মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।
ছাব্বিশ.
১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত পরপর তিন বছর পরপর তিনটি একই বিষয়বস্তু নিয়ে তৈরি করা চলচ্চিত্র মানুষকে ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে বিশেষভাবে ভাবতে বাধ্য করে। সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায়। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ এবং ‘সুবর্ণরেখা’ তাঁর ত্রয়ী চলচ্চিত্র। তিনটি চলচ্চিত্রই একই সুতোয় গাঁথা। ঋত্বিক ঘটক সেই ছোটবেলা থেকেই বরাবরই বিপ্লবী ছিলেন। তিনি সব সময় সামষ্টিক ব্যাথাকে ধারণ করতে চেয়েছিলেন। নিজের আশ-পাশ চারিদিকে ঘর হারা মানুষের কান্না আর বেদনা দেখে তিনি তাঁর ক্যামেরায় তাদের কথা তুলে আনতে চেয়েছিলেন। ঋত্বিক ঘটক বারবারই নিজের কথা আর সমাজের ক্ষত সবার সামনে তুলে আনার জন্য একটি মাধ্যম খুঁজছিলেন। চলচ্চিত্রে আসার পূর্বে তিনি নাটকে মেতেছিলেন। তাঁর সেই কালজয়ী নাটকগুলো দিয়েও তিনি সমাজের বঞ্চিত, নিরন্ন মানুষের কথা বলেছেন। পরে যখন তিনি উপলব্ধি করলেন, নাটকের চেয়ে চলচ্চিত্র প্রভাব অনেক বেশি এবং চলচ্চিত্র একই সময়ে দেশ ও দেশের বাইরের বহু জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া যায় নিমিষেই। ঋত্বিক ঘটক একবার বলেছিলেন, তাঁর কিছু বলার আছে, তিনি সেটা বলতে চান মানুষের কাছে। যেহেতু চলচ্চিত্র এমন একটা মাধ্যম, যার মাধ্যমে খুব সহজেই তাঁর কথাগুলি ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে বলতে পারেন, সে জন্য সেটা তিনি বেছে নিয়েছেন এবং আগামীতে যদি চলচ্চিত্রের চেয়ে আরো ভালো মাধ্যম পান, যার সাহায্যে তিনি তাঁর কথা বলতে পারবেন, তখন তিনি চলচ্চিত্রকে লাথি মেরে সরিয়ে দিয়ে সেই মাধ্যমের কাছে যাবে। আপাত দৃষ্টিতে ঋত্বিক ঘটকের এমন কথাকে অনেকেই দাম্ভিকতা হিসেবে নিতে পারেন, কিন্তু বিষয়টা আমাদের অন্যভাবে নেয়া উচিৎ। আসলে ঋত্বিক ঘটক বলতে চেয়েছিলেন, তিনি তাঁর সব দিয়ে বলে গেছেন, মানুষের জাতিগত ও ধর্মীয় অন্ধত্বের বিরুদ্ধে যা মানুষ ও রাশট্রকে পশুত্বের পর্যায়ে নিয়ে যায়।
‘মেঘে ঢাকা তারা’র আবেগমথিত গল্পে ঋত্বিক তাঁর ভাবনাকে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন। এটি তাঁর চতুর্থ ছবি- এখানে তিনি তাঁর কাহিনির সচেতন ব্যাখ্যা দিতে চাইলেন। সেজন্য ছবির চরিত্রগুলিকে যুক্ত করে দিতে চাইলেন আমাদের দেশজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে, শুধু কাহিনির উপর নির্ভর না করে একে স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ করে তুলতে চাইলেন। নীতার যন্ত্রণাকে বাংলাদেশের দেশজ সংস্কৃতির সংগে যুক্ত করে আমাদের ঐতিহ্য-লালিত মানসিকতাকে নাড়া দিতে চেয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক। সেজন্য তিনি নীতাকে টেনে বাংলা সাহিত্যের সুপরিচিত উমার আবহে।
