মনিস রফিক: চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিত্সু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।
ছয়.
ইউরোপ ঘুরে এসে চার্লি চ্যাপলিন বানালেন তাঁর জীবনের আরেকটি বিখ্যাত ছবি ‘দ্য গোল্ড রাশ’। ১৯১৯ সালে ডি. ডব্লিউ গ্রিফিথ, ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস্, মেরী পিকফোর্ড ও চার্লি চ্যাপলিন মিলে শিল্পীদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে গড়ে তুলেছিলেন ‘ইউনাইটেড আর্টিস্টস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এই সংস্থার পক্ষ থেকে তিনি ১৯২৪ সালে ছবিটি নির্মাণ করলেন। আট লক্ষ্য ডলার খরচ করে সোয়া দুই ঘন্টার এই নির্বাক ছবিটির শ্যুটিং হয়েছিল আলাস্কার বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলে। ১৮৯৮ সালের স্বর্ণ-অভিযানের একটি সত্যিকারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চ্যাপলিন এ ছবিটির চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন। আলাস্কা, ইউকন ও চিলকুট পাশ-এর বরফের মরুভূমিতে সোনা পাওয়া যাচ্ছে এমন একটা গুজব রটে যাওয়ায় দলে দলে অভিযাত্রীরা সোনার সন্ধানে সেখানে গিয়েছিলেন। একশ পঞ্চাশ জনের মধ্যে মাত্র আঠার জন বেঁচেছিলেন। তারা সঙ্গীদের মৃতদেহের মাংস, কুকুরের মাংস এমনকি জুতোও সিদ্ধ করে খেয়েছিলেন। এমন একটি বীভত্স ও করুণ কাহিনীকে চ্যাপলিন একটি হাসির সিনেমায় রূপান্তরিত করলেন। চার্লি চ্যাপলিন প্রায় বলতেন, ভয়ংকরকে ভয় পেয়ো না, ঐ সব মুহূর্তেও তোমাকে হাসতে হবে, নইলে পাগল হয়ে যাবে। তাঁর জীবন ও সিনেমায় এই কথাটায় তিনি বার বার প্রমাণ করতে চেয়েছেন। মানুষের লোভ, মানুষের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষের বাঁচার অপ্রতিরোধ্য তাগিদ ‘দ্য গোল্ড রাশ’ ছবির মূল সুর। এই ছবিতে ক্ষুধার তাড়নায় চার্লি চ্যাপলিনের জুতো সিদ্ধ করে খাওয়ার দৃশ্যটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের একটি স্মরণীয় দৃশ্য হয়ে রইল।
১৯২৮ সালে চার্লি চ্যাপলিন বানালেন ‘দ্য সার্কাস’ ছবিটি। পৌনে দুই ঘন্টার এই ছবিতে চ্যাপলিন প্রমোদ শিল্পের অধিপতিদের চরিত্র স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। যেভাবেই হোক টাকা রোজগারই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। শিল্পী ও শিল্পের প্রতি তাদের মায়া মমতা নেই। এটিই চ্যাপলিনের সর্বশেষ নির্বাক ছবি। ঐ বছরই আমেরিকায় অস্কার পুরস্কার দেয়ার বিষয়টি চালু হয় এবং চ্যাপলিনকে দ্য সার্কাস ছবির লেখক, প্রযোজক, অভিনেতা এবং পরিচালক হিসেবে অস্কার পুরস্কারের সম্মানে ভ‚ষিত করা হয়।
