Home সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের “গোরা” নিয়ে রবীন্দ্রপ্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে পাঠশালার আসর

রবীন্দ্রনাথের “গোরা” নিয়ে রবীন্দ্রপ্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে পাঠশালার আসর

ফারহানা আজিম শিউলী : টরন্টোভিত্তিক সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ২৯তম ভার্চুয়াল আসরটি আগস্ট মাসের ২১ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে নিবেদিত এই আসরে আলোচিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘গোরা’। ‘গোরা’ নিয়ে আলোচনা করেন সঙ্গীত শিল্পী-লেখক-অ্যাক্টিভিস্ট শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার।

‘গোরা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দীর্ঘতম উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘গোরা’। আবার কারো মতে, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের নামই ‘গোরা’। তবে এসব ছাপিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের নজরে আসে — গত বছরে দিল্লীর উপকণ্ঠে সংগ্রামরত কৃষকদের বিক্ষোভ সমাবেশে এক বৃদ্ধ পাঞ্জাবি কৃষকের হাতে হিন্দী অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’। তখনকার বিরামহীন বিক্ষোভের মধ্যে সেই কৃষকের কাছে ‘গোরা’ কি অবকাশ যাপনের অনুসঙ্গ ছিল নাকি সেই উপন্যাসটি ছিল তাঁর চলমান সংগ্রামেরই এক স¤প্রসারণ?
‘গোরা’ উপন্যাসে আমরা দেখি কেন্দ্রীয় চরিত্র আগের গোরা রূপান্তরিত হয় শেষে অন্য এক গোরাতে, যে কিনা হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের বা হিন্দু রিভাইভ্যালিজমের নেতিবাচক স্বরূপ বুঝতে পারে শেষমেষ। ওদিকে এবারে দিল্লীর কৃষক আন্দোলন কৃষকের দাবিদাওয়া ছাপিয়ে সামগ্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ ভারতের সা¤প্রতিক কৃষক আন্দোলনের যে অবস্থানগত রূপান্তর, সেটিই যেন এসে মিশে যায় গোরার রূপান্তরের সাথে। আর সেখানটায় দাঁড়িয়েই আমাদের আজকের অনুসন্ধান। ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে ১৯০৯ সালের রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ‘গোরা’কে আমরা কিভাবে দেখব? এর প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু?

যে আবর্তের মধ্য দিয়ে এগিয়েছিল ঊনবিংশ শতকের অবিভক্ত বাংলা, সেই আবর্ত থেকে উঠে এসেছিল কতগুলো প্রশ্ন — ধর্ম কি, জাতি কি, রাষ্ট্র কি, দেশ এবং বিশ্বের আন্তঃসম্পর্ককে কিভাবে দেখা হবে, জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও প্রকাশ কিভাবে ঘটবে ইত্যাদি। আধুনিক সময়ের তার্কিকতার একটি উল্লেখযোগ্য সময়পর্বের দলিল হিসেবে কি আমরা দেখতে পারি ‘গোরা’কে? ‘গোরা’র ভেতরে কি আমরা খুঁজে পাই একটি সময়কে? নাকি কতগুলো মানুষকে? নাকি চিরন্তন ভাঙা-গড়ার যে মানুষ রবীন্দ্রনাথ তারই এক গুরুত্বপূর্ণ ভাঙা-গড়ার ইতিবৃত্ত লুকিয়ে আছে ‘গোরা’ উপন্যাসের পরতে পরতে? ‘গোরা’ কি কাল্পনিক? ‘গোরা’ কি ঐতিহাসিক? ‘গোরা’ কি রাজনৈতিক? ‘গোরা’র নারীবাদ এখনও কতটা গুরুত্ব বহন করে? ‘গোরা’র কি কোনো স¤প্রসারণ আছে? রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির কতটা জুড়ে ‘গোরা’র তাৎপর্য রয়েছে? এবং আজকের বিভক্ত পৃথিবীর বিভক্ত বাঙালি ‘গোরা’র মাধ্যমে কী করে সূত্রবদ্ধ হতে পারে?

এসব দার্শনিক তার্কিকতার পরিমণ্ডল আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের ৩টি উপন্যাস – ‘গোরা’, ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘চার অধ্যায়’-এ। ‘গোরা’তে পাই ঊনবিংশ শতকের ধর্ম-আন্দোলনের ভেতরের নানা ন্যারেটিভের দ্ব›দ্ব-সংঘাত ও হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের উত্থান। ‘ঘরে বাইরে’তে পাই জাতীয়তাবাদের নানা ন্যারেটিভের বিতর্কের আবহ ও সংকীর্ণ স্বাদেশিকতার সমালোচনা। ‘চার অধ্যায়ে’ পাই তথাকথিত বিপ্লববাদ নিয়ে ন্যারেটিভ ও সংগ্রামের নানা পন্থা। ৩টি উপন্যাসই আত্মজৈবনিক, আবার একইসঙ্গে এই উপন্যাসত্রয়ী সময়ের দলিল ও ঐতিহাসিক অ্যাকাউন্টও। প্রতিটিতেই আমরা ‘আরগুমেন্টেটিভ বেঙ্গলি মাইন্ড’ খুঁজে পাই, খুঁজে পাই নারীবাদও।

অতিমারিকালে বিশ্বজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানপর্বে ‘ঘরে বাইরে’ নিয়ে পাঠশালার আসর হয়েছে ইতোমধ্যে। এবারের আসর ছিল রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘গোরা’ নিয়ে।

আলোচক শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার ‘গোরা’র ভূমিকায় এর সময়কাল, এর বৈশিষ্ট্য ও সামগ্রিকভাবে এর গুরুত্ব তুলে ধরেন। গোরার জন্ম সিপাহি বিদ্রোহের সময়। এর ১৯-২০ বছর বাদে গোরা পরিণত, প্রাপ্তবয়ষ্ক বা কলেজ পড়ুয়া ছেলে হয়েছে। তবে ধরা যায় যে, মোটামুটি ১৮৬৮-৬৯ থেকে ১৮৮০-৮৫ এইরকম একটা সময়পর্বকে ‘গোরা’য় তুলে আনা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৪-৫ এই সময়ে ‘গোরা’ উপন্যাসটির কথা ভাবছেন। মানে এটি জায়মান হচ্ছে তাঁর ভেতরে। তিনি ১৯০৭-১৯০৯ এই সময়ে প্রবাসী পত্রিকাতে ‘গোরা’ ধারাবাহিকভাবে লিখেন এবং ১৯১০ সালে সেটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। ঐ সময়টা বিশেষ করে ১৮৯০ থেকে ১৯১০ রবীন্দ্রনাথের জীবনের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। ঐ সময়টা তাঁর নিজের প্রচুর ভাঙা-গড়া হচ্ছে। তিনি নানাধরণের ভাবধারা ও চিন্তাভাবনার সংস্পর্শে আসছেন, প্রভাবিত হচ্ছেন, প্রভাব মুক্ত হচ্ছেন আবার একটার সাথে আরেকটার থিসিস-অ্যান্টিথিসিস হয়ে একধরনের সিন্থেসিস হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ মানুষটারও হয়ে ওঠার একটা বিরাট পর্ব হচ্ছে ১৮৯০ থেকে ১৯১০ সময়কাল। ফলে ‘গোরা’ উপন্যাস তাঁর হয়ে ওঠারও একটা দর্পণ। আবার বাংলার ইতিহাসে, ভারতের ইতিহাসে রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাব থেকে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এই পুরো সময়পর্বটা যদি ধরি তবে সেটা বাংলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে রাজনীতির, জাতীয় চেতনার, ধর্মাদর্শের ক্ষেত্রে নানা ভাঙা-গড়ার পর্ব এবং বাংলার আলোকায়ন পর্ব বা নবজাগরণ পর্ব (যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ থাকলেও)। এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে ঐ সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ঐ জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে উপন্যাসটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আজকের রাজনীতির দিকে তাকালে দেখব, আজকের রাজনীতির অনেক কিছুরই কোনো না কোনো ভাবে যোগসূত্র বাঁধা হয়ে আছে ঊনবিংশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের প্রথম পর্বের সাথে। আমাদের এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য নানাভাবে এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে সেই সময়পর্বের গতিরেখা। সেই সময়কাল বারবার ফিরে ফিরে আসে নানা আলোচনায়, নানা বিতর্কে।

শুভপ্রসাদ বলেন, ‘গোরা’ রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘতম উপন্যাস হওয়ার একটা কারণ হয়তো – রবীন্দ্রনাথ যতটা বলছেন, যতটা লিখছেন, তাতে লিখেও মনে হচ্ছে যে ঐ সময়টাকে বা যে বিষয়টাকে তিনি ধরতে চাইছেন সেটি ধরা হয়ে উঠছে না। আরো বলতে হবে, আরো নানা দিক থেকে বলতে হবে, নানাভাবে বলতে হবে, নানা চরিত্রের সংশ্লেষ ঘটিয়ে এই বিষয়টাকে আনতে হবে। এই করতে করতে হয়তো ‘গোরা’র দৈর্ঘ্য এতো বড়ো হয়েছে। এবং বোধহয় রবীন্দ্রনাথের এতটা বলার পরেও বলা ফুরোয়নি, সেজন্য পরের দশকেই তা ‘ঘরে বাইরে’ হয়ে আত্মপ্রকাশ করছে এবং তারপর আবার ‘চার অধ্যায়’ হয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। এবং যদি আরো নিবিড়ভাবে দেখি তবে দেখব, রবীন্দ্রনাথের সমাজকর্ম থেকে শুরু করে তাঁর চিঠিপত্র হয়ে, তাঁর নাটক তাঁর গান হয়ে এই গোটা জিনিসটা প্রলম্বিত হয়েছে। এবং এক অর্থে এটা রবীন্দ্রনাথের গোটা জীবনের একটা কন্টিনিউয়াম। ফলে ফিরে ফিরে বিষয়টা এসেছে তাঁর নানা লেখায়।

আলোচক বলেন, ৭৬টা পরিচ্ছদে বিভক্ত গোটা উপন্যাসটি এবং পরিচ্ছদগুলো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ‘গোরা’ উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এখানে যতটা গল্প বলা তার চেয়ে নানা মতাভিমতের দ্ব›দ্ব-সংঘর্ষ, স্রোত-প্রতিস্রোত চিত্রায়িত করা অনেক বেশি। মানুষগুলো, বিভিন্ন চরিত্রগুলোর বিভিন্ন ঘটনা দেখলে মনে হয়, মত-অভিমতের স্রোত-প্রতিস্রোত এবং তার যে ঘাত-প্রতিঘাত এবং তার থেকে যে নানা ধরনের উত্তরণ এবং তার যে কখনো কখনো থমকে যাওয়া, এগিয়ে যাওয়া, পিছিয়ে যাওয়া, এসবেরই এটা শেষ পর্যন্ত একটা চিত্রায়ন। স্রোত-প্রতিস্রোত, ঘাত-প্রতিঘাত এই কথাগুলোই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে ‘গোরা’র মধ্যে তার্কিকতা আছে এবং এই তার্কিকতার মধ্যেও অদ্ভুত কতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। খেয়াল করলে দেখা যায়, এখানে রবীন্দ্রনাথ কোনো চরিত্রের প্রতি সে অর্থে পক্ষপাত করেননি। যে যখন কথা বলছে তার কথাগুলোকে একদম সত্য জ্ঞান করে বলা হচ্ছে। এবং তাকে যখন কেউ খণ্ডন করছে, খণ্ডনকারীর কথা যখন উপস্থাপিত হচ্ছে সেটিও সত্য হিসেবে গ্রহণ করে উপস্থাপিত হচ্ছে। হয় এখানে লেখক নানা চরিত্রের মধ্যে ছড়িয়ে আছেন নয়তো লেখক নিজেকে একরকম অনুপস্থিত রেখে চরিত্রগুলোকে কথা বলতে দিয়েছেন, মন খুলে কথা বলতে দিয়েছেন, প্রাণ খুলে তর্ক করতে দিয়েছেন। এবং তা করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক অর্থে অবিভক্ত বাংলাদেশের তর্কমুখর একটা সময়পর্বের একটা অসাধারণ দর্পণ উঠে এসেছে ‘গোরা’ উপন্যাসে। বলা হয়ে থাকে, What Bengal thinks today, India will think tomorrow. সেসময়ে বাংলার যে তর্কমুখরতা ছিল, সেই তর্কমুখরতা ভারতকে বাদ দিয়ে ভাবেনি, ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করে ভেবেছে। এবং বাংলার সেই তর্কমুখরতা শেষ পর্যন্ত বিশ্বচেতনার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে ‘গোরা’ শুধুমাত্র একটা প্রদেশের গল্প না, একটা শহরের গল্প না, একটা বিশেষ বর্গের মানুষদের গল্প না, এটা শেষ পর্যন্ত মানুষের দার্শনিকতার যে জায়গা আছে তারও নানা প্রশ্ন সেখানে ধরেছে। ফলে ‘গোরা’ সর্বঅর্থেই গুরুত্বপূর্ণ। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ যেমন বারবার তার ধর্মগ্রন্থের কাছে ফেরত যায়, তেমনি আবহমান অসা¤প্রদায়িক বাঙালিকে বারবার ‘গোরা’র কাছে ফিরতে হবে, গোরা’কে নানাভাবে দেখতে হবে।

