মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।

সতের.
বালক সত্যজিৎ যখন দশে পা দিল, তখন পৌষ মেলা দেখার জন্য শান্তিনিকেতন গিয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন মা সুপ্রভা রায়। নতুন অটোগ্রাফের খাতা কেনা হয়েছে। ভীষণ শখ জেগেছে প্রথম আটোগ্রাফটা নিবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে। এক সকালে মা’র সঙ্গে সত্যজিৎ গেল উত্তরায়ণে। পারিবারিকভাবে ঠাকুর পরিবার আর রায় পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিনের সুন্দর সম্পর্ক। সত্যজিৎ এর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন আর পিতা সুকুমার রায় ছিলেন বিশ্বকবির পরম স্নেহভাজন। সুকুমার রায় সম্পাদিত সন্দেশ পত্রিকার তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ পাঠক। দশ বছরের বালক সত্যজিৎ রায়, যাকে মানিক নামেই রবীন্দ্রনাথ চিনতেন, বিশ্বকবির সামনে কিছুটা ত্রস্ত ভঙ্গিতে অটোগ্রাফের খাতাটা নিয়ে দাঁড়াতেই কবি পরম স্নেহে কাছে টেনে নিলেন। জানতে চাইলেন খাতা নিয়ে সে কেন এসেছে। বালক মানিক খাতাটা এগিয়ে তার ইচ্ছার কথা জানাল। কবি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকালেন, তারপর সস্নেহে বললেন, ‘এটা থাক আমার কাছে; কাল সকালে এসে নিয়ে যেও।’ কথামত মানিক পরের দিন গেল। টেবিলের উপর চিঠি-পত্র, খাতা-বইয়ের ডাঁই, তার পিছনে বসে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মানিককে দেখতেই তার ছোট্ট বেগুনী খাতাটা খুঁজতে লাগলেন সেই ভীড়ের মধ্যে। মিনিট তিনেক হাতড়ানোর পর বেরোল খাতাটা। তারপর সেটা তাকে দিয়ে মা সুপ্রভা রায়ের দিকে চেয়ে বললেন, এটার মানে ও আরেকটু বড় হলে বুঝবে।’ খাতা খুলে বালক সত্যজিৎ আট লাইনের ভুবনজয় করা কবিতাটা দেখল। বিশ্বকবির ঘর থেকে বের হয়ে উত্তরায়ণের সামনের যে বিশাল আমগাছ তার নীচে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে আবৃত্তি করতে লাগল;

বহু দিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছে সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু \
একটানে আটটি লাইন আবৃত্তি করে কিছুক্ষণ থামলো সে। তারপর দম নিয়ে লাইনগুলোর নীচের শব্দগুলো উচ্চারণ করলো- ৭ই পৌষ ১৩৩৬ শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ততক্ষণ মা এসে পিছনে দাঁড়িয়েছেন। জানতে চাইলেন লাইনগুলোর মানে বুঝেছে কিনা। সে তখন অল্প মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল, ‘কিছুটা’।

চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়

ভারত উপমহাদেশের চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে সম্মানীত ব্যক্তি এবং যাঁকে চলচ্চিত্র জগতের রবীন্দ্রনাথ বলা হয় সেই সত্যজিৎ রায় সম্ভবত বালক বয়সেই বিশ্বকবির এই আটটি লাইন মনের অজান্তেই গভীরভাবে ধারন করেছিলেন। ফলে ফর্মে আন্তর্জাতিক হলেও বিষয়ে প্রচণ্ডমাত্রায় দেশজ হতে পেরেছেন আর একটানে বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বের চলচ্চিত্র কাতারে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ১৯২১ সালে ২মে কোলকাতায়। পূর্বপুরুষের বাসস্থান বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার মসুয়া গ্রামে। মাত্র আড়াই বছর বয়েসে পিতাকে হারানোর ফলে তাকে আর তার মা’কে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটতে হয়। তবে মামার আশ্রয়ে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পান মা ও ছেলে। মা চাকুরী নেন একটি স্কুলে। আট বছর পর্যন্ত সত্যজিৎ মায়ের কাছে বাড়ীতেই পড়াশুনা করেন। তারপর ১৯৩০ সালের জানুয়ারী মাসে বালিগঞ্জ সরকারী বিদ্যালয়ে কাস সিক্স এ ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই সত্যজিৎ ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ বছর দশ মাস। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৬ সালেই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেন। এই কলেজে তাঁর পিতামহ ও পিতৃদেবও ছাত্র ছিলেন। কলেজের ছাত্র হবার পর বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়ার পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত চর্চায় আরো বেশি মন দেন। আগে যেমন চলচ্চিত্র বিষয়ে ভাবতে গিয়ে শুধুমাত্র অভিনেতাদের নিয়ে ভাবতেন, এবার তাঁর আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ছবি পরিচালনা ও পরিচালক। ইতোমধ্যে পুদভকিনের চলচ্চিত্রের তাত্তি¡ক দিক সর্ম্পকে দুটি বই পড়ে ফেলেছেন তিনি এবং সেই সময়ে বৃটেনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পত্রিকা সাইট এন্ড সাউন্ড এর গ্রাহকও হয়েছেন তিনি। সাইট এন্ড সাউন্ড পত্রিকার চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখাগুলো তাঁকে কিভাবে আলোড়িত করতো তা বলতে গিয়ে পরবর্তী জীবনে তিনি লেখেন, ‘যেন একটা নতুন জগতের দরজা খুলে যাচ্ছে আমার চোখের সামনে। … নজর করে দেখছি যে, ক্যামেরাটাকে কোথায় কীভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে, কোন দৃশ্য কোথায় ‘কাট’ করা হচ্ছে, ছবির গল্পাংশ কীভাবে উম্মোচিত হচ্ছে আর কী কী সেই বৈশিষ্ট্য যা একজন পরিচালকের কাজকে আর একজনের কাজ থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়।’ সেই সময় কোন ছবির ডিসটিংটিভ কোয়ালিটি ফিনিশ দেখে সত্যজিৎ আলাদা করতে পারতেন এমজিএম থেকে প্যারামাউন্ট বা ওয়ার্নার থেকে টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরী ফক্সের ছবি। সেই সঙ্গে ফোর্ড এবং ওয়াইলার বা কাপরার সঙ্গে স্টিভেন্স এর মতো পরিচালকের ছবির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে ফেলতেন। শেষ জীবনে সেই কিশোর সময়ের কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বারবার বলতেন, ‘দিস ওয়াজ প্রেসাইজলি দ্য পয়েন্ট হোয়ার মাই ইনটারেস্ট টুক এ সিরিয়াস টার্ণ’।
১৯৩৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীা দেবার পর সত্যজিৎ ঠিক করেছিলেন হিউম্যানিটিজের কোনও বিষয় নিয়ে পড়বে। তাঁর ইচ্ছে ছিল সাহিত্য নিয়ে পড়বে। কিন্তু ভারতের প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ পিতৃহীন বন্ধুপুত্রকে সাহায্য করার ইচ্ছায় সুপ্রভা রায়কে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সত্যজিৎ যদি অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে বি.এ পরীক্ষা দেয়, তাহলে তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান স্ট্যাটেটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের মুখপত্র সংখ্যা পত্রিকায় চাকুরীর সুবিধা হতে পারে। ‘চাকুরী’ এই শব্দ বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তানের কাছে নিশ্চয় বড় লোভনীয় ছিল। ফলে সত্যজিৎ অনেকটা বাধ্য হয়েই অর্থনীতিতে অনার্স নিয়েছিলেন। কিন্তু অর্থনীতি তার ভালো লাগত না। স্রেফ মুখস্থ বিদ্যার জোরে একটা সেকেন্ড কাস নিয়ে সত্যজিৎ রায় অনার্স পাশ করেন।

