মনিস রফিক : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ মুহম্মদ খসরু। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় তিনি বাংলাদশে সুস্থ্য ও ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করেছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উন্নয়নে তাঁর অবদান সবাই পরম কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করে। গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর প্রথম প্রয়াণ দিবস। মুহম্মদ খসরুকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করেছেন চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক।


২০১৯ সালে টরন্টো ফিল্ম ফোরাম আয়োজিত ৩য় মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, টরন্টো এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুহম্মদ খসরু’কে স্মরণ। মনিস রফিক (বামে) ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল।

খসরু ভাই,
আপনার চলে যাওয়ার এক বছর হয়ে গেল। ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে দেশ ছাড়ার কয়েকদিন আগে আপনার কাছে বিদায় নিতে গিয়েছিলাম। আপনি ধমক দিয়েছিলেন, “মিয়া, তুমিও পলাইয়া যাচ্ছো?” আমি মিথ্যা করে বলেছিলাম, ‘আমি ফিল্ম নিয়ে পড়তে যাচ্ছি, ফোর্সড মাইগ্রেশন নিয়ে কাজ করবো।’ মুহূর্তে আপনার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠেছিল। স্বভাব বিরুদ্ধভাবে আপনি আমাকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। সেই চকচকে চোখেই বলে উঠেছিলেন, ‘তাহলে ঋত্বিক দা’র চেতনা নিয়ে কাজ হবে, খুব ভালো।’

বুড়িগঙ্গা পার হয়ে টেম্পু করে গ্রামীণ পথ ফুঁড়ে কতকাল রোহিতপুরে আপনার কাছে যাওয়া হয়নি। আমি জানি, আর কখনও যাওয়া হবে না। আমি জানি, আর কখনো আপনার সেই ধমক আর ভালোবাসায় আপনার বাড়িতে সেই মাছ আর ভাত খাওয়া হবে না। কত গভীর ভালোবাসা ছিল আপনার সেই ধমকে। ধমক খেয়ে পেট ভরে যাবার পরও আরেকটু খেতে হত শুধু আপনাকে একটু তৃপ্তি দেবার জন্যে। সারাদিনের সেই দিনগুলিতে আমার অনুরোধে সেই দুপুরেই খাওয়ার পর আপনি বাঁশি হাতে নিয়ে অন্য এক মজনু হয়ে বাজিয়ে যেতেন শুধু আমাকে আনন্দ দেবার জন্যে।

খসরু ভাই, বড় বেশি মনে পড়ে, আপনার সেই ভালোবাসা। আপনার সেই কালোতীর্ণ ‘ধ্রুপদী’, ‘চলচ্চিত্রপত্র’, এর সব সংখ্যা অথবা ‘ক্যামেরা যখন রাইফেল’ ‘তিমির হননের নান্দীপাঠ’ বা ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র বিশেষ সংখ্যা অনেক বইয়ের স্তুপ থেকে খুঁজে খুঁজে বের করে আমার হাতে দিয়ে শুধু বলেছিলেন, ‘মিয়া আমি আমার সব তোমাকে দিলাম, খুব যত্ন করে রেখে দিও, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস যদি কখনো লিখতে হয়, তবে এগুলোর খুব প্রয়োজন পড়বে।’ কাঁপা কাঁপা হাতে আপনার সব ভালোবাসা নিয়ে নিঃশব্দে আপনার অগোচরে আপনার দিকে মাথা হেঁট করে সেদিন আপনাকে স্যালুট জানিয়েছিলাম।

শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট বা জাদুঘরের সামনে দিয়ে বই ভর্তি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কিছুটা সামনের দিকে নুয়ে আপনি যখন হাঁটতেন, তখন গোটা বাংলাদেশ না জানলেও আমি হৃদয় দিয়ে জানতাম, সেই বই ভর্তি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলা স্বপ্নবাজ মানুষটি সারাজীবন ফেরি করে চলেছে সুন্দর শৈল্পিক চলচ্চিত্রের। আমি জানি না, পৃথিবীর কোন জনপদে কোন সেই মানুষ আপনার মত একটি জাতির চলচ্চিত্র-চক্ষু উম্মোচিত করার জন্য এমনভাবে সারাজীবন হেঁটে বেড়িয়েছেন।

