খুরশীদ শাম্মী : বিশাল এক সুগার ম্যাপল গাছ শাখা-প্রশাখা মেলে আপন মনে দাঁড়িয়ে। উড়ে উড়ে ক্লান্ত পাখিরা বিরাম নেয় তার কোলে, প্রেমালাপ করে, গলা সাধে। তার শক্ত কায়া চিরে ঘর বাঁধে বন্য প্রাণী। তার তলায় বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পথিক, স্বেচ্ছাসেবী শ্রমিক। ওই বৃক্ষছায়ায় শ্যামলের ভারী দেহ দূর্বাঘাস বিছানো জমিন বুকে আসন পেতে বসে। ধুপ-ধুপ নিঃশ্বাস নেয় গোটা দশেক। ক্লান্ত দেহ জুড়ায় ত্বরিত, শূন্যে বিচরণ করে মন, স্বপ্ন আঁকে, গল্প বাঁধে। গল্পের চরিত্রগুলো নিত্যদিনের মতো লকলকিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। লজ্জা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় তার অন্তর। একা-ই সে ফিক-ফিক হাসে। হ্যাঁ, চশমার আড়ালে শ্যামলের অনড় দৃষ্টি শ্যাম বাগানের তরে।

সম্মুখ সারিতে রূপবতী ডেইজি দাঁড়িয়ে। লাবণ্য তার অলংকার। স্নিগ্ধতা মাখামাখি, যেন সদ্য প্রস্ফুটিত হয়েছে। দৈহিক গড়নও বেশ ভালো। উচ্চতা ও প্রশস্ততা উভয় দিকেই আকর্ষণীয়। সেইজন্য তার বিশেষ খাদ্য তালিকা অনুসরণ করার প্রয়োজন হয় না কখনো। নিজের বৃদ্ধি নিয়ে অহংকার তার ঢের। রোদ বৃষ্টি যা-ই হোক হাত-পা নেড়ে সে মাথা উঁচু করেই থাকে।
ডেইজির নিকটতম পড়োশি চন্দ্রমল্লিকা। তার বৃদ্ধি ডেইজির থেকে ভালো না হলেও, একই হাওয়া, জল ব্যবহারে তার সমতুল্য হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার দেহে আশ্রয় নিয়েছে একদল অণুজীব। শুধু আশ্রয় নিয়েই ক্ষান্ত দেয়নি, অণুজীবগুলো কামড়িয়ে ঝাঁজরা করে দিয়েছে তার শিরা-উপশিরা, নষ্ট করে দিয়েছে সৌন্দর্য। চন্দ্রমল্লিকা জীবনযুদ্ধে বেশ অবসন্ন। মাথানত করে সে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাটিয়ে দেয় দিনের অধিকাংশ।

তাদের অদূরেই থাকে বেলি। আকারে ক্ষুদ্র হলেও তার ডাঁট কম নয়। মিটমিটিয়ে হাসে আর চারপাশ সুবাসিত করে। শুভ্রতা ও কোমলতা তার পোশাক। জনগণ তাকে পছন্দ করে। সেই গর্বে তার বুক ফাটে, তাই অল্পতেই অক্কা পায়।

তাদের ডানপাশে থাকে নীলমণি, বামপাশে ঝুমকোলতা। উভয়ের গঠন মিষ্টি উপচে পড়া। প্রেমের রং নীল-বেগুণি তাদের ঠোঁটে। প্রণয় ছুঁই ছুঁই দৃষ্টি। চলনে ভরা তারুণ্য, বেশ আলগোছে, চতুর্দিকে লটকানো। ওই আলগোছে স্বভাবই তাদের বাধ্য করে পরনির্ভরশীল হতে। তবুও চলার পথে পথিক হয় অভিভূত, প্রশংসা করে তাদের উন্মুক্ত সৌন্দর্য। মাঝেমধ্যে প্রেমিক বাবুদের হোঁচট খাওয়াও থাকে না অবশিষ্ট। লিঙ্গবৈষম্য তাদের মধ্যে খুব পরিলক্ষিত, সুযোগ পেলে নারীর কেশ আলিঙ্গনে কার্পণ্য করে না একটুও।