১৯২৮ সালটি ছিল চার্লি চ্যাপলিনের জীবনে একটি বিষাদময় বছর। এ বছরের আগস্টে তাঁর মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। গেনডেন হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হল, কিন্তু ২৮ তারিখে তিনি চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন। চার্লি চ্যাপলিন তাঁর মাকে একটু খুশি করার জন্য তাঁর সাধ্যমত সব করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর চার্লি যখন জানতে পারলেন তাঁর মা মানসিক রোগ থেকে সেরে উঠছেন, তখনই তিনি তাঁর মাকে আমেরিকায় আনার জন্য তাঁর সেক্রেটারীকে পাঠালেন। মা নিজের কাছে আসবে এই আনন্দে মায়ের থাকার জন্য সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা করলেন। নিজের বাড়িটা যেহেতু এক ধরনের স্টুডিও, সেজন্য হৈ চৈ-এ মায়ের সমস্যা হতে পারে ভেবে স্যান্ট মনিকো বীচের কাছে মায়ের থাকার জন্য সুন্দর একটি বাড়ি কিনলেন। মাকে দেখাশুনার জন্য তাঁর খরচায় এক দম্পত্তিকে সেখানে রেখেছিলেন। এছাড়া সর্বণের জন্য একজন নার্স রেখেছিলেন এবং মায়ের স্বাস্থ্য নিয়মিত পরীক্ষার জন্য একজন ডাক্তার ছিলেন। মা যেমনটি পছন্দ করতেন তেমন আসবাবপত্র দিয়ে ঘর সাজানো হয়েছিল। মা পিয়ানো বাজাতো ভালোবাসতেন, সেজন্য পিয়ানো কিনে দিয়েছিলেন। চার্লি চ্যাপলিন তাঁর সব ছবিই মাকে দেখিয়েছিলেন। নতুন সিনেমা হলে মুক্তি পাবার আগে আলাদাভাবে মাকে দেখিয়ে নিতেন।
১৯৩১ সালের জানুয়ারি মাসে চার্লি চ্যাপলিনের ‘সিটি লাইটস’ মুক্তি পেল। লস এঞ্জেলস্-এর থিয়েটার হলে সেদিন বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছবিটি দেখতে এসেছিলেন। আর তাদের দেখতে আসা সাধারণ মানুষ এত বেশি এসেছিল যে, তাদের ভীড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে চার্লির নিজস্ব অতিথি ছিলেন অধ্যাপক আলবার্ট আইনস্টাইন ও তার স্ত্রী। সবার প্রিয় বিজ্ঞানী আইজেনস্টাইন যখন থিয়েটার হলে ঢুকেন, তখন হলের প্রতিটি দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে বরেণ্য এই ব্যাক্তিকে সম্মান জানিয়েছিলেন। তখন আমেরিকায় সবাক চলচ্চিত্রের প্রচলন হয়ে গেছে। চার্লি এই ছবিতে আবহ সঙ্গীত ছাড়া কোন সংলাপের সাহায্য নিলেন না। এক অন্ধ ফুলওয়ালাকে নিয়ে অপূর্ব এই কাহিনীটি গড়ে উঠেছে। এই ছবিতে তাঁর অধিকাংশ ছবির মতই চার্লি একজন ভবঘুরে। এক রাতে হঠাত করেই এক ধনী মাতালের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। মাতালটি নেশার ঝোঁকে কোমরে পাথর বেঁধে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে যাচিছল। চার্লি মাতালটির কান্ড দেখে আত্মহত্যা থেকে নিবৃত করার চেষ্টা করে এবং জীবন যে সুন্দর সেটা বুঝাতে থাকে। কিন্তু মাতালটি চার্লির কথায় কান না দিয়ে তার দড়িটি চার্লির কোমরে পেঁচিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। অনেক কষ্টে চার্লি নিজেকে ও মাতালকে পানি থেকে উদ্ধার করে। পরে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। ইতোমধ্যে এক অন্ধ ফুলওয়ালীর সাথে চার্লির পরিচয় হয় এবং দু’জনেই দুজনের প্রেমে পড়ে যায়। চার্লি অনেক কষ্টে অন্ধ মেয়েটির চোখ ভাল করার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে থাকে। অবশেষে চার্লির অর্থে অন্ধ মেয়েটির চোখে অপারেশন হয়। কিন্তু মেয়েটি যখন দৃষ্টি ফিরে পায়, চার্লি তখন টাকা চুরির অপরাধে জেল খাটছে। জেল থেকে বের হয়ে চার্লি যখন মেয়েটির সাথে দেখা করতে গেল মেয়েটি তখন তাকে চিনতে পারল না। ভিখেরী ভেবে সে