রবার্ট ইগার, অনুবাদ: কোরবান আলী : (ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিকদা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’-এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

তিন.
প্রথম অধ্যায় : শেকড়ের কথা (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে কাজ করার রোমাঞ্চ মুহূর্তেই উবে গেলো যখন আমি আমার কাজের জায়গায় বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম। তারও আগে লড়াই করার জন্য আমার নিজস্ব নাটকের দৃশ্য আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি যে ছোট্ট বিভাগে কাজ করছিলাম তার প্রধান ছিলো একজন দূর্নীতিবাজ, নষ্ট মানুষ। সে অন্য বিভাগের কাজের জন্য আমাদের বিভাগের বাজেটের তহবিল (সে বলতো, ‘সরকারি মাল’) থেকে বিক্রেতাদের এবং সরবরাহকারীদের অর্থ প্রদান করতো। নিজের এবং এবিসি কোম্পানির অন্যান্য নির্বাহীদের বাসার কাজ করিয়ে নিতে কোম্পানির খরচে ঠিকাদারদের ব্যবহার করতো। আবার ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজের পকেট ভর্তি করতো। নাটক মঞ্চায়নের উদ্দেশ্যে আসবাবপত্র কিনে শহরের মাঝামাঝি এলাকায় অবস্থিত তার উপপত্নীর বাসা সাজাতো। আমাকে এ সমস্ত কাজে সাহায্য করতে হোত। এ সমস্ত কাজ করতে যেয়ে আমি ভীষণভাবে বিরক্ত হোতাম। কিছুদিনের মধ্যেই আমি আমার সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করা শুরু করলাম এ সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমার করণীয় সম্পর্কে। কিন্তু কথাগুলো আবার তার কাছেই ফিরে যেত।

একদিন সে আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠালো। কক্ষে প্রবেশ করা মাত্র সে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলল। বলল, ‘তুমি কত বড় কর্মকর্তা হয়েছো যে নিজে নতুন বাসায় উঠার জন্য অফিসের গাড়ি ব্যবহার কর?’

সত্যি কথা বলতে অফিসের পিক-আপ-ভ্যান ব্যবহার করা আমার কোন এখতিয়ার ছিলো না। আমি আমার এক সহকর্মীর কাছে রসিকতা করে বলেছিলাম আমি আমার নতুন ভাড়া করা বাসায় উঠার জন্য অফিসের গাড়ি ব্যবহার করতে পারি। আমি তাকে বললাম আমার ব্যক্তিগত কাজে অফিসের কোন কিছুই আমি কখনও ব্যবহার করিনি। কিন্তু আমি নিশ্চিৎ আমার কোন সহকর্মী আমার সম্পর্কে তাকে কুমন্ত্রণা দিয়েছে। বলেছে ছেলেটা সমস্যা সৃষ্টি করে।

‘তুমি আমার বিরুদ্ধে গুজব রটনা করছ’ সে বলল। আমি তার বিরুদ্ধে কথা বলছি এটা সত্য। আমি অস্বীকার করলাম না। সে আমাকে অনেক বকাঝকা করল, অনেক নিচে নামিয়ে দিলো। বলল, ‘এখানে তোমার কোনদিন কিচ্ছু হবে না।’

অন্য কোন বিভাগে কাজ খুঁজে নেবার জন্য সে আমাকে দুই সপ্তাহ সময় দিলো। অথবা চাকুরী ছেড়ে অন্যত্র যাবার জন্য বলল। আমার বয়স তখন তেইশ, টেলিভিশনের পেশা প্রায় শেষ হতে চলেছে। কিন্তু আমি হতাশ না হয়ে চাকুরীর নোটিশ বোর্ডের দিকে গেলাম। দেখলাম এবিসি টেলিভিশনে ২৫টি খালি পদের জন্য আবেদনের সুযোগ আছে, কিন্তু একটিতেও আবেদন করার মতো আমার যোগ্যতা নেই। সিনেট্রার কনসার্ট করতে যেয়ে একজনের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো আমি তাকে টেলিফোন করে আমার অবস্থার কথা বললাম। সে আমাকে ১৩৩০ নম্বরে আসতে বলল। ১৩৩০ নম্বর হচ্ছে এবিসি কোম্পানির প্রধান কার্যালয়। আমেরিকাসের ১৩৩০ নম্বর এ্যভিনিউ। এবং একমাস পরে এবিসি স্পোর্টসের চিত্রশালা পরিচালনার তত্বাবধায়ক পদে চাকুরী হয়ে গেলো। যে কাজটা আমি কেবলমাত্র হারালাম, সেটার তুলনায় এর পরিধি একটু বড়। চাকুরী হারালাম, নতুন চাকুরী পেলাম ঘটনা দুটি আমার পেশাগত জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটায়। কেন যেন আমার মনে হতে লাগলো আমি সিনেট্রার কাছে ঋণী। পরে জানতে পারলাম আত্মসাতের অভিযোগে আগের বসের চাকুরী চলে গেছে।