বালক সত্যজিৎ রায়

সত্যজিৎ রায়ের মায়ের একান্ত বাসনা ছিল, সত্যজিৎ শান্তি নিকেতনের শিল্প বিষয় নিয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে কলকাতার পাইকপাড়ার সিংহবাড়ীতে এক অনুষ্ঠানে সুপ্রভা রায় ও সত্যজিৎ রায় গিয়েছিলেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে সুপ্রভা কবিকে প্রণাম করতেই কবি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার ছেলে কি করছে? তাকে আমাদের আশ্রমে পাঠাও না কেন?’ রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে সুপ্রভা রায়ের সুপ্ত ইচ্ছটা জেগে উঠল এবং এক রকম জোর করেই সত্যজিৎকে শান্তি নিকেতনে জ্ঞানলাভ করতে পাঠালেন। কলকাতার সরগরম পরিবেশ ছেড়ে শান্তিনিকেতনের মত একটি নিরব নিশ্চুপ পরিবেশে যেতে তার একেবারে মন টানছিল না। উপরন্ত শান্তিনিকেতনে নিয়মিত সিনেমা দেখার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া আশ্রমিকদের কিছুটা মেয়েলি ও কৃত্রিম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সত্যজিতের একবারে পছন্দের ছিল না। কিন্তু মা’য়ের ইচ্ছের কাছে একমাত্র বাধ্য সন্তান ১৯৪০ সালে ১৩ জুলাই শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভর্তি হলেন। শান্তিনিকেতনের প্রথম দিনে সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কবি তখন উত্তরায়ণ চৌহদ্দির মধ্যে সবে তৈরি ‘উদীচী’ বাড়িতে ছিলেন। সেখানে সত্যজিৎ দেখলেন, কবি সামনের বারান্দায় বসে আছেন আরাম কেদারায় ঠেস দিয়ে, তাঁর চাদরে ঢাকা পা দুটো সামনে একটা টুলের ওপর তোলা। সত্যজিৎকে দেখে খুশী হলেও মুখের ভাবে সে খুশী প্রকাশ করার একটু অসুবিধা ছিল, কারণ একজন নাম করা বাঙালী ভাস্কর তার মূর্তি গড়ছেন মাটি দিয়ে। আর রবীন্দ্রনাথ অনড় হয়ে বসে তাকে সিটিং দিচ্ছেন। শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর যে বিশেষ দু’জনের øেহ সত্যজিৎ সারাজীবন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন তারা হচ্ছেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। তিনি প্রায় বলতেন। শান্তি নিকেতন তাঁকে দুটি বিষয় শিখিয়েছে- ছবি দেখা এবং প্রকৃতিকে চেনা। ফলে ভীষণ বাস্তববাদী কবিত্বহীন মন নিয়ে তিনি শান্তিনিকেতনেই খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর ভবিষ্যতের যাত্রাপথ। তিনি বলেছেন, ‘দ্য প্লেস হ্যাড ওপেনড উইনডোস ফর মি। ইট হ্যাড ব্রট টু মি অ্যান আওয়ারনেস অফ আওয়ার ট্রাডিশনস হুইচ আই নিউ উড সার্ভ অ্যাজ এ ফাউন্ডেশন ফর এনি ব্রাঞ্চ অফ আর্ট দ্যাট আই উইশড টু পারস্যু।’ এইখানেই ভবিষ্যতের এক শিল্পীর গড়ে ওঠার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আড়াই বছর শান্তিনিকেতনে চিত্রকলার শিগ্রহণ করে অধ্য নন্দলাল বসুর অনুমতি নিয়ে কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হওয়ার বাসনায় তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। অথচ সত্যজিৎ এর শান্তিনিকেতনে চার বছর থাকার কথা ছিল।