‘কোমল গান্ধার’ চলচ্চিত্রের নামকরণে সাংগীতিক আবেদন বাদ দিলেও রবীন্দ্রনাথের ‘তাই আমি নাম দিয়েছি কোমল গান্ধার / যায় না বোঝা যখন চক্ষু তোলে / বুকের মধ্যে অমন করে / কেন লাগায় চোখের জলের মিড়। এ চলচ্চিত্রে নায়িকাকে তিনি করে তুলতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের মুখ। এ ছবির নায়িকার নাম অনসূয়া- যার মানে হচ্ছে, যার কোন ঈর্ষা নেই। দুটি প্রতিদ্ব›দ্বী নাট্যদলের রেষারেষির মাঝে অনসূয়া মিলনের পথ তৈরি করে। গণনাট্য সংঘের ভাঙ্গন, ভাঙ্গা বাংলা-এর উৎস ঋত্বিক ঘটক মনে করেছিলেন পারিস্পারিক অবিশ্বাস। অনসূয়া ঋত্বিকের স্বপ্নের প্রতীক, যে ভাংগনকে জোড়া লাগাতে পারবে।
‘সুবর্ণরেখা’ চলচ্চিত্রের নায়িকা সীতার সামগ্রিক চরিত্রে ঋত্বিক টেনে আনেন পুরাণ-কাহিনি। সীতার আত্মহনন মিলে যায় ধরিত্রীকন্যা সীতার ধরিত্রীর কোলে ফিরে যাওয়ার সংগে। ঈশ্বরের নামকরণও তাৎপর্যময়। একটি কাপুরুষ, পলাতক, চরিত্র ঈশ্বর। আর নবজীবন কলোনীর যুবকদের যে রাত জেগে থাকার আহবান জানায় তার নাম অবিনাশ।
১৯৬২ সালে ‘সুবর্ণরেখা’ নির্মাণের পর ঋত্বিক ঘটকের জীবনে এক চরম বন্ধ্যা সময় কাটে। সেই বাষট্টি সালের পর থেকে পরের এগার বছর তিনি কোন পূর্ণ দৈর্ঘ কাহিনীচিত্র বানাতে পারলেন না। ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্য লাগে। এমন কী ঘটেছিল ঋত্বিক ঘটকের জীবনে যে, সবচেয়ে স্ন্দুরতম সময়ে তিনি একেবারে ঊষর হয়ে পড়লেন। ঋত্বিক ঘটকের মাত্র ৫১ বছরের জীবনে ১১ বছর কেটে গেল তাঁর মনের মত ছবি নির্মাণ না করেই। এই সময়ে ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া, পুনে’তে বছর দুয়েকের মত ভিজিটিং প্রফেসর ও ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে কাজ করার সুখ স্মৃতি ছাড়া তাঁর আর তেমন কিছু করা হয়নি।
১৯৬০ সালে ভারতের পুনে শহরে জাতীয়ভাবে ভারতের একমাত্র এই চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট করা হয়। ঋত্বিক ঘটক ১৯৬৬ সালে এই ইনস্টিটিউটে যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে। পরে তিনি ভাইস প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। শ্রুতি আছে যে, তাঁকে ভাইস প্রিন্সিপাল পদের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইন্দ্রিরা গান্ধী। তখন তিনি ভারতের ইনফরমেশন এন্ড ব্রডকাস্টিং মিনিষ্টার। জনশ্রুতি আছে, ইন্দিরা গান্ধী যখন ঋত্বিক ঘটককে ভাইস প্রিন্সিপাল হওয়ার প্রস্তাব দেন, তখন তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, ‘দিদি, ঠিক আছে। তুমি যা চাও, তাই হবে। কিন্তু মনে রেখ, যদি কোনো আমলাকে প্রিন্সিপালের পদে বসাও, তাহলে খুনোখুনি হলে কিন্তু আমার কোনো দোষ নাই।’ ঋত্বিক চেয়েছিলেন, চলচ্চিত্র শিক্ষার জায়গায় দরকার চলচ্চিত্রের প্রতি সত্যিকারের দরদ ও জ্ঞান থাকা প্রিন্সিপাল আর শিক্ষক। ইন্দিরা গান্ধী ঋত্বিক ঘটকের কথা রেখেছিলেন, উনি যতদিন পুনে ইনস্টিটিউটে ছিলেন, ততদিন কোন প্রিন্সিপালকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। উল্লেখ্য, ইন্দিরা গান্ধী ঋত্বিক ঘটককে খুব ভালোবাসতেন এবং ঋত্বিক ঘটক ইন্দিরা গান্ধীর ওপর একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করছিলেন।