এবিসি কোম্পানির উত্তাল সময় সত্তরের দশক থেকে আশির দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। এ সময়ে এবিসি স্পোর্টস সবচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জনকারী বিভাগ ছিলো। মানডে নাইট ফুটবল এবং ওয়াইড ওয়ার্ল্ড অব স্পোর্টস ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ছিলো। কলেজ ফুটবল, বেজবলের প্রধান খেলাগুলো, গুরুত্বপূর্ণ গল্ফ টুর্নমেন্ট, বক্সিং চাম্পিয়নশীপ সমান জনপ্রিয় ছিলো। দা আমেরিকান স্পোর্টসম্যান এবং দা সুপারস্টার অনেক জনপ্রিয় ছিলো। ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস সরাসরি স¤প্রচার করতো এবিসি স্পোর্টস।

যারা স্পোর্টসে কাজ করতো এবিসি কোম্পানিতে তাদের ‘শান্ত ছেলের দল’ বলে সম্বোধন করা হতো। তাদের চলাফেরা, খাওয়, পরিধানের কাপড় সবকিছুই অন্যরকম ছিলো। তারা সবসময় শরীরের মাপে জামা কাপড় পড়তো, মোজা ছাড়া দামী জুতা পড়তো। তারা দুপুরের খাবারের সাথে দামী মদ বা স্কচ পান করতো। হলিউড তারকা, বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ, রাজনীতিবিদ তাদের সাথে আড্ডা দিতে পছন্দ করতো। তারা প্রায়শই বিদেশে কোথাও না কোথাও কাজে ব্যাস্ত সময় কাটাত। তারা বিমানে করে প্যারিসে এবিসি টেলিভিশনের অফিসে যেত আবার সেখান থেকে কোন খেলাধুলার চিত্রধারণ ও স¤প্রচারের জন্য মন্টে কার্লো বা সেইন্ট মরিজ বা অন্য কোথাও যেত।

শেষ পর্যন্ত আমার পদমর্যাদা এতোটায় উপরে উঠে যে কোম্পানির খরচে কনকোর্ড বিমানে ভ্রমণ আমার অধিকারের মধ্যে চলে আসে। মূলত এবিসির ওয়াইড ওয়ার্ল্ড অব স্পোর্টস আমার জীবন বদলে দেয়। এ বিভাগে যোগদানের পূর্বে আমি কখনও দেশের বাইরে যায়নি। হঠাৎ করেই আমি সারা বিশ্ব ভ্রমণ করা শুরু করি। (জিম ম্যাককেইনের উদ্বোধনী কন্ঠস্বর ইথারে সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাজতে থাকে আর আমরা সারা পৃথিবী চষে নিত্য-নতুন খেলা-ধূলা সংগ্রহ করতে থাকি।) যে কোন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমাকে ব্যাস্ত থাকতে হতো, হয়তো হাওয়াইয়ের সার্ফিং চ্যাম্পিয়নশিপে অথবা প্রাগের ফিগার-স্কেটিং খেলায় অথবা বুদাপেস্টের ভার উত্তোলন প্রতিযোগীতায় অথবা চায়েনের ফ্রন্টিয়ার ডেজ রোডিওতে। অ্যাকাপুলকোতে ক্লিফ ডাইভিং, চাইনা, রোমানিয়া বা রাশায় জিমনাস্টিক।