বাগানের এক কোণে দোল খায় বেগুন। রূপ ও গুণে সে সর্বদা লোভনীয়। কণ্টকমালা তার গলা জড়িয়ে থাকলেও তার সজীবতায় আকৃষ্ট হয় সকলে। কিন্তু তার অপেক্ষা বাবুর্চি, খানসামার জন্য। অন্তিম গন্তব্য তার খাদ্যবিলাসী পর্যন্ত।

উল্টো পাশে বাতাসে দোল খায় গোলাপ। ফুরফুরে মেজাজে সৌরভ ছড়ায়। সৌন্দর্য তার পরতে পরতে। প্রেম জয়ের এক মহৌষধও সে। গ্রহণযোগ্যতা তার সর্বস্তরে। তাই দেমাগ করে সে নিঃসংকোচে। প্রজাপতি ডানা মেলে পাপড়ি জড়িয়ে চুমু খায়।

শ্যামল দৃষ্টি সরিয়ে নিজের হাত দেখে। হাতে লেপ্টে থাকা মাটি শুকিয়ে চটা ধরেছে। বিরতি শেষ করতেই হয়। হাত-পা ঝেড়ে পুনরায় কাজে লেগে পড়ে সে। শান্ত চিত্তে লোহার খোন্তা চালায় মাটির বুকে। ভূপৃষ্ঠ কেটে বায়ু চলাচলের সুযোগ করে দেয়। জল ঢেলে তাদের তেষ্টা মেটায়। ওদিকে নিজের গলা শুকিয়ে কাষ্ঠ হয়, তা দেখার সময় নেই যেন। এ আর নতুন কী? প্রতিদিনই এমন হয় তার। দু’বেলা সে পরিদর্শন করে শ্যাম বাগান। শ্যামল কেবল একজন পরিদর্শক নয়, শ্যাম বাগানের সকল সদস্যের পরিচর্যাও করে। তাদের খাওয়ানো, স্নান করানো, নখ-চুল কেটে পরিপাটি রাখা, সবই সে দায়িত্ব নিয়ে করে।

শ্যামলের মতো নিয়মিত বাগান পরিদর্শন করে কালু ও ধলু। চেহারা তাদের নিতান্ত নিরীহ, সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর মতো নিষ্পাপ। আজও তারা বাগানে উপস্থিত হতে ব্যতিক্রম ঘটায়নি। তারাও এসেছে। তবে, শ্যামলকে দেখে দূরেই বসে। চুপচাপ গোঁফে তেল দেয়। ঠোঁট চেটে অগ্রিম বেগুনের স্বাদ লয় মনে মনে। তাদের অপেক্ষা শ্যামলের প্রস্থান। হ্যাঁ, প্রতিদিন একাধিকবার শ্যাম বাগান ঘুরে বেড়ায় কালু-ধলু সুখী দম্পতি। এই কালু-ধলু দম্পতির চেহারার সাথে তাদের কাজের অমিল ঠিক যেন রাত-দিন। তারা স্বার্থপর। তারা তাদের স্বার্থের জন্য করতে পারে না এমন কিছু নেই। ন্যায় ও অন্যায় বিচারের প্রয়োজন বোধ করে না, সবই তাদের কাছে অধিকার বলে মনে হয়। আলোচনা কিংবা দাবি তোলার ধার ধারে না, যখন ইচ্ছে তখন সরাসরি হামলা চালায়। নির্লজ্জ এই দম্পতি সুযোগ পেলেই দৌড়ে এসে ডেইজি, চন্দ্রমল্লিকা, বেলির শরীরের গন্ধ নেয়, কচমচ খামচে দেয়। শ্যাম বাগানের লতা-পাতা, ফল-ফুল ছাড়া কখনো হয় না তাদের খাদ্য তালিকা।

