হিমাদ্রী রয় : বিশে বিষ গেলো একুশে খুশির রঙ ফিকে করে আবার আজ ২ এপ্রিল শনিবার থেকে লকডাউন। আমাদের মর্জি আর শাসনের উপর আমরা এত অহংকারী ছিলাম তাই প্রকৃতি শিখিয়ে যাচ্ছে এই সৃষ্টিতে হুকুমত এখনো প্রকৃতির। একটা বিষয় পরিস্কার অন্তত আমার কাছে কোভিড যথেষ্ট অবসর নিয়ে এসেছে আমাদের জীবনে। করোনা মৃত্যুর ছলে তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দেহ নিয়ে এখনো বিরাজমান আমাদের আঙিনায়।
আতঙ্কিত না হয়ে পজেটিভ হওয়াতে আন্তরিক হওয়া চাই আর করোনা হতে থাকতে হবে নেগেটিভ। এর জন্য বিজ্ঞানী হওয়া কিংবা হুজুরের পানিপরা কোনটারই দরকার নেই। যা দরকার সেটা হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পড়া, হাত সেনেটাইজ করা আর সম্ভব হলে নিজেদের অন্তরটাকে সেনেটাইজ করা। কারণ মানব হয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে কোন গৌরব নেই, গৌরব মানবিক হওয়ার মধ্যে বলতেন দীনেশচন্দ্র দাস আমার শিক্ষক।
বইয়ে পড়েছি জীবন একবার মিলে কিন্তু করোনার এই এক বছরে আমরাতো প্রতিদিন জীবন পাচ্ছি একবার যে আসে সে মৃত্যু। কত মুখ চলে গেছে দ্রুত রথে অসময়ে গত এক বছরে। তবু ‘সত্যিকারের বাঁচার আশা বিঘ্ন ঘটায় তৈরি হয়নি এমন কোন খাঁচা’।
পরাজিত মানুষ সময়কে জিজ্ঞেস করে আমরা জীবনের কাছে হেরে যাই কেন? সময়ের উত্তর, আমি ঝড়, তুফান, প্লেগ, সোয়াইন ফ্লু, করোনা যাই আসুক আমাকে চলতে হয়, থামার নিয়ম নেই ফিরবার পথ নেই। এর মাঝে আমাকে সুসময় -দুঃসময় দুইই পার হতে হয় কিন্তু আমি দাঁড়াতে পারি না আমি চলে যাই, চলে যেতে হয়। আমার সাথে চলতে শিখো হারতে হবে না জীবনের কাছে। ঠিক তাই সময় যত খারাপ হউক কালের চাকাতো ঘুরবেই, বেঁচে থাকার জজবা ফিরে আসবেই।
জীবন এক জার্নি। ভ্রমণের মধ্যেই নিজের নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ভালো হওয়া, ভালো দেখানো সব। সুসময়ের সময়ের অপেক্ষায় বসে থাকলে নিজের ছোট ছোট সাধগুলো মেটাতে লম্বা জীবনও কম পড়ে যায়। তাই যে সময় মিলছে তাকেই উত্তম করে নিতে হয়। সুদিনের অপেক্ষায় কোটি স্বপ্ন মরে গেছে। তার উপর সাধ্যের মধ্যে সাধগুলো মেটানোর বড় বাধা লোকে কি বলবে।
আমাদের অভ্যাস হচ্ছে অন্যের কাছে নিজের গুরুত্ব খোঁজে নিরাশ হওয়া। অন্যের দৃষ্টিতে নিজেকে বিচার করা কিন্তু বিচারতো আমাদের নিজের দৃষ্টিতে করা উচিত। আমার প্রিয় হাসান মাহমুদ ভাই চমত্কার করে বলেছিলেন একদিন আমায়। ‘নিজের লোকেদের খুশি করে কোন কাজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না’।
