জগলুল আজিম রানা : গত ১৪ই ফেব্রুয়ারির রাতে আমার মা-বাবার একটি ছবি দেখছিলাম। কেন যেন হঠাত করেই মা’কে খুব বেশি মনে পড়ছিল। মাঝে মধ্যেই আমি বাবা-মা’র ছবিগুলো বের করে দেখি আর তাঁদের সেই অন্যরকম স্নেহ-ভালোবাসার স্পর্শগুলো চোখ বন্ধ করে একটু নেবার চেষ্টা করি। সেদিন রাতে মায়ের মুখটা একটু ভালভাবে দেখতেই শরীরের ভেতরটা কেমন যেন নাড়া দিয়ে উঠলো। নিজের অজান্তেই দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। পাশেই ছিল আমার জীবন সঙ্গিনী শিখা। আমার চোখ দিয়ে ওমনভাবে অশ্রু গড়াতে দেখে সে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমি কাঁদছি কেন? আবেগ লুকোবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম।
পরের দিন ১৫ই ফেব্রুয়ারি সকাল বেলায় আমার মেজো বোন নীরা আপার ফেসবুকের একটি পোষ্ট দেখে নিজের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণা বোধ হলো। হয়তো আগের রাতে মা আমাকে জানান দিয়ে গেলেন, তুমি তোমার গর্ভধারিণী মায়ের ২১তম প্রয়াণ দিবসটি ভুলেই বসে আছো! একেই বলে মা-সন্তানের যোগসূত্র। সমস্ত যুক্তির ওপারে থাকে মা-সন্তানের এই যোগাযোগ। আমার জীবনে আমার মা এক অন্যরকম একজন, যাঁর স্নেহ-মমতা ভালোবাসার ভাণ্ডার আমার জন্য উজাড় করে দিয়েছিলেন। আমার জীবনের কোন আকাঙ্খাই তিনি অপূর্ণ রাখেননি। সব সময়ই তিনি মমতাভরে আমায় এক অবর্ণনীয় ভালোবাসার ছায়া আগলে রাখতেন।
নিশ্চয়ই পৃথিবীর সকল মা’ই, তাঁদের সন্তানের কাছে শ্রেষ্ঠ মা এবং এটাই সত্য, মায়ের কোন পরিপূরক নাই। তবে আমার মায়ের নিষ্পাপ চেহারা, চাল-চলনে অন্যের প্রতি আচার ব্যবহার আমাকে ছোটবেলা থেকেই ভীষণভাবে আকৃষ্ট করতো। মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অতুলনীয় ও অনুকরণীয়। আমি বিশ্বাস করি, কয়েকটি নমুনা জানাতে পারলে হয়তো আমার মায়ের আত্মা শান্তি পাবে। কয়েক বছর পূর্বে কানাডার টরন্টো শহরে এক বাসায় একজন ভদ্র লোকের সাথে পরিচয় ঘটে ২০১২ সালে। বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলাপচারিতার ফাঁকে ভদ্রলোক আমার মামাদের (হায়দার পরিবার অর্থাত জিয়া হায়দার, রশীদ হায়দার, মাকিদ হায়দার, দাউদ হায়দার প্রমুখ) বিষয়ে অবগত হলেন। উনি আমার মায়ের বিষয়ে জানতে চাইলেন, আমার মা জিয়া হায়দার ও রশীদ হায়দারের বড় কি না। এর পরে আমাকে অবাক করে ভদ্রলোক শ্রদ্ধাভরে আমার মায়ের বিবরণ দিয়ে গেলেন। মাকে উনি প্রথম দেখেছেন প্রায় তেপান্ন-চুয়ান্ন (১৯৬৭ বা ৬৮ সালে) বছর পূর্বে আমার নানী বাড়িতে যেটা হচ্ছে ঢাকার মালিবাগ, গুলবাগ আবুজরগিফারী কলেজের পূর্ব পার্শে। আমার আজও স্মরণে আছে, ওখানে একটি বরফ কল ছিল। যেখানে আইসক্রিমও পাওয়া যেত। নানীমা, খালা, মামারা থাকতেন সেই বাড়িতে। সেদিনের আমার মায়ের আতিথেয়তা টরন্টোর সেই ভদ্রলোক আজও ভুলতে পারেননি। তাঁর বিবরণে ভেসে উঠেছিল মায়ের ছবি। পরনে সবুজ প্রিন্টেড সাদা শাড়ি, মার্জিত অলংকার, পান খাওয়া লাল ঠোঁট। তিনি সব কিছুই সুক্ষ্মভাবে বলে গেলেন। তাঁর সেই বর্ণনায় আমি আমার মাকে একেবারে স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম। কিছু কিছু মানুষের হৃদয় নিংড়ানো নিখাদ ভালোবাসা এত দিন পরেও ভুলার নয়। অচেনা মানুষের মুখে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসার কথা আমাকে মুহূর্তের জন্য আবেগে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। সেই ভদ্রলোক হচ্ছেন আমার মেজ মামার বন্ধুর ছোট ভাই অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল খান।
ঠিক ওমনি আরেকটি দিন, এই সুদূর টরন্টো শহরেই এক বাসায় এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়। উনি বাংলাদেশ পিডব্লিউতে’তে চাকুরি করতেন। সত্তর দশকে উনি আমাদের ঢাকার শ্যামলী’র ‘ইছামতী’ বাড়িতে বাবার কাছে মাঝে মধ্যে যেতেন। উনিও শ্রদ্ধাভরে মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। সেই সাথে অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতিচারণ করলেন। মায়ের প্রতি অপরের শ্রদ্ধা, প্রশংসা কোন সন্তানের না ভাল লাগে!
