সাজ্জাদ আলী
– চিকেন ফ্রাই উইথ টমেটো ২৫.০০ ডলার
– বিফ ম্যারিনা ২৮.০০ ডলার
– ভেজিটেবলস মোজারিলা ১২.০০ ডলার
– চকোলেট-ভ্যানিলা আইসক্রিম ৮.০০ ডলার
ইত্যাদি ইত্যাদি। এ রকম আরো অনেক খাবারের নাম এবং দাম লেখা কাগজটিতে। নিউইয়র্ক শহরের একটি অভিজাত রেস্তোরার চলতি সপ্তাহের ফুড মেনু এটি। করোনা সংকটে ওদের কেনাবেচা লাটে উঠেছে। লোকসান কমাতে রেষ্টুরেন্টটি সম্প্রতি ফুড মেনুতে একটি নতুন আইটেম যুক্ত করেছে,
– কমফোর্টিং ওয়ার্ড ১.০০ ডলার
দামে বেশ সস্তা। তবে এই “কমফোর্টিং ওয়ার্ড বা সান্ত্বনা-কথা” আইটেমটি কোনো খাওয়ার বস্তু নয়। করোনা পরিস্থিতিতে খরিদ্দারদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য এটি একটি অভিনব বন্দোবস্ত। ফুড মেনুতে খাবারের অন্যান্য আইটেমগুলোর যেমন সংক্ষিপ্ত বিবরণী লেখা থাকে, এই আইটেমেরও তেমনি একটা বর্ণনা বলা আছে। ওরা লিখেছে, খাবার পরিবেশনের আগে আমাদের সুন্দর/সুন্দরী ওয়েটার/ওয়েট্রেসরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলবে,
“কিচ্ছু ভাববেন না, সব আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে। আপনি শুধু যতটা সম্ভব সাবধানে থাকুন”।
এক ডলার খরচ করে নিউইয়র্কের লোকেরা সেই “সান্তনা-কথা” হুমড়ি খেয়ে কিনছে কি না, তা জানি না। তবে হ্যাঁ, শীঘ্রই “সব কিছুই আগের মতো যেন ঠিক হয়ে যায়”-এমন আশায় বুক বেঁধে আছি। আর তো এই করোনা-যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না! চারিদিকে হাহাকার, নিজে দুর্দশায়, বন্ধু-স্বজনেরা সংকটে, এমনকি শত্রুরাও দুর্বিপাকে। প্রকৃতি যেন তার অবাধ্য সন্তানদের নির্বিচারে শাস্তি দিচ্ছে। করোনার সরাসরি সংক্রমন তো আছেই, তার উপরে এর পরোক্ষ আক্রমনগুলো এখন যেন “বোঝার উপর শাকের আঁটি”। সব মিলিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে সহস্রজন। তাদেরই একজন আমার সহকর্মী এবিগ্যাল। ওর করোনা হয়নি বটে, কিন্তু করোনা-সংকটে সে আজ জীবন-সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ সকালে ঘন্টাব্যাপী ভিডিও ফোন কলে এবিগ্যালের সাথে কথা বলে মনটা ভীষন ভারী হয়ে আছে।
উঠতি যৌবনে অতিরিক্ত খোটাবাছা করতে যেয়ে এবিগ্যাল বিয়ে করতে দেরি করে ফেলেছে। ৪১ বছর বয়সে যদিও বা সে মনের মানুষটি খুঁজে পেল, কিন্তু করোনা-তান্ডবে এখনও তার বিয়ের পিঁড়িতে বসা হলো না। ওর বাগদত্তা জ্যাকব বৃটিশ নাগরিক, ইংল্যান্ডের ম্যানচেষ্টার শহরের অধিবাসি সে। বছর চারেক আগে ফেসবুকের কোনো একটা ইভেন্টে ওদের পরিচয়। সময় গড়িয়ে সে পরিচয় প্রণয়ের রূপ নিয়েছে। গেল বছরের মার্চে জ্যাকব মাসখানেকের জন্য এসে এবিগ্যালের বাড়িতে থেকেছিল। সেই সময়টায় দুজন দুজনকে কাছে থেকে শুয়ে-বসে নিরীক্ষা করে তারপরে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত জুলাইয়ের ২৫ তারিখে টরন্টো’র সেন্ট মাইকেলস ক্যাথিড্রেলে ওদের বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে আর হতে পারলো কই? করোনা লক-ডাউনের কারণে জ্যাকব তো কানাডা আসার অনুমতিই পেল না।
