মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।
সাত.
যাত্রাপথ সোজা হলিউড থেকে কোলকাতা। ১৯৪৯ সালে গঙ্গা দেখবেন বলে ছুটে এসেছিলেন চারজনের একটি দল। দলের মূল ব্যক্তি ছিলেন ইতোমধ্যে বিশ্ব চলচ্চিত্রে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে নেওয়া জ্যঁ রেনোয়া। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ব্রাজিলিয়ান স্ত্রী দিদো, দীর্ঘদিনের সঙ্গী ফরাসী আর্ট ডিরেক্টর ইউজেন লুরিয়ে এবং ক্যামেরাম্যান কাইড দে’ভিন। দুই বছর আগে ‘দি ওম্যান অন দি বীচ’ ছবিটি তৈরির পর রেনোয়া একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। পরবর্তী ছবি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভাবনায় ডুবে ছিলেন। হঠাৎ করেই এক আমেরিকান প্রযোজক তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন সুদূর ভারতবর্ষের বাংলায় গিয়ে একটি ছবি করার। রেনোয়া চোখ বন্ধ করে তাঁর আরাম চেয়ারে নিজেকে হেলিয়ে দিলেন। মার্কিন প্রযোজক বলে চললেন নতুন ছবির কাহিনী। ভারত প্রবাসী একটি ইংরেজ পরিবার এবং তাঁদের প্রিয়জনদের নিয়ে কাহিনীটি গড়ে ওঠেছে। এই ইংরেজদের কেহ শাসক ইংরেজ নয়। গঙ্গা নদীর তীরে বেড়ে ওঠা এরা যতটা না বেশি ইংরেজ তার চেয়ে অনেক বেশি বাঙালি। এদের সাথে দৈনন্দিন কাজে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে বাংলার কিছু মানুষ। পরম আত্মিক আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে ওঠে এদের মধ্যে। আর সবকিছু ছাপিয়ে তাদের জীবনের পাশ দিয়ে বয়ে চলে স্রোতসিনী গঙ্গা।
প্রযোজক নিজেই এসে কাহিনীটি শোনালেন রেনোয়াকে। জানালেন এমন একটি ছবি তৈরির জন্য তিনি রেনোয়া ছাড়া আর কারো কথা ভাবতে পারেন না। রেনোয়া চোখ খুলে কিছুক্ষণ প্রযোজকের কথা শুনলেন তারপর আবার চোখ বন্ধ করলেন। তাঁর মনশ্চক্ষে ভেসে আসলো তাঁর প্রিয় শীন নদী। ছেলেবেলায় যখন বাবার ছবি আঁকা দেখবেন বলে বাবার সাথে ছুটে আসতো শীন নদীর তীরে। তখন ছবি আঁকার অবসরে বাবা শুনাতেন পৃথিবীর অজস্র নদীর কথা। সেই সময়েই বাবা পিয়ের অগুস্ত রেনোয়া পৃথিবীর অতি পরিচিত এক চিত্রকর হিসেবে সম্মানীত হয়েছেন। চিত্রকলার ইম্প্রেশনিজম ধারার অন্যতম প্রবক্তা তিনি। বাবা বলে যেতেন কেনো তিনি তাঁর ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন প্রকৃতি, ভূ-চিত্র, ফুল, পাতা, নৌকা আর নদীর ধারের দৃশ্য। অথবা শেষ বিকেলে জীবনের নদীতে স্নানরত মহিলাদের ছবি। তখনই ইম্প্রেশনিস্ট বাবা ছোট্ট রেনোয়াকে জানিয়েছিলেন গঙ্গা নদীর কথা, আর গঙ্গার দুই তীরে বাস করা প্রকৃতির মত সরল মানুষগুলোর গল্প। শিল্পী বাবার অনেক সাধ ছিল গঙ্গা নদীর তীরে যাবেন। সবুজ সুন্দর প্রকৃতির মাঝে অনেকদিন কাটাবেন আর মনের আনন্দে রং তুলিতে তুলে আনবেন সুন্দর সব মানুষের সারল্য।