সেই ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ (পরে এর নামকরণ হয় ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ’) যখন ঢাকায় যাত্রা শুরু করে সেই যাত্রার একেবারে শুরু থেকে আপনি হাঁটা শুরু করেছিলেন। তারপর হেঁটে চললেন জীবনভর। আমি এখন উপলব্ধি করি, কেন আপনি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট এর ‘সাইট এন্ড সাউন্ড’ আর ‘মান্থলি ফিল্ম বুলেটিন’ স্বপ্ন দেখা সব চলচ্চিত্রকর্মীদের পড়ার ব্যবস্থা করতেন, আর নিয়মিতভাবে পৃথিবীর সব কালজয়ী চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীর জন্য এত বেশি দৌড়িয়ে বেড়াতেন। আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায়, কি মমতা আর আনন্দ স্পৃহায় আপনি বিশ্ব চলচ্চিত্রের সব অবশ্যপাঠ্য বই সংগ্রহ করে চলচ্চিত্রদ্যুতি জ্বলে ওঠা বই পিপাসুদের পড়তে দিয়ে চলচ্চিত্র আর সেই বই নিয়ে আলোচনা করতে বলতেন।

খসরু ভাই, আমি সত্যিই এখন উপলব্ধি করি, সেই ১৯৭৪ সালেই আপনি কেন ‘ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছিলেন, আর ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে ‘ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া’র অধ্যাপক সতীশ বাহাদুরকে ঢাকায় এনে তিন সপ্তাহব্যাপী ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্সের ব্যবস্থা করেছিলেন, আর সেই কোর্সের পর থেকে কেন বাংলাদেশে একটি ফিল্ম আর্কাইভ করার জন্য ওমন এক সংগ্রামের মেতেছিলেন। চলচ্চিত্র সংরক্ষণের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য সেই ১৯৭৫ সালে চলচ্চিত্র সংরক্ষণ ব্যবস্থার পথিকৃত ফরাসী ফিল্ম আর্কাইভ ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হেনরী ল্যাংলোয়া’র সম্মানে ওমন এক অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানের সেই স্মরণিকাটি বারবার উল্টিয়ে আমি দেখি আর অবাক বিস্মিয়ে ভাবি সেই লেটার প্রেসে কত নিখুঁতভাবে আপনি সব প্রকাশনাগুলো সম্পাদনা করতেন। আমি শুনেছিলাম, স্বয়ং সত্যজিত রায় আপনার সম্পাদিত ‘ধ্রুপদী’ সম্পর্কে বলেছিলেন, পত্রিকাটি ভারত উপমহাদেশে সবচেয়ে সুন্দর চলচ্চিত্র পত্রিকা।

খসরু ভাই, সেই ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র অধ্যাপক মাইক উইভার আর গর্ডন সি’র মত অনেক চলচ্চিত্রজ্ঞানীদের এনে আপনি কি পরম যত্নে খোলা চোখে চলচ্চিত্রের সৌন্দর্য খোঁজা এক ঋদ্ধ যুব সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। সেই চোখ আরো ঋদ্ধতর করতে কি অপার পরিশ্রমে আপনি একে একে আয়োজন করে গেছেন সের্গেই আইজেনস্টাইন, আকিরা কুরোশাওয়া, অরসন ওয়েলস, ফ্রাসোয়া ত্রুফো, জ্য লুক গদার, অ্যালা রেনে, ইঙ্গমার বার্গম্যান, ডি সিকা, রেনে ক্লেয়ার, জ্য ককতো, ফ্রেদোরিকো ফেলেনি, আলফ্রেড হিচকক, মিখাইল কালতোজভ, গ্রেগরি চুখরাই, সত্যজিত রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, আদ্রে ওয়াইদা, রোমান পোলানস্কি, জ্য রেনোয়া, রবার্ট ফ্লাহার্টি’র মত সব কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সেই কালোতীর্ণ সব চলচ্চিত্র। আমি খুবই বিস্মিত হই, যখন আমি জানতে পারি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের জন্ম থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রায় পাঁচ শ পূর্ণ দৈর্ঘ্য ও দুই শ স্বল্প দৈর্ঘ্যের সব শৈল্পিক চলচ্চিত্র দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। একটি দেশের জন্মের পূর্বের প্রায় সাত বছর আর পরের সাত বছরের এই আয়োজন এক ঝাঁক ঝকঝকে সিনেমার মানুষ সৃষ্টির পথ উম্মোচনে অবশ্যই যথেষ্ট ছিল।

