তাসলিমা হাসান: অন্ধকার গলি দিয়ে চলতে গিয়ে পূর্বা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। কিছুটা অন্ধের মতোই চলছিল। এ রাস্তাটায় লাইট কখনোই থাকে না। তবুও এ পথ দিয়েই রোজ অফিসে যেতে হয়। কারণ অফিসে যাবার পথ এই একটাই। বাড়ি থেকে বেরুলে অনেকটা পথ রোজই হাঁটতে হয়। অন্ধকার গলিটার দিকে ঢুকলেই পূর্বার মনে ভয় আর আতঙ্কে শিহরিত শিহরিত হয়, গা ছম ছম করে।
শিহরিত হয়, গা ছম ছম করে। পূর্বা প্রতিদিন এই আতঙ্ক নিয়েই গলি পাড় হয়ে বড় রাস্তায় বাস ধরে অফিসে যায়।
পূর্বা, ছন্দময় ফিগার, আলো ঝলমলে সবুজাভ এক উপবন। তারুণ্যের তাবৎ নির্যাসকে নিংড়ে নিংড়ে উপভোগ করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন ওকে বিধাতা। দেহের ভাঁজে ভাঁজে শুধু যৌবনেই ছাপ। ওর উষা রাঙা ঠোঁট, পদ্দ পুকুর আঁখি, লম্বাচুল, এলো কেশী তার বেণী। কিংবদন্তি শিল্পীর রঙিন ক্যানভাসে আঁকা এক নারী। পূর্বা ২৪ বছরের এক মাধুর্য্য ময় তরুণী। গলার স্বরে অদ্ভুত মাদকতা।
পূর্বা এক রিয়াল এস্টেট কোম্পানীতে চাকরি করে। বসের পার্সোনাল সেক্রেটারী। বাবা চার বছর হলো মারা গিয়েছেন তখন থেকেই মা আর ছোট বোনের দায়িত্ব ওর ওপরে। অফিসের বস ওকে মনে করেন তার প্রাইভেট প্রপার্টি। যখন তখন বসের সাথে অফিসিয়াল কাজে বাইরে যাওয়া ছাড়াও ব্যক্তিগত কাজও করে দিতে হয়। বেতন ভাল পায়, তাতে ওদের সংসারটা ভালভাবে চলে।
বসের বয়স ৫০-এর কাছাকাছি। বস ওকে সুনজরে দেখেন। ওকে নিয়ে বিদেশে অফিসিয়াল ট্যুরে যেতে চান, পূর্বা রাজি হয় না বলে কত কথা শুনতে হয়। বলেন, ‘তুমি একটু সেকেলে মেন্টালিটির, আধুনিক হবার চেষ্টা কর। আই মিন দ্যাটস আ্যবসুলেটলি ফাইন, আমি তোমাকে বোঝাবার চেষ্টা করছি, তুমি ভাল পরিবারের মেয়ে, সেন্টিমেন্টে লাগে এমন কোন মন কষ্ট তোমাকে দিতে চাই না, তোমার মতামতের মূল্য আছে বাকি’। বস পূর্ণ দৃষ্টিতে পূর্বার দিকে তাকিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন।
অরবিন্দুর সাথে ওর সখ্যতা বসের চোখে পড়েছে। অরবিন্দুকে ঘিরে জীবনের সুখ-দু:খের আগামী দিনগুলো আবর্তিত হতে চলেছে এটা সহজেই বুঝে নিয়েছেন বস। অরবিন্দু বড় লোকের ছেলে, হ্যান্ডসাম, বাবা বেঁচে থাকতেই ওর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অরবিন্দু ওকে খুব তাড়া দেয় বিয়েটা সেরে ফেলতে কিন্তু ওদের সংসার চালানোর দায়িত্ব তো পূর্বারই। পূর্বা একটি ভালোবাসার শান্তির নীড় চায়, যেখানে ভালোবাসা রোদে শুকিয়ে না যায়। জীবন ক্লেদাক্ত না হয়, সম্পর্কের অবনতি যাতে না হয়, দিনগুলো যেন সোনালি রোদে পাখা মেলে, স্বপ্নগুলো পাহাড়ি ঢলে হোঁচট খেয়ে নীচে গড়িয়ে না পড়ে, স্বপ্নে ঘেরা সিন্ধ কুমারী জীবনে কেয়া ফুলের অপরুপ গন্ধে ভরা, প্রজাপতির মতো নরম, সুন্দর স্বপ্নে ভরা সুখী আর তৃপ্ত শান্তির নীড় চায়। জীবনে কোন দু:খের করাত যেন ছিন্ন ভিন্ন না করে সে সংসার। হতে চায় সাব্মীর চোখে চন্দ্রমল্লিকা।