শুভপ্রসাদ ‘গোরা’র গল্পাভাষ বলতে গিয়ে বলেন, উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরা। তার জন্ম সিপাহি বিদ্রোহের সময়। সে এক আইরিশ দম্পতির সন্তান। যার পিতা বিদ্রোহীদের গোলার আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন এবং যার মা তাকে গর্ভে ধারণ করা অবস্থায় স্বামীকে হারানোর পর এক বাঙালি দম্পতির কাছে এসে আশ্রয় নেন। এবং সেই বাঙালি দম্পতির আশ্রয়ে তিনি গোরাকে জন্ম দিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তারপর সেই বাঙালি দম্পতি গোরাকে গ্রহণ করেন, গোরাকে পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব প্রদান করেন। গোরা তাদের কাছেই মানুষ হয়। গোরার পালক মা আনন্দময়ী ছিলেন অত্যন্ত গোঁড়া, ধার্মিক ও ধর্মাচারী হিন্দু ব্রাহ্মণ মহিলা। তিনি গোরাকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে তার এতদিনের ধর্মের সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি গোরাকে কোল দেন আর বর্জন করেন লালিত সংস্কার। গোরার পালক পিতা কৃষ্ণদয়াল ছিলেন সেইসময় অত্যন্ত ভোগবাদী একজন মানুষ। ধর্ম, আচারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না তার। কলেজে পড়ার সময় তিনি পানাহার করতেন, হোটেল রেস্টুরেন্টে খেতেন, কোনোকিছুর তোয়াক্কা করতেন না, সংস্কারের কোনো ব্যাপার ছিল না, ধর্মের চর্চার কোনো ব্যাপার ছিল না। স্বামী-স্ত্রী ছিলেন ভিন্ন মেরুর। গোরাকে তারা পৈতে দেন এবং গোরাকে ব্রাহ্মণ সন্তান হিসেবেই লালনপালন করেন। তারা তখন ছিলেন পশ্চিমে, লক্ষ্ণৌয়। পরে চলে আসেন কোলকাতায়। আনন্দময়ী কৃষ্ণদয়ালের প্রথম স্ত্রী নন, তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী মহিম নামে এক পুত্রসন্তান জন্ম দিয়ে মারা যান। মহিমকে কৃষ্ণদয়াল তার মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। দ্বিতীয় বিয়ের পর তিনি লক্ষ্ণৌয় চলে যান। পরে কোলকাতায় এলে তিনি মহিমকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন এবং দুই সন্তানকে একসঙ্গে মানুষ করেন। এই পর্ব থেকে দেখা যায়, আনন্দময়ী গোরাকে যতটা মাতৃত্ব দান করতে থাকেন তত বেশি উদার হতে থাকেন, ধর্ম সংস্কার থেকে মুক্ত হতে থাকেন। কিন্তু ওদিকে কৃষ্ণদয়াল হঠাৎ করে খুব সংস্কারী হয়ে ওঠেন, নৈষ্টিক ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠেন, শূচিতা তার কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। তিনি পানাহার ত্যাগ করে ধর্মপালন, শাস্ত্রপালন, ছোঁয়াছুঁয়ি পালন এসমস্ত কিছু শুরু করে দেন। এই পর্বের এক জায়গায় দেখা যায়, গোরার অভিন্নহৃদয় বন্ধু বিনয়কে আনন্দময়ী প্রায় সন্তানের মতো গ্রহণ করেন। বিনয় মাতৃপিতৃহারা এক ব্রাহ্মণ সন্তান। তার কাকা থাকেন দেশে আর সে কোলকাতায় থেকে পড়াশোনা করে।

উপন্যাসটা শুরু হচ্ছে গোরার বন্ধু বিনয়ের জায়গা থেকে। সে কোলকাতা শহরে এক বর্ষার সকালে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর বসে আছে। এক বাউল বাড়ির পাশ দিয়ে গান গেয়ে যায় – ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়।’ সে সময় এক দুর্ঘটনা ঘটে তার বাড়ির সামনে। পরেশ নামে এক বয়ষ্ক ভদ্রলোক ও তার কন্যা সুচরিতা দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়। সে তাদেরকে তার বাসায় এনে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে তারা সুস্থ হন। তারা ছিলেন ব্রাহ্ম। পরে জানা যায়, সুচরিতা পরেশবাবুর নিজের কন্যা না, তার পালিত কন্যা। সে পূর্ব বাংলার এক ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে। তার ভাইয়ের জন্মের সময় মা মারা যান। তাদের একঘরে করে দেওয়ায় তার বাবা চলে আসেন ঢাকায়। একসময় বাবাও মারা যান কিন্তু তিনি তার আগেই তিনি তার সম্পত্তি ছেলেমেয়ের নামে ভাগাভাগি করে পরেশবাবুকে বুঝিয়ে দিয়ে যান। সেই থেকে সুচরিতা ও তার ভাই সতীশ পরেশবাবুর পালিত পুত্র-কন্যা হয়ে ওঠে। পরেশবাবুর স্ত্রী বরদাসুন্দরী। তাদের তিনটি কন্যা – লাবণ্য, ললিতা ও লীলা। পরিবারটি বেশ কট্টর ব্রাহ্ম এবং তাদের পরিবারে আনাগোনা আছে আরো কিছু নবীন ছেলের যারা নবীন ব্রাহ্ম ও কট্টর পন্থার ব্রাহ্মমতে বিশ্বাস করে। ঘটনাচক্রে পরে দেখা যায়, পরেশবাবু ও গোরার পালক পিতা কৃষ্ণদয়াল কলেজ জীবনের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং একসঙ্গেই তারা আচার-সংস্কার না-মানা, বাইরে খাওয়া, ধর্মকে তুচ্ছ করা এসব করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে কৃষ্ণদয়াল হয়ে ওঠেন সংস্কারমুখি এবং দুজনের মধ্যে আর যোগাযোগ ছিল না।

গোরার বন্ধু বিনয়ের সঙ্গে পরেশবাবুর পরিবারের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। এটা জানার পর গোরা খুব ক্ষিপ্ত হয় কারণ গোরা বিশ্বাসের দিক থেকে ছিল গোঁড়া। যদিও প্রথমজীবনে সেও আক্রমনাত্মক ব্রাহ্ম ছিল, হিন্দু সংস্কার মানা মানুষদের আক্রমণ করত। তবে কৃষ্ণদয়ালের কাছে যেই লোকগুলো আসত, তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে বেদান্ত নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে, তার তর্কের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আস্তে আস্তে গোরা বুঝতে পারে যে তাকে বেদান্ত জানতে হবে। এর মধ্যে জনৈক ইউরোপিয়ান সাহেব হিন্দুধর্মকে কটাক্ষ করে লেখালেখি করায় সেটার প্রতিবাদ করে হিন্দু ভাবনা, হিন্দু পরিচিতি নিয়ে লিখতে গিয়ে তার ভাবনার মধ্যে হিন্দু এবং ভারতীয় একীভূত হয়ে যায় এবং সে বিশ্বাস করে যে, প্রাচীন সংস্কারগুলোকে পালন করার মধ্য দিয়ে, মেনে চলার মধ্য দিয়ে এই দেশের সঙ্গে একাত্ম হওয়া যাবে এবং এই দেশকে জাগাতে হলে এই দেশে যারা সংস্কারে ডুবে আছে তাদেরও একজন হতে হবে। ব্রাহ্মরা যেভাবে একধরনের ‘অপরত্বে’র মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের সমালোচনা করে গোরা তার ঠিক উল্টোদিক থেকে ভাবে। সে ভাবে, তাকে এদের একজন হয়ে উঠতে হবে। এই তর্ক-বিতর্ক হতে থাকে। এ কারণেই বিনয়ের পরেশবাবুর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় গোরা ক্ষুব্ধ হয়।

একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, গোরার পালক পিতা-মাতা তাকে ব্রাহ্মণ সন্তান হিসেবে মানুষ করলেও, তাকে পৈতে দিলেও, তারা কখনো ভাবতেও পারেন না গোরাকে কোনো ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে। তাই কৃষ্ণদয়ালের মনে হয়, গোরাকে তার ব্রাহ্ম বন্ধু পরেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে, ভাব করিয়ে দিয়ে, সেই পরিবারের ৪ কন্যার একজনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া গেলে একদিক দিয়ে তিনি বেঁচে যান। তিনি নিজে নৈষ্টিক হিন্দু হয়েছেন কিন্তু মনে মনে চান গোরা যেন ব্রাহ্ম পরিবারেই বিয়ে করে। গোরা যে এতটা হিন্দু হয়ে উঠছে সেটা তিনি পছন্দ করেন না। গোরাকে তিনি সন্তানের মর্যাদা দিয়েছেন কিন্তু তাকে হিন্দুত্বের মধ্যে স্থান দিতে চান না। আবার ওদিকে পরেশ-বরদা’র পালিতা কন্যা সুচরিতাকে বরদাসুন্দরী তাদের বাড়িতে আসা এক ব্রাহ্ম ছেলে, যে ছেলেটিকে তিনি স্বমর্যাদা বা স্বস্তরের মনে করেন না, হারান নামের সেই ছেলের সঙ্গে চান সুচরিতার বিয়ে দেওয়া হোক। মজার ব্যাপার, দুই জায়গাতেই পালিত সন্তানকে গ্রহণ করা হচ্ছে কিন্তু বিয়ে দেওয়ার সময় অপর জায়গায় দিতে চান, অর্থাৎ বিয়ের সময় আর নিজের সমাজে গ্রহণ করা যায় না। কৃষদয়ালের বুদ্ধিতে গোরাকে একটা চিঠি দিয়ে পাঠানো হয় পুরোনো ব্রাহ্ম বন্ধু পরেশ বাবুর কাছে, যেখানে গোরা ভীষণরকম তর্কে জড়িয়ে পড়ে। তার নিজের মতবাদ অর্থাৎ প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতি, সমাজ, আচার, জাতব্যবস্থা, ছোঁয়াছুঁয়ি সমস্ত কিছুর সমর্থনে তার যুক্তি উপস্থাপন করে ওখানকার আগ্রাসি ব্রাহ্ম পরিবেশে। সে সেই বাড়িতে হারানের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। এই রকম তার্কিক আবহেই দেখা যায় বিভিন্ন চরিত্রগুলো একটু একটু করে ভাঙছে। তাদের যে কট্টর অবস্থান সেখান থেকে ভাঙছে।