শান্তিনিকেতন থেকে চলে আসার তিনমাস পরে ১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল সত্যজিৎ চাকুরী পেলেন বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমার-এর জুনিয়র ভিসুলাইজার আর্টিস্ট হিসেবে। বাইশ বছরের চলচ্চিত্র রসিক সত্যজিৎ তখনো চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠার কথা ভাবেননি। ১৯৪৮ সালে নাগাদ সত্যজিৎ ডি জে কিমার আর্ট ডিরেক্টর হয়েছিলেন।

চাকরী জীবনে শনিবার বিকেলে ফিল্ম দেখা তাঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেয়েছিল। চলচ্চিত্র সংক্রান্ত পড়াশুনার জন্য মাঝে মধ্যেই যেতেন ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরফেশন লাইব্রেরীতে। সেখানেই আলাপ হয়েছিল বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে। কাশ্মীর থেকে ১৯৪৩ সালে কলকাতায় আসা বংশী ইতোমধ্যে কলকাতা গ্রæপের সদস্য হয়েছেন এবং চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর গভীর ভাবনা থাকায় খুব সহজেই সত্যজিতের সাথে বংশীর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সেই দিনগুলোতে সত্যজিতের হাতে রজার ম্যানভিলেন ফিল্ম বইটি। বইটির শেষ পরিচ্ছেদের শিরোনাম ছিল হোয়াই নট স্টার্ট এ ফিল্ম সোসাইটি। লেখাটি নিয়ে সত্যজিৎ বংশী দুজনেই নিজেদের মধ্যে আলাপ করলেন। অবশেষে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতায় একটি ফিল্ম সোসাইটি সংগঠিত করবেন। সমমনা চলচ্চিত্রে আগ্রহী কিছু যুবক নিয়ে ১৯৪৭ সালের ৫ অক্টোবর যাত্রা শুরু হয় ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির। পঁচিশজন সদস্য নিয়ে সোসাইটিটির পত্তন হয়। সত্যজিৎ ও বংশী চন্দ্রগুপ্ত ছাড়া সোসাইটির উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হচ্ছেন, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, পূর্ণেন্দু নারায়ণ, মনোজেন্দু মজুমদার। সত্যজিৎ লিখেছেন, ‘সাধারণত আমাদের বাড়ীর বৈঠকখানায় বসে আমরা ১৬ মিলিমিটারের ফিল্ম দেখতাম এবং যেসব ফিল্ম দেখতাম তার নানান দিক নিয়ে আলোচনা করতাম নিজেদের মধ্যে। আমরা প্রথম দেখেছিলাম আইজেনস্টাইনের ক্যাসিক ছবি ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’।