ভালোবাসাহীন যন্ত্রের মতো জীবনের চাহিদা মেটাতে পারবে না পূর্বা। এ সবই সম্পূর্ণ ঘৃণ্য প্রশ্ন অসম্মানের নর-নারীর জীবনের টানাপোড়নগুলো ওর বোধের বাইরে। সব সময় ভাবে এই অন্ধকার আমাবস্যা কেটে গেলে কখন ও অরবিন্দুর সংসারে সুখের প্রদীপ জালাবে।
সেদিন সকাল থেকে শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। এতো বৃষ্টি ঝড়ছিল মনে হচ্ছিল আকাশ তার চোখের সব পানি ঢেলে দিচ্ছে জমিনের উপর। অফিস থেকে বেরুতে সেদিন বেশ রাত হয়ে গেল, বাসও লেট করে পেল পূর্বা। গম্ভীর রাত, সারাদিনের বৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে, তবুও আকাশ অন্ধকারই ছিল। অন্ধকার ঘন হতে শুরু করে, ঘন-ঘনতর – ঘনতম। ঝিম ঝিম নেশায় স্বপ্ন চরাচরে রাত। লাইট পোষ্টগুলো দাঁড়িয়ে আছে প্রেতের মতো! হিম নামতে থাকে বাতাসে, আকাশের চাঁদ লজ্জায় কালো চাদর দিয়ে আলো ঢেকে দিয়েছে তার শরীরে।
এমন নিবিড় আঁধারে পূর্বা গলির ভেতরে ঢুকে হাঁটছিল। কিছু দূর হেঁটে ভেতরের দিকে যেতেই চাপা গলায় কিছু কথা কানে আসতে থাকে, মনে হচ্ছিল কয়েকটা পুরুষ লোকের ফিস্ ফিস্ কন্ঠ, বলছিল, ‘সেই সুন্দরী যাচ্ছে ধর ধর ওকে,’ সাথে অট্ট হাসি।
ওদের কথা শুনে খানিক ক্ষণের জন্য সরে গিয়ে সন্তর্পণে পূর্বা তলিয়ে যেতে থাকে আরো অন্ধ্রকারে, কেঁপে উঠলো ওর শরীর ভয়ে, ঢোঁক গিললো, চিবুক ও গলার পেশীগুলো টান টান হোল। চোখ ঘুরিয়ে অন্ধকারে আলো খুঁজতে থাকলো। দ্রুত পা চালিয়ে এগোতেই তিনচারজন লোক ওর উপর ঝাঁপিয়ে পরে আচমকা পূর্বার কোমর ধরে টেনে নিল নিজেদের দিকে। ঠোঁট চেপে ধরলো একজনের ঠোঁটে। জিভটা জোর করে ঠেলে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল মুখের ভেতরে।
তারপর কোমর তুলে নিল যেন নরম ঘাসের মধ্যে, ডুবে গেল একজন ওর শরীরের ভেতরের নীচের দিকে। অন্যগুলি ওর ঠোঁট কামরে হাত দিয়ে বøাউজের বোতাম খুলে ফেললো, ওদের মুখ থেকে মদ আর সিগারেট মেশানো গন্ধে বমি আসতে লাগলো। পূর্বা নিজেকে ছাড়ানোর বহু চেষ্টা করলো। কিন্তু ওরা ওর ঠোঁট কামড়ে ওকে রক্তাক্ত করলো। বাজে গন্ধটা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। একটানে ওর পেটিকোট খুলে দিয়ে প্রচন্ড জোর করে নিজেকে প্রবেশ করালো ওর মধ্যে!