চার্লিকে কয়েকটি পয়সা সাহায্য দিতে গেল। কিন্তু হাতের স্পর্শ লাগতেই মেয়েটি চার্লিকে চিনতে পারল। সুন্দর মিলনে ছবিটি শেষ হল। ‘সিটি লাইটস্’ ছবিটির কাহিনী এবং এই ছবিতে চার্লির অভিনয় দর্শকদের গভীরভাবে মুগ্ধ করে। চার্লি চ্যাপলিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবি ‘মডার্ণ টাইমস’। যন্ত্রচালিত আধুনিক সমাজের ধনী ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে প্রভেদ তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিতে। যে সব শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে চলে যন্ত্রের চাকা, সেইসব শ্রমিকরা মালিকপক্ষ থেকে কতবেশী বঞ্চিত ও নিগৃহীত তা এই ছবিতে দেখানো হয়েছে। ছবির প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় একদল ভেড়া ধাক্কাধাক্কি করতে করতে এগিয়ে চলেছে কসাইখানার ফটকের মধ্যে। এ দৃশ্য মিলিয়ে গিয়ে তার জায়গায় ফুটে ওঠে আরেকটি দৃশ্য। এ দৃশ্যে একদল শ্রমিক কারখানায় ঢুকছে কাজ করতে। চার্লিও এই দলে আছে। আধুনিক সময়ে ভেড়ার পাল আর কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে যে কোন পার্থক্য নেই এবং দুই দলই যে মৃত্যু গহ্বরে ঢুকছে সেটা স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই ছবিতে। শ্রমিক চার্লির ভাগ্য বিড়ম্বনায় এক কারখানা থেকে আরেক কারখানায় ছুটে চলা বা এক কারখানা থেকে চাকুরী হারিয়ে আরেক কারখানা চাকুরী গ্রহণ এবং অবশেষে উপলব্ধি করা সব জায়গা একই, শুধু স্থানের পরিবর্তন। চার্লির মত চার্লির বান্ধবীরও ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটে। সে হোটেলে চাকুরী করে, কিন্তু সেখানে বিপত্তি ঘটায় তাকে সেখান থেকে পালাতে হয়। আমরা দর্শকরা দেখি চার্লি ও তার বান্ধবী দু’জনেই বেকার হয়ে রাস্তার ধারে বসে আছে। চার্লির বান্ধবী হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছে। ওদের মত মানুষগুলোর এই সমাজ ব্যবস্থায় বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু চার্লি হতাশাকে ঘৃণা করে। সে বাঁচতে চাই প্রয়োজনে আজীবন লড়াই চালিয়ে যাবে, কিন্তু কোনক্রমেই হতাশায় নিমজ্জিত হবে না। তাই ছবির শেষ দৃশ্যে চার্লি বলে ওঠে, ‘হতাশা নয়, চল আমরা এগিয়ে যাই।’
চার্লি চ্যাপলিন যেদিন জন্মেছিলেন ঠিক তার চার দিন পর ১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল সেই লন্ডনের বার্মনসি থেকে প্রায় এক হাজার মাইল পূর্বে জার্মানী শহরে চার্লির মতই একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলেন আরেকজন শিশু। পরবর্তী জীবনে দুজনেই পৃথিবীর ইতিহাসে নিজেদের স্থান মোটা দাগে চিহ্নিত করে নেন। বেশভুষা এবং উচ্চতায় অপূর্ব সমিল থাকা এই মানুষ দুটির একজন পৃথিবীর মানুষকে হাসিয়েছেন, আর সবসময় কান্নাকে দু’পাশে সরিয়ে রেখে জীবনের আনন্দের মধ্যে নিজেদের রাঙাতে বলতেন। যাকে সবাই আদর ও সম্মানের সাথে ডাকতো চার্লি নামে।
