যে একজন প্রাসাদ দাসী চুপিচুপি আমার একটা পায়ের পাতার উপর দিলো একটা চুমু! আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, “আমার পায়ে তো আছে ধূলো ময়লা! এই ধূলো তো তোমার মুখে গেছে, তোমার কি ভয় করছে না?”, মেয়েটি ফুঁপিয়ে কেঁদে জবাব দিলো, “জাঁহাপনার পা ময়লা হতে পারে না। এই দাসীর ঠোঁটের চেয়ে জাঁহাপনার পদ যুগল অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন!”

শুদ্ধাচার অনুশীলন গৃহে আসা আটজন নপুংসক খোজা দাসদের নির্বাচন করলেন আমার মাতা মং ফুরেন। তাঁর বেছে নেয়া প্রায় সব খোজা দাসই এসেছে তাঁর নিজ জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। সবাই খুব সুদর্শন। আমি আগেই বলেছি যে, ছোট বেলা থেকেই আমি খোজা দাসদের পছন্দ করি না। তাই ওরা যখন আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে অভিবাদন জানাতে এলো, তখন আমি ওদের দিকে খুব ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এরপর শুদ্ধাচার অনুশীলন গৃহের বাইরে নানা রকম খেলার দক্ষতা দেখাতে নির্দেশ দিলাম। মাটির উপর দাগ কেটে, দাগের উপর দিয়ে লাফালাফি করার খেলাটা খেলতে বললাম। ওদের মধ্যে কে কে খেলায় একটু বেশি পারদর্শী তা যাচাই করতে চাচ্ছিলাম। যে রকম আশা করেছিলাম, সে রকম দক্ষতা তারা দেখাতে পারলো না। তারা খানিক ক্ষণ খেলে আর খেলতে পারলো না! তাদের মধ্যে কেউ কেউ একে বারেই দম ধরে রাখতে পারে না। আবার কারো কারো আছে হাঁপানি রোগ। ওরা ঘেমে চুপ চুপে হয়ে মানুষ হাসালো।

শুধু একটা মাত্র অল্প বয়সী ছেলের মধ্যে দেখলাম প্রাণবন্ত ভাব, খেলাগুলোতেও বেশ দক্ষতা দেখালো সে। দাগ টানা লাফালাফি খেলায় সে বেশ কিছু কলাকৌশল দেখালো, যা আমি আগে জানতাম না। আমি লক্ষ্য করলাম, ওর অবয়বের মধ্যে খানিকটা মেয়েদের মতো কমনীয়তা আছে। ওর লাফ দেয়ার ভঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছে সাবলীলতা আর প্রাণ চঞ্চলতা। মাটিতে দাগ কেটে হা ডু ডু’র মতো খেলা হচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় একটা খেলা, যেটা মোটেও রাজ পরিবারের প্রচলিত ক্রীড়া নয়! কাবাডি খেলার মতো খেলায় ঐ ধরনের ক্রীড়া নৈপুণ্য যা কি না আমার কাছে বেশ খানিকটা অপরিচিত। এই নৈপুণ্য আমাকে মুগ্ধ করেছে।
খানিক ক্ষণ পরে আমি ছেলেটাকে ডাকলাম এবং আমার সামনে আসতে বললাম।
“তোমার নাম কি?”
“ইয়েন লাঙ, ছোট কালে আমার নাম ছিলো সুয়ো আ’র, পাঠশালায় আমার নাম ছিলো খাই ছি।”

“তোমার বয়স কত?”, আমি হেসে উঠলাম! ওর কথার ধরনে আমার মনে হচ্ছে যে, ছেলেটা বেশ চটপটে আর বুদ্ধিমান।
ছেলেটি বললো, “আমার বয়স বারো বছর, আমি মেষ রাশির জাতক।”
আমি বললাম, “রাতে তুমি আমার বিছানার নীচে শুয়ে থাকবে। আমি ইয়েন লাঙের কাঁধে হাত রেখে ওকে কাছে টেনে নিয়ে আসলাম। ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপিচুপি বললাম, “আমরা এক সাথে প্রতিদিনই মাটিতে দাগ কেটে লাফ দেয়ার খেলাটা খেলবো!”