এবিসি স্পোর্টস আমাকে পৃথিবী দেখিয়েছে, ধীরেধীরে আমি পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে উঠেছি। এমন সমস্ত বিষয় আমার সম্মূখে উন্মোচিত হয়েছে যা আমি কখনও চিন্তা করিনি। আমার পরিষ্কার মনে আছে আমি কবে, কখন, কোথায় প্যারিসে প্রথম উপাদেয় ফ্রেঞ্চ খাবার খেয়েছি। আমি কখন প্রথম ‘মন্ট্রাচেট’ শব্দটি উচ্চারণ করেছি। আমি কখন বিলাস বহুল স্পোর্টস-কার মোনাকো চালানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করি। একটা ছেলে যে কিনা নিউ ইওর্কের ওসেনসাইড এলাকার একটা বাসায় বড় হয়েছে তার পক্ষে কিভাবে সম্ভব। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে। এটি বিলাস বহুল উন্নত জীবন যাপনের চেয়েও বেশি ছিলো। আমি নিয়মিত উন্নয়নশীল দেশগুলো পরিভ্রমণ করতাম। একরোখা দুর্নীতিগ্রস্থ পরিচালনা কমিটির সাথে আলোচনা করে বাইজেনটাইন প্রথাগুলোর সাথে সমন্বয় করে সাম্যবাদী দেশগুলোর খেলাধুলার অনুষ্ঠানগুলো স¤প্রচার করতাম। আমি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি কিভাবে মানুষ লোহার ফটকের আড়ালে বসবাস করতো, আর তাদের জীবনের প্রতিদিনের দুর্ভোগ সহ্য করতো। (শীতকালে যখন সরকার বৈদ্যুতিক গ্রীডে বিদ্যুৎ সঞ্চালন বন্ধ করে দিতো তখন আমি অন্ধকারাচ্ছন্ন বুখারেস্ট শহরের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতাম, সে কথা আজও ভুলিনি।) তাদের স্বপ্নগুলো খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম, সেগুলো আমেরিকার গড়পরতা মানুষের স্বপ্নের চেয়ে কোনভাবেই আলাদা ছিলো না। রাজনীতিকরা পৃথিবীটাকে দিখন্ডিত করার তাগিদ অনুভব করেন, তৈরি করতে চান ‘আমরা বনাম তারা’ অথবা ‘ভালো বনাম মন্দ’ আমি তার চেয়েও নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখী হয়েছি এই সমস্ত পূর্ব-ইউরোপীয় দেশসমূহে।

অতীত এবং বর্তমানের যতো জাঁকজমকপূর্ণ স্থাপনা, জীবনযাপন দেখেছি মনের মুকুরে একই ধরনের কথামালা ভেসে উঠেছে সেটা হচ্ছে ‘অযৌক্তিক, দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন, অবান্তর, কোন মানে হয় না’। সে যাই হোক এবিসি স্পোর্টস তখনও নিজ কক্ষপথে দাপটের সাথে স্বমহিমায় ঘুর্ণয়মান, স্বভাবগত কারণে এবিসির অন্যসব বিভাগগুলোকে এবিসি স্পোর্টস নিয়ন্ত্রণ করতো। রুন আরলেজই এবিসি স্পোর্টসের মধ্যমণি। ১৯৬০ সালে রুন আরলেজকে এ বিভাগ পরিচালনার দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। যখন আমার এবিসি স্পোর্টসে পদার্পন, তখন রুন টেলিভিশন জগতের রাজাধিরাজ। সম্পচার ইতিহাসে তিনিই প্রথম স¤প্রচার কৌশলে বিপ্লব ঘটান। আমরা টিলিভিশনে খেলাধুলা সংক্রান্ত যা কিছু দেখি তার সবই রুনের অবদান।
তিনিই সর্বপ্রথম জেনেছিলেন আমরা শুধুই ঘটনার স¤প্রচার করতে আসিনি, আমরা গল্প বলতে এসেছি। আর কোন মহৎ গল্প বলতে বড় প্রতিভার প্রয়োজন। তিনিই নিরঙ্কুশ যোগ্যতম ব্যাক্তি যার অধীনে আমি কাজ করেছি। অক্লান্ত উদ্ভাবকও বটে। তিনি এও জানতেন তাঁর চার পশের লোকজনও অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত এবং মেধাবী। তাঁর চার পাশের প্রথম তিনজন হলেন জিম ম্যাককে, হাওয়ার্ড কসেল, কেইথ জ্যাকসন। স্কী খেলা স¤প্রচারের জন্য ছিলেন ফ্রাঙ্ক জিফর্ড, ডন মেরিডিথ, ক্রিস স্কেনকেল। মোটর রেসিং এর জন্য ছিলেন জ্যাকি স্ট্যুয়ার্ট। এরা সবাই ছিলেন প্রবলভাবে আকর্ষণীয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। এদের প্রত্যেকের নাম মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত। সবকিছুই সম্ভব হয়েছিলো রুনের সৃজনশীলতার কারণে।