অন্যদিকে অপরজন, দাম্ভিকতা ও প্রতিরোধের নেশায় এত বেশি মরিয়া হয়ে গেলেন যে, লাখ লাখ মানুষকে মৃত্যুর কঠোর কঠিন হিম রাজ্যে পাঠাতে তার অন্তরাত্মা সামান্যতম কেঁপে উঠতো না। নিজ জাতির শুদ্ধতায় বিশ্বাসী এই দাম্ভিক ব্যক্তিটিকে সামনে দেখলে তার বাঘা বাঘা জেনারেলরাও কেঁপে উঠতেন। লোকে খটমটে জার্মানীর উগ্র এই জাতীয়তাবাদী নেতার নাম দিয়েছিলেন ‘হের’। ‘হের হিটলার’। নিজের খামখেয়ালীর মূল্য দিতে গিয়ে লাখ লাখ সাধারণ ও নিরীহ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলেন এডলফ হিটলার। ‘মর্ডাণ টাইমস্’-এর তিন বছরের মধ্যে শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যে যুদ্ধের প্রতক্ষ্য কারণ এডলফ হিটলার। ফ্যাসিবাদী এই মানুষটাকে এবং তার কাজকর্মকে আঘাত করার জন্য চার্লি নতুন এক চিত্রনাট্য তৈরি করলেন। এর জন্য তার দীর্ঘ পরিচিত ভবঘুরে বেশভুষা ছেড়ে তিনি নতুনরূপে পর্দায় উপস্থিত হলেন। তিনি সবাইকে জানিয়ে দিলেন, ‘আমার পরবর্তী নতুন ছবিতে এই ভবঘুরেটিকে আর মজাদার চরিত্রে দেখতে পাবেন না। আমি তার চরিত্রকে আরো ধারাল করে তুলেছি। যারা তাকে এতদিন ভালোবাসতেন এখন থেকে তাদের এই ভবঘুরেটি সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হবে। চ্যাপলিনের দুই ঘণ্টার এই ‘দি গ্রেট ডিক্টেটর’ ছবির মূলত: বক্তব্যধর্মী রাজনৈতিক ছবি। সংলাপের ওপর প্রচন্ড গুরুত্ব দিলেন তিনি এই ছবিটিতে। চ্যাপলিন স্বয়ং এতে অভিনয় করলেন দুটি ভূমিকায় একটিতে এক ইহুদী নাপিত এবং অপরটিতে টোমানিয়া দেশের শাসক, প্রচন্ড মতাশালী ডিক্টেটর হিস্কেল। হিটলার ছাড়াও ফ্যাসিষ্ট শাসক ইতালীর মুসোলিনীকেও অভিনয়ের মাধ্যমে পর্দায় আনেন তিনি। এই ছবিতে অদ্ভুত কিছু সিকোয়েন্স রয়েছে। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, ফ্যাসিষ্ট হিস্কেল অর্থাত হিটলার একটি গোবকে হাতে নিয়ে লোফালুফি করছে। গোটা পৃথিবীর একচ্ছত্র অধীশ্বর হবার লালসায় সে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। গোবটি একবার হাত দিয়ে নাড়াচ্ছে, একবার পা দিয়ে ঠেলছে, আবার কখনো কখনো বুকে জড়িয়ে ধরছে। এই করতে করতে গোবটি এক সময় হঠাত বেলুনের মত ফেটে গেল এবং হিস্কেল উপুর হয়ে পড়ে কান্না শুরু করে দিল। ১৯৪৫ সালে ইতিহাসের দানব হিটলারের ভাগ্যে যে পরিণতি অপো করছিল ১৯৪০ সালে চার্লি এ ছবির মাধ্যমে তারই আভাস দিয়ে দেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও সাধারণ মানুষের জীবন শান্তি ফিরে আসেনি। যুদ্ধের পর একদিকে যেমন শিল্পোত্পাদন কমে গিয়েছিল, অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের বাজার সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় রপ্তানি কমে গিয়েছিল। অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও রপ্তানি বাণিজ্য হ্রাসের দরুণ লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছিল। সাধারণ মানুষদের সংসার চালানো দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের ওপরতলার মানুষদের এসবের আঁচ একটুও লাগেনি বরং তাদের প্ররোচনায় সরকার সাধারণ মানুষের ওপর ট্যাক্স বাড়িয়ে দিচ্ছিল। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে ১৯৪৭ সালে চ্যাপলিন তৈরি করলেন ‘মঁসিয়ে ভের্দু’। এখানেও চার্লিকে ভবঘুরের পরিচয়ে দেখা গেল না। বরং দেখা গেল, সংসারের ভারে জর্জরিত এক কেরাণী হিসেবে। সংসার জীবনে পরাজিত কেরাণী মরিয়া হয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য অভিনব শঠতার আশ্রয় নিল। বিভিন্ন ধনী পরিবারে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে সে একের পর এক ধনীর কন্যাদের সাথে বিয়ে করে তাদের সোনাদানা কেড়ে নিয়ে তাদের হত্যা করতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত ভের্দু পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এবং তার ফাঁসি হয়। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় অনাচারের বিরুদ্ধে চার্লি যে ইঙ্গিত করেছিলেন, তাতে বুর্জোয়া সমালোচক মহল তার পেছনে লেগে যায় এবং তাকে কমিউনিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করে। অনেক জায়গায় ছবিটির প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়।
চার্লি চ্যাপলিনের জীবনের শেষ স্মরণীয় চলচ্চিত্র ‘লাইম লাইট’ এবং আমেরিকায় নির্মিত এটাই তাঁর শেষ ছবি। এর পরও তিনি যে দুটো ছবি তৈরি করেছিলেন সেগুলো হয়েছিল ইউরোপে। ক্যালভেরো নামের প্রবীণ কমিডিয়ানের জীবনের করুণ চিত্র তিনি তুলে এনেছেন এ ছবিতে। বলা যেতে পারে অসংখ্য শিল্পী জীবনের অমোঘ কড়াচা ওঠে এসেছে এখানে। প্রবীণ কমেডিয়ান জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যখন খ্যাতি ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে বসেছে, সেই রকম এক মুহূর্তে টেরি নামক এক তরুণী ব্যালে শিল্পীর সাথে তার পরিচয় হয়। জীবনের দারিদ্র্য ও হতাশা সহ্য করতে না পেরে টেরি একসময় আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়, সেইসময় ক্যালভেরো তাকে রক্ষা করেন এবং নতুনভাবে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেন। ধীরে ধীরে টেরি নতুন আশায় বাঁচতে শেখে এবং জীবনে কিছুটা উন্নতি করতে থাকে। এদিকে ক্যালভেরোর দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে। তার জনপ্রিয়তা কমে গেছে, থিয়েটার থেকে তার ডাক পড়ে না এবং আর্থিক দৈন্যতার মধ্যে তাকে দিন কাটাতে হচ্ছে। ক্যালভেরোর এমন দূর্দিনে টেরি তাকে ভুলে যায়নি। সবসময় তার পাশে থেকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে চলে। সে ক্যালভেরোর জন্য একটি ছোট্ট অভিনয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, ক্যালভেরোকে সাহায্য করার জন্য একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যে অনুষ্ঠানে ক্যালভেরো অভিনয় করবেন আর টেরি নাচবে। সেই অনুষ্ঠানে সমস্ত শক্তি নিয়ে ক্যালভেরো মরিয়া হয়ে অভিনয় করে। কিন্তু মঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসে সে নিজের উত্তেজনাকে ধরে রাখতে পারে না। মাথা ঘুরে স্টেজের পাশে পড়ে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে সে একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেল। অন্যদিকে ক্যালভেরোর সাহাযার্থে আয়োজিত অনুষ্ঠানের দর্শকদের