সিনহা মনসুর : এক.
দেবদাস-পার্বতী-চন্দ্রমুখী’র কাহিনীটি কি সত্যি? বলা হয়ে থাকে ‘পার্বতী’ চরিত্রটি বাস্তব। পার্বতী ছিল জমিদার ভূবন মোহন চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী। এও বলা হয় থাকে লেখক শরত্বাবু ওই গ্রামে গিয়েছিলেন। গ্রামের নাম হাতিপোতা!
তিনি যখন বিহারের ভাগলপুরের খঞ্জরপুর পল্লিতে থাকতেন, সে সময় লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি ‘দেবদাস’ উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন। তখন তার বয়স মাত্র চব্বিশ। সালটা ছিল ১৯০০ সাল। উপন্যাসটি নিয়ে শরত্বাবুর মনে প্রচন্ড দ্বিধা ছিল। তাই দীর্ঘ সতের তিনি বছর বইটি প্রকাশ করা থেকে বিরত ছিলেন।
১৯১৩ সালে জুন মাসে বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্য লেখা এক চিঠিতে শরত্চন্দ্র বলছেন:
‘ওই বইটা একেবারে মাতাল হইয়া বোতল খাইয়া লেখা’!
একই বছরের ১৭ জুলাই প্রমথনাথকে লেখা আরেক চিঠিতে তিনি বলেছেন:
‘শুধু যে ওটা আমার মাতাল হয়ে লেখা তাই নয়, ওটার জন্যে আমি নিজেও লজ্জিত’!
(সূত্র: শরত্চন্দ্র, গোপালচন্দ্র রায়)
বন্ধু ও প্রকাশকের তাগাদার কারণেই শরত্চন্দ্র পরে দেবদাসের পান্ডুলিপি কিছুটা ঠিকঠাক করে ছাপার ব্যাপারে মনস্থির করেন। ভারতবর্ষ পত্রিকার ১৩২৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র ও ১৩২৪-এর বৈশাখ-আষাঢ় সংখ্যায় উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরে ভারতবর্ষ গোষ্ঠীরই মালিকানাধীন প্রকাশনা সংস্থা গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স থেকে ১৯১৭ সালের জুন মাসের ৩০ তারিখে বইটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
সেই হিসেবে বইটির বয়স ১০৪, আর পান্ডুলিপির বয়স ১২১!
এই ১২১ বছরে বইটি পাঠক দিনে দিনেই বাডছে। বাঙালির এমন কোন পাঠক নেই যে বইটির নাম শুনেনি। এমন কোন পাঠক নেই যিনি একবার অন্তত বইটি পড়েননি। কেউ কেউ পড়েছেন একাধিকবার! আবার যারা পড়েননি তারা দেবদাস চলচিত্রটি উপভোগ করেছেন। সেই হিসেবে এটি বাংলা সাহিত্যের বহুল পঠিত একটি উপন্যাস।
দুই.
গল্পটি বিদগ্ধ পাঠক মাত্রই জানেন। তাই তার পুনরাবৃত্তি করবো না। তবে একটি প্রশ্ন বার বার মনের কোণায় উঁকি দেয়:
চন্দ্রমুখী না পারু?
পারু কি শুধুই কৈশোর আর প্রথম যৌবনের সাথী না চিরদিনের ভালোবাসা?
চন্দ্রমুখী কি কেবলই ক্ষণিকের ভালোবাসা না অবলম্বন?
এই অমিমাংশিত সত্যের উত্তর মেলেনি! মেলেনি দ্ব›দ্ব থেকে মুক্তি! মৃত্যুর ঠিক আগে দেবদাস, পারুর দরজায় এসে পৌঁছাতে পারলেও সমাজের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করা যায়নি, পাওয়া হয়নি প্রেমিকার শেষ স্পর্শটুকু!
শরত্বাবু বলছেন:
‘শুধু দেবদাসের জন্য বড় কষ্ট হয়? তোমরা যে-কেহ এ কাহিনী পড়িবে, হয়ত আমাদেরই মত দুঃখ পাইবে? তবু যদি কখনও দেবদাসের মত এমন হতভাগ্য, অসংযমী পাপিষ্ঠের সহিত পরিচয় ঘটে, তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও? প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হউক, যেন তাহার মত এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে? মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহকরস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে- যেন একটিও করুণার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়? মরিবার সময় যেন কাহারও একফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে?’
এভাবেই শরত্বাবু শেষ করেছেন তাঁর উপন্যাস, দেবদাসের কাহিনি? নায়কের জন্য লেখকের করুণার অন্ত নেই?
এই ট্র্যাজেডিই সম্ভবত দেবদাসকে অমর করেছে। আর তাই রুপালী পর্দায় বারে বারে ফিরে এসেছে দেবদাসের প্রেম!
