অনলাইন ডেস্ক : করোনা মহামারির কারণে আয় কমে গেছে। ঘর ভাড়া পরিশোধ, খাওয়া-পরা সবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে দেশের যৌনপল্লিগুলো থেকে বের হয়ে যাচ্ছে নারী যৌনকর্মীরা। অন্য কাজ পাওয়ার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। তবে তাদের বেশিরভাগই ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছেন।
যৌনকর্মীরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে তারা খেয়ে-পরে বাড়িতে টাকাও পাঠাতে পারতেন। তবে বর্তমানে যৌনপল্লীতে খদ্দের কম আসায় নিজেদেরই অর্ধাহারে থাকতে হয়। কক্ষের ভাড়া দিতে পারছেন না, পরিবারকেও সহযোগিতা করতে পারছে না। তাই তারা যৌনপল্লি থেকে বের হয়ে আসছেন।
গত ৪ ডিম্বেবর জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ময়মনসিংহের রমেশ সেন রোড যৌনপল্লির এক তরুণী ফোন দিয়ে জানান, তারা দুই জন যৌনপল্লি থেকে বের হতে চান। পরবর্তীতে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার পুলিশ তাদের দুই জনকে উদ্ধার করে। দুই তরুণী প্রায় দেড় বছর ধরে ওই পল্লিতে ছিলেন। তাদের একজনের বাড়ি নোয়াখালী এবং আরেকজন মিরপুরের একটি বস্তিতে থাকতেন। যৌনপল্লিতে যাওয়ার পর একজন মাও হয়েছেন। পুলিশ ওই দিন তাদের উদ্ধার করে দুই জনের ইচ্ছে অনুযায়ী ঢাকার ট্রেনে তুলে দেন। দুই জনেই ঢাকায় পৌঁছে মিরপুরের কোনও এক স্বজনের বাসায় উঠেছেন।
এদের মধ্যে এক তরুণী জানান, করোনা শুরু হওয়ার পর বেশ কয়েকদিন যৌনপল্লি বন্ধ ছিল। এরপর থেকেই খদ্দের কমে আসে। তার বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। বর্তমানে আয় হচ্ছে না, তাই তিনি পল্লিতে আর থাকবেন না। তবে সেখান থেকে সহজে বের হওয়া যায় না। পল্লির সর্দারনি তাদের বের হতে দিতেন না। তাই পুলিশের সহায়তায় বের হয়েছেন। একজন দালালের মাধ্যমে তারা দুই জনেই এই পল্লিতে এসেছিলেন।
ঢাকায় এখন কী কাজ করবেন- জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘পোশাক কারখানায় কাজ করবো।’
দুই তরুণীকে উদ্ধারকারী ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার ১ নম্বর পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আল আমিন বলেন, ‘আয় না থাকায় তারা দুই জন চলে গেছেন। তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। তারা ঢাকায় পৌঁছে ফোন দিয়ে জানান দুই জনই ঠিকঠাকভাবে পৌঁছেছেন।’
দেশের ১১ যৌনপল্লি থেকেই কমছে কর্মী
বেসরকারি সংস্থা ‘সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড)’ ২০১৭-১৮ সালে যৌন কর্মীদের সংখ্যা নিরূপন করার জন্য একটি জরিপ করে। তাদের ওই জরিপে বলা হয়, দেশের ১১টি যৌনপল্লিতে প্রায় চার হাজার মেয়ে কাজ করেন। বিভিন্ন যৌনপল্লিতে কর্মরত যৌনকর্মী, সর্দার ও এনজিওকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার প্রভাবে আয় কমে যাওয়ায় এসব যৌনপল্লি থেকে যৌনকর্মীরা চলে যাচ্ছেন।
দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি দৌলতদিয়ায়। এখানে স্বাভাবিক সময় প্রায় দেড় হাজার যৌনকর্মী থাকেন। তবে করোনা মহামারিতে কমেছে এর বাসিন্দা। বর্তমানে এক হাজার ৫০ জনের মতো যৌনকর্মী রয়েছেন। তবে আরও কয়েকজন রয়েছেন যারা আগে এই কাজ করতেন, এখন বয়সের কারণে ছেড়ে দিয়েছেন।
এই যৌনপল্লির কর্মীদের নিয়ে কাজ করে মুক্তি মহিলা সমিতি। এর নির্বাহী পরিচালক মর্জিনা বেগম। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে অনেকে ছুটিতে গিয়ে আর আসেনি। তবে তাতে সংখ্যার হেরফের বেশি একটা হয় না। কারণ এখানে স্থায়ীভাবেই বেশি যৌনকর্মী থাকেন।’
তিনি জানান, ‘বর্তমানে অর্থকষ্ট রয়েছে, সবাই কষ্ট করে চলছে। কোনও রকমে নিজেরা খেয়ে থাকার মতো করে আছে যৌনকর্মীরা। বাড়িতে আর টাকা পাঠানোর উপায় নেই কারও।’
দেশের অন্য যৌনপল্লির কয়েকটিতে খোঁজ নিয়েও একই চিত্র পাওয়া গেছে। অনেক যৌনকর্মী আবার এক পল্লি ছেড়ে দেশের অন্য কোনও পল্লিতে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ ঢাকায় এসে ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবেও কাজ করছেন বলে জানান মর্জিনা।
প্রায় অবস্থা জামালপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর রথখোলা, ফরিদপুর সিঅ্যান্ডবি, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা বানিশান্ত, যশোর বাবুবাজার, ময়মনসিংহ রমেশ সেন রোড ও যশোর মাড়ুয়া মন্দির যৌনপল্লিতে থাকা যৌনকর্মীদের। রোজগার কমে যাওয়ায় অনেকেই পল্লি ছেড়ে বের হয়ে গেছেন।