আনন্দ দেবার জন্য টেরি নেচে চলেছে। ক্যালভেরোর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ছবিটি শেষ হয়। অপূর্ব বেদনাময় সিকোয়েন্সটি দীর্ঘদিন দর্শকদের মনে গেঁথে ছিল। বলা হয় ‘লাইমলাইট’ ছবিটির শেষ দৃশ্যটি শতবর্ষের সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম একটি অসাধারণ দৃশ্য। বিখ্যাত ফরাসী নাট্যকার ও অভিনেতা মলিয়েরও ঠিক এভাবেই অভিনয় করতে করতেই মঞ্চের ওপরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
লন্ডনে ‘লাইমলাইট’ ছবির মুক্তি উপলক্ষে ১৯৫২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর চ্যাপলিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে কুইন এলিজাবেথ জাহাজে করে লন্ডনের দিকে রওনা হলেন। আমেরিকায় ফিরে আসার রি-এন্ট্রি পারমিট তাঁকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রওনা হবার দু’দিন পরে জাহাজে তাঁকে জানিয়ে দেয়া হল, অ্যাটর্নী জেনারেল ম্যকগ্রানারীর আদেশে তাঁর রি-এন্ট্রি পারমিট বাতিল করা হয়েছে অর্থাত চার্লি চ্যাপলিনকে আর আমেরিকায় ফিরতে দেয়া হবে না। এরপর লন্ডনে চ্যাপলিন আরো দুটি ছবি তৈরি করলেন। প্রথমটি ‘এ কিং ইন নিউইয়র্ক’ এবং দ্বিতীয়টি ‘এ কাউন্টেস ফ্রম হংকং’। প্রথমটি তাঁর অভিনীত শেষ ছবি, অপরটির তিনি শুধু পরিচালক ছিলেন। নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মার্লোন ব্র্যান্ডো ও সোফিয়া লোরেন।
চার্লি চ্যাপলিনের ইচ্ছে ছিল শেষদিন পর্যন্ত তিনি আমেরিকাতেই থাকবেন। আমেরিকার সাধারণ মানুষদের তিনি খুব ভালোবাসতেন। এরাই ছিল তাঁর ছবির পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু শেষে যখন তার স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাস করা সম্ভব হল না। ফলে ১৯৫৩ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সুইজারল্যান্ডের ভেভে’তে ৩৭ একর জমিসহ একটি বাড়ি কিনে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করলেন। স্বদেশ সম্পর্কে তাঁর কোন মোহ ছিল না। গ্রেট ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের জন্যে তিনি লজ্জিত ছিলেন। গান্ধীজীর সঙ্গে তিনি নিজের গরজেই দেখা করেছিলেন এবং ভারতের স্বাধীনতার প্রতি তাঁর সহানুভূতির কথা তিনি গান্ধীজীকে জানিয়ে এসেছিলেন।
১৯৭৭ সালের শুরু থেকেই চার্লি চ্যাপলিনের শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। শরীরে বার্ধক্য এসে ভর করেছে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় না করলেও লিখে চলেছেন নিজের জীবনের না বলা কাহিনী। ১৯৭৪ সালে লিখলেন ‘মাই লাইফ ইন পিকচার্স’ গ্রন্থটি। প্রতিদিন প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা তিনি লিখতেন। ধীরে ধীরে চলে আসলো ১৯৭৭ এর বড় দিন।