এবার আসি লোকের কথায়। লোকের কি? লোক প্রথম হাসাহাসি করবে দ্বিতীয় দিন বিদ্রুপ করবে তৃতীয় দিন ভুলে যাবে। রেলগাড়ির ষ্টপের মত ষ্টেশনে-ষ্টেশনে নেমে পড়বে সবাই। আপনি-আমি রয়ে যাবো একা।
জীবনের ম্যারাথনে যুক্ত হয় অনেকই। বন্ধু, স্বজন তবে আমাদের খুশিতে তারাই যুক্ত হয় যাদের আমরা চাই আর আমাদের দুঃখে, শোকে তারাই যুক্ত হয় যারা আমাদেরকে চায়।
জীবনে আঘাত তো আসবেই প্রতিটি আঘাতের পেছনেও শিক্ষা থাকে। ছেলে বেলায় ঘরে ঢুকতে কিংবা বেড়োতে যতবার বাবার সামনে চৌকাঠে পা লেগে হুচট খেয়েছি, আমাদের মেঠো ভাষায় যাকে ওষ্টা খাওয়া বলে, বাবা ততবারই আচ্ছা করে ধমক দিত। ‘চোখ কই থাকে দেইক্কা হাঁটতে পারোস না’। এখন সময় শিখিয়েছে নত হয়ে কেন হাঁটতে হয়। আর এই ওষ্টা খাওয়া থেকে যেমন সাবধানি হয়ে হাঁটার শিক্ষা মিলে তেমনি হৃদয়ে চোট লাগলে পরেই তবে আমরা সমাঝদার হয়ে চলতে শিখি। ধাক্কা খাওয়াটা অনেক সময় খুব কাজে আসে।
দুঃসময়ের ভালো দিক হলো অভিজ্ঞতা দিয়ে যায়। কিছু মানুষ চেনা যায় যারা সুযোগ মিলতেই মুখোশ ছেড়ে বের হয়ে আসে। আর এক দল সব সময় সুযোগের তালাশে থাকে মুখোশের আড়ালে। রাগ হয় না তাদের জন্য। যেখানে বিনা নোটিসে জীবন ছেড়ে যায় ভরসাতো যেতেই পারে।
ব্রীজ আর দেয়াল একই কংক্রিট আর সিমেন্টে তৈরি হয় তবে ব্রীজ একপাড়ের সাথে অন্য পাড়ের মানুষকে সংযোগ করে আর দেয়াল আলাদা করে। আমরাও সবাই এক মসলাতেই তৈরি হয়ে এসেছি পৃথিবীতে। কেউ আশায় করি বাস, মুখিয়ে থাকি প্রেম নিতে ও প্রেম দিতে আর কেউ করি হিংসা আর লোভের চাষ। কে কেমন ব্যবহার করি তা আমাদের সংস্কারের উপর নির্ভর করে। আমাদের ভাবনা হলো বীজের মত আজকের ভাবনা কালকের অঙ্কুর। আমাদের নির্মাণ আমাদের ভিতর থেকে হয় যা অন্তরে লালন করি তাই প্রকট হয় বাহিরে। পরমহংস বলেন মনকে ধোপা বাড়ির সাদা কাপড়ের মত রাখো যাতে সত্যিকারের রঙে চুবাতে পারো। অর্থাত মনের দাস নয়,মনকে আমাদের দাস করতে বলেছেন।
আসলে কে কোথায় আছি, কি করছি, কোন সময়ের মধ্যে পার হচ্ছি বিষয় সেটা নয় বিষয় কি ভাবছি।
কৃপা কিংবা অনুগ্রহের চিন্তা আসলে, আমি নিজের চেয়ে যার কৃপার পাল্লা নিচে তার দিকে তাকাই আপনি আপ কৃতজ্ঞতায় নত হই। মুশকিলের বেলায় নিজের চেয়ে যে বেশি মুশকিলে আছে তার দিকে তাকাই। যে মানুষটি ভেন্টিলিটার নিয়ে হাসপাতালে আছে তার কথা ভেবে কৃতজ্ঞ থাকাইতো উচিত। কাল কি হবে কে জানে।দাওয়া আমাদের হাতে নেই তবে
দোয়াতো করতেই পারি।
‘সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ’।
হিমাদ্রী।