ময়মনসিংহ রমেশ সেন রোডের যৌনপল্লিতে স্বাভাবিক সময় ২১০ থেকে ২২০ জন যৌনকর্মী থাকেন। তবে করোনার কারণে এখন সেখানে দেড়শ জনের মতো যৌনকর্মী রয়েছেন বলে জানিয়েছেন পল্লীর সর্দারনি সোফিয়া।
মাড়ুয়া মন্দির যৌনপল্লির কর্মীদের নিয়ে কাজ করে শক্তি উন্নয়ন সংঘ নামে একটি সংগঠন। এর সম্পাদিক রানী বেগম। তিনি বলেন, ‘এখানে স্বাভাবিক সময় ২০০/১৮০ জন যৌনকর্মী থাকেন। কিন্তু করোনা শুরু হওয়ার পর যৌনকর্মীরা অভাবে চলে গেছেন। করোনার পর থেকে অন্তত ২৫/৩০ জন যৌনকর্মী চলে গেছেন। বর্তমানে বয়স্কসহ ১৪০ জন রয়েছেন। খদ্দের না থাকায় ধারদেনা ও গয়নাগাটি বিক্রি করে সন্তানদের নিয়ে চলছেন তারা। অনেকের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন জায়গায় থেকে লেখাপড়া করে, তারাও এখন বিপাকে পড়েছেন। সন্তানদের খরচ চালাতে যৌনকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছেন।’
ছুটিতে গিয়ে আর আসছেন না যৌনকর্মীরা
সর্দারনিদের কাছ থেকে যৌন কর্মীদের অনেকেই ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার কথা বলে পল্লি থেকে বের হয়ে আর ফিরছেন না। কেউ কেউ আবার পুলিশের সহায়তাও যৌনপল্লি ছাড়ছেন।
পটুয়াখালী যৌনপল্লির যৌনকর্মীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন মঞ্জু বেগম। তার সংগঠনের নাম শক্তি নারী সংঘ। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে অনেক মেয়ে পল্লি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তবে এখন স্বাভাবিক হওয়ায় আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। কতদিন না খেয়ে থাকা যায়? বাড়িতে বসে খাবে কী? তাই পেটের টানে আবার চলে আসছে। এখনও অনেকে ছুটিতে আছে। অনেকে অন্য পল্লিতে চলে গেছে। এভাবেই চলছে।’
এই পল্লিতে বর্তমানে ১৩০/১৩৫ জনের মতো যৌনকর্মী রয়েছেন। তবে স্বাভাবিক সময়ে ১৫০/১৮০ জন করে থাকেন বলে জানান তিনি।
দুর্দশায় ভাসমান যৌনকর্মীরাও
করোনায় ভাসমান যৌনকর্মীরাও দুর্দশায় রয়েছেন। করোনার মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় তাদের দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। খদ্দের কম থাকায় তারা অনেকে ভিক্ষাবৃত্তির দিকে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন অক্ষয় নারী সংঘের পরিচালক কাজল আক্তার।
তিনি বলেন, ‘আমি অনেক জায়গায় নক করেও ভাসমান যৌনকর্মীদের জন্য তেমন কিছুই করতে পারিনি। বেসরকারিভাবে কিছু সহায়তা পেয়েছিলাম। করোনার মধ্যে প্রথম দুই মাস সেই সহযোগিতা থেকে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ভাসমান যৌনকর্মীদের চাল-ডাল দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে তাও বন্ধ।’
সরকারি বরাদ্দ অপ্রতুল
লকডাউনের সময় দেশের ১১ যৌনপল্লির বাসিন্দাদের সরকারি সহযোগিতা দেওয়া হয়েছিল। তবে তা ছিল খুবই অপ্রতুল। কোনও পল্লিতে একবারই সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে, কোথাও দেওয়া হয়েছে একাধিকবার। প্রথম চার মাস বেসরকারি উদ্দোগেও সহযোগিতা করা হয়েছে। তবে এরপর সহযোগিতা নেই বললেই চলে।
ময়মনসিংহ রমেশ সেন রোডের যৌনপল্লিতে একবারই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল দেওয়া হয়েছিল বলে জানান যৌনপল্লির কর্মীদের নিয়ে কাজ করা ‘শক্তি উন্নয়ন সংঘ’র সম্পাদিক রানী বেগম। তিনি বলেন, প্রথমদিকে এই সহায়তা দেওয়া হয়। এরপর বেসরকারি উদ্যোগেও কিছু ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে সহযোগিতা নেই।
দৌলতদিয়া যৌনপল্লির কর্মীদের সরকারিভাবে একবার চাল দেওয়া হয়েছে। তবে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লকডাউনের সময়টাতে সহযোগিতা করেছে। তারা ভালোই সহযোগিতা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা স্থানীয় সংগঠন ‘মুক্তি মহিলা সমিতি’র নির্বাহী পরিচালক মর্জিনা বেগম। তিনি বলেন, ‘এখন সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ায় সাহায্য বন্ধ।’
এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, ‘লকডাউনের প্রথম থেকেই যৌনকর্মীদের খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। এখন যদি আর কোথাও প্রয়োজন হয় তাহলে আবার দেওয়া হবে। এছাড়া বেসরকারিভাবে তাদের সহযোগিতা করা হয়েছে। তারা বিভিন্ন প্রকল্পের ভাতাও পান। তাদের কারও ব্যক্তিগত প্রয়োজন হলে স্থানীয়ভাবে জানালেও যৌনকর্মীদের সহযোগিতা করা হবে।’