১৯৫৫ সালে নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’র পোস্টার।

যে পথের পাঁচালী ছবি করে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র পরিচালনার জগতে নিজের স্থান করে নেন, সেই পথের পাঁচালী’র কাহিনীটা একটু নাটকীয়ভাবে তাঁর জীবনে আসে। সত্যজিৎ যে কোম্পানীতে চাকুরী করতেন, সেই কোম্পানী থেকে বাংলা সাহিত্যের সব সুন্দর বইগুলো একেবারে সাধারণ পাঠক বা কিশোরদের উপযোগী করে নতুন সংস্করণে ছাপা হতো। আর এই সব বইগুলির প্রচ্ছদ থেকে ছবি আঁকার দায়িত্ব পড়তো সত্যজিৎ রায়ের উপর। একদিন কোম্পানীর ডি কে গুপ্ত সত্যজিৎকে ডেকে বললেন। পথের পাঁচালীর এক কিশোরপাঠ্য সংস্করণ বের হবে এবং এর ছবিগুলো তাঁকে আঁকতে হবে। সময়টা ছিল ১৯৪৫ সাল। সত্যজিৎ তখনও পথের পাঁচালী পড়েননি। ব্যপারটা শুনে ডি কে গুপ্ত তাঁকে স্নেহ ধমক দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন, এই বইয়ের কাহিনী থেকে একটি সুন্দর চলচ্চিত্র হতে পারে। সত্যজিৎ তিনশত পৃষ্ঠার মূল বই পড়ে ফেললেন। পড়ে শুধু তিনি অস্ফূট স্বরে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘অপূর্ব’! তারপরই কাহিনীটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
এর মধ্যে কয়েক বছর কেটে গেল। পথের পাঁচালী নিয়ে ছবি করার ভাবনা একেবারে উস্কে গেল ১৯৪৯ সালে। বিখ্যাত ফরাসী চলচ্চিত্রকার জ্যঁ রেনোয়া সেই সময় কোলকাতায় এসেছেন তাঁর ছবি দি রিভার এর লোকেশন দেখার জন্য। সেই সময়ে রেনোয়ার কোলকাতায় আগমন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির তরুণদের অদ্ভুতভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল। রেনোয়া সত্যিই ছিলেন একজন ‘মেকার’। এই ‘মেকার’ শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ অর্থেই নয় বরং চলচ্চিত্রের পরিচালক ও কলাকুশলী তৈরির অর্থেও। রেনোয়া আপন করে নিয়েছিলেন বাংলার এই চলচ্চিত্র পাগল যুবকদের। তিনি সোসাইটির খোঁজ খবর রাখতেন। সোসাইটির ছেলেদের সাথে বসে চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে খুঁটিনাটি আলাপ করতেন এবং উৎসাহী যুবকদের প্রত্যভাবে চলচ্চিত্র বিষয়ক জ্ঞান দেওয়ার জন্য নিজের শ্যুটিং ইউনিটে কাজের সুযোগ করে দিতেন। তবে কোলকাতার এই যুবকদের মধ্যে রেনোয়ার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল সত্যজিৎ রায়কে। ছয় ফুটের উপরে লম্বা এই বাঙালী ছেলেটির বিশ্ব চলচ্চিত্র এমনকি তাঁর ছবি নিয়ে এত স্বচ্ছ ধারণা তাঁকে বিস্মিত করেছিল। সত্যজিৎ তখন চাকুরী করেন। শুধুমাত্র শনিবার তাঁর ছুটি। রেনোয়া যতদিন কোলকাতায় ছিলেন সেই দিনগুলোতে সত্যজিৎ প্রতি শনিবার রেনোয়ার কাছে আসতেন। তারপর তাঁর গাড়ীতে করে বের হয়ে যেতেন নতুন শ্যুটিং লোকেশন-এর সন্ধানে। রেনোয়াও সত্যজিতের জন্য আকুলভাবে অপো করে থাকতেন। রেনোয়াকে সত্যজিৎ প্রথম বলেছিলেন পথের পাঁচালী নিয়ে ছবি করার। রেনোয়া শুধু বলেছিলেন, ‘তোমার বাংলায় যে ঐশ্বর্য আছে, সেটাই ব্যবহার কর। নিছক হলিউডের ছবির নকল করার কথা কখনো ভাববে না। তবে পাশ্চাত্য জ্ঞান আবশ্যই গ্রহণ করবে।’ হয়তোবা গুরু রেনোয়ার কথাগুলোকে সত্যজিৎ চিরদিন সম্মান জানিয়ে এসেছেন, ফলে দেখা যায় তিনি ফর্মে আন্তর্জাতিক হলেও বিষয়ে একেবারে দেশজ। আটত্রিশ বছর পর সত্যজিৎকে ফ্রান্সের সবচেয়ে সম্মানীয় বেসামরিক পুরস্কার লিজিয়ন অফ দ্য অনার দেওয়ার জন্য স্বয়ং ফরাসী রাষ্ট্রপতি ফট্রাসোয়া মিতেরা ছুটে এসেছিলেন কোলকাতায়। সেই সময় এক প্রশ্নের উত্তরে সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন, ফ্রান্সের জ্যঁ রেনোয়া তাঁর প্রিন্সিপাল মেন্টর। (চলবে)