প্রযোজককে ‘হ্যাঁ’ বলতে রেনোয়া একটুকুও সময় নিলেন না। তিনি শুধু জানালেন আগামী মাসেই তিনি রওনা হবেন নতুন ছবি ‘দি রিভার’ এর শ্যুটিং এর সম্ভাব্য লোকেশন দেখার জন্য। সেই কথা মতই চারজনের এই দলের কোলকাতা শহরে আসা। তারা উঠলেন গ্রেট ইর্স্টান হোটেলে। আসার একদিন পরই স্টেট্ম্যান পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনে জানিয়ে দিলেন; তিনি এই দেশে একটি ছবির শ্যুটিং করতে চান, যেটাতে এদেশীয় কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয় করবেন। সেই বিজ্ঞাপনে তিনি আরো জানিয়েছিলেন, যে সব অভিনেতা-অভিনেত্রী এ ছবিতে অভিনয় করতে চান, তারা যেন তাঁর সাথে দেখা করেন। আগ্রহীদের তিনি যে হোটেলে উঠেছেন, সেখানে দেখা করতে বলেছিলেন।
জ্যঁ রেনোয়ার কোলকাতার আসার দুই বছর পূর্বেই অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ রায়, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, চিদানন্দ দাসগুপ্ত, পূর্ণেন্দু নারায়ন, মনোজেন্দু মজুমদার এবং এদের মত আরো কিছু যুবক মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। মোট পঁচিশ জনের এই দলটি মূলত সত্যজিৎ রায়ের বাড়ীর বৈঠকখানায় বসে ফিল্ম নিয়ে আলোচনা করতেন। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির সদস্যরা প্রথম দেখেছিলেন সের্গেই আইজেনস্টাইনের ক্যাসিক ছবি ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’। ছবিটি দেখে তারা সবাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। চলচ্চিত্রের ভাষা যে এত সুন্দর হতে পারে এই ছবিটা না দেখলে জানাই যেত না। ভারতে যেসব ছবি তৈরী হয় সেগুলোর সাথে আইজেনস্টাইনের ছবির কি বিশাল পার্থক্য!
ফিল্ম সোসাইটির সদস্যদের কাছে আইজেনস্টাইনসহ বিশ্ব চলচ্চিত্রের যে কয়েকজন চলচ্চিত্র পরিচালক পরম সম্মানের স্থান অধিকার করেছেন। তারমধ্যে জ্যঁ রেনোয়া ছিল অন্যতম। তাদের বেশ কয়েকজন ইতোমধ্যে রেনোয়ার ‘দ্য সাদার্নার’ ছবিটি দেখে ফেলেছেন। ছবিটিতে অনেক দৃশ্যের শ্যুটিং এ স্টুডিওর নকল সেট না বানিয়ে যে বাইরে লোকেশন বেছে নেওয়া হয়েছে, সেটাও তাদের অভিভূত করে। ফলে স্বভাবতই রেনোয়ার সফর কোলকাতায় অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির প্রাণ সত্যজিৎ রায় তার কিছুদিন পূর্বে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান ডি জে কিমার এ্যান্ড কোম্পানিতে চাকুরী নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের কাছে। হেঁটে গেলে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। স্টেটম্যান পত্রিকায় যেদিন জ্যঁ রেনোয়ার বিজ্ঞাপনটি ছাপানো হয়। সেদিনই সত্যজিৎ রায় অফিস ছুটির পর রেনোয়ার হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হন। পঞ্চান্ন বছরের বিশ্বখ্যাত এক প্রবীণ চলচ্চিত্রকারের সামনে আটাশ বছরের যুবক নতুন চলচ্চিত্রের