অনলাইন ডেস্ক : নিজের প্রথম মেয়াদে চীনকে বেশ ভুগিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তারপরও চীনের প্রত্যাশা, ট্রাম্পই যেন পুনর্নির্বাচিত হন। চীনের হিসাব-নিকাশ বলছে, ট্রাম্পের অধীনে গত চার বছরে ‘বিশ্বমোড়ল হয়ে থাকার যোগ্যতা’ হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এবারও ট্রাম্প নির্বাচিত হলে সবাইকে ছাড়িয়ে পাকাপাকিভাবে ‘সুপারপাওয়ার’ হয়ে উঠবে বেইজিং।

প্রায় চার দশক আগে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর এবারই নজিরবিহীন শীতল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। ‘আমেরিকা প্রথম’ স্লোগান তুলে চীনকে বৈশ্বিক গণতন্ত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি চীনের সঙ্গে ব্যাপক মাত্রায় বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন, চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছেন। করোনা মহামারির জন্য তিনি বেইজিংকেই দায়ী করে আসছেন। যদিও বেইজিং বলেছে, তারা ওয়াশিংটনের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে জড়াতে চায় না।

এত কিছুর পরও ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হলে সুবিধার চূড়ায় উঠে যাবে চীন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার দেশকে ‘সুপারপাওয়ার’ বানানোর পরিকল্পনা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাকনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ঝু ঝিকুন বলেন, ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সুযোগকে হস্তগত করতে চান জিনপিং। এ সুযোগে তিনি চীনকে বিশ্বায়নের রোল মডেল এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার নতুন নিদর্শন হিসেবে গড়ে তুলতে চান।

২০১৬ সালে ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রকে ক্রমেই মিত্রহীন করে তুলেছেন ট্রাম্প। দেশটির জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্য চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছেন ট্রাম্প। তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। চীনা পণ্যে কয়েক বিলিয়ন ডলারের শুল্ক্ক বসিয়েছেন। সবশেষ করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ট্রাম্পের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্র যখন গত চার বছরে একের পর এক চুক্তি এবং সংগঠন থেকে বেরিয়ে গেছে, তখন জিনপিং জলবায়ু থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য- সবক্ষেত্রে চীনকে ‘বৈশ্বিক চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে সামনে এনেছেন।

ট্রাম্পের রক্ষণশীলতার বিপরীতে মুক্তবাণিজ্যের পক্ষে সামনের সারির নেতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন জিনপিং। চলতি বছর জাতিসংঘের ভাষণে সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরিবেশের সুরক্ষায় ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করে ভাষণ দিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট। করোনার টিকা আবিস্কার হলে সে ক্ষত্রে দরিদ্র দেশগুলোকে সবার আগে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে জিনপিংয়ের ঘোষণা তাকে একক বিশ্ব নেতায় পরিণত করেছে।

অধ্যাপক ঝু বলেন, ‘ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়া মানে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে এককভাবে চীনের উত্থান।’ যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের চীন বিশেষজ্ঞ ফিলিপ লি কোরে বলেন, ‘ট্রাম্পের রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হলে আন্তর্জাতিকতাবাদের পতাকাবাহী হয়ে উঠবে চীন। ওয়াশিংটন তখন তার পুরোনো বন্ধুদের হারাবে, সে জায়গা দখল করবে বেইজিং।’

চীনের জাতীয়তাবাদী নেতারাও অনেকটা প্রকাশ্যেই চাচ্ছেন ট্রাম্প যেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হন। ব্যাপকভাবে সরকারি নজরদারিতে থাকা চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও চলছে সে আলাপ। যদিও রিপাবলিকান পার্টির নেতারা এবং স্বয়ং ট্রাম্প প্রচার চালাচ্ছেন, তার পুনর্নির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে চীন।

বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে চীনকে বাণিজ্য চুক্তি করতে বলতে গেলে বাধ্যই করেন ট্রাম্প। চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও বন্দুক তাক করে রেখেছে ওয়াশিংটন। চীনের মোবাইল কোম্পানি হুয়াওয়ে রয়েছে ট্রাম্পের হিটলিস্টে। এ ছাড়া তাইওয়ান, হংকং এবং উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার হরণের বিষয়ে বেশ সোচ্চার ট্রাম্প প্রশাসন। তবে ট্রাম্পের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন জয় পেলে তা হবে বেইজিংয়ের জন্য বেশ অস্বস্তিকর।

বাইডেন নির্বাচিত হলে উইঘুর, তিব্বত এবং হংকংয়ে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও কঠোর হতে পারে। বাকনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঝু বলেন, ‘বাইডেন নির্বাচিত হলে উইঘুর এবং তিব্বতিদের মানবাধিকার বিষয়ে ট্রাম্পের চেয়ে বেশি সোচ্চার হবেন, সেটি নিশ্চিত।’ চায়না পাওয়ার প্রজেক্ট অ্যাট দ্য সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক বনি গ্ল্যাসার বলেন, ‘ট্রাম্পের আরোপ করা শুল্ক্ক বাইডেনও উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে চলবেন হয়তো। এই শুল্ক্ক প্রত্যাহারের জন্য ওয়াশিংটনের বেশ কিছু শর্ত হয়তো বেইজিংকে মেনে নিতে হতে পারে।’

যুক্তরাষ্ট্রে চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রসার বাড়াতে তথ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে বেইজিংকে। পঞ্চম প্রজন্মের ইন্টারনেট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক নেতা হিসেবে খ্যাত হুয়াওয়ে এমনিতেই ওয়াশিংটনের রোষানলে পড়েছে। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার আগ থেকেই হুয়াওয়ের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে ওয়াশিংটন। বাইডেন নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রে হুয়াওয়ের ব্যবসা করা শুধু মুশকিল নয়, অসম্ভব হয়ে পড়বে। এসব বিবেচনায় ট্রাম্পকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পছন্দ চীনের।