অনলাইন ডেস্ক : চীনের জনসংখ্যা এখন প্রায় দেড়শ কোটি। অর্থনীতি প্রায় ১৫ ট্রিলিয়ন ডলারের। বছরে আমদানি দুই হাজার বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ পণ্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ভোক্তাবাজারে শুল্ক্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ভোগ করছে। গত জুলাই থেকে এই সুবিধা কার্যকর হয়েছে। শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা প্রাপ্তির প্রথম তিন মাসে করোনাভাইরাসের কারণে চীনে রপ্তানি তেমন বাড়াতে পারেনি বাংলাদেশ। শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা শতভাগ কাজে লাগাতে একটি পথনকশা করা হচ্ছে। রপ্তানি ছাড়াও শুল্ক্কমুক্ত এই সুবিধা বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের এক নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে বলে মনে করছেন বাণিজ্য বিশ্নেষকরা।

বাংলাদেশের জন্য চীনে যে সম্ভাবনার দ্বার খুলল তাতে উদ্যোক্তা, রপ্তানিকারকরা খুবই খুশি। তারা বলছেন, আগামীতে চীনই হবে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার। বাণিজ্য বিশ্নেষক ও সরকারের সংশ্নিষ্ট বিভাগগুলোও উদ্যোক্তাদের এই আশাবাদের সঙ্গে অভিন্ন মত দিয়েছেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন করে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধায় চীনে নিয়ে যেতে চান দেশটির অনেক উদ্যোক্তা। বাণিজ্য স্বার্থ হচ্ছে, চীনে মজুরি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। কোনো একটা পণ্য চীনে উৎপাদন ব্যয় বেশি, বাংলাদেশে কম। ফলে পণ্যটি বাংলাদেশে উৎপাদন করে চীনে নিয়ে বাজারজাত করা বাণিজ্যিকভাবে অনেক বেশি লাভজনক। কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যয় বাংলাদেশে অর্ধেক। এই সুবিধা কাজে লাগাতে নতুন করে চীনা বহু উদ্যোক্তা জৈবপ্রযুক্তি, কম্পিউটার প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের কার্যক্রম শুরু করেছেন। বাংলাদেশের জন্য এই ক্ষেত্রগুলো তুলনামূলক নতুন। এই বিবেচনায় চীনের দেওয়া শুল্ক্কমুক্ত সুবিধাকে কভিডের সংকটকালেও সুখবর হিসেবেই দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের আট হাজার ২৫৬টি পণ্যের শুল্ক্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে চীন। গত ১ জুলাই থেকে এই সুবিধা কার্যকর হয়েছে। গত ১৬ জুন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর ট্যারিফ কমিশন এ-সংক্রান্ত নোটিশ জারি করে। আগে থেকেই এশিয়া প্যাসিফিক বাণিজ্য চুক্তির (আপটা) আওতায় তিন হাজার ৯৫টি পণ্যে শুল্ক্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা ছিল। নতুন সুবিধার আগে বছরে গড়ে ৮০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হতো চীনে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকের অংশ ৫০ কোটি ডলারের মতো।

বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, নতুন স্কিমের আগে চীনে তৈরি পোশাকের ২০০ ক্যাটাগরিতে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করেছে বাংলাদেশ। ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯৭ শতাংশ পণ্যে এই সুবিধায় পোশাকের প্রায় সব পণ্যই শতভাগ শুল্ক্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধার আওতায় এলো। তিনি বলেন, এলডিসির অধীনে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা বেশি লাভজনক হলেও এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এই সুবিধা আর থাকবে না।

বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বিরোধ এবং কভিডের কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমদানি কমিয়েছে চীন। উৎপাদিত পণ্যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েছে তারা। দেশটির বাণিজ্য নীতির শর্তে রপ্তানিযোগ্য পণ্য স্থানীয় বাজারে বিপণনে কোনো বাধা নেই। এ কারণে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়েনি; বরং প্রধান পণ্য তৈরি পোশাকের রপ্তানি কম হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে আগের অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি কম হয়েছে ৩৪ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক অর্থ ও বাণিজ্য বিশ্নেষণী প্ল্যাটফর্ম বিজনেস ইকোনমিকসের তথ্য থেকে জানা গেছে, সম্প্রতি চীনে আমদানি আবার ব্যাপক হারে বাড়তে শুরু করেছে। গেল সেপ্টেম্বরে আমদানি বেড়েছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে চীনের আমদানির পরিমাণ ছিল ২০৩ বিলিয়ন ডলার। এই বৃদ্ধি চীনা আমদানির সর্বকালের রেকর্ড। সর্বশেষ সমাপ্ত অক্টোবরেও আমদানি বেড়েছে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এই আমদানি প্রবণতা এবং শুল্ক্কমুক্ত সুবিধার নতুন স্কিমের সুবিধায় এবার চীনে বাংলাদেশের রপ্তানিও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ডেনিম এক্সপার্ট এবং বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, শুল্ক্কমুক্ত সুবিধায় চীনই হবে বাংলাদেশের পণ্যের প্রধান গন্তব্য। একক রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বেশি রপ্তানি করে বাংলাদেশ। ক্রমেই এই স্থান দখল করবে চীন। বিশ্বব্যাংকের তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ২০২৫ সাল নাগাদ পোশাকের ৪০ শতাংশ বাজার হবে চীন ও ভারত। এখনই দেশটির পোশাকের অভ্যন্তরীণ বাজার ১৬০ বিলিয়ন ডলারের। গত কয়েক মাসে রপ্তানি বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক্ক লড়াইয়ের কারণে রপ্তানি কমেছে চীনের। বাধ্য হয়ে উৎপাদিত পণ্য অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যবহার হচ্ছে। এ কারণে অন্য দেশ থেকে আমদানি কমছে। তিনি বলেন, চীনের আমদানি আবার বাড়ছে। এবার বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে বড় অঙ্কে।

চীনে পোশাক রপ্তানি করে উর্মি গ্রুপ। রপ্তানি পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, মানসিক এই প্রতিবন্ধকতা কাটাতে দু’দেশের মধ্যে আরও সফর হওয়া দরকার। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। চীনের সব প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া উচিত। কাঁচামাল আমদানি হয় চীন থেকে। এই সুবিধায় ‘উইন উইন’ ভিত্তিতে আরও ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং বাণিজ্য বাড়ানোর সুযোগ আছে বলে তিনি মনে করেন।

রপ্তানি বাড়াতে একটি পথনকশা করছে দু’দেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ- চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ( বিসিসিসিআই)। সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব আল মামুন মৃধা বলেন, নতুন সুবিধার অধীনে রপ্তানি বাড়াতে উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য একটা কার্যকর পথনকশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে চীনা বাজারে সম্ভাবনা কাজে লাগানো, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে উদ্যোক্তাদের সহায়তার বিষয়টি রয়েছে। বাণিজ্য-সংক্রান্ত বিরোধ নিরসনে প্যানেল ল’ ইয়ার রয়েছে তাদের। এর বাইরেও বাণিজ্য বাড়াতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হবে। মোট কথা, কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই যাতে বিশ্বের প্রধান ভোক্তা বাজারে শুল্ক্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে যা যা করা প্রয়োজন, সবই করবেন তারা।

তিনি আরও বলেন, চীনা ভাষা থেকে পণ্যের তালিকা ইংরেজিতে করতেও কিছুটা সময় লেগেছে। এ ছাড়া শুল্ক্কমুক্ত ঘোষিত ১৯৭টি পণ্য এই সুবিধার আওতায় নেই বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৪৮টি পোশাক পণ্য। এসব নিয়ে চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা জানিয়েছে, এ রকম হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ প্রসঙ্গে ট্যারিফ কমিশনের সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ বলেন, এখানে ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগ নেই। পোশাকের নিট এবং ওভেন শতভাগ পণ্যই নতুন শুল্ক্কমুক্ত সুবিধার আওতায় রয়েছে। সে অনুযায়ী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পণ্যের তালিকা উদ্যোক্তাদের সরবরাহ করেছে।