স্বপ্ন দেখা সত্যজিৎ যখন উপস্থিত হন তখন চারিদিক সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে লম্বা বাঙালি যুবক সত্যজিৎ এর দিকে তাকিয়ে রেনোয়া বেশকিছু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎই তাঁর মনে হয়েছিল, যুবকটির চোখে এক অদ্ভত ফিল্মকদ্যুতি রয়েছে। তারপর প্রথম আলাপের পরই দু’জনে বয়সের ব্যবধান ভূলে গিয়ে হয়ে গেলেন পরম বন্ধু। ফলে সত্যজিৎ এর অফিস ছুটির দিনগুলোতে রেনোয়া তাঁকে ডেকে নিতেন তাঁর সাথে ছবির সম্ভাব্য লোকেশন খুঁজতে। রেনোয়া বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করতেন সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র জ্ঞানের ব্যাপকতা, গভীরতা আর স্বপ্নকে। সত্যজিৎও লক্ষ্য করতেন আর মুগ্ধ হতেন ফরাসী জ্যঁ রেনোয়ার বাংলার প্রকৃতি প্রীতি দেখে। মাঠ-ময়দান, মানুষজন, পাকাবাড়ি, কুঁড়েঘর, কচুরিপানায় ভর্তি ডোবার ধারে কলাগাছের ঝাড়-এর দৃশ্য এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রেনোয়া দেখতেন যে সত্যজিতের তাক লেগে যেত। সেইসাথে রেনোয়া যখন দৃশ্যগুলো দেখে ‘আ!, উ!’ শব্দ করতেন তখন মনে হত, মস্তবড় এক দক্ষ চিত্রকরের গলার মাঝ থেকে বের হয়ে আসছে এইসব ধ্বনিগুলো। সেই দিনগুলোতে সত্যজিৎ রেনোয়ার কাছ থেকে দীক্ষা পেয়েছিলেন তাদের কি ধরনের ছবি করা উচিৎ।
বারবার রেনোয়া বলেছিলেন, অবশ্যই যেন তারা হলিউডের ছবির নকল কিছু না করে। বরং নিজস্বতা বাজয়ে রেখে যেন তারা নিজেদের চলচ্চিত্র বানায়। রেনোয়া সত্যজিৎ রায়কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, চলচ্চিত্র তখনই উন্নতমানের শিল্প হয়ে ওঠে, যখন ‘কনটেন্ট’ বা বিষয়বস্তু হয় দেশীয় আর ‘ফর্ম’ বা নির্মাণশৈলী হয় আন্তর্জাতিক মানের। সত্যজিৎও রেনোয়ার কথায় আবেগে উদ্বেলিত হয়ে দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরার প্রত্যয়ে প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছিলেন।
কিন্তু কিছুদিন পর সত্যজিৎকে তাঁর অফিসের লন্ডন শাখায় বদলী করা হয়। ফলে রেনোয়ার ‘দি রিভার’ ছবির শ্যুটিং তাঁর আর দেখা হল না। তবে রেনোয়ার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় রেনোয়া সত্যজিৎকে তাঁর একটি ফটোগ্রাফ দেন যার পিছনে তিনি লিখেছিলেন, ‘মানিক রায়কে, তার বিয়ের অপোয় থাকব, জ্যঁ রেনোয়া’। রেনোয়া সত্যজিৎকে মানিক নামেই ডাকতেন। তিনি হলিউডে যাওয়ার পর আবার কোলকাতায় এসে ‘দি রিভার’ ছবির শ্যুটিং এর মাঝেই সত্যজিৎ তাঁর বড় মামার ছোট মেয়ে বিজয়াকে বিয়ে করেন। কিন্তু এই বিবাহিত দম্পতির সাথে সেই সময় রেনোয়ার আর দেখা হল না। কারণ তখন রেনোয়া কোলকাতায় আর সত্যজিৎ স্ত্রীসহ লন্ডনে।