গোরা উপন্যাসের গল্পটা কোলকাতা শহরের উচ্চ বর্ণের। দুটি পরিবার ঘিরে। একটি কট্টর হিন্দু, আরেকটি কট্টর ব্রাহ্ম পরিমণ্ডলে গল্পের শুরু। পরে গল্পটা বিস্তৃত হতে থাকলে অন্ত্যজ চরিত্রের দেখা মেলে। গোরা সেই শহরের একদম অন্ত্যজ শ্রেণির এক পাড়ায় নন্দ নামে একজনের কাছে মাঝেমধ্যে যেত। এর মাধ্যমেই গোরাকে কোলকাতার উচ্চ বর্ণের পরিবার পরিমণ্ডল থেকে ভেঙে বের করে দেওয়া হচ্ছে। নন্দ ধনুষ্টঙ্কারে আক্রান্ত হয়ে শুধুমাত্র অন্ধ কুসংস্কারে অপচিকিৎসায় মারা যায়। এবং সেখান থেকে দাঁড়িয়ে গোরার প্রথম ভদ্রলোক বৃত্তের বাইরের মানুষের জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় হয়। ওখান থেকে গোরার খানিকটা করে ভাঙা শুরু। এর পরে দেখা যায়, সে ত্রিবেণীতে যায় গঙ্গাস্নানে। উল্লেখ্য, এই উপন্যাসে বেশ কিছু দুর্ঘটনা আছে। এই গল্পের শুরু এক দুর্ঘটনা দিয়ে। পরেশবাবুর পরিবার দুর্ঘটনায় পড়ে। নন্দ মারা যায় হঠাৎ করে অপঘাতের মতো। ত্রিবেণীতে যাবার পথে মানুষজন ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে লঞ্চে উঠতে গিয়ে কিছু লোক পানিতে পড়ে যায়। তা নিয়ে লঞ্চের ওপরে এক সাহেবের সঙ্গে এক নব্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় বাঙালি মোসাহেবি করে পড়ে যাওয়া লোকজনদের নিয়ে কটাক্ষ করে, নিন্দা করে। সহ্য করতে না পেরে গোরা ওপরে গিয়ে প্রতিবাদ করে দারুণরকমভাবে। এভাবে একজন বাঙালি যুবককে সাহেবের সঙ্গে মুখোমুখি প্রতিবাদ ঐ নব্য শিক্ষিত বাঙালি অবাক হয়ে দেখে কিন্তু গোরাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। ঐ সাহেবটি চুপ করে যায়। পরেরদিন লঞ্চ থেকে নামার সময় সে গোরার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে। এখানে গোরা প্রথম দেখতে পায়, শ্বেতাঙ্গ মানুষ মাত্রেই অত্যাচারি না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনেক লেখায় ছোটো ইংরাজ, বড়ো ইংরাজের কথা বলেছেন। বড়ো ইংরেজের সাথে পরিচয়টা গোরার কট্টরপন্থা ভাঙার আরেকটা ঘটনা। তার্কিকতার পরিমণ্ডলে দাঁড়িয়ে তারপর আরেকটা সময় গোরার মনে হয়, সে দেশভ্রমণে বের হবে। তার একটা সংগঠন ছিল, যেখানে তার মতাদর্শগুলো তার অনুগামীদেরকে নিয়ে সে প্রচার করত। সে বই লিখে এবং হিন্দু ধর্ম নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে সে শেষ পর্যন্ত ‘হিন্দুইজম’ নামে একটা বইই লিখে ফেলে। একসময় সে বেরিয়ে পড়ে দেশ ভ্রমণে। বেরিয়ে গিয়ে সে কতগুলো জিনিসের সঙ্গে পরিচিত হয়। দেখে, সে কট্টর হিন্দুয়ানিকে ধরে রেখেছে অথচ গ্রামবাংলায় অন্ত্যজ পরিমণ্ডলে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ এক নাপিত পরিবার কী অবলীলাক্রমে সেই সংস্কার ভেঙে অপর ধর্মের এক শিশুকে মানুষ করছে। এখানেও একটা দেখার বিষয় যে, উপন্যাসের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, গোরার পরিবারে গোরা একজন আইরিশ খৃষ্টান দম্পতির সন্তান যে বেড়ে উঠছে এক নৈষ্টিক হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। আবার দেখা যাচ্ছে এক অন্ত্যজ শ্রেণির হিন্দু পরিবার এক মুসলিম সন্তানকে প্রতিপালন করছে। একটি পরিবারে অন্য ধরনের সন্তান এটি উপন্যাসের এক চিত্তাকর্ষক দিক। গোরা ভ্রমণে গিয়ে আরো দেখে যে, নীলচাষ ঘিরে সেখানে ইংরেজ মালিকের সঙ্গে কৃষকের লড়াই এবং লড়াইয়ের ফলে এক মুসলিম কৃষক অত্যাচারিত, প্রচুর লোকজন জেলে গেছে। দেখতে পায়, এক নৈষ্টিক ব্রাহ্মণ নীল সাহেবদের মোসাহেবি করছে, অত্যাচারির পক্ষ নিচ্ছে। আবার ওদিকে অত্যাচারিতদের পক্ষ নিচ্ছে অন্ত্যজ শ্রেণির লোকেরা। গোরা সেখানে অত্যাচারিতের পক্ষ নেয়। এতে তার ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটা ভাঙতে শুরু করে। কারণ সে যদি ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায় তবে সে সংস্কারের পক্ষে থাকতে পারে না। তাকে নাপিতের ঘরে অন্ন জল গ্রহণ করতে হয়, যে মুসলমান শিশুকে স্থান দিয়েছে। আবার যদি সংস্কারের পক্ষে থাকে তবে সে ন্যায়ের পক্ষে থাকতে পারে না। তবে তাকে সেই অত্যাচারি মোসাহেবি ব্রাহ্মণের সঙ্গে থাকতে হয়। সেই পল্লীতে পুলিশ, রাষ্ট্রযন্ত্র, বিচারব্যাবস্থা, ঔপনিবেশিক শাসন এবং সেসবের দোসর মুৎসুদ্দি শ্রেণি সবার সঙ্গেই গোরার পরিচয় হয়। এবং এই পরিচয়ের মধ্য দিয়ে গোরা শেষমেষ ওখানে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে সংস্কারের বিপক্ষে চলে যায় এবং তাকে কারাবাসও বরণ করতে হয়। কারাবাসকে সে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করে। যে গরিব কৃষকেরাও সেই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তারা কারাগারে থাকবে কিন্তু তার বন্ধুরা, পরিচিত উকিলরা গিয়ে তাকে মুক্ত করে আনবে সেটা সে চায় না। সে চায় কৃষকদের যা হবে তারও তাই হোক। অর্থাৎ তাদের একজন সে হয়ে উঠতে চায়। আগে আমরা দেখেছি, সে এই দেশের সংস্কার, সংস্কার-মানা সমাজ, অস্পৃশ্যতা-মানা সমাজ, জাতিবর্ণে বিভক্ত সমাজের একজন হয়ে দেশকে পাল্টাতে চায়। এখানে দেখা যায়, অত্যাচারিত যে সমাজ তাদের একজন সে হয়ে উঠতে চায় এবং সে এক মাসের কারাদণ্ড গ্রহণ করে। সে বুঝতে পারে তার এতদিনের যে বিশ্বাস তার সবটাই ছিল ভুল। তার এতদিনকার ধারণাগুলো ভেঙে, হিন্দুত্বকে শুধু অস্পৃশ্যতা ছোঁয়াছুঁয়ির ছোট্ট গণ্ডিতে না রেখে, সবাইকে নিয়ে যে হিন্দুত্ব সেই বৃহত্তর পরিসরের ভাবনা সে ভাবে। গল্পের এক পর্যায়ে সে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলে কৃষ্ণদয়াল কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না এবং তখনই গোরাকে জানিয়ে দেন তার আসল জন্মপরিচয় – গোরা তাদের আসল সন্তান না, এক আইরিশ দম্পতির সন্তান। গোরা নিজের পরিচয় জানতে পেরে এক অর্থে নিজেকে মুক্ত ভাবে। সে দেখে, সে এখানকার কেউ না, সে বর্ণব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তই না। কাজেই সবাইকে নিয়ে যেই চলা, সবাইকে নিয়ে যে ভারত গড়া, সবাইকে নিয়ে যেই জাতি নির্মাণ – তেমন একটি চেতনা তার মধ্যে কাজ করে। তখন সে অনুভব করে, তার পালক মা আনন্দময়ীই আসলে সেই সবাইকে নিয়ে চলার যে ভারতবর্ষ, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এমনকি পাশ্চাত্য সমস্তকিছু মিলিয়ে যে ভারতবর্ষ তার প্রতীক এবং সে মা’র কাছে এসে বলে – তুমিই আমার ভারতবর্ষ। এই হচ্ছে মোটামুটি গল্পাভাষ।

আলোচক বলেন, অনেকে বলে, ‘গোরা’ একজোড়া মানব-মানবীর প্রেমের গল্প। এটা সত্যি, ‘গোরা’য় প্রেম আছে। গোরার সঙ্গে সুচরিতা ও বিনয়ের সঙ্গে ললিতা প্রেমে জড়িয়ে পড়ে এবং প্রেমটাই শেষ পর্যন্ত সত্যে রূপ পায়। কিন্তু পুরো উপন্যাসে তার্কিকতার এক বিশাল পরিমণ্ডলে চরিত্রগুলোর ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে প্রেম একটা রূপ পায়, যেদিকটা উপন্যাসটি নিয়ে অনেকের ব্যাখ্যায় অনুপস্থিত।

একটি বিষয় উপন্যাসটিতে খেয়াল করার মতো। আমরা দেখি, গোরার মা নেই। সে দেশকে খুঁজছে, এক অর্থে সে তার মা’কেও খুঁজছে। বিনয়ের মা নেই, সুচরিতারও মা নেই। মাতৃহারা কতগুলো মানুষ দেশ নির্মাণ করছে এই উপন্যাসের গল্পে।