ইনস্টিটিউটে মোট দু’বছরের মত ঋত্বিক ঘটকের অবস্থান সেখানকার পরিবেশ পরিবর্তনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। পুনে ইনস্টিটিউটে ঋত্বিক ঘরাণার সৃষ্টি হয়। চলচ্চিত্রকে নিছক বিনোদনের মাধ্যম না ভেবে জীবনের সত্যিকারের গল্প বলতে চাওয়া একঝাক ছাত্র তাঁর আক্ষরিক অর্থে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, আদুর গোপাল কৃষ্ণান, মনি কাউল, জন আব্রাহাম, সৈয়দ মির্জা, কুমার সাহানী, সুভাষ ঘাই, বিধু বিনোদ চোপড়া প্রমুখ। এরা সবাই ভারতীয় চলচ্চিত্রের উজ্জ্বলতম নির্মাতা। ঋত্বিক ঘটক এবং অন্যরা পুনের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট শুরুর সময়ে যে অবদান রেখেছিলেন, তা এখনও সবাই কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। উল্লেখ্য, পৃথিবী চলচ্চিত্র শিক্ষার ইনস্টিটিউটের র্যাংকিং এ বর্তমানে ‘ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া’র অবস্থান পঞ্চম। নিঃসন্দেহে, এটা ভারত উপমহাদেশের জন্য একটা বিশেষ অর্জন। ঋত্বিক পুনে থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন চলচ্চিত্র নির্মাণ করার জন্য। কিন্তু ১৯৭৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র ছাড়া তিনি কোন কাহিনিচিত্র তৈরি করতে পারেননি।
তখন ঋত্বিক ঘটকের চরম ক্রান্তিকাল। সত্তর দশকের মাঝামাঝির একটু আগে। মদ পানের মাত্রা অনেক বেড়ে গিয়েছিল তাঁর। হাতে কোন ছবি ছিল না। তাঁর এক শিষ্যকে নিয়ে তিনি তখন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছেন। এই ঘুরতে ঘুরতেই এক দিন চলে গিয়েছিলেন তাঁর এক সময়ের প্রিয় জায়গা ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া, পুনেতে। ঋত্বিক ঘটক যখন ইনস্টিটিউটের গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকেছিলেন, তখন রাত প্রায় দুটো। তিনি তখন একেবারে মাতাল। তাঁর শিষ্য কোন রকমে তাঁকে সামলানোর চেষ্টা করছিলেন। সেই ইনস্টিটিউটের ‘উইজডম ট্রী’র কাছে এসে তিনি চীফ সিকিউরিটি আব্দুর রহমানের নাম ধরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন। রহমান তাঁর এক সময়ের প্রিয় ভাইস প্রিন্সিপালের ডাক শুনে ছুটে এসেছিলেন। তারপর রেস্ট হাউসে ঋত্বিক ও তাঁর শিষ্যের থাকার ব্যবস্থা করলেন। ততক্ষণে রাত না জাগা ছাত্ররা টের পেয়ে গেছে, তাঁদের গুরু ঋত্বিক ঘটক তাদের ক্যাম্পাসে। মুহূর্তেই ভীড় জমে গিয়েছিল। ছাত্রদের প্রায় সবাইই ঋত্বিক ঘটককে চাক্ষুষ দেখেনি, কিন্তু তাঁর নাম সদা ঘুরে বেড়াতো ইনস্টিটিউটের প্রতিটি বিন্দুতে। সেই রাতেই প্রিন্সিপাল চলে এসেছিলেন ঘুম ঘুম চোখে। প্রিন্সিপাল আসার আগেই ঋত্বিক তাঁর আশে পাশে ভীড় করা ছাত্রদের মাতাল কন্ঠে বলেছিলেন, ‘ফ্রম টুমোরো, আই উইল টেঁক ইয়োর ক্লাস ফ্রম নাইন ও’ক্লক। আই ওয়ান্ট অল অফ ইউ হেয়ার শুড বি প্রেজেন্ট। এন্ড টুমোরো, দেয়ার উইল বি নো আদার ক্লাসেস।’ ছাত্রদের সাথে যখন ঋত্বিক এমন সব কথোপকথন চলছিল, তখন ঋত্বিকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন প্রিন্সিপাল। পূর্ব পরিচিত প্রিন্সিপালকে ‘ফ্রেন্ড’ সম্বোধন করে ঋত্বিক আগের মতই বলতে শুরু করলেন, ‘আই থিং আই উইল নট বি হেয়ার লং, আই থিং আই উইল নট সারভাইভ লং, সো এজ লং এজ আই সারভাইভ এন্ড এজ লং আই উইল স্টে হেয়ার, আই উইল টেঁক অল দ্য ক্লাসেস ফ্রম টুমোরো।’ প্রিন্সিপাল সংগে সংগে ভক্তি নিয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘অফ কোর্স, অল দ্য ক্লাসেস উইল বি সাস্পেন্ডেড এজ লং এজ য়ু স্টে হেয়ার। অনলি ইউ উইল টেঁক ক্লাসেস এন্ড আই উইল বি ইয়োর ফার্স্ট স্টুডেন্ট।’ তারপর ঋত্বিক ঘটক একটানা তিন দিন ইনস্টিটিউটে ক্লাস নিয়েছিলেন। সকাল নয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। মাঝখানে শুধু থাকতো প্রয়োজনীয় বিরতি। সেই তিন দিন ইনস্টিটিউটের অন্য সব ক্লাস বন্ধ ছিল। ছাত্র শিক্ষক সবাই নিবিষ্ঠ মনে ঋত্বিকের ক্লাস উপভোগ করেছিলেন।
ঋত্বিক চলচ্চিত্রের সব শাখা নিয়ে যেভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছিলেন তা বিস্মিত করেছিল সব ছাত্র এবং শিক্ষকদের। যে সব ছাত্ররা এতদিন ইনস্টিটিউটের বাতাসে ঋত্বিকের নাম শুনে এসেছিল, তারা তাঁর ক্যারিস্ম্যাটিক ক্ষমতায় তাঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। মন্ত্রমুগ্ধের মত তারা দেখেছিল চলচ্চিত্রের এক মহাজ্ঞানীকে।
টানা তিন দিন ক্লাস নেওয়ার পর ঋত্বিক ঘটক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে পুনে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। টানা ২৪ দিন সেই হাসপাতালে থাকার পর তাঁকে ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের একটা মেডিক্যাল হেলিকপ্টারে করে বোম্বেতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেখান থেকে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। সেদিন ঋত্বিককে কলকাতায় ফিরিয়ে আনতে তাঁর প্রিয় বন্ধু প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মৃণাল সেন গিয়েছিলেন। সেই সময় ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং কয়েকদিন পর পর তিনি নিজে ফোন করে ঋত্বিক ঘটকের খোঁজ নিতেন।