ওয়াইড ওয়ার্ল্ড আব স্পোর্টস টেলিভিশন প্রগ্রামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সময় রুনের একটা বাক্য আমি আজও ভুলতে পারিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘খেলাধুলা প্রতিযোগীতার মানব নাটক আমরা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে চাই’। আমরা যারা টেলিভিশনে তার পরিকল্পিত ও পরিচালিত খেলাধুলার যে প্রগ্রামগুলো স¤প্রচার করতাম সেগুলোকে তিনি এভাবেই দেখতেন। তিনি মনে করতেন বিশ্বমঞ্চে প্রত্যেক ক্রীড়াবিদই একটা চরিত্রে অভিনয় করছেন। সেগুলো ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় দেখানো হোত না। তাদের বাড়ি কোথায়? কি কি বাধা পেরিয়ে তারা এখানে এসেছেন? রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে এ প্রতিযোগীতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ কেমন? ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে এ প্রতিযোগীতার তাৎপর্য কেমন? এভাবে আমরা শুধু খেলাধুলাই আমেরিকাবাসীর সামনে তুলে ধরতাম না বরং গোটা বিশ্বকে তাদের সামনে পরিবেশন করতাম। কয়েক কোটি আমেরিকাবাসী তাদের বসার ঘরে সোফায় হেলান দিয়ে বিশ্ব চালচিত্র পর্যবেক্ষণ করতে পারতেন।

আমি যত জনের নেতৃত্বে কাজ করেছি তার মধ্যে তিনিই প্রথম যিনি চিত্রধারণে উন্নততর প্রযুক্তির প্রয়োগ ভালোবাসতেন। নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা অসাধ্য সাধন করেছিলাম। চিত্রধারণ ও স¤প্রচার জগতে বিপ্লব সংগঠিত হয়। রিভার্স-এ্যঙ্গেল ক্যামেরা, স্লো-মোশন রিপ্লে, সেটেলাইটের মাধ্যমে সরাসরি স¤প্রচার সবই রুনের আবিষ্কার। তিনি চিত্রধারণে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের পরিক্ষামূলক ব্যাবহার নিশ্চিৎ করেছেন এবং পুরনো প্রথা নিয়ম-কানুন ভেঙ্গে নতুন নিয়ম-কানুন নির্মাণ করেছেন। তিনি সবসময় অভিনব উপায় খুঁজতেন দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এবং দর্শক-শোতাকে রীতিমতো মুগ্ধ করে ফেলতেন। রুন আমাকে প্রশাসনিক ভাষা ও উচ্চারণ শিখিয়েছিলেন যা পরবর্তী সমস্ত পেশাগত জীবনে আমাকে নির্দেশনা দিয়েছে। তিনি বলতেন, অভিনব কিছু কর অথবা মর। আরও বলতেন, আপনি যদি নতুন কোনকিছু করার কোন চেষ্টাই না করেন, নতুনকে যদি ভয় পান, তবে আপনি আপনার কাজে অভিনবত্ব আনতে পারবেন না।