এ পর্যায়ে শুভপ্রসাদ বলেন, রবীন্দ্রনাথের লেখায় চরিত্রগুলোর নাম শুধুমাত্র বিশেষ্য থাকে না, এর মধ্যে বিশেষণও ঢুকে যায়। যেমন গোরা। সে শ্বেতাঙ্গ মেমসাহেবের পুত্র। তার নাম গৌরাঙ্গও হতে পারত, শুভ্রকান্তিও হতে পারত। কিন্তু গোরা কি এইজন্যে যে গোরার একটু এদিকওদিক হলে গোঁড়াও চলে আসে? হয়তোবা, কারণ রবীন্দ্রনাথ তো কবি। কবিরা শব্দার্থের কারাগার থেকে শব্দকে মুক্ত করে দিয়ে পুনর্জন্ম দেন। গোরার পালক মা’র নাম আনন্দময়ী। রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শন দেখলে দেখি, আনন্দ মীমাংসা তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো কথা। তিনি সুখের চেয়ে আনন্দকে বড়ো করে দেখেন, বিষন্নতার চেয়ে বেদনাকে। ফলে যার কাছে শেষ পর্যন্ত উপন্যাসটা গিয়ে শেষ হয়, যেখানে গিয়ে উপন্যাসটা পরিণতি পায়, দেশ এবং মা যেখানে একাকার হয়ে যায়, তার নাম আনন্দময়ী ছাড়া আর কী হতে পারে? একইভাবে দেখা যায়, গোরার বন্ধুর নাম বিনয়। সে গোরার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিন্তু গোরার কট্টরপন্থাকে মেনে নিতে পারে না। এমনকি ব্রাহ্মদের কট্টরপন্থাকেও সে মেনে নিতে পারে না। সেও কিন্তু নৈষ্টিক হিন্দু। গোরার স্বপক্ষে সে সব জায়গায় কথা বলে কিন্তু গোরার মতো করে বলে না, তার একটা মৃদু কণ্ঠস্বর আছে, অনুচ্চ কণ্ঠস্বর আছে, বিনয় আছে, কোনোরকম ঔদ্ধত্ব নেই। সুচরিতার নামের সঙ্গেও চরিত্রের মিল আছে। জীবনের লালিত্য আছে ললিতার মধ্যে। ফলে নামগুলো যেন কোথাও গিয়ে বিশেষণ হয়ে যায়। ‘রক্তকরবী’ নাটকের বিশু একজন বিশ্বপাগল, রঞ্জন রাঙায়, নন্দিনী জীবনের নন্দন। ‘ঘরে বাইরে’র নিখিলেশ নিখিলের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। সব চরিত্রের ক্ষেত্রে এই সমীকরণ খাটে না কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অনেক চরিত্রের নামই ভিন্ন ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়।

‘গোরা’ উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে আলোচনায় শুভপ্রসাদ বলেন, কৃষ্ণদয়ালের প্রথম পক্ষের পুত্র মহিম এমন এক চরিত্র, যে ঔপনিবেশিক নব্য শিক্ষায় শিক্ষিত, নিজের ভালোমন্দটুকু জানে, জানে বৃটিশকে মেনে নিতে হবে, রোজগার করতে হবে। উল্লেখ্য সেসময়ের লোকেরা বাইরে কার্যক্ষেত্রে নব্য ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদের মতো আচরণ করত কিন্তু বাড়িতে তাদের পুরোনো আচার নিষ্ঠা ছিল অপরিবর্তিত। ঐ নব্য মুৎসুদ্দি চরিত্রের প্রতিফলন পাওয়া যায় মহিমের মধ্যে। কৃষ্ণদয়ালের মধ্যে আছে কট্টর মানুষ, কট্টর হিন্দু। আবার ওদিকে পরেশ একজন উদার মানুষ। সেইসময়কার ব্রাহ্মদের মধ্যে যে কট্টরপন্থা ছিল, পরেশবাবুর মধ্যে সেটা নেই। তিনি নানা ধরনের বইপত্র পড়েন। গোরা তার বাড়িতে গেলে প্রথমে তার নজরে আসে পরেশবাবুর আলমারিতে থিওডোর পার্কারের বই, দেয়ালে চৈতন্যের ছবি, যিশুর ছবি। তিনি কোথাও উচ্চকণ্ঠে কথা বলেন না পুরো উপন্যাস জুড়ে। কিন্তু তার বাড়িতে নিয়মিত আসেন যেই ভদ্রলোক, হারান নাম, সেই হারান এবং পরেশের স্ত্রী বরদাসুন্দরী কট্টর ব্রাহ্ম। এত কট্টর যে, যা কিছু হিন্দু, যা কিছু ভারতীয় সমস্তকিছুকে তারা অগ্রাহ্য করেন, প্রত্যাখ্যান করেন। সুচরিতা বাবার দ্বারা খুব প্রভাবিত। তার মধ্যে একধরনের ব্রাহ্ম কট্টরতা ও হিন্দু আচারের প্রত্যাখ্যান থাকলেও সে তার হবু বর হারানের কট্টরপন্থাকে সমর্থন করে না। পরেশবাবুর দ্বিতীয় কন্যা ললিতা খুবই উচ্চকণ্ঠ মেয়ে। নিজের কথা লুকিয়ে রাখে না, বলে দেয় স্পষ্টাস্পষ্টিভাবে। এই উপন্যাসের একটা বৈশিষ্ট্য – ভাঙাগড়া। অন্ত্যজ চরিত্র যেমন নাপিত, নন্দ, মুসলিম ফলওয়ালা, তমিজ, ফরুসর্দার এরা বাদে উপন্যাসের প্রায় প্রতিটি চরিত্র কট্টর। উদার দুটি চরিত্র আনন্দময়ী এবং পরেশ বাদে আর প্রতিটি চরিত্রেরই ভাঙাগড়া আছে। প্রতিটি চরিত্রের এক অবস্থান থেকে আরেক অবস্থানে উত্তরন ঘটছে। এই উপন্যাসে দেখা যায়, কোনো চরিত্র একটা জায়গায় স্থিত না, ক্রমাগত ভাঙছে, গড়ছে। এভাবেই চরিত্রের ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে উপন্যাসটা এগোয়।

শুভপ্রসাদ বলেন, তার্কিকতার জায়গা থেকে এই উপন্যাসের আঠারো নাম্বার পরিচ্ছদ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কৃষ্ণদয়াল ও গোরার হিন্দুত্বের পার্থক্য দেখা যায়। কৃষ্ণদয়ালের হিন্দুত্ব শুধু আচার মানার মধ্যে, শাস্ত্র মানার মধ্যে। কিন্তু গোরার হিন্দুত্ব শুধু শাস্ত্র মানা এবং আচার মানায় না, তার সাথে এক্টিভিজম জড়িয়ে আছে, একটা দেশকে চেনা জড়িয়ে আছে, একটা জাতিকে চেনা জড়িয়ে আছে এবং সমাজকর্মের জায়গা জড়িয়ে আছে। গোরার হিন্দুত্ব কতটা ধর্ম হিসেবে আর কতটা জাতি হিসেবে সে প্রশ্নও আছে। এই ভূমিতে যারা আছে সবাইকে কি সে হিন্দু বলে ধরে নিচ্ছে? কারণ সে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মুসলিম ফলওয়ালাকেও অন্তর্ভুক্ত করে নিচ্ছে, নন্দকেও অন্তর্ভুক্ত করে নিচ্ছে। তার মানে শুধু উচ্চবর্ণের হিন্দুকেই সে হিন্দুত্বের মধ্যে দেখছে না, হিন্দুত্বকে বৃহত্তর অর্থে দেখছে। হিন্দু কি তার কাছে ভারতীয় অর্থে নাকি দেশের অর্থে? গোরার মতে, সনাতন আচার পালনের মাধ্যমেই সেটা হতে পারে, আচার ত্যাগ করে না। এই পরিচ্ছদে গোরার হিন্দুত্ব ও কৃষ্ণদয়ালের হিন্দুত্বের পার্থ্যক্য স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে। পরেশ-সুচরিতার ব্রাহ্মত্ব আর হারান-বরদাসুন্দরীর ব্রাহ্মত্বের তফাৎও খুব স্পষ্টভাবে এসেছে এই পরিচ্ছদে। একটা বড়ো ধরনের তাত্তি¡ক বিষয়ও চলে এসেছে এই পরিচ্ছদে। পুরোপুরি প্রাচ্য পরিহার ও ইউরোপকেন্দ্রিকতা এবং প্রাচ্য বন্দনা ও ইউরোপ পরিহার, এই উগ্রতার প্রেক্ষিতে তার্কিকতার জায়গাটা এই পরিচ্ছদে খুব বেশি করে উঠে এসেছে। এমনকি নাস্তিকতার যে উগ্রতার জায়গা সেটিরও ইঙ্গিত আছে এই পরিচ্ছদে। রামমোহনের আদর্শ ছিল – কোনো ধর্মমতই অভ্রান্ত না, আর রামকৃষ্ণের মতামত ছিল – যত মত তত পথ, সবগুলোই অভ্রান্ত, সবগুলোই গ্রহণ করো। এই যে দুধরনের ধর্মাদর্শ, তাদের যে বৈপরীত্ব সেটিও এই পরিচ্ছদে দেখতে পাই। আরো দেখতে পাই, সত্যকে কী করে দেখব, কোন পথে দেখব? সত্যকে কি শক্তির পথে দেখব নাকি সত্যকে শান্তির পথে দেখব? পরেশের পথ সত্যের কাছে শান্তির পথ ধরে যাওয়া, আর গোরার পথ শক্তির মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, গোরা ও ‘ঘরে বাইরে’র সন্দীপ দুজনের পথই শক্তির হলেও, সন্দীপ কিন্তু সৎ মানুষ না। অন্যদিকে গোরার সমস্ত চরিত্রগুলো নিজস্ব অবস্থানে সততা নিয়ে আছে।