মানুষের প্রতি মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসার দৃষ্টান্ত আমার শিশুমনকে বিশেষভাবে উদ্বেলিত করেছিল একদিনের ঘটনায়। সময়টা ৭৩ বা ৭৪ সাল হবে। মা সাধারণত সারা মাসের বাজারের জন্য ঢাকার নিউমার্কেটের নির্ধারিত দোকানেই যেতেন। সেদিন আমিও সাথে ছিলাম। মিরপুর রোড ধরে যাবার সময় ধানমন্ডি মাঠের পূব পাশে কোন কারণে আমাদের গাড়িটি ধীর গতীতে চলছিল। মা কেন যেন ড্রাইভার রমিজকে থামতে বললেন। মনে আছে হঠাত করেই গাড়ি থেকে নেমে মা গাছের নিচে বসে থাকা এক বৃদ্ধা ভিক্ষুকের কাছে গেলেন। প্রচন্ড শীত, বৃদ্ধা রীতিমত কাঁপছেন। আমিও গাড়ি থেকে নেমে মা’র পিছ পিছ গেলাম। মা গাছের নিচে বসে থাকা বৃদ্ধার সাথে কিছু কথা বললেন, তারপর উনার পরনের শালটি (চাদর) বৃদ্ধার শরীরে জড়িয়ে দিয়ে কিছু টাকা তার হাতে গুঁজে দিলেন। আমি মায়ের কাণ্ড দেখে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম এবং সে সময় আমার উত্সুক মন মা’কে জিজ্ঞেস করেই বসলো,
‘মা, আপনি একজন অচেনা বৃদ্ধাকে না জেনেশুনে আপনার পছন্দের শালটি দিয়ে দিলেন! সে যদি অভিনয় বা মিথ্যা বলে থাকে?’ মা সে সময় আমার কথার যে উত্তর দিয়েছিলেন, তার মর্মটা তখন আমি অতটা বুঝিনি। তবে এখন বুঝি, কতটা মূল্যবান ও শিক্ষণীয় কথা বলেছিলেন মমতাময়ী মা আমার। মা আমাকে খুব শান্তভাবে বলেছিলেন, ‘সব সময়ই মানুষকে সাদা মনে বিচার করবে এবং কাউকে কিছু দিলে বা কারো কোন উপকার করলে, তার কোন প্রতিদানে কোন কিছু প্রত্যাশা করবে না। তুমি শুধু ভাববে, যাকে তুমি কিছু দিচ্ছো, সেটা যেন তাকে আগের চেয়ে ভালো রাখে, সে যেন একটু আনন্দ পাই, সুখ পায়।’ আমার মা একটু থেমে আবার বলেছিলেন, ‘তুমি যদি সারাজীবন এটা মেনে চলো, তাহলে দেখবে, তোমার মনে কষ্ট পাবার সম্ভাবনা থাকবে না, বরং তুমি সারাজীবন শান্তি পাবে।’
আমার মা নিষ্পাপ শিশুর মতো সাদা মনের মানুষ ছিলেন। অন্যের কষ্টে নিজে কষ্ট পেতেন। এমনকি নাটক, সিনেমার সংবেদনশীল দৃশ্যে আবেগ ধরে রাখতে পারতেন না। এনিয়ে বাবা মাঝে মধ্যে দুষ্টুমি করে হাসি তামাশাও করতেন, যা ছিল মায়ের প্রতি বাবার স্নেহ, মমতা আর প্রগাঢ় প্রেমের বহি:প্রকাশ। আমার মা বাবাকে শ্রদ্ধাভরে ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন। ছোট বড় সবার প্রতি মায়ের ব্যবহার এত মধুর ছিল যে, সবাই মাকে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। এই ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা তিনি শুধু পরিবারে সদস্যদের কাছ থেকেই পেতেন না, বরং তা পেতেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। আমার মা তেমন বড় কোন ডিগ্রীধারী ছিলেন না। কিন্ত তিনি পড়তেন, বলতে গেলে প্রচুর পড়তেন। সংসারের কাজকর্ম এবং আমাদের দেখভাল করার পর সময় পেলেই মা গল্পের বই পড়তেন। এই বই পড়া তাঁকে বিশেষভাবে ঋদ্ধ করেছিল। অসম্ভব সুন্দর মানবিক গুণে গুণবতী হয়ে উঠেছিলেন আমার মা।
আমার মা বলে বলছি না, অত্যন্ত সাদা মনের, মানবিক গুণে পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন তিনি। সেই ছোট বেলায় থেকে আমৃত্যু মা আমার তাঁর এই স্বচ্ছ মন আর স্বচ্ছ মানবিকতা নিয়ে জীবন পার করেছেন।
আমার মাকে স্মরণ করতে গিয়ে আমি সবার মা-বাবার প্রতি পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাচ্ছি। যে মা-বাবারা চলে গেছেন, তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। যাদের মা-বাবা বেঁচে আছেন, তারা সত্যিই খুবই ভাগ্যবান। তাদের প্রতি একান্ত অনুরোধ, অনুগ্রহ করে মা-বাবার জন্য আরেকটু বেশি কিছু করুন, তাঁদের ভাল থাকা আর সুন্দর থাকার জন্য।