ইয়েন লাঙের লাজুক চেহারাটা খানিকটা লাল হয়ে গেছে। আমি লক্ষ্য করলাম ওর চোখের তারা জোড়া পানির মতই স্বচ্ছ আর পরিষ্কার। ওর লম্বা সরু কালো ভ্রæ-র এক প্রান্তে আছে একটা অদ্ভুত লাল জন্মদাগ। ওটা দেখে আমি খুবই অবাক হলাম। আমি আমার হাতের অঙ্গুল দিয়ে ঐ লাল রঙের জন্ম দাগটা টেনে তুলে ফেলতে চাইলাম। হয়তো আমার প্রয়োগ করা বলের পরিমাণ একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল, ইয়েন লাঙ ব্যথায় লাফিয়ে উঠলো। সে মুখ দিয়ে বলেনি তার ব্যথার কথা, কিন্তু তার মুখ অবয়ব প্রকাশ করছিলো যে, সে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে। আমি দেখলাম সে হাত দিয়ে লাল জন্ম দাগটা ঢেকে মাটিতে গড়িয়ে পরলো। অবশ্য একটু পরেই লাফ দিয়ে উঠে বসলো। তারপর মাটিতে মাথা ঠুকে বললো, “জাঁহাপনা, আমাকে ক্ষমা করেন।”

আমার কাছে মনে হচ্ছে, ইয়েন লাঙ একটা মজার মানুষ! আমি আমার আসন থেকে লাফ দিয়ে নেমে, হেঁটে ইয়েন লাঙের কাছে গিয়ে ওকে দু’হাত দিয়ে উঁচু করে ধরলাম। তারপর প্রাসাদ দাসীদের কাছ থেকে শেখা একটা কাজ করলাম! মুখ থেকে খানিকটা লালা নিয়ে ওর লাল জন্ম দাগটার উপর লেপে দিলাম। আমি ইয়েন লাঙ-কে বললাম, “আসলে আমি তোমার সাথে খানিকটা মজা করছিলাম। খানিকটা থুতু ঘষে দিয়েছি ঐ জায়গাটায়, এখন আর ব্যথা করবে না!”

অশ্রু সজল চোখে যে প্রাসাদ দাসীগুলো কিছু দিন আগে শুদ্ধাচার অনুশীলন গৃহ ত্যাগ করে চলে গেছে, আমি তাদের এখন একে বারেই ভুলে গেছি! গত একটা বছরে সিয়ে রাজ প্রাসাদের ভেতর অনেক ঘটনাই ঘটেছে, অনেক পুরনো মানুষের বদলে এসেছে অনেক নতুন মুখ! প্রাসাদ দাসী আর নপুংসক দাসদের রদবদল হয়েছে অনেকটা নাটকের দৃশ্য পট পাল্টানোর মতোই! চৌদ্দ বছর বয়সের একজন সম্রাটের কাছে, কাউকে পছন্দ করা কিংবা মন চাইলে কাউকে ভুলে যাওয়া, দু’টোই হচ্ছে খুব সহজে ঘটে যাওয়া ঘটনা!
আমার খুব ইচ্ছা করে, ইয়েন লাঙের নপুংসক হওয়ার পর ওর দেহের নীচের অংশের কি অবস্থা হয়েছে সেটা জানার!
একবার আমি ওকে জোড় করলাম, হুকুম দিলাম কাপড় খুলে শরীরের নীচের অংশ আমাকে দেখাবার জন্য। সাথে সাথে ইয়েন লাঙের মুখটা সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। সে আমাকে খুব মিনতি করে বললো, ওকে যেন বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে না ফেলি। সে ওর কোমর বন্ধটা দু’হাত দিয়ে টান টান করে টেনে ধরে রাখলো। আমি আমার কৌতুহল চেপে রাখতে পারছিলাম না! সবশেষে ইয়েন লাঙ ওর পায়জামাটা খুললো, আর সেই সাথে উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠলো। সে মুখটাকে এক পাশে ফিরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “জাঁহাপনা, তাড়াতাড়ি দেখার কাজ শেষ করেন।”