ঊনবিংশ শতকের তার্কিকতা ঘিরে ‘গোরা’র গল্প আবর্তিত বলে এ পর্যায়ে আলোচক ঊনবিংশ শতকের ভাব আন্দোলন ও রাজনীতি, দেশ, জাতীয়তা, ধর্ম নিয়ে আলোচনা করেন। বৃটিশরা ভারতে আসার পর প্রথমে কোম্পানির শাসন, তারপর পুরোপুরি বৃটিশের শাসন। এতে ভারতীয় প্রতিক্রিয়া বা বাংলার প্রতিক্রিয়া কীভাবে হচ্ছে? এই পরিক্রমায় রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথে আসা যায়। কারণ ঐ সময়কালটা বুঝতে হলে পেছনে ফিরে দেখতে হবে। রামমোহনের জন্ম ১৭৭২ সালে। তিনি ১৮১৫ সালে কোলকাতায় আসেন সেরেস্তাদারির চাকরি ছেড়ে। এসে তাঁর অ্যাক্টিভিজম শুরু হয়। এই প্রথম একজন অ্যাক্টিভিস্টকে দেখা যায়। তাঁর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভবে জড়িত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। রামমোহন রায় কোলকাতায় এসে আত্মীয়সভা গঠন করেন একেশ্বরবাদ চর্চার জন্য। একইসঙ্গে তিনি হিন্দু ধর্মের সংস্কারের ব্যাপারে যুক্ত হন। হিন্দু ধর্ম সংস্কারের জন্য তিনি কোলকাতায় একটি একেশ্বরবাদী সমিতি করেন ১৮২৩ সালে, দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং উইলিয়াম এডামকে নিয়ে। ১৮২৮ সালে তিনি গঠন করেন ব্রহ্মসভা। রামমোহন রায় বিশ্বাস করতেন কোনো ধর্মই অভ্রান্ত না। তিনি এই দেশকে আবিষ্কার করা, এই জাতিকে আবিষ্কার করা নিয়ে ভাবতেন এবং বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে তিনি দেখেন যে, সাধারণ জায়গাটি হচ্ছে একেশ্বরবাদ। তাই তিনি চেয়েছেন একেশ্বরবাদের চর্চা হোক বিভিন্ন ধর্মে। চেয়েছেন বেদান্ত ভিত্তিক হিন্দু একেশ্বরবাদ, ইসলামের একেশ্বরবাদ, খৃষ্টধর্মের একেশ্বরবাদ এসবের চর্চা হোক এবং এর মাধ্যমে ঐক্য রচিত হোক। সেজন্য তিনি ব্রহ্মসভা করেন। ১৮২৯ সালে তিনি বিদেশে চলে যান। ১৮৩১ সালে একেশ্বরবাদী উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই উপাসনালয়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আসত, খৃষ্টানরা আসত, শ্বেতাঙ্গরা আসত, মুসলিমরা আসত। রামমোহন রায় বিদেশ চলে গেলে ব্রহ্মসভায় দুটো বিষয় ঘটে। রামচন্দ্র তর্কবাগীশ সব ধর্মকে অভ্রান্ত না-মানার জায়গা থেকে সরে এসে বেদান্তকে সর্বান্তভাবে অভ্রান্ত বলে মেনে নিয়ে ব্রহ্মসভার চর্চা বেদান্তভিত্তিক করে তোলেন এবং তিনি ব্রাহ্মসমাজের ধারণা নিয়ে আসেন। এদিকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৩৯ সালে তত্ত¡বোধিনী সভা করেন একেশ্বরবাদের ওপর ভিত্তি করে। এ দেশের বাঙালিদের খৃষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া ঠেকাতে তিনি তত্ত¡বোধিনী সভা করেন। এ পর্যায়ে তর্কবাগীশ ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যৌথ প্রয়াসে ব্রাহ্ম ধর্ম আসে। তাঁরা দেখেন, একটা আলাদা ধর্ম না করলে, কিছু আচার প্রতিষ্ঠা না করলে লোককে আটকানো যাবে না। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪৮ সালে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন। তত্ত¡ চর্চা, ধর্ম চর্চা, ধর্ম সংস্কার এসবের একটা বাতাবরণ দেখা যায় ঐ সময় জুড়ে। তখন অক্ষয়কুমার দত্ত এসে বোঝান দেবেন্দ্রনাথকে, বেদকে অভ্রান্ত বললে হবে না। এ সময় দেখা যায়, একেশ্বরবাদী খৃষ্টধর্মের সঙ্গে এক ধরনের ডায়ালগ শুরু হয়ে যায় নানাভাবে। তারপর ১৮৫৭ সালে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যুক্ত হন। তিনি অত্যন্ত ক্যারিশমাটিক এবং গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন। বৈষ্ণব পরিবারে জন্ম নেওয়া কেশবচন্দ্র সেন দারুণ বক্তা ছিলেন, নানাদিকে পাÐিত্য ছিল তাঁর। তিনি ব্রাহ্মসমাজে যুক্ত হওয়ার পর ব্রাহ্মসমাজকে স¤প্রসারণ ও নানা ধর্মের সঙ্গে ডায়ালগের জায়গায় নিয়ে যান। তিনি অ্যাক্টিভিজমের জায়গায় নিয়ে যান বিষয়টিকে। তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। এসব বলার কারণ, গোরা উপন্যাসে এই বিষয়গুলোর ছায়া আছে। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ব্রহ্মানন্দ উপাধিতে ভূষিত করেন ও ব্রাহ্মউপাসনা আচার্য বানান। উল্লেখ্য, কেশবচন্দ্র সেন প্রথম অব্রাহ্মণ আচার্য। যদিও ব্রাহ্মধর্মের লোকেরা হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা এসব মানতেন না কিন্তু তাঁরা বর্ণাশ্রম মানতেন। এবং অদ্ভুত ব্যাপার, ঠাকুর পরিবারেও কিন্তু নানা চর্চার যুগপৎ সহাবস্থান ছিল ঐ সময়টায়। ফলে এটাকে কেন্দ্র করে পুরনো ব্রাহ্মসমাজের মানুষের মধ্যে খুব একটা আপত্তির জায়গা ওঠে। কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম আন্দোলনকে নানা জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেন এবং তিনি সামাজিক সংস্কারের কাজ করতে গিয়ে একটা মিশনের মতো প্রতিষ্ঠা করেন। এইসমস্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে পুরোনো ব্রাহ্ম সমাজের লোকদের সঙ্গে কেশবচন্দ্র সেনের একটা দ্ব›দ্ব দাঁড়ায়। শুধুমাত্র বেদান্ত নির্ভরতার ব্যাপারটিকে নিয়েও দ্ব›দ্ব দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজ বিভাজিত হয়ে যায়। এটি ছিল আদর্শগত বিভাজন। দেবেন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্ম সংস্কারের পক্ষপাতি ছিলেন কিন্তু তাড়াহুড়োর পক্ষপাতি ছিলেন না এবং হিন্দু আর ব্রাহ্ম প্রতিপক্ষ দাঁড়াক সেটাও তিনি চাইতেন না। কিন্তু কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম আলাদা সত্তা, হিন্দু আলাদা সত্তা হিসেবে ভাবতেন। ফলে ব্রাহ্মকে হিন্দুর বাইরে গিয়ে আলাদা কিছু ভাবা এটা নিয়ে মতবিরোধ হয়। কেশব সেন অসবর্ণ বিয়ে দেওয়া, পৈতে ত্যাগ করা এ ধরনের সামাজিক সংস্কারের কাজেও হাত দেন। এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, অন্নদাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ব্রাহ্মণ হওয়া সত্তে¡ও পৈতে ছাড়েন। এসব নিয়ে বিরাট ধরনের বিতর্ক দাঁড়ায়। এ পর্যায়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গার সমস্ত কিছু গ্রহণ করে আত্মপ্রকাশ করে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ। আর অন্যদিকে রয়ে যায় আদি ব্রাহ্মসমাজ। অ্যাক্টিভিস্ট সব চলে যান ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে। তবে এ সময় কেশবচন্দ্র সেনের মধ্যে একটা অস্থিরতাও দেখা দেয়। তিনি ইংল্যান্ডে যান, খৃষ্টান ইউনিটারিয়ান চার্চের সঙ্গে, হিন্দু ধর্ম, মুসলিম ধর্ম, খৃষ্টান ধর্মের সঙ্গে ডায়ালগ করে এক ধরনের ধর্মবিশ্বাসের কথা ভাবেন। কিন্তু সমস্যার জায়গাটা হলো তিনি নিজেকে একজন প্রেরিত পুরুষ ভাবতেন। যে পৌত্তলিকতার বিরোধিতার জায়গা থেকে ব্রাহ্মসমাজের জন্ম, তিনি সেই নানা ধরনের পৌত্তলিকতার চর্চা শুরু করেন। ব্রাহ্মদের নিজস্ব বিবাহ বিধি, বিবাহ বিষয়ক সংস্কার ইত্যাদি অগ্রাহ্য করে কেশব সেন নিজের মেয়েকেই নাবালক অবস্থায় বিয়ে দেন কুচবিহারের মহারাজার সাথে। এ নিয়ে বিরাট হুলুস্থুল হয়। তখন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ভেঙে একদল বেরিয়ে গিয়ে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ গঠন করে। এই সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি ব্রাহ্মসমাজের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওদিকে কেশবচন্দ্র সেন নববিধান নাম দিয়ে নানা ধরনের পৌত্তলিকতা যেমন পতাকার পুজো, বিশেষ ধরনের চার্চ প্রতিষ্ঠা, দিন মানা, নানাধরনের আচার সংযুক্ত করেন। শেষ পর্যন্ত কেশব সেনের নববিধান এবং দেবেন্দ্রনাথের আদি ব্রাহ্মসমাজে হিন্দু পুনরুত্থানের নানা রকমের উপাদান যুক্ত হতে থাকে। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ খুব কট্টরপন্থার পাশাপাশি ধর্মতত্তে¡র চেয়ে সামাজিক কাজকর্ম যেমন স্কুল করা, শিক্ষার প্রসার করা ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করে। এখান থেকেই পরে ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সূচনা হয়। এবং এঁদের থেকেই সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় পরবর্তীতে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেন, এখান থেকেই অনেকে জাতীয়তাবাদের দিকে যান। ওদিকে নববিধান একটা ধর্মমতের মতো হয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, আর আদি ব্রাহ্মসমাজ দিনদিন ছোট হতে থাকে। এই পর্বের যে সার্বিক তার্কিকতা সেটাই ‘গোরা’ উপন্যাসে মধ্যে দারুণরকমভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

এ পর্যায়ে শুভপ্রসাদ বলেন, গোরা চরিত্রটা রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে মাথায় রেখে করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ব্রহ্মবান্ধবের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। ব্রহ্মবান্ধবের প্রকৃত নাম ছিল ভবানীচরন বন্দোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন একজন সংগ্রামী সাংবাদিক। তাঁর জীবনটা নানারকমের উথালপাথালের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ১৮৬১ সালে তাঁর জন্ম। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিনি কয়েক মাসের বড়ো ছিলেন। তিনি ছিলেন কেশবচন্দ্র সেনের শিষ্য ও স্বামী বিবেকানন্দের সহপাঠী। তিনি ছিলেন কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। ১৮৮১ সালে তিনি কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন অর্থাৎ তিনি নববিধানের পক্ষ নেন। এরপর তিনি সিন্ধু প্রদেশে যান ও সেখানকার ব্রাহ্ম স্কুলে শিক্ষকতা করেন। কেশবচন্দ্র সেন মারা যাবার পর তিনি ফিরে আসেন। তখন তিনি খৃষ্টান ধর্মের দিকে অনুরক্ত হন। প্রথমে অ্যাংগলিকান ও পরে ক্যাথলিক চার্চের দ্বারা দীক্ষিত হন। তখন তিনি তাঁর নাম বদলে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় নাম ধারণ করেন। তিনি সোফিয়া নামে একটা পত্রিকা বের করতেন করাচি থেকেই। নিজেকে পরিচয় দিতেন হিন্দু ক্যাথলিক বলে। তিনি আদি হিন্দু ধর্মের সমস্ত কিছু আচার মানতেন কিন্তু চিন্তায় ছিলেন ক্যাথলিক। তখন বিভিন্ন স্রোত প্রতিস্রোতের দ্ব›দ্ব-সংঘর্ষে এ ধরনের অদ্ভুত যোগসূত্র দেখা যেত। একসময় তিনি খৃষ্টধর্ম থেকে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে আসেন। তাঁর সাহচর্যে এসে রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত হন এবং হিন্দু ধর্মের আদি রূপটুকু তুলে ধরার বিষয়টি ভাবেন, যা আমরা গোরার মধ্যে দেখি। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবান্ধবকে নিয়ে এসে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করেন। ব্রহ্মবান্ধব ‘সন্ধ্যা’ নামে একটা পত্রিকা বের করতেন, যেটি খুব আউটস্পোকেন পত্রিকা ছিল। তাঁর মধ্যে স্বাদেশিকতা ছিল, স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন তিনি, আবার একইসঙ্গে ক্যাথলিক ছিলেন। ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় রবীন্দ্রনাথের মধ্যে গোঁড়া হিন্দুত্ব ছিল এবং বর্ণাশ্রমের ভিত্তিতে তিনি শান্তিনিকেতনে স্কুল স্থাপন করেন। কিছুদিন পর রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মবান্ধব পর্ব থেকে বেরিয়ে আসেন, মূলত স্বদেশী আন্দোলনের সময়। গোরা যেমন গ্রামে গিয়ে দেখে অন্ত্যজের প্রতি ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটা এবং তার মোহভঙ্গ হয়, ঠিক তেমনি রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলনের সময় গ্রামে গ্রামে প্রচার করতে গিয়ে বর্ণাশ্রমের ব্যাপারে তাঁর মোহভঙ্গ হয়। তিনি স্বদেশী আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসেন। এভাবে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ গোরা চরিত্রটা নির্মান করেছেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের আদলে। আবার কেউ বলেন, গোরার মধ্যে কিছুটা সিস্টার নিবেদিতাও আছে। সিস্টার নিবেদিতার স্বাদেশিকতার যে ধারা ছিল, সেটা ছিল প্রাচীন ভারতের হিন্দু ধর্মাশ্রিত স্বাদেশিকতা। রবীন্দ্রনাথের কাছে সিস্টার নিবেদিতা বেড়াতে যান শিলাইদহে। তখন রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতাকে ‘গোরা’ উপন্যাসের গল্পটা বলেছিলেন। উপন্যাসের গল্পের পরিসমাপ্তি পরিবর্তন করার জন্য সিস্টার নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন যে, সুচরিতা যেন গোরাকে গ্রহণ করে এবং রবীন্দ্রনাথ সেটা মেনে নেন।

