শামীম আহসান মহাবুল্লাহ : খুবই অপ্রত্যাশিত ব্যাপার, ইয়াং ফুরেন কফিনের ভেতর শোয়া থেকে উঠে বসেছেন! তাঁর এলোমেলো অবিন্যাস্ত চুল, যা কাঠের ভূষি আর লাল চিকন বালিতে মাখা, একে বারেই ভেজা। ওঁনার মুখমণ্ডল প্রচণ্ড রকম ফ্যাকাশে যা কিনা এক পাতা সাদা কাগজের মতোই দেখাচ্ছে! ঐ দিন, যে কথাগুলো তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, সেই কথাগুলো আবার বলার মতো গায়ের জোড় আর তাঁর নেই! আমি দেখতে পাচ্ছি, তাঁর হাতে ধরা আছে সেই উত্তরাধিকার দলিলটা, তিনি জনতার দিকে ইশারা করছেন সেটা বার বার নাড়িয়ে নাড়িয়ে!

কয়েকজন প্রাসাদ ভৃত্য খুব দ্রুত কফিনের ভেতরে জোড় করে শুইয়ে দিলো ইয়াং ফুরেনকে; ওরা আরও কয়েক বস্তা বালি ঢেলে কফিনটাকে ভর্তি করে দিলো।
তারপর ইয়াং ফুরেনের শবাধারের ঢাকনির উপর নতুন করে পেরেক মারা হলো; স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হলো শবাধারের মুখ!
আমি গননা করছি; প্রাসাদ ভৃত্যরা কফিনের ঢাকনাতে ঠুঁকে দিচ্ছে মোট উনিশটা লম্বা পেরেক!
সিয়ে দেশ, সম্পর্কে যাবতীয় জ্ঞান ও তথ্য আমি জেনেছি সন্ন্যাসী চুয়ে খোং এর কাছ থেকে। তাঁকে আমার গুরু হিসাবে নিযুক্ত করেন আমার পিতা তাঁর জীবদ্দশায়।

আমার গুরু চুয়ে খোং এক জন জ্ঞানী মানুষ। চীন দেশের যোগ ব্যায়াম, কুংফু-র চর্চা, সামরিক অনুশীলনের কাজে তরবারীর চালনা ইত্যাদিতে তাঁর আছে নিপুন দক্ষতা। এ ছাড়াও তিনি তারের বাদ্য যন্ত্র ‘ছিন’ বাজাতে পারদর্শী। তিনি খুব ভালো দাবা খেলেন। চীনা অক্ষর তুলি দিয়ে লেখার কাজ অর্থাৎ ক্যালিগ্রাফিতে তাঁর আছে বিশেষ দক্ষতা। চীনের ঐতিহ্যবাহী বিশেষ ধরণের কাগজের উপর জল রঙ দিয়ে আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী বিষয়ক শিল্প কর্মে তাঁর হাতের নৈপুণ্য অসাধারণ।

নৈকট্য পাহাড় গুরু গৃহের অধ্যয়ণ কালে কঠোর নিয়ম মেনে আমি খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করতাম। আমার গুরু চুয়ে খোং এর তীক্ষè দৃষ্টি সব সময়ই আমাকে অনুসরণ করতো। তিনি আমাকে বলেছেন, সিয়ে দেশের আছে দু’শ বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস! আরও আছে নয় শত লি আয়তনের বিস্তৃত এলাকা। পূর্ববর্তী রাজাদের আছে ঐতিহ্য, আছে সাফল্য ও অর্জন!