সেই দিনগুলোতে রেনোয়ার পাশে শুধু সত্যজিৎই ছিলেন না, বরং ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির ছবি বানানোর স্বপ্নে বিভোর এক দল যুবক ছিল, আর এই চলচ্চিত্র পাগল যুবকরা যদি সেদিন রেনোয়াকে তাদের কাছে না পেতেন তাহলে সম্ভবত কোলকাতার বাংলা ছবির দূর্দিন কাটতে অনেক বেশি বছর লেগে যেত। রেনোয়া তাদের সামনে সুন্দর ছবি নির্মাণের সুন্দর দিগন্ত উম্মেচন করে দিলেন। রেনোয়া হলেন তাদের পথ প্রদর্শক, ফলে বাংলা ছবিকে একটা গ্রহণযোগ্য ও শৈল্পিক জায়গায় তুলে আনার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাওয়া এই যুবকরা নত মস্তকে রেনোয়ার ঋণকে অভিবাদন জানিয়ে তাঁকে গুরু হিসাবে মেনে নিলেন।
রেনোয়া এসব যুবকদের শুধু সঙ্গই দিলেন না, বরং হাতে নাতে তাদেরকে চলচ্চিত্রের শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য ‘দি রিভার’ ছবির শ্যুটিং করার সময় তাঁর চলচ্চিত্র ইউনিটের সাথে নিয়ে নিলেন। সত্যজিৎ-এর ‘পথের পাঁচালি’র দুই স্তম্ভ সুব্রত মিত্র এবং বংশী চন্দ্রগুপ্তকে রেনোয়া ‘দি রিভার’ ছবিতে অভিনয় ও সহ শিল্প নির্দেশক এর কাজে যুক্ত করলেন। চিদানন্দ দাসগুপ্তকেও রাখলেন তাঁর ইউনিটে। রেনোয়ার মত একজন বড় মাপের পরিচালকের সাথে কাজ করা এবং প্রতিদিনের শ্যুটিং শেষে শ্যুটিং-এর খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনায় অংশ নিতে পারায় এই যুবকদের চলচ্চিত্র জ্ঞানের মনন জগতে এক বিরাট পরিবর্তন হতে শুরু করে যা বাংলা চলচ্চিত্রে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। সেই সাথে এই প্রভাব বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন যুগের সূচনার পথ উম্মোচিত করে।
যাঁর হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন যুগের সূচনা হল সেই জ্যঁ রেনোয়ার জন্ম হয় ১৮৯৪ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের প্যারিস শহরে। প্যারিসে জন্ম হলেও তাঁর বাল্যকাল কাটে প্যারিস থেকে কিছুটা দূরে এক গ্রাম অঞ্চলে। তার কারণ ছিল মাঝে মধ্যে পিতা স্বনামধন্য ইম্পেশনিস্ট চিত্রশিল্পী পিয়ের অগস্ত রেনোয়া তাঁর ছবি আঁকার জন্য গ্রামীণ পরিবেশে সময় কাটাতেন। কাছ থেকে বিখ্যাত পিতার শিল্পকর্ম সৃষ্টির প্রক্রিয়া তাঁর মধ্যে এক গভীর শিল্পী সত্তার জন্ম দেয়।
বিশ বছর বয়েসে জ্যঁ রেনোয়া ফরাসী সৈন্য বাহিনীতে যোগ দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি ফরাসী অশ্বারোহী বাহিনীতে এবং বিমান বাহিনীতে কাজ করেন। সম্মুখ যুদ্ধে বেশ কয়েকবার তিনি আহত হন এবং দীর্ঘদিন হাসপাতালে কাটান। যুদ্ধ শেষে বিজয়ী রেনোয়া ঘরে ফেরার কয়েক মাস পর ১৯১৯ সাল তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর কিছুদিন পর তিনি পিতার এক মডেল আঁদ্রে হিউসলিঙ্গকে বিয়ে করেন। দু’জনেই দীর্ঘ চার বছর মৃৎশিল্প চর্চা করেন। কিন্তু মৃৎ শিল্পের প্রতি নিবেদিত না থেকে দু’জনেরই চলচ্চিত্রের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। ইতোমধ্যে