১৩ বছর আমরা একই পেশায় কাজ করছি। শুধু সহকর্মী নয়, এবিগ্যাল আমার বন্ধুও বটে। পেশাগত পরিচয়ের বাইরে সে চমত্কার একজন মানুষ। হাস্যজ্জ্বল, যৌবনোচ্ছল, প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর। তিন কুলে কেউ নেই তার। বাবা-মা গত হয়েছেন ১০/১২ বছর হবে। উত্তরাধিকার সূত্রে যথেষ্ট অর্থ সম্পত্তির মালিক বনেছে সে। বাকি জীবন বসে বসে খাওয়ার জন্য তা পর্যাপ্ত বটে। তবুও এবিগ্যাল পরিশ্রমী, কাজে কোনো ঢিলেমি নেই। গত বছরে জ্যাকব টরন্টোতে এলে তার সৌজন্যে ওদেরকে আমি ডিনারে ডেকেছিলাম। ৩২/৩৩ বছরের যুবকটি ভারি প্রাণবন্ত। কথায় কথায় শেক্সপিয়ারের কবিতা আওড়ায়। আগে একবার বিয়ে করেছিল, সে সম্পর্ক টেকেনি। এখন আবার এবিগ্যালের মতো প্রাণোচ্ছল একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। জ্যাকবের নারীভাগ্য ঈর্ষা করার মতো বৈকি!
এ দিকে গত ফেব্রুয়ারিতে এবিগ্যালের ক্যানসার ধরা পড়েছে। ১ম ধাপের চিকিত্সা সফল হয়েছে বটে। কিন্তু কেমোথেরাপির ধাক্কায় মানুষটি বড়ই দুর্বল এখন। এই করোনার মধ্যে দুবার তার বাড়িতে তাকে দেখতে গিয়েছি। বাড়িতে যাওয়া মানে তো ওই লনে দাঁড়িয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে খানিকক্ষণ কথা বলা। বর্তমান পরিস্থিতিতে কারো ঘরে ঢোকার তো আর অবস্থা নেই। এবিগ্যালকে ওই দুর্বল শরীর নিয়ে সপ্তাহে অন্তত দুবার থেরাপি নিতে একাকী হাসপাতালে যেতে হয়। গত ফেব্রুয়ারি থেকে মানুষটি মৃত্যুর সাথে রশি টানাটানি খেলছে। তার পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। ঔষধ কিনতে তাকে বেরুতে হয়। পথ্য নিজেরই রান্না করে খেতে হয়। এক গ্লাস জল ঢেলে খাওয়াবারও লোক নেই তার।
জ্যাকব সেই ফেব্রুয়ারি থেকে টরন্টো আসবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু সে বৃটিশ নাগরিক এবং এখনও এবিগ্যালের হাসবেন্ড নয়। পরিবারের আইনগত নিকটজন কানাডায় আছেন, এমন পরিস্থিতি ছাড়া অন্য কারো এখন কানাডা ঢোকার অনুমতি নেই। প্রেমিক, ঘনিষ্টতর বন্ধু অথবা বাগদত্তা ইত্যাদি সামাজিক পরিচয়গুলো সর্বগ্রাসী করোনার কাছে মূল্যহীন। এবিগ্যালের একমাত্র আপনার জন জ্যাকব, কিন্তু আইনের চোখে সে “আপন” নয়। জ্যাকোবের উড়াল দেবার অনুমতি মেলেনি। সাঁতরিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দেবার শক্তি তো তার নেই। এর মধ্যে যদি কোনোদিন এবিগ্যালের শেষ ডাক এসে যায়, তবে তাকে নিঃসঙ্গতা আঁকড়ে ধরেই নিঃসীম শূন্যতায় বিলীন হতে হবে।
আর কতদিন আমাদের সর্বগ্রাসী এই ভাইরাসের দাপট দেখতে হবে? কতদিনে রেস্তোরাগুলো আবার জমে উঠবে? কবে এবিগ্যালের লাল ঠোঁটে হাসির ঝিলিক খেলবে?
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)