পুনে’তে যাওয়ার আগে ঋত্বিক ঘটক নিজের বড় মেয়ে সংহিতা ঘটককে নিয়ে গিয়েছিলেন দিল্লীতে। তারা যে হোটেলে ছিলেন সেই হোটেলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দফতর থেকে ফোন এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী ঋত্বিক ঘটককে তাঁর বাসভবনে যেতে বলেছেন। ঋত্বিক ঘটক সোজা জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ব্যস্ত, সেদিন যেতে পারবেন না। মেয়ে সংহিতা বাবার সব কিছু লক্ষ্য করছিল। সে জানে তার বাবার হোটেল কক্ষে শুয়ে থাকা আর পায়চারী করা ছাড়া আর কোন ব্যস্ততা নেই। কন্যা জানতে চেয়েছিল পিতার কাছে, প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ নাকচ করা হলো কোন ব্যস্ততার কারণে। পিতা ঋত্বিক শুধু উত্তর দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ডাকলেই তাঁর ইচ্ছেমত সুড়সুড় করে যাওয়ার পাবলিক তিনি নন। তাঁর কোথাও যাওয়াটা তারই মর্জির ওপর নির্ভর করে।
পরের দিন ঋত্বিক ঘটক কন্যাকে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীর বাসভবনে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সেদিন তাঁর কোন এপোয়েন্টমেন্ট ছিল না। উপরন্তু সেদিন ইন্দিরা গান্ধী অসুস্থতার জন্য কারো সাথে দেখা করছিলেন না। ঋত্বিক ঘটক গেটে গিয়ে কিছুটা চেঁচামেচি করে ফেললেন। বললেন তাঁর দিদি অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীকে খবর দিতে। যখন ইন্দিরা গান্ধীর কাছে কোনভাবে খরবটা গিয়েছিল, তিনি ঋত্বিক ও তাঁর কন্যাকে ভিতরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ঋত্বিক ও ইন্দিরার সেদিন অনেক কথা হয়েছিল। তাঁদের সেই সব কথা শুনে চলছিলেন সংহিতা। দু’জনের কথার একেবারে শেষের দিকে ইন্দিরা গান্ধী ঋত্বিক ঘটককে বলেছিলেন, ভারতের যে শহরে তিনি থাকতেন চান, সেই শহরে তাঁর জন্য মাসিক এক টাকা বরাদ্দে তাঁর আজীবনের জন্য একটা এপার্টমেন্ট দিতে চান। সংহিতার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠেছিল। তার ভাবনায় আনন্দ জমা হতে লাগলো, এবার অন্তত তাদের থাকার দুশ্চিন্তার অবসান ঘটতে যাচ্ছে।
কিন্তু ঋত্বিক ঘটক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে শুধু বলেছিল, ‘দিদি, গোটা দেশ জুড়ে অগনতি মানুষ রাস্তা ঘাট আর খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। তাদের মুখে খাবার নেই, থাকার ঘর নেই। স্রেফ শিয়াল-কুকুরের মত তাদের জীবন। তুমি আগে তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করো, তারপরে আমি তোমার কাছ থেকে নিজের থাকার জন্য এপার্টমেন্ট নিবো।’
বাবা আর কন্যা যখন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের ফটক পেরিয়ে সাধারণ রাস্তায় এসে দাঁড়াল, তখন, কন্যা সংহিতা অনেকটা ক্ষোভের সাথে বলে উঠেছিল, বাবা, তুমি এ কী করলে, আমাদের থাকার কোন নিজস্ব জায়গা নেই, তুমি কেন এই সুযোগ ছেড়ে দিলে।’ ঋত্বিক ঘটক কিছুটা ধমকের স্বরে কন্যাকে বলেছিলেন, কোটি কোটি মানুষের থাকার জায়গা নেই, তাদের বাসস্থানের সংস্থান না হওয়া পর্যন্ত ঋত্বিক ঘটক কখনো সরকারের কৃপায় কোন এপার্টমেন্ট নিতে পারে না।’ (চলবে)