তাঁরা দেখে ফেলছেন চার্লি চ্যাপিলিনের কিছু ছবি, বিখ্যাত রাশিয়ার অভিনেতা মোঝুখিন অভিনীত কয়েকটি ছবি এবং এরিথ ফন স্ট্রোহাইমের ‘ফুলিশ ওয়াইভস’ ছবিটি। এগুলো দেখে রেনোয়া চলচ্চিত্র নামের নতুন এই শিল্পের প্রতি এত বেশি অনুরাগী হয়ে পড়েন যে সিদ্ধান্ত নেন চলচ্চিত্র নির্মাতা হবেন। নিজের আর্থিক সমস্যা থাকায় বন্ধুবান্ধবদের সহযোগিতায় কিছু অর্থ সংগ্রহ করে একটি প্রযোজনা সংস্থা গড়ে তোলেন এবং নিজে স্ত্রীকে অভিনয়ে নামিয়ে দেন। অভিনেত্রী হিসেবে স্ত্রীর নাম রাখেন ক্যাথারিন হেসলিং।
রেনোয়ার প্রযোজনা সংস্থা থেকে প্রথম ছবি নির্মিত হয় ১৯২৪ সালে। ছবিটির নাম ‘ইউন ভি সাঁ জোয়া’। ছবিটিতে রেনোয়া এবং তার স্ত্রী দু’জনেই অভিনয় করেন। ছবিটির সব আয়োজন এবং উদ্যোগ রেনোয়া নিলেও এর পরিচালনার দায়িত্ব দেন বন্ধু পিয়ের ফিলিটকে। ছবিটি শ্যুটিং-এর তিন বছর পর এটাকে পুনরায় সম্পাদিত করে ক্যাথরিন নাম দিয়ে একে মুক্তির দেয়া হয়।
১৯২৪ সালেই রেনোয়া ছবি পরিচালনায় আসেন। তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি ‘লা ফি দ্য লিউ’। একটা অতি নাটকীয় ঘটনা নিয়ে ছবিটির কাহিনী গড়ে ওঠে। এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন রেনোয়ার স্ত্রী ক্যাথরিন। ছবিটির কাহিনীতে দেখা যায় দুই ভাই একটি বজরায় করে যাবার সময় এক দুর্ঘটনায় এক ভাই জলে ডুবে মারা যায়। মৃত ভাইয়ের এক কন্যা ছিল। সেই কন্যার প্রতি আরেক ভাই অকারণে উৎপীড়ন চালায়। ফলে মেয়েটি জলপরীদের দেশে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং জলপরীরা তাকে পরম যত্নে আগলে রাখে।
১৯২৬ সালে এমিল জোলার বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে রেনোয়া নির্মাণ করলেন ‘নানা’ ছবিটি। ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন স্ত্রী ক্যাথরিন হেসলিং এবং পুরুষ মূখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন জার্মান অভিনেতা ওয়ার্নার ক্রাউস। ১৯২৭ সালে রেনোয়া দুটি ছবি পরিচালনা করেন। প্রথম হচ্ছে ‘সুর আঁ এয়ার সাঁলস্তি’ এবং দ্বিতীয়টি ‘মারকিতা’। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ভিত্তিক প্রথম ছবিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ছবিটির কাহিনীতে দেখা যায় একজন নিগ্রো একটি বেলুনে চড়ে ইউরোপের একটি মরুভূমি অতিক্রম করে চলেছে। সেই মরুভূমির ভেতর সে একটি প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে। সেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরের একটি আদিম বন্য মেয়ের সাথে তার পরিচয় হয়। মেয়েটির সাথে ভাব হওয়ার পর মেয়েটি তাকে অপূর্ব এক নাচ দেখায়। নিগ্রো যুবকটি বুঝতে পারে মেয়েটির নাচটি হচেছ সাঁর্লস্ত নাচ যেটা দেখার জন্য সে দীর্ঘদিন ধরে অধীর আগ্রহে অপো করেছিল। (চলবে)