যুদ্ধ ক্ষেত্রে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে প্রাণ উৎসর্গকারী সৈনিকদের কাহিনী আমি শুনেছি তাঁর মুখ থেকে।
তিনি আমাকে জানিয়েছেন, সিয়ে দেশে আছে কয়টা পর্বত শৃঙ্গ এবং গিরিমালা, আছে কতগুলো নদীর প্রবাহ। তিনি আমাকে আরও জানিয়েছেন, সিয়ে দেশের মানুষ মূলত বাজরা, জানার, ভুট্টা…. এ জাতীয় ফসল বুনে জমিতে। ওরা শিকার করে বন্য প্রাণী, আর ধরে মাছ, জীবিকা নির্বাহের জন্য।

আমার যখন আট বছর বয়স হলো, সেই বছর আমি কতগুলো সাদা ভূত দেখতে পেয়ে ছিলাম! প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলায় আঁধার ঘনিয়ে আসার পর প্রদীপ জ্বালানোর সময় ঐ ভূতগুলো লাফ দিয়ে চলে আসতো আমার পড়ার টেবিলে, এমনও হয়েছে ওরা দাবার বোর্ডের ঘরগুলোর উপর সারি বদ্ধভাবে এক সাথে নাচানাচি করতো। ভূতের এই কাণ্ডকারখানা দেখে আমার খুব ভয় হতো। এই খবরটা পাওয়ার সাথে সাথে আমার গুরু চুয়ে খোং চলে এসেছিলেন, উনি বের করে ছিলেন ওনার তলোয়ার, আমার চোখের সামনেই তলোয়ার নাচিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন ছোট ছোট সাদা রঙের ভূতগুলোকে। সেই থেকে, অর্থাৎ আমার বয়স আট বছর পূর্ণ হওয়ার পর থেকেই আমি আমার গুরু চুয়ে খোং এর ভক্ত বনে গেছি।

আমার কাছে তিনি হয়ে গেছেন একজন আদর্শ মানুষ!

আমি সন্ন্যাসী চুয়ে খোং-কে নৈকট্য পাহাড় গুরু গৃহ থেকে রাজ প্রাসাদে এসে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তিনি রাজি হয়েছেন। তিনি ছোট ছোট পদক্ষেপে প্রবেশ করলেন প্রাসাদের ভেতর; মাথা নীচু করে অভিবাদন করলেন; আমি লক্ষ্য করছি তাঁর চেহারায় ফুটে উঠেছে মনোকষ্টের ছাপ।
এর কারণ বোধ হয় আমি!
আমি জ্ঞানার্জন থেকে দূরে সরে এসেছি, আমাকে গুরু গৃহ ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে।
তাঁর হাতে রয়েছে; তিনি ধরে রেখেছেন; বহু বার, বহু জনে পড়ার কাজে ব্যবহার করে পুরোনো করে ফেলেছে, এমন একটা গ্রন্থ!
বইটার নাম : “ভাষা তত্ত্ব”!

এটা আসলে কনফুসিয়াসের দর্শন বিষয়ক একটা চটি গ্রন্থ; ‘কনফুসিয়াস দর্শন’-এর সারাংশ।
আমি লক্ষ্য করছি, তাঁর গেরুয়া রঙের সন্ন্যাসীর পোশাক বেশ ময়লা হয়ে গেছে! বেশ কয়েক জায়গায় জামাটা ছিঁড়ে গেছে! পাটের দড়ি দিয়ে তৈরী, তাঁর পাদুকা জোড়া খুবই ময়লা, আর কাদায় মাখা!
আমি প্রশ্ন করলাম, “গুরুজী, আপনি ‘ভাষা তত্ত¡’ বইটা হাতে করে বয়ে প্রাসাদ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন কেনো?”
তিনি আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “তুমি তো ‘ভাষা তত্ত¡’ বইটা পড়ে শেষ করনি।”
আমি পাতা মুড়ে চিহ্ন দিয়ে রেখেছি।
সিয়ে রাজ্যের রাজা এই বইটা পড়ে শেষ করবেন; এ জন্যই আমি বিশেষ করে নিজের হাতে বইটা নিয়ে এসেছি এখানে।”