সাধারণত কালু-ধলু দম্পতি শ্যামলের মুখোমুখি হওয়া থেকে বিরত থাকে। দূরে বসে তারা সুযোগের অপেক্ষা করে। তবে খুব বেশি খিদে পেলে, হামলাটা ভিন্নভাবে শুরু করে। প্রথমে পাতার আবডালে চুপিচুপি আহার খোঁজে, তবে দৃষ্টি থাকে শ্যামলের চোখে। কোনো কারণে ধরা পড়ে গেলে, বোকার মতো মাথা চুলকায়, মোচ নাড়ে। তারপর, টুক করে খাবার ছিঁড়ে মুখে নিয়েই লেজ তুলে দৌড়ে পালায়।

তাদের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা আজ আবার ঘটল। তবে, একটু ভিন্ন ধারায়। শ্যামলের প্রস্থানের অপেক্ষায় থেকে থেকে কালু বেশ বিরক্ত। খানিকক্ষণ বাদে পা টিপে টিপে পাশে এসে দাঁড়ায় ধলু। সেও চোখ নেড়ে এদিক-ওদিক দেখে। কিন্তু শ্যামল স্থির করেছে আজ সে যাচ্ছে না এত সহজে। সে দেখেই নেবে কালু-ধলুর কাণ্ড। কালু ও ধলু অবস্থা বেগতিক দেখে নয়নে নয়ন রাখে। ধলু স্থান ত্যাগ করে ফিরে যায়। কালু জেদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, কান খোঁটে, নাক খোঁটে, লেজ নেড়ে বাতাস পরিষ্কার করে। ইতোমধ্যে ধলু আবার ফিরে আসে। এবার সে একা নয়, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তাদের একমাত্র সন্তান। দু’জনের গায়ের রং মিলে বাদামি রং হয়েছে তাদের সন্তানের। শ্যামল নাম দেয় তার বাদু। বাদুকে দেখে তার মায়া হয়। নিজের সন্তানদের কথা মনে পড়ে। একটা সময় ছিল, যখন সে দশ ঘণ্টা করে কাজ করত সন্তানদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য। আজ সন্তানেরা বড় হয়ে দূরে চলে গেছে। অবসর জীবনে কেউ নেই তার এই এক বাগান ও কালু-ধলু পরিবার ছাড়া। শ্যামল উঠে একটু দূরে গিয়ে বসে। অমনি কালু-ধলু দু’জনে দু’টো কচি বেগুনের বোঁটায় কামড় বসায়। বাদু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখে। তারা দু’টো বেগুন নিয়ে এক্কা-দোক্কা-এক্কা নরম পায়ে চলে যায় সুগার ম্যাপল গাছের গুহায় তাদের গৃহের উদ্দেশ্যে। বাদু তাদের অনুসরণ করে।

শ্যামল কাস্তেটা মাটিতে রেখে চলে নার্সারির উদ্দেশ্যে। বেগুন, টমেটো, ওলকপি, ফুলকপির চারা কিনে এনে রোপণ করে বাগানের চার কোণে। জল ঢালতে ঢালতে সে ভাবে, দু’টো বেগুন গাছে যে বেগুন ধরত, তা দিয়ে কালু-ধলুর চলে যেত বেশ, এখন ওদের সংসার বড় হচ্ছে, নিশ্চয়ই খাবারও অধিক লাগবে। প্রয়োজন হলে পরের বছর শ্যাম বাগানে আরও সবজি গাছ লাগাব, যেন খাদ্যের জন্য ওদের অন্য বাগানে হামলা করতে না হয়। হঠাত খসখস শব্দে ঘুরে তাকায় শ্যামল। বাদু ফুলকপির একটি চারা মুখে তুলে নিয়েছে ইতোমধ্যে। শ্যামলের চোখে চোখ পড়তেই সে দৌড়ে পালায় ঠিক তার মা-বাবার মতো।
খুরশীদ শাম্মী : টরন্টো, অন্টারিও