অনলাইন ডেস্ক : দক্ষিণখানে আমিনুল ইসলাম হান্নানের বাড়ির বাইরে একটি বড় ব্যানার টাঙানো। ব্যানারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, আওয়ামী লীগের প্রয়াত এমপি সাহারা খাতুনের পাশেই বড় করে হান্নানের ছবি। আশপাশে অনেক পোস্টার, ব্যানার-ফেস্টুন। যে কেউ দেখলেই বুঝবে এটা আওয়ামী লীগের বড় কোনো নেতার বাড়ি। তবে বাস্তবে আওয়ামী লীগের দলীয় কোনো পদ ছিল না তার।
পুলিশ জানায়, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে এলাকায় অনেক পোস্টার লাগায় হান্নান। তাই এলাকাবাসী তাকে ‘পোস্টার হান্নান’ বলেও জানে। কয়েকবছর আগে একবার জাপানে গিয়েছিলেন হান্নান। এলাকার কেউ কেউ তাকে ‘জাপানি হান্নান’ বলেও চেনেন।
শুধু আওয়ামী লীগ পরিচয়ে নয়, নিজেকে একটি মানবাধিকার সংস্থার সাধারণ সম্পাদক উল্লেখ করেও বিভিন্ন থানায় গিয়েও হুমকি-ধমকি দিতেন হান্নান।
এর আগে বুধবার (২৪ মার্চ) সকালে দক্ষিণখানের আইনুশবাগে চাঁদনগর এলাকায় আবদুর রশীদ নামের এক জনকে জাপানি হান্নান ও তার সহযোগীরা গুলি করে হত্যা করেছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। হত্যার পর সড়কে দীর্ঘক্ষণ পড়েছিল রশীদের নিথর দেহ। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রশীদ ও হান্নানের মধ্যে পূর্ব শত্রুতা ছিল। সর্বশেষ বালু রাখা কেন্দ্র করে রশীদের কাছে চাঁদা দাবি করে হান্নান। রশীদ চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় দুপক্ষের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আবদুর রশিদ ওই এলাকার আবদুল মালেকের ছেলে। তিনি রড-সিমেন্টের ব্যবসা করতেন। এদিকে ঘটনার পর হান্নানসহ সাত জনকে আটক করেছে পুলিশ।
হান্নানের আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গসংগঠনে কোনো পদ নেই। তিনি নিজেকে বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দাবি করতেন। আর এ পরিচয় ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করতেন বলে আমিনুল ইসলাম হান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে এলাকাবাসী।
পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্থানীয়রা বলেছে— হান্নান নিজে একটি মানবাধিকার সংগঠন তৈরি করেছে। সেটার নাম দিয়েছে জাপান-বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস। সংগঠনের চেয়ারম্যান হিসেবে সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মো. রফিকুল ইসলামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক হলেন হান্নান নিজেই। সংগঠনের ওয়েবসাইটে নিজেকে ‘মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন সৎ মনোভাবাপন্ন, মানবতার সেবায় নিবেদিত’ বলে দাবি করেন হান্নান। এলাকায় কোনো দুর্ঘটনা বা মারামারির ঘটনা ঘটলে সেগুলো সমাধান বা বিচারের নামে উভয়পক্ষ থেকে টাকা নিতেন।’
এছাড়াও তিনি নিজেই ‘ঢাকাস্থ বৃহত্তর কুমিল্লা সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করেন। যদিও এ সংগঠনের কাজ কী, ওই এলাকায় বসবাসরত চাঁদপুর ও কুমিল্লার কেউ বলতে পারেননি।
বাড়ি বানালেই চাঁদা নিতে হাজির হান্নান, হাতিয়ে নিতেন জমি
দক্ষিণখান এলাকার বাসিন্দা মোজাম্মেল পাটোয়ারী বলেন, ‘এলাকায় কেউ বাড়ি করতে চাইলেই চাঁদা দিতে হতো। আমি বাড়ি বানানোর সময় হান্নান আমার বাসার নির্মাণাধীন সাইটে এসে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। বাসার আংশিক নির্মাণকাজ শেষ হলে সেই বাসার কয়েকটি ফ্ল্যাট আমি ভাড়া দেই। তবে চাঁদা না দেওয়ায় হান্নান আমার ভাড়াটিয়াদের বাসা থেকে বের করে দেয়। বাসার গ্যাস-পানির সংযোগ বন্ধ করে দেন।’