চীনের সক্ষমতা: কভিডের অভিঘাতে বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশই কমবেশি নাকাল। তবে যেসব দেশ দ্রুত কভিড কাটিয়ে উঠেছে সেসব দেশই বিশ্ববাণিজ্যে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে চীন এক নম্বর। উহান দিয়ে চীনে কভিডের সূত্রপাত হলেও সব দেশের আগেই পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে দেশটি। ফলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে চীন। পশ্চিমা প্রচলিত কোনো কোনো দেশে কভিডের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। প্রথম দফার ধকলও এখনও শেষ হয়নি কোনো কোনো দেশে। কিন্তু চীন সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে।

এদিকে বাজার ধরতে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক বছর ধরে পণ্য ও বাজারে বৈচিত্র্য আনতে বারবার তাগাদা দিয়েছেন। বাণিজ্য বিশ্নেষকরাও বিকল্প বাজার সন্ধানের কথা বলে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। কারণ, কোনো একক পণ্য এবং কোনো একক বাজারের প্রতি অতি নির্ভরতায় বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে দেশ। সেই ঝুঁকি থেকে সুরক্ষায় উপযুক্ত বিকল্প হচ্ছে চীন। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যেও প্রধান সমস্যা হচ্ছে লিড টাইম (রপ্তানি আদেশ পাওয়া থেকে ক্রেতা প্রতিনিধিদের হাতে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময়) বেশি লাগে। প্রতিবেশী দেশ হওয়ার কারণে চীনে রপ্তানিতে লিড টাইম অনেক কম লাগে। এর ওপর শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে একক প্রধান বাজার হয়ে উঠতে পারে চীন। পোশাক ছাড়াও চীনে উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে পাট ও পাটপণ্য, চামড়া পণ্য, চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি।

চীনের বিনিয়োগ: রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির বড় ধরনের সুযোগ তৈরি করেছে ঘোষিত এই শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা। চীনে মজুরি বেশি হওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যয়ও বেশি। এই সুযোগে চীনা অনেক উদ্যোক্তা নতুন করে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য যোগাযোগ শুরু করেছেন। বায়োটেক, কম্পিউটার টেকনোলজির মতো উচ্চ প্রযুক্তির নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগে কয়েকটি চুক্তি সই হয়েছে এরই মধ্যে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। ৮৩ কোটি ডলারেরও বেশি। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ১৭ কোটি ডলার।

উৎস বিধির শর্তের প্রতিবন্ধকতা রয়েই গেল: চীনে রপ্তানি বাড়াতে উৎস বিধির শর্ত এখনও বড় প্রতিবন্ধকতা। শুল্ক্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পেতে স্থানীয়ভাবে অন্তত ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করতে হবে। আপটার অধীনে এত দিনও শুল্ক্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পেতে একই হারে মূল্য সংযোজনের শর্ত ছিল। এ কারণে অন্যান্য দেশের দেওয়া শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা যেভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে, চীনের দেওয়া সুবিধা সেভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জম বলেন, ইইউতে শুল্ক্কমুক্ত রপ্তানিতে উৎস বিধির শর্ত অনেক শিথিল। যে কোনো দেশ থেকে যে কোনো কাঁচামাল এনে পণ্য তৈরি করলেই শতভাগ শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায়। চীনে রপ্তানিতে সেই সুবিধা নেই। স্থানীয় দুর্বল অবকাঠামো সুবিধায় ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন সহজ নয়। এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও দেশের প্রধান প্রধান পণ্যে যাতে এই সুবিধা অব্যাহত থাকে, সে বিষয়ে এখন আলোচনা শুরু করা দরকার। বিদ্যমান আপটার অধীনেও এই সুবিধা অব্যাহত রাখার সুযোগ রয়েছে।