ডঃ বাহারুল হক : মানুষের মতি গতি বোঝা মুস্কিল। মানুষ যাতার নাই তা পেতে চায়; আবার যা অঢেল আছে তাও পেতে চায়। সে জন্য দরিদ্র যেমন টাকার ধ্যানে থাকে তেমনি ধ্যানে থাকে বেসুমার টাকার মালিকও। উভয়ের ধ্যান একটা – টাকা। আমি নদী পারের মানুষকে দেখেছি নদী অন্তঃপ্রাণ। আবার নদ-নদীহীন অঞ্চলের মানুষকেও দেখেছি নদী অন্তঃপ্রাণ। এই যেমন আমি। আমার জন্ম যেখানে সেখানে নদী কেন কোন খালও নাই। নদীতে আমি ভেসে বেড়াই নাই; সাঁতার কাটি নাই। নৌকার মাঝির কন্ঠের “রুপালী নদীরে…” ধরনের কোন গান শুনে শুনে আমি আমার শিশুকাল বা শৈশব অতিবাহিত করি নাই। অথচ আমিও নদী অন্তঃপ্রাণ। নিজের গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও গেলে আমি শুধু নদী খুঁজতাম। নদী আমাকে কাছে টানতো, এমনকি এখনো টানে। নদীতে কী আছে, নদীতে আমি কী দেখি বা কী খুঁজি আমি জানি না।
ছোটবেলায় একবার বাসে চড়ে আমি আর আব্বা ফেনী যাচ্ছিলাম। শীতকাল। ঠান্ডা বাতাস যাতে ভিতরে না ঢোকে সেজন্য বাসের জানালা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সে সময় বাসের বডি নয় শুধু জানালাও ছিল কাঠের। ফলে জানালা বন্ধ মানে বাহিরে সব কিছু দেখা বন্ধ। আমার মন খারাপ। আব্বাকে বললাম জানালাটা খুলে রাখতে। আব্বা বললেন, “কেন”? আমি বললাম- “বাস নদীর উপরব্রীজে উঠলে আমি নদী দেখবো”। আব্বা একগাল হেসে বললেন- “পাগল ছেলে! নদী দেখার কী আছে”? আব্বার সে প্রশ্নের কোন উত্তর আমার কাছে ছিল না। আমার আর নদী দেখা হলো না। আমার আব্বা আমার সাধ কিন্তু অপূর্ণ রাখেননি। আব্বা আমাকে নিয়ে ফেরার সময় কিছু পথ বাসে না চড়ে নৌকায় চড়েছেন। আমার মনে আছে আব্বা সুন্দর একটা নৌকা ভাড়া করেছিলেন আর নৌকার মাঝিকে আব্বা বলেছিলেন তীরে তীরে ধীরে ধীরে নৌকা চালাতে।
ফেনী নদী দিয়ে আমার নদী দেখা শুরু। একটু বড় হলাম। একা একা ঢাকা যাই। আমার বোনের বাসা থেকে বিকালে চলে যেতাম উর্দু রোডে (পুরান ঢাকা)। সেখান থেকে মাসুককে নিয়ে চলে যেতাম সদরঘাট। তারপর দুজনে নৌকায় চড়তাম। বার বার ওপারে যেতাম, আবার এপারে ফিরে আসতাম। কোন কোন দিন সদরঘাট টার্মিনালের ছাদে উঠতাম। ছাদে বসে বসে আমি বুড়িগঙ্গা দেখতাম। মাসুকের ভালো লাগতো না। ওরও প্রশ্ন- “নদীতে কী”? লেখাপড়া শেষে কর্মস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে। ডিপার্টমেন্ট থেকে ফি বছর আমরা পিকনিকে যেতাম বাহিরে কোথাও। আমার দাবি থাকতো নদীর পাশে কোন স্পট। নদী তীরে কোন পিকনিক স্পট পেলে এবং গেলে আমি যে কী খুশি হতাম! এক্সটারনাল এগজামিনার হয়ে দেশের অনেক জেলায় আমি গিয়েছি। গেলে এবং সেখানে নিকটে নদী থাকলে সে নদী তীরে না বেড়িয়ে আমি চট্টগ্রাম ফিরতাম না। দেশের বাহিরে গেলেও আমার ঐ নদী খোঁজা, নদী দেখা। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে ডক্টোরাল ষ্টুডেন্ট হিসেবে ভারতের কর্ণাটক ইউনিভার্সিটিতে চার বছর ছিলাম। কর্ণাটক ইউনিভার্সিটিছিল মনোরম আধা পার্বত্য এক এলাকায়। সে এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট এক নদী, গঙ্গাভালি। গঙ্গাভালির রুপ দেখে আমি যারপর নাই মুগ্ধ। নদী আর বৃক্ষের কি অপুর্ব কোলাকোলি! নদীর দুপাশে ঘন চির হরিৎবৃক্ষের বন। সে বন যেন গঙ্গাভালিকে পরম মায়ায় আগলে রেখেছে। গঙ্গাভালিকে আমি কত জায়গা থেকে যে দেখেছি! সর্বত্র গঙ্গাভালি আপন রুপে রুপান্বিত। গঙ্গাভালি নদী থেকে সৃস্টি হয়েছে এক দৃস্টি নন্দন ঝরনা, যা মগদ ফলস নামে পরিচিত। অনেকউপর থেকে স্বশব্দে জলধারা অবিরাম নিচে ঝরে পড়ছে। বর্ষা কালে এর শ্রী বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। সেজন্য বর্ষা কালে মগদ থাকে দর্শকে ভরা। গঙ্গাভালির উৎপত্তি ভারতের ওয়েস্টার্ন ঘাট থেকে। উৎপত্তির পর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এ নদী মিশে গেছে আরব সাগরে।
কারোয়ার আরব সাগরের তীরের এক বন্দর নগর আর সেখানেই আছে কর্নাটকইউনিভার্সিটির মেরিন সাইন্স ইনস্টিটিউট। গবেষণা কাজে আমাকে কিছুদিন কারোয়ার থাকতেহয়েছিল। আমার সাথে থাকতো ঐ ইনস্টিটিউটের এক ছাত্র, আভীর। আভীর সেখানে আমার দেখ-ভালকরতো বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। কারোয়ারে আমার আকর্ষণ ছিল কালি নদী। সময় পেলে নৌকা আর আভীরকে নিয়ে নেমে পড়তাম কালি নদীতে। কালি নদীর উৎপত্তি স্থলও ওয়েস্টার্ন ঘাট। উৎপত্তির পর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কালি মিশেছে আরব সাগরে। সাগর পারে কালির মোহনায় স্থাপিত হয়েছে একটা অনন্য সুন্দর ব্রীজ। সঁন্ধার আগে ঐ ব্রীজের উপর আমি হাজির থামতাম আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরব সাগরে সুর্যাস্ত দেখতাম। নদী-সাগর-সুর্য্য এই তিনে মিলে তৈরী হতো এক অসাধারন আবহ। আমি যেন সেই আবহে নিজেই বিলীন হয়ে যেতাম সুর্যাস্তের সময়। কত নদীর মোহনা দেখেছি, কিন্তু কালির মত এত সুন্দর মোহনা আর কোন নদীর দেখি নাই। ভারতের মহীশূরও ছিলাম কিছুদিন। মহীশূর একদা এক স্বাধীন রাজ্য ছিল। সেই মহীশূরের ণৃপতি ছিলেন ভারত বিখ্যাত বীরাত্মা টিপু সুলতান, আর মহীশূরের রাজধানী ছিল শ্রীরাঙ্গাপট্টম। শ্রীরাঙ্গাপট্টম গিয়ে আমি দেখা পাই কাবেরীর। কাবেরী নদী।কাবেরী দেখেমন ভরে গেল। মনে মনে ভাবলাম এতদিন পর একটা নদীর দেখা পেলাম। টলটলে জলে টই টুম্বুর এক নদী। শান্ত শ্রোত বুকে নিয়ে বয়ে যাচ্ছে কাবেরী।কাবেরীর বুকে নৌকার ছড়াছড়ি। ইচ্ছে হচ্ছিল একটা নিয়ে ঘুরে বেড়াই। কাবেরী ভারতের অন্যতম প্রধান এক নদী। দক্ষিন ভারতের এ নদীর উৎপত্তি কর্ণাটক রাজ্যে। তবে কর্ণাট্ক পার হয়ে কাবেরী প্রবেশ করেছে ভারতের সর্ব দক্ষিনের রাজ্য তামিল নাড়ুতে। তারপর পড়েছে ভারত মহা সাগরে। কাবেরীর পানি নিয়ে চরম বিবাদ চলে কর্ণাটক আর তামিল নাড়ু এই দুই রাজ্যের মধ্যে। ১৯৯১ সনে পানি নিয়ে তামিল আর কান্নাড়িদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। সে দাঙ্গায় দুই রাজ্যের কয়েক জন লোক নিহত হয়। দাঙ্গা আর হতাহতের খবর শুনে আমি হতবাক। মনে মনে ভাবলাম পানি নিয়ে ভারতের সাথে আমাদেরওতো বাকবিতন্ডা কম হচ্ছে না। কিন্তু কৈ দাঙ্গাতো কখনো হয়নি।