কষ্টে, রাগে বিরক্তি, ঘৃণায় ওর শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠলো। ও কষ্ট সহ্য করতে না পেরে খামচে ধরলো লোকটার টিশার্ট। পূর্বা চিৎকার করে বললো, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, নষ্ট কোর না আমাকে, বাচঁতে দাও’। আরো জোরে চিৎকার করে আপ্রাণ চেষ্টা করলো নিজেকে বাঁচাতে, ‘আমাকে বাঁচান, কেউ আছেন? সে রাতে কেউ এলো না পূর্বাকে বাঁচাতে। পূর্বা রক্তাক্ত হোল। হৃদয় বিদারক এক ধরনের ধ্বনি রাতের মৌনতাকে ভেদ করে বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো। তখন পৃথিবীটা ছিল একদম চুপচাপ।
পূর্বার দেহটা ক্ষত-বিক্ষত করে কালিমা লেপন করে দিল কতগুলি মানুষ নামের পশু! পূর্বা জ্ঞান হারালো। রক্তাতো দেহটা ভোরে আবিষ্কার করলো পথচারীরা। পুলিশ এসে হসপিটালে নিয়ে গেল। ডাক্তার আবিষ্কার করলো, বেঁচে আছে তবে তার নারীত্ব চিরদিনের মতো হারিয়েছে। এ ভাবে আমাবস্যায় কালো নিবিড় অন্ধকার কাটিয়ে পূর্বা চোখ খুললো। ভয়াল কালো বরণ একমেঘের আস্তরণ আবৃত করে রাখে পূর্বার মনটাকে। পূর্বার জীবন যেন এক অন্ধকার কারাগার এখন। ওর কালো চোখে নিবিড় ব্যাথার ছায়া, হতাশা লুকানোর কোন জায়গা নেই। সারা দেহে শারীরিক ক্ষুধা নিবৃত্তি করে দেবার পশুদের নিষ্ঠুর বিকৃতির ছাপ। নির্দোষ, অপবাদহীন, অকলঙ্ক, নির্মল, পবিত্র এক সুন্দরী নারী পূর্বা সমাজে কলঙ্ক নিয়ে ধর্ষিতা হয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণার ব্যাথা বইবে কিভাবে!
জানাজানি হোল সব কিছু। পাড়া প্রতিবেশীরা এলো না ওকে দেখতে, এমন কি আত্মীয়স্বজনরাও। এতটুকু সহানুভূতিও জানালো না কেউ।
অরবিন্দু এলো না কারণ ও এখন একজন ধর্ষিতা নারী! অফিসের চাকরিটা হারালো, শুধু কিছু পাওনা বেতন মিললো। একবার দেখা করতে এলো না এতো আধুনিক বস।
জীবন এরকমই পাল্টে যায় পরিস্থিতির কারণে। আত্ম শ্লাঘা এক জটিল বিষয়। সময়ে তা ভালোবাসার মতো বলিষ্ঠ আবেগের টুটি চেপে ধরে। অরবিন্দুর সঙ্গে ১০ বছরের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ভালোবাসার। এক ঝড়ের দুর্ঘটনায় সব সমাপ্তি ঘটলো। নিজের প্রতি উপেক্ষা, কান্নাকাটি, প্রচুর কটু কথা শোনা ইত্যাদি হার্ড লাইফ পেরিয়ে তবেই যবণিকা পরে সমাজে বহু পূর্বার। এ ক্ষেত্রে সমাজের, ব্যাক্তিবর্গের তেমন কিছুই আসে যায় না। কারণ পূর্বা একজন ধর্ষিতা নারী! অরবিন্দু, অফিসের বস মিথ্যে আত্মমর্যাদা বোধের পোষাক পড়ে সমাজে বেঁচে থাকবে যুগে যুগে। আর ধর্ষিতা নারীদের সমাজে স্থান নেই, তারা ঘৃণিত এই পুরুষ সমাজে। অন্ধকার, নিষ্ঠুরতা, ক্ষত বিক্ষত আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে পুড়ে বেঁচে থাকবে ধর্ষিতারা পচা ড্রেনের দুর্গন্ধ যুক্ত ময়লার মতো। আর সোনার মুকুট পড়ে রাজা হয়ে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করবে কিছু পুরুষরা!
অন্ধকারময় জীবনে ধারালো ছুড়ির আঘাতে রক্তাক্ত পূর্বাদের মতো। নারীদের জীবন। স্বপ্নে ভরা স্নিগ্ধ কুমারী জীবন দলিত হবে নারীত্ব হারাবে মানুষ নামে পশুদের কাছে। নিষ্ঠুর ঘৃণা এ সবই নারীদের প্রতি পুরুষের, প্রতিরোধের কোন উপায় নেই। রক্ত মাংশে গড়া একজন নারী স্পর্শকাতর আর নান্দনিক নারী সত্তা তার স্বপ্ন পুরুষের কাছ থেকে অস্তিত্বের সর্বোচ্চ সম্মানটুকু পর্যন্ত পায় না। প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তিকে বোঝাবার ক্ষমতা নেই তাদের। তাই পূর্বা অবদমন করে ভেতরটাকে ক্লেদাক্ত করে তোলে ওর মন!
কত রুপের দ্যুতি এখন যৌবন ওর অভিশপ্ত হয়ে গেল সর্ব নাশা এক দুর্ঘটনায়! রূপ ওর পূর্ন চন্দ্রের মতো কিন্তু সেই রুপ এখন অমলিন জ্যোস্নার মতো! কাল অন্ধকার ওর জীবনকে গ্রাস করে নিল!