গোরা আইরিশ হবার পেছনেও একটা কারণ আছে। ‘আত্মপরিচয়’ শিরোনামে, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে ১৯১২ সালের দিকে রবীন্দ্রনাথের একটা বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। সেই বক্তৃতা আর দেওয়া হয়নি। এটি পরে প্রবন্ধ আকারে বের হয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নে ইংলিশ ও আইরিশের প্রসঙ্গ আনেন। ভারতীয় বর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে ভিন্নধর্মীকে যেভাবে অচ্ছুৎ করে বাইরে রাখা হতো, সেটির তুলনা টানতে গিয়ে তিনি আইরিশ ও ইংলিশদের কথা বলেছেন। আইরিশদের সঙ্গে কোথাও একটা প্রতিতুলনা টেনেছেন মুসলিমদের। ওখানে রিসিভিং এন্ডে আছে আইরিশরা, এখানে রিসিভিং এন্ডে আছে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ, মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দেখা যায়, আয়ারল্যান্ডের বিপ্লববাদী কাজকর্ম ও ডি ভ্যালেরার প্রতি বিপ্লবীরা খুব শ্রদ্ধাপূর্ণ ছিলেন। বিপ্লবীদের কথায় আয়ারল্যান্ডের কথা ফিরে ফিরে আসতো। তাই গোরাকে আইরিশ করার ব্যাপারে এ বিষয়টাও হয়তো কাজ করেছে এবং হয়ত এতে সিস্টার নিবেদিতারও একটা ছায়া আছে। ওদিকে বিনয়ের মধ্যে আমরা রবীন্দ্রনাথকে কিছুটা খুঁজে পাই। আর পরেশের মধ্যে পাওয়া যায় দেবেন্দ্রনাথের ছায়া। দেবেন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের মানুষ হয়েও তাঁর খুব স্নেহ ছিল কেশবচন্দ্র সেনের প্রতি। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতি তাঁর আশির্বাদ ছিল, দুটো ব্রাহ্মসমাজকেই তিনি কিন্তু অর্থ সাহায্য করতেন। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ যখন প্রতিষ্ঠা হয় তখন তিনি আশির্বাণী পাঠিয়েছিলেন এবং ঠাকুর পরিবারের তরফ থেকে বারবার এই তিনটা ব্রাহ্মসমাজকে মেলাবার চেষ্টা হয়েছে। সমঝোতার যে ভাবাদর্শ দেবেন্দ্রনাথের, সেটা পরেশের মধ্যে দেখা যায়। আবার একইসঙ্গে পরেশের মধ্যে কেশবচন্দ্র সেনের প্রথম জীবনের কিছুটা ছায়া আছে। উপন্যাসে দেখি, থিওডোর পার্কারের বই রাখা আছে পরেশের বইয়ের আলমারিতে। আমরা জানি, থিওডোর পার্কারের লেখার দ্বারা ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা ভীষণরকমভাবে প্রভাবিত ছিল। সাধারন ব্রাহ্মসমাজ কেশবচন্দ্র সেনের প্রতি ক্ষিপ্ত হয় কারণ একটা সময় তিনি পৌত্তলিকতার দিকেও ঘুরে আসেন এবং হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতাকেও তিনি একেশ্বরবাদের সাধনার জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তখন বিভিন্ন ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা হয়েছিল। যেমন রাজনারায়ণ বসু আদি ব্রাহ্মসমাজের একজন কট্টর মানুষ, রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, তিনিই হচ্ছেন দ্বিজাতিতত্তে¡র প্রথম উদ্গাতা হিন্দুমালার মাধ্যমে। তাঁর কন্যার সঙ্গে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের একজনের বিয়ে হয়। সেই বিয়েতে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের লোকজন বলেছিল তারা কোনো ধরনের পৌত্তলিক আচার পালন করবে না এবং রাজনারায়ণ বসু তা মেনে নিতে বাধ্য হন। এইভাবে আদি ব্রাহ্মসমাজের বিয়েতে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা আসত কিন্তু পৌত্তলিক আচারে অংশ নিত না। এই যে মেলানোর একটা চেষ্টা হতো, এটা হারান চরিত্রের মধ্যে দেখা যায়।

ভারতের সা¤প্রতিক কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে ‘গোরা’র যোগসূত্র এবং যোগসূত্রের তাৎপর্য প্রসঙ্গে আলোচক বলেন, ভারতীয় কৃষক আন্দোলনটিকে ঠিক কৃষক আন্দোলন বলা যায় না। দেখতে হবে আন্দোলনটি কখন হচ্ছে ভারতবর্ষে এবং সেজন্য ফিরে তাকাতে হবে ১৯৪৭ এর সময়কার ভারতবর্ষকে। ১৯৪৭ এ যখন দেশ ভাগ হওয়া মোটামুটি স্থিরীকৃত হয়ে যায়, ভারত এবং পাকিস্তানের জন্য দুটো সংবিধান গণপরিষদ তৈরি হয় তখন প্রশ্ন ওঠে, দেশ ভাগ মানে কি মুসলমানদের একটা দেশ আর হিন্দুদের একটা দেশ? আসে দ্বিজাতিতত্তে¡র কথা। তবে দ্বিজাতিতত্তে¡র একটা পূর্বসুর আছে। ১৯০৮ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাস লিখছেন সেই সময়পর্বে ভাই পরমানন্দ নামে আর্য সমাজের এক নেতা বলেছিলেন, ভারতকে দুই ভাগে ভাগ করা উচিত, হিন্দু ভারত ও মুসলিম ভারত। সিন্ধু নদীর পশ্চিম তীরটা মুসলিম ভারত হবে আর সিন্ধু নদীর পূর্ব তীরটা হবে হিন্দু ভারত। এই পারের সব মুসলিম যাবে ঐপারে এবং ঐপারের সব হিন্দু আসবে এই পারে। ১৯২৫-২৬ সালে লালা লাজপৎ রায় আবার বলেন, ভারতকে দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। একটা হিন্দু ভারত, আরেকটা মুসলিম ভারত। সব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ নিয়ে হবে মুসলিম ভারত। পাঞ্জাব ও বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করা হবে: হিন্দু পাঞ্জাব ও মুসলিম পাঞ্জাব, হিন্দু বাংলা ও মুসলিম বাংলা। সমস্ত মুসলিম ভারতীয় চলে যাবে মুসলিম ভারতে আর হিন্দু ভারতীয়রা যাবে হিন্দু ভারতে। ১৯৩৯ সালে যখন দ্বিজাতিত্তত্ব আসে, পাকিস্তান দাবি আসে, তখন জিন্নাহ বলেন, দেশ দুটো ভাগ হবে, একটা হবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে। জিন্নাহর ‘জিম্মি তত্ত¡’ বিখ্যাত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একটা দেশ পাকিস্তান আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আরেকটা দেশ হিন্দুস্তান। পাকিস্তানের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা হিন্দুস্তানের মুসলিমদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে এবং হিন্দুস্থানে হিন্দুর সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাকিস্তানের হিন্দুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে। এটাকে ‘হোস্টেজ থিওরি’ বা ‘জিম্মি তত্ত¡’ বলা হয়। একটা দেশের সংখ্যালঘু আরেকটা দেশের সংখ্যাগুরুর কাছে জিম্মি থাকছে।

দেশভাগের সময় গণপরিষদে বিতর্কে কেউ বলেছেন হিন্দু ভারত করতে, মানে মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হোক বা মুসলিমরা সবাই এখান থেকে চলে যাক এবং এটা একটা হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠুক। এটাই সংবিধান গণপরিষদে প্রাধান্য বিস্তারকারী বক্তব্য ছিল মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু পর্যন্ত। মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর বিতর্কটা পুরো পালটে যেতে দেখা যায়। তখন বিতর্ক হয় – ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হবে, সমস্ত স¤প্রদায়ের দেশ হবে। কারণ মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু ভারতবর্ষের সা¤প্রদায়িকতার রাজনীতিকে বিরাট ধাক্কা দেয়। মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর আগে ভারতবর্ষে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করলে পুরষ্কার দেওয়া হবে প্রকাশ্যে বলা হতো এবং এক শ্রেণির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদরা মহাত্মা গান্ধীকে খুন করার পর সারাদেশে মিষ্টান্ন বিতরণ করেছিল। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী খুন হওয়ার পর দেখা যায়, ভারতবর্ষের মানুষ তাকে কতটা ভালোবাসে। বিভিন্ন জায়গায় যে প্রতিক্রিয়া হয় সেই প্রতিক্রিয়ার ফলে ভারতের সংবিধান গণপরিষদ ঠিক করে দেশটা হবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত এবং সেটা হবে সমস্ত স¤প্রদায়ের ভারত। জিন্নাহর সংবিধান গণপরিষদের বক্তব্যও এর দ্বারাই প্রভাবিত এবং লিয়াকত আলি খানও বুঝেছিলেন, কী ভয়ঙ্কর অবস্থা হচ্ছে হিন্দুস্তান-পাকিস্তান করতে গিয়ে, লাখে লাখে মানুষ মরছে। এখান থেকে ভারতবর্ষ একটা সিদ্ধান্তে আসে – we are opting for a republic, a secular republic. সাংবিধানিক গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, যাকে বলা হয় নেহরুভিয়ান সোশ্যালিজম বা নেহরুভিয়ান কাঠামো। ২০১৪ সালে ভারতের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে এই কাঠামোটা চ্যালেঞ্জড হয়। আস্তে আস্তে ২০১৯ এর পর, ভারতের রাজনীতিতে ঠিক যেভাবে নিওলিবারেল বা নয়া উদারবাদী অর্থনীতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, একইসঙ্গে ভারতের সেক্যুলার রিপাবলিকের কাঠামো একে একে ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং তার সঙ্গে এসেছে ভারতের কৃষি ব্যবস্থার ওপর আক্রমণ। তিনটি কৃষি আইন এনে ভারতের কৃষক না, পুরো কৃষিই বিপন্ন করা হয়েছে। ফলে এই কৃষি রক্ষার লড়াই আর ভারতের রিপাবলিক রক্ষার লড়াই এক হয়ে যায়। ভারতবর্ষের রিপাবলিক ভাঙার পক্ষে যেই যুক্তিগুলো আনা হচ্ছে, সেখানে সেই ঊনবিংশ শতকের হিন্দু পুনরুত্থানবাদী বিতর্ক এবং ৪০ এর দশকে দেশে দ্বিজাতিতত্ত¡ আসার পর পাকিস্তানের দাবি শক্তিশালী হলে কংগ্রেসের ভেতরে গড়ে ওঠা উগ্র হিন্দুত্ববাদী চক্র যেই কথাবার্তা বলত, হিন্দুত্বের কথা, সেই বিতর্কগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে? সেই বিতর্কগুলো এসে এখন ভারতবর্ষের একটা রাষ্ট্রীয় ভাষ্য হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তায় এখন আবার ভারতবর্ষে এই কথাটা ফিরে এসেছে: Whatever is Hindu is Indian and whatever is not Hindu is not Indian. রবীন্দ্রনাথের গোরা যেই হিন্দুত্বের কথা বলছে, আর সাভারকরের যেই হিন্দুত্ব সেটি এক না। কে হিন্দু প্রশ্নে গোরা বলছে, ভারতের এই পরিকাঠামোর মধ্যে যারা আছে সবাই হিন্দু। আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় পাই – ‘কেহ নাহি জানে কার আহŸানে কত মানুষের ধারা, দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা। পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার, দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে। তপস্যাবলে একের অনলে বহুরে আহুতি দিয়া, বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া।’ অর্থাৎ নানা লোক যুগ যুগ ধরে এসে একটা জাতি গড়ছে। কেউ এখানে ‘আদার’ বা ‘অপর’ না। সবাই এখানে আত্ম’র মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। কিন্তু ভারতবর্ষের নতুন শাসনতন্ত্রে হিন্দুত্বের সংজ্ঞা কী? এই হিন্দুত্ব গোরার হিন্দুত্ব না। কিংবা গোরা শেষমেষ আনন্দময়ীর মধ্যে যেটা দেখছে সেই হিন্দুত্ব না। এখন বলা হচ্ছে – ভারতকে যারা শুধু জন্মভূমি না, ভারতকে যারা পুণ্যভূমি ভাবে তারাই শুধু ভারতীয়। অর্থাৎ মক্কা বা ভ্যাটিকানকে পুণ্যভূমি ভাবলে সে ভারতীয় না, সে হিন্দু না। ভারতবর্ষে কারা হিন্দু? যারা ভারতবর্ষকে একইসঙ্গে জন্মভূমিও ভাবে, পূণ্যভূমিও ভাবে। যা যা হিন্দুরা করে সেটাকে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়েই সবাইকে এই দেশের জাতীয়তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এই যে নতুন করে জাতীয়তার সংজ্ঞায়ন হচ্ছে হিন্দু ধর্মের ভিত্তিতে, সেইখানে দাঁড়িয়ে কৃষক যখন আন্দোলন করছে, সে কিন্তু তখন দেখছে, তার কৃষিকে রক্ষা করার লড়াই আর ভারতবর্ষকে রক্ষা করার লড়াই একাকার হয়ে গেছে। সেজন্যেই সে ‘গোরা’র মাধ্যমে নিজের দেশকে আবিষ্কার করছে। কারণ কৃষিকে রক্ষা করতে হলে তাকে এই ব্যবস্থাটার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ফলে আজকে যে কৃষক আন্দোলন হচ্ছে সেটা কিন্তু কৃষক আন্দোলন শুধু না, সেখানে আজ ‘গোরা’ যেমন ফিরে এসেছে, তেমনি রামপ্রসাদ বিসমিল ফিরে আসছেন। সেই বিক্ষোভে শিখ কৃষক ছাড়াও ফকিররা আসছে, আর্য সমাজের ভিন্ন ধারার সাধুরা আসছে, নানা ধর্মের মানুষ আসছে। ফলে এই আন্দোলনটা আসলে What India was and what India should be সেটি প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই এবং what India should not be সেটি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই। সেজন্যেই ‘গোরা’ আজকের কৃষক আন্দোলনে প্রাসঙ্গিক হয়েছে।