আমি খুব ভালো করে ইয়েন লাঙের গোপন অঙ্গ পর্যবেক্ষণ করলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, ইয়েন লাঙের গোপন অঙ্গটায় আছে ক্ষত চিহ্ন, সেটা যেন স্বাভাবিক মানুষের মতো নয়। একটু স্ফীত, তার উপরে আছে একটা আবছা লাল রঙের পোড়া দাগ!
আমি জানি না কেনো, হঠাত করেই আমার মনের পটে ভেসে উঠলো হীম প্রাসাদের তাই নিয়াং এর ফুলে থাকা হাতটার ছবি! আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না, আমার এই অনুভূতিটা কেমন!
তবে আমি বুঝতে পারছি যে, আমার মন খারাপ হয়ে গেছে!
“তুমি অন্য আট-দশটা সাধারণ মানুষের মতো নও!
কে তোমাকে খোজা বানিয়েছে?”, আমি ইয়েন লাঙ-কে প্রশ্ন করলাম।
“আমার বাবা!”, ইয়েন লাঙ কান্না চেপে রাখলো। সে বললো, “আমার বাবা একজন কামার।
যে বার, আমার আট বছর পূর্ণ হয়, সেই বছর, আমার বাবা একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এক টুকরো লোহার পাতকে গন গনে আগুনে লাল করে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তৈরী করেন একটা ছোট ছুরি, আর সেটা দিয়ে অপসারণ করা হয় আমার শুক্রাশয় দু’টো!
আমি মরার মতো অজ্ঞান হয়ে পরেছিলাম তিন দিন।”
“কেনো এমন করা হয়েছে? তুমি কি বলেছিলে যে তুমি খোজা হতে চাও?”
“আমি কিছুই জানতাম না! আমার বাবা আমাকে ব্যথা সহ্য করতে নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন, ‘যদি এক বার প্রাসাদে ঢুকতে পারো, যেতে পারো সম্রাটের কাছাকাছি, তাহলে আর জীবনে খাওয়া-পড়ার অভাব থাকবে না’, তিনি আরও বলেছেন, ‘প্রাসাদে ঢুকতে পারলে তুমি বাবা-মা-র জন্যও কিছু করতে পারবে, তুমি তোমার পূর্ব পুরুষদের গড়া বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে!’”
“তোমার বাবা হচ্ছে একটা জানোয়ার! কবে যে আমার সাথে ওর দেখা হবে!
আমি সাথে সাথেই হুকুম দেবো, ওর অন্ডকোষ কেটে ওকে খোজা বানিয়ে দিতে!
আমি দেখতে চাই, ওর কেমন ব্যথা লাগে।”
এরপর, আমি বললাম, “ঠিক আছে, এখন তুমি তোমার পায়জামাটা পরে নাও।”
ইয়েন লাঙ খুব দ্রুততার সাথে পায়জামাটা পরে নিলো।ওর মুখ থেকে কান্নার ভাব চলে গেলো, ফুটে উঠলো হাসির ছাপ। আমি দেখতে পাচ্ছি, ওর ভ্রæ-র পাশে থাকা লাল জন্ম দগটা যেন, রেশমের পর্দার গায়ে ঝুলতে থাকা মূল্যবান চুনি পাথরের মতো মিট মিট করে জ্বলছে, বিকিরণ করছে আলো!

এখন শরত কাল। এটা হচ্ছে পাতা ঝরার সময়। প্রাসাদ ভৃত্যরা প্রাসাদের চত্বরে পরে থাকা মরা পাতা ও গাছের ডাল ঝাড়ু দিয়ে এক জায়গায় সুমার করছে। কাঠ মিস্ত্রি এসেছে, প্রাসাদের বড় জানালার পাল্লার ফাঁক হয়ে যাওয়া কাঠের মাঝে চিকন কাঠের টুকরা বসিয়ে ফাঁকগুলো বুজে দিতে, উদ্দেশ্য উত্তর থেকে পাক খেয়ে বালি বয়ে আনা বাতাসকে ঠেকানো। (চলবে)