তিনি কোন কাজই শেষ করতেন না, যতক্ষণ না সেটি শতভাগ নিখুঁত হয়। এবিসি স্পোর্টসে শুরুর দিকে আমি প্রত্যেক সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ছেষট্টিতম সড়কের নিচের তলায় নিয়ন্ত্রণ দপ্তরে কাজ করতাম। আমার কাজই ছিলো সারা বিশ্ব থেকে আগত ছবি সংগ্রহ করা আর সেগুলো প্রযোজক আর সম্পাদকদের হস্তান্তর করা। তারা সেগুলো কাটছাঁট করে কন্ঠ দিয়ে স¤প্রচারের জন্য পাঠাতেন। সেই নিয়ন্ত্রণ কক্ষে প্রায় রুন আসতেন। কখনও কখনও তিনি আসতে পারতেন না তখন তিনি ফোনে আমাদের সাথে কথা বলতেন। (নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের প্রতিটি কক্ষে শুধুমাত্র রুনের সাথে কথা বলার জন্য একটি করে লাল রঙের ফোন ছিলো। যখন কোন সরাসরি স¤প্রচারের কাজে মাঠ পর্যায়ে কাজে থাকতাম তখনও সেখানে লাল রঙের ফোন থাকতো।) স্পোর্টসের কোন স¤প্রচার তিনি দেখেননি তা কখনও হয়নি। অনেক সময় বাসায় বসে বা অন্য কোথাও থেকে তিনি অনুষ্ঠান দেখছেন এবং তার পছন্দ হয়নি এমন কিছু প্রচারিত হচ্ছে তিনি ফোন করে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ফিডব্যাক দিতেন। এই ক্যামেরার এ্যাঙ্গেল ভুল। ঐ ধারাভাষ্যে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা দর্শকদের আগেই বলতে চাইনা পরবর্তীতে কি প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে!

বিস্তারিতভাবে না বললে সেটা রুনের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো না, বলতেন খুব ছোট হয়েছে। যে কাজের ছোট ছোট খুঁতগুলো দূর করা হয়েছে সেটিই তাঁর কাছে নিখুঁত কাজ। সিনেট্রা কনসার্টের মতো আমি এমন অসংখ্য অনুষ্ঠানের কথা জানি যেটি স¤প্রচারের আগের দিন তিনি সমস্ত গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন করে অনুষ্ঠান নির্মাণ করতেন। টিমের সমস্ত মানুষকে পুনর্র্নিমাণ কাজে নিয়োজিত করতে দেখেছি। প্রয়োজনে তিনি রাতভোর ছবি কাটাছেঁড়া করে তার কাঙ্খিত অনুষ্ঠান পুনরায় নির্মাণ করেছেন। তাঁকে কখনও চিৎকার করতে দেখিনি, কাজের ক্ষেত্রে তিনি বলিষ্ঠ ও নির্মম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভুল ধরিয়ে দিতেন এবং বলতেন ভুল শুধরানোর দ্বায়িত্ব আমাদের সবার। কি পরিমান কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে এই ভুলগুলো শুধরানো সম্ভব তা তিনি কখনই বিবেচনায় আনতেন না। অনুষ্ঠানটি নিখুঁতভাবে স¤প্রচারিত হবে এটিই আসল কথা। অনুষ্ঠানটিই তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারপর যারা অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছে তাদের গুরুত্ব। আপনি যদি রুনের অধীনে কাজ করেন তবে শান্তিপূর্ণ সহবস্থান বজায় রাখার একমাত্র উপায় হচ্ছে মনোযোগ দিয়ে নিখুঁতভাবে কাজ করুন। কোন কিছুকে চমকপ্রদ করে তোলার ক্ষেত্রে তার যে একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা তা ছিলো দুর্দান্ত, অসাধারণ। বেশিরভাগ সময় এটি হতো ভিষণ বিরক্তিকর, ভিষণ হতাশাজনক কারণ তিনি একেবারে শেষ মুহূর্তে এ পরবির্তনের নির্দেশনাগুলো দিতেন। কিন্তু নতুন দৃষ্টিভঙ্গি কর্মীদের অনুপ্রাণিতও করতো। হতাশার চেয়ে অনিুপ্রেরণার পাল্লায় ভারি হতো। আপনি জানতেন তিনি একটা অনুষ্ঠানকে চমকপ্রদ করে তুলতে তার প্রচেষ্টা ও যতেœর সীমা পরিসীমা থাকতো না। আপনাকে শুধু আপনার অংশটুকু তার প্রত্যাশা মাফিক সংশোধন করতে হতো। (চলবে)