দেবদাসের জন্য লেখক ও পাঠক দু’পক্ষই চোখের জল ফেলুন ক্ষতি নেই? কিন্তু পাঠক হিসাবে লেখকের কাছে একটা প্রশ্ন তো করাই যায়- পার্বতীর কী হল?
তার সন্ধান কি লেখক করেছেন?
পার্বতীর দিবা-রাত্র কী ভাবে কাটছে, জানতে কি ইচ্ছা করে না আমাদের?
উত্তর শরত্বাবু দেননি এমনটা নয়?
তিনি জানাচ্ছেন:
‘তাহার পর দাসী-চাকর মিলিয়া ধরাধরি করিয়া পার্বতীর মূর্ছিত দেহ টানিয়া আনিয়া বাটীর ভিতর লইয়া গেল? পরদিন তাহার মূর্ছাভঙ্গ হইল, কিন্তু সে কোনো কথা কহিল না? একজন দাসীকে ডাকিয়া শুধু জিজ্ঞাসা করিল, রাত্রিতে এসেছিলেন না?
সমস্ত রাত্রি তাহার পর পার্বতী চুপ করিয়া রহিল’!
লেখকের দিক থেকেও পার্বতীর কথা ভাবার তেমন তাগিদ দেখা যায় না?
শরত্বাবু জানিয়ে দেন:
‘এখন পার্বতীর কি হইয়াছে, কেমন আছে জানি না? সংবাদ লইতেও ইচ্ছা করে না’!
তিন.
আর চন্দ্রমুখী?
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদে সেই যে ‘আর একবার প্রণাম করিয়া চন্দ্রমুখী কাঁদিয়া কক্ষান্তরে পলাইয়া গেল’ তারপর আর তার দেখা নেই আখ্যানে!
অবশ্য ষোড়শ পরিচ্ছেদের শুরুতে একবার তার প্রসঙ্গ সরাসরি উত্থাপিত হয়েছে? দেবদাস চন্দ্রমুখীকে চিঠি লিখিয়াছিল:
‘মনে করিয়াছিলাম, আর কখনো ভালোবাসব না? একে ত ভালোবেসে শুধু হাতে ফিরে আসাটাই বড় যাতনা, তার পরে আবার নতুন করে ভালোবাসতে যাওয়ার মত বিড়ম্বনা সংসারে আর নাই’! দেবদাসের চিঠির উত্তরে চন্দ্রমুখীর নিশ্চয় কিছু বলার ছিল? হয়ত সে বলেওছিল হৃদয়ের দুটো কথা, কিন্তু শরত বাবুর তাতে আগ্রহ নেই? লেখক সরাসরি জানিয়ে দেন:
‘প্রত্যুত্তরে চন্দ্রমুখী কি লিখিয়াছিল তাহাতে আবশ্যক নাই’!
দেবদাস’-এর চন্দ্রমুখী আর ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর রোহিণীর সামাজিক অবস্থান অনেকটা এক রকম? কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র এ আর্জিটুকু পাঠকের কাছে অন্তত জানিয়েছিলেন, সে যেন রোহিণীর জন্যে পাঠক একটুকু ‘আহা’ করে? শরত্বাবু এটুকু জায়গাও চন্দ্রমুখীর জন্য রাখেননি!
দেবদাস তার ধ্যান-জ্ঞানকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে বসে আছে যে দেবদাস বিনা তার অন্য কোন ভাবনা নেই? হতে পারে দেবদাস মহত(?)প্রেমিক, কিন্তু প্রেম তো পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর হৃদয়ে কিছু কম ছিল না!
ভালোবাসার পাল্লায় তাহার ওজনও যে নেহায়েত কম নয়!
সে কথা শরত বাবু ছাড়া আমার বা আপনার বোঝার কথ না!
কিন্তু তিনি বোঝেননি! দিনশেষে সবটুকুই ভালোবাসাই তিনি তুলে রেখেছেন দেবদাসের জন্যে।
পার্বতীর জন্য কেবল নীরবতা!
আর গোত্র-পদবীহীন চন্দ্রমুখী, সে তো নর্তকী! হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কীই বা হতে পারে!
চার.
শরত্বাবুর বিরুদ্ধে কর্তা ব্যক্তিদের যতই রাগ আর ক্ষোভ থাকুক না কেন, আমারও যত রাগ-ক্ষোভ থাকুক না কেন?
আখেরে বা শেষ বিচারে জিত কিন্তু তারই!
কারণ দেবদাসের জন্যে চোখের জল ফেলার লোকের অভাব নেই!
আসমুদ্র হিমাচল বাংগালি যেখানে, দেবদাসের জন্যে সেখানেই হয়েছে শোকের মিছিল।
না, রাস্তায় নয়!
মিছিল হয়েছে বাঙালির হৃদয়ে!
কারণ আখ্যানটি যে মাস্টার-মেকার শরত্চন্দ্রের!
তিনি যে মধ্যবিত্তের সাহিত্য-দেবতা!
সিনহা মনসুর।