খসরু ভাই, এই সব কাজের কৃতিত্ব কিন্তু শুধু আপনার একার নয়। আরো অনেকে ছিলেন যাদের ধমনীতে সতত খেলা করেছিল ভালো ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের প্রতি এক তীর ছোঁড়া টান। সবাই ছিলেন একই যাত্রায়, কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে হাঁক দিতে দিতে আপনি হয়ে উঠেছিলেন এক চির সবুজ সংশপ্তক যিনি অবলীলায় এক প্রবল প্রেম আর ঋদ্ধতায় হেঁটে গেছেন চলচ্চিত্র-যাত্রায় ছাপান্ন বছর।

বছর দশেক আগে রাজশাহীর এক সাঁওতাল পল্লীর চুয়ানি খেয়ে শুকনো পদ্মার শুকনো বালুতে আধো জোসনা পড়া আলোতে চরে হাঁটতে হাঁটতে টালমাতাল আপনি আপনার খিস্তি আওরাতে আওরাতে খেদের সাথে বলে উঠেছিলেন, ‘শালার দেশে চলচ্চিত্রটা দাঁড়ালো না। সব শালা বস্তাপচা মাল বানাতে ব্যস্ত। চলচ্চিত্রের ভাষাটায় কোন শালা ধরতে পারলো না।’
সেদিন রাতে আপনি আর ঋত্বিক ঘটক মিলেমিশে একেকার হয়ে গিয়েছিলেন। মুহূর্তেই আমার মনে পড়ে গিয়েছিল সেই ১৯৭৪ সালে ঢাকার হোটেল গ্রীন এ সকাল সাতটায় আপনি কাওসার ভাই, প্রিন্স ভাই, শাহজাহান ভাই আর মাহবুব ভাই ঋত্বিক ঘটকের কি এক অসাধারণ সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন।

আমি ঋত্বিক ঘটকের সব সাক্ষাত্কার পড়েছি, কিন্তু বাজী ধরে বলছি, “শেষ সাক্ষাৎকার প্রথম নমস্কারের আগে”র মত আর কোন সাক্ষাত্কার ওমনভাবে ঋত্বিক ঘটককে পাঠকের সামনে তুলে আনতে পারেনি।

সেই চুয়ানি-ঘোর লাগা পদ্মার চরের ফিকে জোসনায় আমরা যখন শুকনো বালি মাড়িয়ে হাঁটছিলাম, তখনই ফাঁকা বিস্তীর্ণ চর ছাপিয়ে, চরের মধ্যে গজিয়ে ওঠা কাশের ডগা ছুঁয়ে স্রোতের মত ছুটে আসছিল এক করুণ বাঁশির সুর। যে সুর এক লহমায় আমাদের মস্তিস্কের নিউরণে সপাত আঘাত করে আমাদের সামনে উম্মোচিত করেছিল বাস্তুহারা মানুষের গভীর তী² ক্রন্দন। আমি জানি, ঠিক ওই জায়গাতেই দেশ ভাগের আগে পদ্মা ছাড়ার পূর্বে মাঝ রাতে ঋত্বিক ঘটক তাঁর বাঁশিতে বাজাতেন ওমন সব সুর।

খসরু ভাই, সেই ঘোর লাগা মাঝ রাতের পদ্মার চরের বাঁশির সুর আমি আরেক বার শুনেছিলাম রোহিতপুরের মাঝ দুপুরে আপনার ঘরে আপনার ‘মজনু বাঁশি’তে।