‘গোরা,’ ‘ঘরে বাইরে,’ ‘চার অধ্যায়’ এই উপন্যাসত্রয়ীর আন্তঃযোগাযোগ প্রসঙ্গে শুভপ্রসাদ বলেন, ‘গোরা’র পর ‘ঘরে বাইরে’ লেখা। গোরা শেষ হচ্ছে সবার ভারতবর্ষে গিয়ে, যেখানে কেউ ‘অপর’ নেই। সবাইকে ‘আত্ম’র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা। একটা অন্তর্ভুক্তির আদর্শের ভারত যেটা রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ কবিতায় আছে। এই কবিতায় আমরা ‘গোরা’ উপন্যাসের শেষটা খুঁজে পাই। ১৯০৭ এ রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলন থেকে বেরিয়ে এসে যখন ‘গোরা’ লিখছেন, তখন তিনি একটা ইনক্লুসিভ ভারতবর্ষের কথা ভাবছেন। কারণ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে গিয়ে তিনি দেখেন, আমরা বাইরের মিলনটা করতে চাইছি, ভেতরের মিলন করিনি। সেখান থেকে সূত্র নিয়ে উনি ‘ঘরে বাইরে’ লিখেন, যেখানে ইনক্লুসিভ ভারতবর্ষ থেকে বেরিয়ে উনি জাতীয়তার চেয়ে ঊর্ধ্বে স্থান দিচ্ছেন মানবতাকে, সভ্যতাকে, সত্যকে, জীবনের বৃহত্তর সত্যকে। ‘ঘরে বাইরে’ এসেছে ‘গোরা’র ধারাবাহিকতায়। ‘ঘরে বাইরে’তে সশস্ত্র বিপ্লবপন্থার অসহিষ্ণুতার একটা দিক আছে। উল্লেখ্য, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় যেমন গোরায় আছে, তেমনি চার অধ্যায়ের ইন্দ্রনাথেও আছে। বিনয় যেমন গোরাকে সমর্থন করে কিন্তু গোরার সঙ্গে সববিষয়ে এক হয় না, অর্থাৎ গোরার মতকে মানে, পথকে না। ব্রহ্মবান্ধব পর্বে রবীন্দ্রনাথের জায়গাটাও এটাই ছিল। তিনি ব্রহ্মবান্ধবের মতকে মানতেন, পথকে না। প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার জাগরণের কথা রবীন্দ্রনাথ সেই পর্বে ভাবছিলেন কিন্তু তিনি পন্থা মেনে নিতে পারছিলেন না। স্বদেশী আন্দোলনে গিয়ে তাঁর মোহভঙ্গ হয় এবং তিনি ব্রহ্মবান্ধব পর্ব থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসেন। আসলে, শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র বিপ্লববাদ তো মুষ্টিমেয়তন্ত্রের কথাই বলে। ফলে এই তিনটি উপন্যাস মিলে একটা জায়গায় দাঁড়ায়। ‘গোরা’র গোরা মানুষটা কিন্তু সৎ কিন্তু ‘ঘরে বাইরে’র সন্দীপের সততার যে ভান সেটা উন্মোচিত হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘গোরা’তে মনে হচ্ছে, অন্তর্ভুক্তি যদি আমরা সম্পন্ন করতে পারি, তবে জাতীয়তাবাদের ইতিবাচকতা আছে। জাতীয়তাবাদ একটা ইতিবাচক ভূমিকায় দাঁড়াবে, জাতীয়তাবাদ একটা মুক্তির পথ দেখাবে। কিন্তু ‘ঘরে বাইরে’তে গিয়ে উনি দেখতে পাচ্ছেন, জাতীয়তাবাদ শেষ পর্যন্ত পশুত্বের দিকে নিয়ে যায়। ‘ঘরে বাইরে’তে শক্তির ইঙ্গিত আছে যা শেষ পর্যন্ত সত্যের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ায়, সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, যা ‘ঘরে বাইরে’র চন্দ্রনাথ চরিত্রের মুখে বারবার ফিরে আসে এবং নিখিলেশের কথার মধ্যেও ফিরে আসে। ১৯০৭-০৯ সময়ে ‘গোরা’র রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘ঘরে বাইরে’তে গিয়ে জাতীয়তাবাদের ভেতরের সমস্যাটুকু অনুধাবন করেছেন। মানে গোরা যদি তার অবস্থানেই থাকে তাহলে কিন্তু সে সন্দীপ হয়ে যাবে। আর গোরা যদি ওখানে না থাকে, তবে তাকে নিখিলেশ হতে হবে। কারণ নিখিলেশের মধ্যে গরিব মুসলিম চাষাদের জন্য দুঃখ আছে, স্বদেশকে জাগানোর কথা আছে। অর্থাৎ ‘গোরা’ থেকে ‘ঘরে বাইরে’তে রবীন্দ্রনাথের আরেকটা অতিক্রমণ হচ্ছে। পরে এর থেকেও আরো উত্তরণ ঘটে জীবনের শেষদিকে। তিনি এক জায়গায় বলেছিলেন, আমাকে একটা জায়গায় স্থির করে রেখো না। কাজেই গতিধারার সমগ্র নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে হবে, সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে দেখতে হবে।
গোরা, ঘরে বাইরে, চার অধ্যায় – এই উপন্যাস তিনটির বাইরে চতুরঙ্গ উপন্যাসে দেখি, ঠাকুরদা ঈশ্বরকে অস্বীকার করছেন। তিনি বলছেন, যদি ঈশ্বর থাকে তো উনিই আমার ভাবনাচিন্তা তৈরি করেছেন। সেই ভাবনাচিন্তা দিয়েই দেখছি ঈশ্বর নেই। মানে ঈশ্বরই ঠিক করে দিচ্ছেন, ঈশ্বর নেই।
এরকম একটা নাস্তিকতার জায়গাও আমরা চতুরঙ্গে দেখি। আবার রবীন্দ্রনাথকে শুধুমাত্র উপন্যাসে না রেখে অন্য সৃষ্টিতে গেলে দেখা যায়, তিনি বঙ্কিমের বন্দে মাতরম সুর করেছেন। উল্লেখ্য, রামমোহন রায়ের ঈশ্বর ঠিক গাছের তলায় বা গুহায় বসে সাধনা করে পাওয়া না, তাঁর ঈশ্বর জ্ঞানের দ্বারা পাওয়া, জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জিত ঈশ্বর। রামমোহনের ঈশ্বর কোনো প্রার্থনা চান না। ঈশ্বর তাঁর কাছে সবসময় ‘তিনি’। ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে তিনি ডাকছেন সহপথিক ভারতবাসীকে, দেশকে দেখছেন, দেশকে উন্নত করা, ধর্ম সংস্কার করা ইত্যাদি ভাবছেন। ঈশ্বর আমাকে সুকৃতি দেবেন, আমার মঙ্গল করবেন, সেটা না। এটা পরবর্তীতে পালটে যায়। বঙ্কিমচন্দ্রে এসে দেখছি, দেশ আর প্রতিমা এক হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলছেন, ‘তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।’ রবীন্দ্রনাথও প্রথম অবস্থায় বন্দে মাতরমের সুর করেন। কিন্তু পরে তিনি এখানটায় থাকেননি। তিনি দেশকে দেখেন ঘরের মা’য়ে। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের পরতে পরতে আমরা ঘরের মা’কে পাই। পরবর্তীতে দেশ হয়ে ওঠে বিশ্ব মা – ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা। তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।’ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেন, ‘সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি’। এই যে জাতীয়তাবাদ যেখানে আমার দেশকে সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হতে হবে, সারা পৃথিবী এর প্রজা হবে। রবীন্দ্রনাথ এর উত্তরে বলছেন, ‘জানি নে তোর ধনরতন, আছে কিনা রানীর মতন। শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে।’ অর্থাৎ মা তো মা। তাকে ভালোবাসতে হলে তাকে রানি হতে হবে না। ঐখান থেকেও তিনি বেরিয়ে এসে বলছেন, ‘হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’ সেই মানুষটাই বলছেন, ‘বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে’ কিংবা ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।’ এবং সবশেষে বলছেন ‘ঐ মহামানব আসে।’ তখন কিন্তু দেশ, জাতি নেই। এই মহামানব কোনো মানুষ না। এটা একটা মানব দল, এটা একটা বিপ্লবাত্মক কথা। এই মহামানব অবতার না। এখানে বলা হচ্ছে মানব অভ্যুদয়ের কথা। রবীন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রনাথ, কেশব সেন, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ হয়ে আবার রামমোহনেই ফিরে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে কোনো বিশেষ ধর্মের স্থান নেই কিন্তু একেশ্বরের সাধনা আছে। ওখানে সব ধর্মের উৎসবই পালিত হয়।