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয়েছে দক্ষিণখান এলাকায় হান্নানের বাড়ির আশপাশের ৫-৬ জন বাসিন্দার সঙ্গে। তারা সবাই হান্নানকে ‘ভূমিদস্যু’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘মাদক ব্যবসায়ী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
দক্ষিণখানে ‘হান্নানের গুলিতে’ নিহত আবদুর রশীদের চাচাতো ভাই মাহমুদুল হাসান সুজন বলেন, ‘হান্নান এক জন ভূমিদস্যু। সে অন্যের জমি পড়ে থাকতে দেখলেই দখল করত। অনেকের কাছ থেকে আবার জোরপূর্বক জমি কিনে নিতো। তার কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে তিনি এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এলাকায় যে যাই করুক তাকে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে বাড়ি বানাতে দেয় না হান্নান।’
স্থানীয়রা জানান, এমনকি ওয়াজ মাহফিল বা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান থেকেও টাকা নিতেন তিনি। নিজেকে আওয়ামী লীগের নেতা ও মানবাধিকারকর্মী দাবি করতেন। এছাড়াও কেউ যদি নির্মাণাধীন বাড়ির রাবিশ (ইট-সুরকির ময়লা) ফেলতে যেত তখনও সেখান থেকে চাঁদা আদায় করতেন।
আইনুশবাগের নাম ‘চাঁদনগর’ দিয়েছেন হান্নান
দক্ষিণখানের স্থানীয়রা জানান, হান্নানের বাড়ি চাঁদপুরে। এলাকায় চাঁদপুরের লোকজনকে নিয়ে তিনি একটি গ্রুপ করেছেন। তাদের নিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতেন। এ কারণে দক্ষিণখানে তার বাড়ির সামনের এলাকাকে চাঁদনগর নামকরণ করা হয়েছে। এলাকার প্রতিটি বাসার নামফলক ও দোকানের সাইন বোর্ডে আইনুশবাগ বদলে ‘চাঁদনগর’ লিখতে বাধ্য করেছেন তিনি।
বাড়ি ঘিরে রেখে যেভাবে আটক করা হয় হান্নানকে
সকালে আবদুর রশীদকে গুলি করে হত্যার পরই এলাকাবাসী হান্নানের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। তার বাড়িতে ইটপাটকেল ছোড়ে এবং হান্নানের ব্যবহৃত গাড়িটি পুড়িয়ে ফেলে। তখনই ফেসবুক লাইভে এসে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন হান্নান। সেসময় পুলিশ ঘটনাস্থলে অবস্থান নিয়ে হান্নানকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। দীর্ঘক্ষণ পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা করেন হান্নান। পরে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
হত্যার মোটিভ জানার চেষ্টা চলছে : এডিসি হাফিজ
দক্ষিণখান জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. হাফিজুর রহমান রিয়েল বলেন, ‘ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে গিয়ে রশীদকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে মেডিকেলে পাঠানো হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পুলিশের একটি ফোর্স সঙ্গে সঙ্গে হান্নানের বাড়িতে যায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তার বাড়ির বাইরে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে। আমরা স্থানীয়দের সান্ত্বনা দিয়ে হান্নানকে আটক করি।’
এডিসি হাফিজ জানান, এ ঘটনায় হান্নানসহ মোট সাত জনকে আটক করা হয়েছে। বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। হান্নানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পূর্ব শত্রুতা বা অন্য কোনো কারণে তিনি এ ঘটনাটি ঘটিয়েছেন কি না- তা জানান চেষ্টা চলছে।