আমি বললাম, “আমি তো এখন দেশের রাজা! আমাকে আবার বই পড়তে হবে কেনো?”
তিনি বললেন : “সিয়ে দেশের সম্রাট, যদি আর পড়াশোনা না করার সিদ্ধান্ত নেন, তবে এই ভিক্ষু ফিরে যাবে তিক্ত বাঁশ মন্দিরে; আবার শুরু করবে ধর্মের কঠোর অনুশীলন।”
“আপনি মন্দিরে ফিরে যেতে পারবেন না!” আমি চিৎকার করে বললাম।
আমি ‘ভাষা তত্ত¡’ বইটা চুয়ে খোং-এর হাত থেকে নিয়ে সিংহাসনের নীচে ছুঁড়ে মারলাম।
আমি বললাম, “আমাকে ফেলে আপনি কোথাও যেতে পারবেন না। আপনি চলে গেলে, আমার কাছে আসা ভূতগুলোকে কে তাড়িয়ে দেবে? ঐ সাদা রঙের ছোট ছোট ভূতগুলো এখন বেশ বড় হয়ে গেছে!

ওরা এখন আমার মশারীর ভিতরে এসেও নাচানাচি শুরু করতে পারে!”

আমি দেখতে পাচ্ছি, দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা, দু’টি প্রাসাদ দাসী মুখ ঢেকে হাসছে! আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, আমার ভীরুতা দেখেই ওরা হাসাহাসি করছে!
আমার খুব রাগ হচ্ছে!
আমি মোম বাতি দানী থেকে টান দিয়ে একটা জ্বলন্ত মোম বাতি উঠিয়ে নিলাম, ছুঁড়ে মারলাম ওদের মধ্যে একজনের মুখের উপর!
“তোমরা কেউ হাসবে না!” আমি চিৎকার করে উঠলাম, “আবার যদি কেউ হাসহাসি করে তবে তাকে জ্যান্ত ঢুকিয়ে দেবো সম্রাটের কবরে!”
রাজকীয় উদ্যানে বইছে শরতের মৃদু মন্দ বাতাস। বাগান জুড়ে ফুটেছে হলুদ রঙের চন্দ্র মল্লিকা ফুল। যেন ফুটন্ত পুষ্পের বান ডেকেছে পুরো বাগানটায়!
কিন্তু আমার তো মন ভালো নেই! বাগানের দিকে তাকিয়ে আমি যত দূর দেখতে পাচ্ছি, ততো দূর পর্যন্তই আমার কাছে মনে হচ্ছে, গোটা বাগান জুড়ে পরে আছে হলুদ ধূসর রঙের মরে যাওয়া কিছু ঝোপ ঝাড়!
আমি এরই মধ্যে বাগান মালীকে নির্দেশ দিয়েছি, শবল দিয়ে বাগানের প্রতিটা চন্দ্র মল্লিকা ফুল গাছ উপরে ফেলার জন্য!

সে মুখে বলেছে : “ঠিক আছে, ঠিক আছে, উঠিয়ে ফেলবো সব চন্দ্র মল্লিকা গাছ!”
কিন্তু গাছগুলো উঠিয়ে ফেলার ইচ্ছা তার আদৌ নাই কিংবা ছিলো না!
রাতের বেলা সে গোপনে গোপনে ব্যাপারটা অবগত করেছে, আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন-কে। পরে আমি জানতে পেরেছি, বাগানের সব জায়গায় চন্দ্র মল্লিকা ফুল গাছ লাগানোর কারণ!
এই কাজটা হয়েছে আমার দাদীর হুকুমে? তিনি যাবতীয় পুষ্পরাজীর মধ্যে চন্দ্র মল্লিকা ফুলকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। এ ছাড়াও তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, চন্দ্র মল্লিকা ফুলের দুর্লভ ঘ্রাণ হচ্ছে তাঁর মাথা ঘুরা রোগের একটা চমৎকার উপশম!

এরই মধ্যে আমার মা মং ফুরেন আমাকে গোপনে জানিয়েছেন যে, আমার দাদী শরৎ কালে তাঁর জন্য রান্না করা বেশিরভাগ তরকারিতে চন্দ্র মল্লিকা ফুলবাটা যোগ করেন। তিনি প্রাসাদের রাঁধুনী আর পাচকদের নির্দেশ দিয়েছেন, প্রতি বেলা তাঁর জন্য চন্দ্র মল্লিকা ফুলের সালাদ তৈরী করার জন্য। আর সেই সাথে রান্না করতে হবে চন্দ্র মল্লিকা ফুলের সুপ। এগুলোই হচ্ছে তাঁর দীর্ঘ জীবন আর রোগ প্রতিকারের গোপন রহস্য!