এই পর্যায়ে আলোচক ‘গোরা’ উপন্যাসে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’ গানটির কথা উল্লেখ করে বলেন, এটা কি শুধুই একটা আবহসঙ্গীত? এই গানটাকেও বরং উপন্যাসের একটা চরিত্র ধরা যায়। কেন? যখনই বিনয়ের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ আসছে, এই গানটা তার মনে হচ্ছে। ঊনবিংশ শতকের নবজাগরনের আন্দোলন শুধু কোলকাতা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না। আবুল হাসান চৌধুরী বলছেন, কোলকাতা শহরে যখন নবজাগরণ আন্দোলন হচ্ছে, তখন সমান্তরালে গ্রামবাংলায় একটা নবজাগরণ হচ্ছিল কুষ্টিয়ায় লালন সাঁইয়ের নেতৃত্বে এবং এই দুটো নবজাগরণ একটা আরেকটার খবর জানতো না। শুধু একজন জানতেন এই দুটোর খবর। তিনি রবীন্দ্রনাথ। তিনি দুটোর সেতু ছিলেন। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানটির মাধ্যমে গোরায় তিনি একটি অনুপস্থিত সংলাপ ধরিয়ে দিয়েছেন, অন্ত্যজদের কণ্ঠও। লালনের গানের একটা পদ আছে – অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই। এই কথাও গোরার এক সংলাপে আছে, সাকার এবং নিরাকারের তর্কে। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলো বিষয় ভেঙেছেন। কোলকাতার উচ্চবর্ণের পরিসর থেকে ভেঙে গোরা শহরবাসী অন্ত্যজ নন্দর কাছে গেছে, গ্রামবাসী অন্ত্যজ হিন্দু নাপিত, শহরের মুসলিম ফলওয়ালা থেকে গ্রামের মুসলিম পর্যন্ত গেছে। এবং এই গান দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কোথাও একটা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ঐটা যখন কোলকাতা শহরে ঘটছে একইসঙ্গে কুষ্টিয়াতেও একটা ঘটনা ঘটছে। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৭ এ যখন ‘গোরা’ লিখছেন তখন উনি পূর্ববাংলার ব্যাপারটা জানতেন। তাই তিনি সব ভাব আন্দোলনকে ‘গোরা’য় এনেছেন। কিন্তু লালন সাঁই এর ভাব আন্দোলনকে তো কোলকাতার উচ্চমধ্যবিত্তের বাড়ির বিতর্কে আনা যায় না। এজন্য ব্যাপারটাকে একটা আবহসঙ্গীত হিসেবে নিয়ে এসেছেন। না হয় এই গানকে আবহসঙ্গীত হিসেবে আনার অন্য কোনো কারণই নেই। এছাড়াও, এই উপন্যাসে বারবার অন্ধকার আসে। গোরার যখন সুচরিতার জন্য প্রেম জাগছে, তখন সে গঙ্গার অন্ধকারে দাঁড়াচ্ছে, সুচরিতাও গোরার প্রেমে পড়ে অন্ধকারে দাঁড়াচ্ছে, বিনয়ও অন্ধকারে দাঁড়াচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ এই প্রাকৃতিক অন্ধকারের কথা বলতেন। ঔপনিবেশিক শহর কোলকাতার আলো থেকে তিনি শিলাইদহে যখন যান, তখন অন্ধকারকে মায়ের মতো দেখছেন। গানে পাই –
‘সন্ধ্যা হল গো ও মা, সন্ধ্যা হল, বুকে ধরো। অতল কালো স্নেহের মাঝে ডুবিয়ে আমায় স্নিগ্ধ করো।’

‘গোরা’য় নারীবাদ প্রসঙ্গে আলোচক বলেন, ‘গোরা’য় রবীন্দ্রনাথ দেখিয়ে দিচ্ছেন আমাদের জাতীয়তাবাদের নির্মাণে কোথাও একটা অসম্পূর্ণতা আছে। মেয়েরা প্রচ্ছন্ন থাকায় স্বদেশ অর্ধসত্য হয়ে আছে। নারীকে সর্বত্র অনুগামিনী করে রাখা হচ্ছে। অনুগামিনী না করে তাকে নিজের ভাষা দিতে হবে। ‘ঘরে বাইরে’তে বিমলাও যখন নিজের ভাষা নিতে চায় তখন সন্দীপ সেটা মেনে নিতে পারে না। সন্দীপও বিমলাকে তার অনুগামিনী করতে চায়। গোরা, ঘরে বাইরে ও চার অধ্যায় উপন্যাসে আমরা ব্যক্তিস্বাত্যন্ত্রে পূর্ণ সবল নারী চরিত্রের দেখা পাই এবং তিনটি উপন্যাসেই নারী-পুরুষের মাত্রিক সম্পর্কের সাহসী উচ্চারণ পাই। ‘গোরা’য় আনন্দময়ী, সুচরিতা, ললিতা অর্থাৎ শুধু নারী চরিত্র না, পরেশ, বিনয়ও নারী বিষয়ে অগ্রসর ধারণা রাখেন এবং গোটা উপন্যাসটার সুরেই এক ধরনের নারীবাদ আছে। ‘গোরা’য় গোরা শুরুতে যেভাবে নারীকে দেখে ঠিক একইভাবে আমরা আজকের পৃথিবীর সর্বত্র মৌলবাদীদের নারী সম্পর্কে ভাবতে দেখি। নারী মুখর হওয়া মানেই এক ধরনের উশৃঙ্খলতা। কিন্তু গোরার উত্তরণও ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে উপন্যাসে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত উপন্যাসে যেভাবে নারী চরিত্রের চিত্রায়ন হয়েছে, সে কারণেও গোরা আজও প্রাসঙ্গিক। আবার ‘ঘরে বাইরে’তে জাতীয়তাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেজন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে রবীন্দ্রনাথ প্রায় দেশদ্রোহিতার আখ্যা পেয়ে যান। তিনি ‘চার অধ্যায়,’ ‘ঘরে বাইরে’ দুটোর জন্যই নিন্দিত, সমালোচিত হয়েছিলেন।

গোরার ভাষা, আঙ্গিক, শৈলী নিয়ে শুভপ্রসাদ বলেন, উপন্যাসের শুরুটা প্রায় ফিল্মের মতো। একটা গান, একটা কর্মচঞ্চল শহর, একটা অ্যাক্সিডেন্ট। এবং এর মাধ্যমে শুধু দুটো পরিবার না, দুটো মতের ধারা মিলিত হচ্ছে। উপন্যাসে দুর্ঘটনাগুলো যেভাবে এসেছে এবং সেগুলো যেইভাবে বাঁক বদল করেছে, সেটা শৈলীর দিক থেকে চমকপ্রদ। শুরুতে পরেশবাবুদের গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট, সেখান থেকে শুরু করে মুসলিম ফলওয়ালার অ্যাক্সিডেন্ট, তারপর নন্দর অপঘাতে মৃত্যু, ত্রিবেণীতে যাবার পথে লঞ্চ থেকে মানুষ পড়ে যাওয়ার ঘটনা এবং সবশেষে গোরার আত্মপরিচয় জানা – এই সমস্তকিছু একটা পর্বান্তর ঘটিয়ে দেয়। এই উপন্যাসে লেখক আছেন কিন্তু লেখক নেইও। প্রতিটি মত সত্য জ্ঞান করে, সততার সঙ্গে উপস্থাপিত হচ্ছে, কোনোটার প্রতি পক্ষপাত করা হচ্ছে না। এটি উপন্যাসের আরেকটা অভিনব দিক।

রবীন্দ্রনাথ ‘আত্মপরিচয়’ প্রবন্ধে বলেছেন, একদিন তো এমনও হতে পারে, একটা পরিবারে একটা সন্তান হয়ত ব্রাহ্ম, একটা সন্তান হিন্দু, একটা সন্তান মুসলিম, একটা সন্তান খৃষ্টান। বহু ধরনের বিশ্বাস নিয়ে একটি পরিবার। ‘গোরা’ উপন্যাসে এটা বারবার ঘটেছে। যেমন কৃষ্ণদয়ালের নৈষ্টিক ব্রাহ্মণ পরিবারে এক আইরিশ ছেলে, হিন্দু নাপিতের ঘরে এক মুসলিম সন্তান। আবার ওদিকে ব্রাহ্ম ও হিন্দুর বিয়ে, ললিতার সঙ্গে বিনয়ের। কী মতে হবে? মতটাকে বড়ো না করে মানুষটাকে বড়ো করা, ধর্মবিশ্বাসের চেয়েও মানুষকে বড়ো করে দেখা, মতাভিমতের চেয়েও মানুষকে বড়ো করে দেখা – উপন্যাসের প্রধান সুরটা এখানেই, যেখানে শেষ পর্যন্ত মানুষগুলো বড়ো হয়েছে। প্রতিটি চরিত্র তার মতামতগুলোকে তুলে ধরার পরও কিন্তু মানুষগুলোকে উপেক্ষা করা হয়নি। মানুষগুলোর প্রতি লেখক সহৃদয় থেকে গেছেন, তাদের মতামত যাই থাক। এবং শেষে দুই ভিন্ন ধর্মের দুই জুটি সুচরিতা-গোরা ও ললিতা-বিনয়ের সম্পর্কের পরিণতির মধ্য দিয়েও মতের চেয়ে মানুষই বড়ো হয়েছে। ব্রাহ্মসমাজে বিয়ের আচারের কারাগার এবং তার থেকে মুক্তিও এই উপন্যাসে এসেছে। চরিত্রগুলো ধীরে ধীরে ভেঙে শেষে প্রেমে এসেছে, গোরা যেমন শক্তি থেকে প্রেমে এসেছে। ভারততীর্থ কবিতায় পাই – ‘এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।’

সবশেষে আলোচক শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার বলেন, ঊনবিংশ শতকে রামমোহন রায়ের সময় থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যে কোলকাতা, এই কোলকাতায় যে বিভিন্ন ভাব আন্দোলন, বিভিন্ন মতবাদ, মতধারা, তার মধ্যে যে স্রোত প্রতিস্রোত, ঘাত প্রতিঘাত তার প্রকৃত অনুসন্ধান এবং প্রকৃত অবগাহন আমাদের কিন্তু আজও হয়নি। আজকেও বিশ্বসাধনার কোনো পটভূমি এই বাংলায়, দুই বাংলায়, এই ভারতে, দক্ষিণ এশিয়াতে, এই উপমহাদেশে যদি করতে হয় তবে ঐ ঊনবিংশ শতকের কাছেই ফিরে যেতে হবে আমাদের। কেরালাতে কিছুদিন আগে সবরীমালা মন্দিরে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নিয়ে একটা বড় ধরনের অশান্তি হয়। তখন সেখানকার প্রগতিশীল লোকেরা ফিরেছেন ঊনবিংশ শতকের বিতর্কে। এর মাধ্যমে তাঁরা সমকালকে দেখতে চেয়েছেন। আমাদেরকেও, আজকের বাংলাকে, বাংলাদেশের বাংলাকে, শাহবাগের বাংলাকে, কোলকাতার বাংলাকে সব বাংলাকে যদি আরো গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হয়, তাহলে ঊনবিংশ শতককে আমাদের আরো নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান করতে হবে।

আমরা জানি, “গোরা” উপন্যাসের আবহ মোটেও ক্ষণজন্মা নয়। এখনো সেটি প্রাসঙ্গিক এবং এখনো অনেকক্ষেত্রে তা বিস্ময়করভাবে সাযুজ্যপূর্ন। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘এ বিশাল সৃষ্টির পর রবির বাকি সৃষ্টি অনেক বেশি খর্ব দেখায়, বেশি অপূর্ন লাগে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত পাঠশালার এই আয়োজনে রবীন্দ্রনাথেরই একটি অন্যতম সৃষ্টি ‘গোরা’ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে স্মরণ করা হয় তাঁকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে নিবেদিত পাঠশালার আসরে আলোচক শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের গভীর ও তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা দর্শক-শ্রোতারা ভীষণ উপভোগ করেছেন এবং প্রশ্ন-মন্তব্য করে সক্রিয় থেকেছেন আলোচনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

এই আসরের পরিকল্পনা ও সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।

Exit mobile version