সুইজারল্যান্ডের ভেভের বিশাল বাড়িটা সামান্য হলেও সাজানো হয়েছে ছেলেমেয়েদের জন্য। ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বাড়ির লনে দেখেছেন বাচ্চাদের ছুটোছুটি আর আনন্দ, আর স্ত্রী উনার কর্মব্যস্ততা। সন্ধ্যা পেরিয়ে যখন রাত ঘনিয়ে এল, বাচ্চারা যখন ঘুমের মধ্যে অপেক্ষা করছে শুভ্র দাঁড়ির ফাদার ক্রিসমাস স্কে গাড়িতে করে আসবে তাদের জন্য বড় দিনের উপহার নিয়ে। তখন চার্লি নিজেও এক লহমায় ছোট্ট বাচ্চা হয়ে গিয়েছিলেন। তার মনে পড়ে গিয়েছিল সেই লন্ডনের বার্মাসির বস্তির কথা যেখানে দরিদ্র্যের মধ্যে কেটেছে তাঁর মলিন বাল্যকাল। তার ভাই সিডনী বা তার অন্যান্য বন্ধুদের কাছে তখন ফাদার ক্রিসমাসের আনা উপহার মানে পেটপুরে খাওয়া। বড়দিনে ছোট্ট চার্লি দেখেছে আশেপাশের অনেকেই গীর্জায় গেলেও তার বাবা যেতেন না। শুড়িখানার টেবিলে মাথা নিচু করে লালচে পানির গাসটা শক্ত হাতে আঁকড়িয়ে ধরে কী যেন ভাবতেন সব সময়। আর মা পাগলা গারদে অথবা জীর্ণ মলিন মুখে নিজেদের খুপড়িতে বসে অপেক্ষায় থাকতেন তার দুই সন্তানের। সেই সময়গুওলোতে হয়তো ভিখিরির মত চার্লি আর সিডনি রাস্তায় রাস্তায় খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন কিছু পয়সার জন্যে।
সেই বড়দিনের সাজানো বাড়িটা এবং ছেলেমেয়েদের আনন্দের ছুটোছুটি তাঁকে বারবার তাঁর শৈশব জীবনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। নির্জন একাকী ঘরে হঠাত ডুকরিয়ে কেঁদে উঠলেন চার্লি। বাইরে বরফ পড়ছে। ছেলেমেয়েরা ঘুমের মধ্যে অপেক্ষা করছে তুষার রাজ্য থেকে স্কে গাড়িতে করে ফাদার ক্রিসমাস আসবে। ছেলেদের এই বোকামী দেখে নিজের মনেই একটু হেসে উঠেছিলেন তিনি। তখনো তিনি জানালা দিয়ে বাইরের বার্চ ও পাইন গাছগুলো দেখছেন। সাদা বরফের ওপর আবছা আলোয় কেমন যেন এক মোহনীয় পরিবেশ তখন। হয়তো হঠাত তখন তাঁর খুব ইচ্ছে করেছিল, বাচ্চাদের মত তিনিও ফাদার সান্তা ক্লুজের জন্য অপেক্ষা করবেন। তবে সান্তা ক্লুজের এর কাছ থেকে কোন উপহার পেতে নয় বরং তার স্কেজের গাড়িতে চড়ে অজানা অদৃশ্য কোন এক জগতে চলে যেতে। হয়তো তিনি যখন এমন সব ভাবছিলেন, তখনই হঠাত তাঁর চোখ আটকিয়ে গিয়েছিল। তিনি দেখছিলেন, অনেক দূর থেকে সাদা চুল দাড়ির সান্তা ক্লুজ স্কেজে চড়ে চলে আসছেন তাঁরই দিকে। ব্যাপারটা একেবারে কল্পনায় ছিল না, চার্লি একেবারে সজাগ থেকে চোখ খোলা রেখে দেখে চলেছিলেন তাঁর একেবারে সামনে সাদা বরফের পথ ধরে ¯েøজ গাড়িটি তাঁর সামনে এসে থামলো। তাঁর হঠাত খটকা লাগলো, সারাজীবন ধরে ফাদার ক্রিসমাসের যে গল্প শুনে এসেছেন তাহলে কী সেটা সত্যিই সত্যি! বাচ্চারা যা বিশ্বাস করে তা তাহলে একেবারে ভুল নয়!
ভাবনাটা শেষ না হতেই চার্লি দেখলেন জানালার ওপারে এসে দাঁড়িয়ে আছেন ফাদার ক্রিসমাস। তিনি অনেক ভালোবাসায় চার্লিকে বলে উঠলেন, ‘আপনার জন্য স্কেজ তৈরি, চলুন আমরা ফিরে যাই যেখান থেকে আমরা এসেছি।’ সাদা চুল দাড়ির ফাদারের কথা শুনে মুহূর্তেই ছোট্ট বাচ্চা হয়ে দরজা খুলে সাদা বরফ মাড়িয়ে এক লাফে স্কেজে উঠলেন পড়লেন চার্লি। তাঁর তখন খুবই তাড়া, সকাল হবার পূর্বেই তাঁকে স্কেজ গাড়িতে চড়ে যেতে হবে মহাদিগন্ত পারের সূবর্ণরেখায়!
সেই দিন সকালেই অর্থাত ১৯৭৭ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর সকালে চার্লি চ্যাপলিন আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গিয়েছিলেন। (চলবে)