আমি অবশ্য এই ব্যাপারে বিশ্বাসী নই। আমার মত ভিন্ন। আমার কাছে মনে হয়; চন্দ্র মল্লিকা ফুল আমাকে মনে করিয়ে দেয় মৃত মানুষের কথা, শক্ত হয়ে যাওয়া মৃত দেহের কথা? আমার কাছে যেন চন্দ্র মল্লিকা ফুল খাওয়া, আর মৃত দেহের পঁচা গোস্ত ভক্ষণ করা একই কথা!
এটা তো একটা অসহ্য কষ্টকর কাজ!

সকাল বেলা বিশাল ঘন্টায় টান দিয়ে করা হয় ঘন্টা ধ্বনি; সেই সাথে বেজে ওঠে ঢোলের বাদ্য সমেত নহবত!
আমি প্রবেশ করি রাজ দরবারে, দর্শন দিয়ে জানান দেই সভায় উপবিষ্ট মন্ত্রী বর্গ আর উচ্চ-পদস্থ আমলাদের, আমার সশরীরে উপস্থিতি!
সিংহাসনে আমি আমার আসন গ্রহণ করি, আমার এক পাশে বসেন আমার দাদী হুয়াং ফু ফুরেন, অন্য পাশে বসেন আমার মাতা মং ফুরেন।
রাজ দরবারে আমার যে কোন পরামর্শ বা মতামতের সমর্থন, কিংবা গৃহীত হওয়া, অথবা না হওয়া; নির্ভর করে ওনাদের দু’জনের চোখের ইশারা কিংবা নীরব ইঙ্গিতের উপর!
অবশ্য এ ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নেই, বরং আমি বেশ খুশী!

যদিও পর্দার পিছন থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রণকারী এই দুই মহিলার যে কোন সিদ্ধান্তকে বাতিল করার মতো বয়স আমার হয়েছে; জ্ঞান ও যোগ্যতা দু’টোই আমার আছে!
আমার অবশ্য মজাই লাগে শুনতে, রাজকীয় ফরমানের ভাষা; যেখানে থাকে অনাবশ্যক শব্দ আর শব্দালঙ্কারের ছড়াছড়ি!

গভীরভাবে চিন্তা করে এই শব্দ অলঙ্কারের প্রয়োগ নিঃসন্দেহে খুবই কঠিন কাজ।
আর আমি খুবই আনন্দিত, কারণ এই কষ্টদায়ক কাজটা আমাকে করতে হচ্ছে না!
আমি আমার হাঁটুর উপর রেখেছি একটা ছোট কৌটা, যেটার মধ্যে আছে কালো পাখাওয়ালা বেশ কয়েকটা ঝিঁঝি পোকা।
রাজ দরবারের কার্যক্রম চলে সুদীর্ঘ সময় ধরে, যা আমার কাছে খুবই এক ঘেয়ে ও বিরক্তিকর লাগে। কিন্তু আমাকে বসে থাকতে হয়!
হঠাৎ যখন ঝিঁঝি পোকা গুলো ডেকে ওঠে, তখন ক্ষণিকের জন্য হলেও আমার এক ঘেয়েমীর ভাবটা চলে যায়!

আমি ঝিঁঝি পোকা পছন্দ করি; ওদের ঝিঁ ঝিঁ ডাক শুনতে আমি ভালোবাসি!
শীত কাল এগিয়ে আসছে, আবহাওয়া ঠান্ডা হয়ে আসছে। আমার ভয় হয়, ঠান্ডার দিন গুলোতে প্রাসাদ ভৃত্যরা আমার জন্য পাহাড় থেকে এই ধরনের তীক্ষ্ণ শ্রুতি মধুর স্বরের ঝিঁঝি পোকা গুলো ধরে আনতে পারবে না, খুঁজে পাবে না ওদের! (চলবে)