অনলাইন ডেস্ক : গত সপ্তাহে পরিসংখ্যান কানাডা থেকে প্রাপ্ত নতুন তথ্যে দেখা গেছে যে, দেশটিতে জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কানাডার পরিসংখ্যান বিভাগ জানিয়েছে, চলতি বছরের জুনে ভোক্তা মূল্যসূচক বেড়ে আট দশমিক এক শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মে মাসে মূল্যস্ফীতির এই হার ছিল সাত দশমিক সাত শতাংশ। ১৯৮৩ সালের পর এটাই কানাডার মূল্যস্ফীতিতে বড় পরিবর্তন।

তবে সতর্ক কিছু আশাবাদেরও কারণ রয়েছে। আর সেটি হল কানাডা হয়তো মূল্যস্ফীতির চূড়ান্ত পর্যায় অতিক্রম করছে।
পরিসংখ্যান কানাডার মতে, খাদ্যের দাম স¤প্রতি শ্বাসরুদ্ধকর গতিতে বেড়েছে, গত বছরের তুলনায় যা ৮.৮ শতাংশ বেশি। তবে এটি আসলে আগের মাসের মতো বৃদ্ধির একই বার্ষিক গতি। তাছাড়া মুদি দোকানের পণ্যেগুলোর দাম মে মাসে যে অবস্থানে ছিল সেখান থেকে প্রকৃতপক্ষে কম ছিল। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে দামের এমন অবস্থান এটিই প্রথমবার প্রত্যক্ষ করেছে কানাডা।
মাংসের খুচরা মূল্য এপ্রিলের তুলনায় এখন কম, এবং জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস অনুসারে ফল ও সবজির দাম টানা দুই মাস ধরে কমেছে। এর প্রভাব সামগ্রিকভাবে বোঝা না গেলেও কিছুটা স্বস্তি পেতে শুরু করেছেন কানাডিয়ানরা।

হ্যালিফ্যাক্সের ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির খাদ্য বিতরণ ও খাদ্য নীতির অধ্যাপক সিলভাইন শার্লেবোইস বলেছেন, “আমি আসলে মনে করি যে আমরা খাদ্য মূল্যস্ফীতির টানেলের শেষ প্রান্ত দেখতে শুরু করছি। আপনি অনুভব করতে পারেন যে আমরা জুন মাসে বা তারও আগেই মূল্যস্ফীতির শীর্ষে পৌঁছেছি। খাদ্যের দাম বাড়বে, তবে যে গতিতে দাম বাড়ছে তা ২০২২ সাল শেষ হওয়ার সাথে সাথে ধীর হয়ে যাবে।

যদিও এটা বিশ্বাস করা কঠিন, স্ট্যাটিস্টিক্স কানাডার হিসাব মতে- পুরুষের পোশাক, গাড়ির বীমা, কম্পিউটারের মতো ডিজিটাল সরঞ্জাম এবং নন-অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়ের মতো বৈচিত্র্যময় পণ্য এবং পরিষেবা মে মাসের তুলনায় জুন মাসে সস্তা ছিল। যেহেতু প্রায়শই লোকেদের প্রচুর অর্থ ব্যয় করার প্রবণতা নেই, তাই ভোক্তারা ব্যয় কমে আসার এই প্রভাবটা অনুভব করতে পারেন না। যেমন খাবারের মতো কিছুর বিপরীতে, যেখানে দাম বৃদ্ধি ভোক্তাদের বিরক্ত করে কারণ তারা এটি প্রায়শই ক্রয় করে।

পেট্রোলের দামের ক্ষেত্রেও সেটাই, এবং এই ফ্রন্টেও আশার কারণ আছে। গত বছরে জ্বালানির দাম ৫৪.৬ শতাংশ বেড়েছে, কিন্তু সেই বার্ষিক বৃদ্ধির বেশিরভাগই ২০২২ সালের শুরুর দিকে ঘটেছিল, যখন পুতিনের ইউক্রেনে আগ্রাসন তেলের বাজার অশান্তিতে ফেলেছিল, যখন বিশ্ব রাশিয়ার অনুমোদিত অপরিশোধিত তেলের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছিল।

ডিসেম্বরের মতো স¤প্রতি এক ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৭০ মার্কিন ডলারের নিচে ছিল। মার্চ মাসে এটি ১২৩ ডলার পর্যন্ত উঠেছিলো। স¤প্রতি এটি প্রায় ১০০ মার্কিন ডলারে লেনদেন করছে। যদিও এটি বছরের বাকি সময়ের জন্য মুদ্রাস্ফীতির একটি কারণ হতে পারে, সেখানে একটি ক্রমবর্ধমান বিশ্বাস রয়েছে যে তেলের দাম ইতিমধ্যেই শীর্ষে পৌঁছেছে।

এই বসন্তে গ্যাসোলিনের গড় খুচরা মূল্য ২.১৪ ডলার প্রতি লিটারে পৌছালে চালকরা হতবাক হয়ে যায়। তবে এটি সারা দেশে তেলের দামের সাথে গড়ে ১.৮৬ ডলারে নেমে এসেছে এবং এই গ্রীষ্মে আরও কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এটা শুধু তেল ও জ্বালানি নয়; গম ও তুলার মতো শস্য থেকে শুরু করে অ্যালুমিনিয়াম, ইস্পাত এবং তামার মতো নির্মাণ উপকরণ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম সা¤প্রতিক মাসগুলোতে দ্রুতগতিতে কমেছে, কারণ মন্দার আভাস ভোগ্যপণ্যের সমস্ত ধরণের সামগ্রীর চাহিদাকে কমিয়ে দিয়েছে।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাঙ্কুভার স্কুল অফ ইকোনমিক্সের অধ্যাপক মাইকেল ডিভারেক্স বলেছেন, এই মুদ্রাস্ফীতির অনেকগুলো কারণ অস্থায়ী হতে পারে, বিশেষকরে সেগুলো বৈশ্বিক শক্তির ফল, যেমন- ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পরে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বৃদ্ধি। কাঁচামালের দাম যা সবকিছুতে ব্যবহার হয়, আমরা যা খাই তা থেকে শুরু করে আমরা যে পণ্যগুলো কিনি তার দাম দ্রুত কমছে।

সিবিসি নিউজ আসবাবপত্র কোম্পানি, বেকারি, খুচরা বিক্রেতা এবং অন্যান্য লজিস্টিক সংস্থাগুলোর দুর্দশার বিষয়ে বিস্তৃতভাবে রিপোর্ট করেছে, যারা কয়েক মাস ধরে সতর্ক করে আসছে যে উচ্চ পরিবহন খরচ গ্রাহকদের জন্য উচ্চ মূল্য কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাপী শিপিং শিল্পকে ট্র্যাক করা কোম্পানি ফ্রেইটস বলেছে, পণ্যবাহী জাহাজগুলোর চলাচলে অচলাবস্থা কেটে গেছে। যা একটি স্পষ্ট লক্ষণ যে চাহিদা শেষ পর্যন্ত হ্রাস পেতে শুরু করেছে।

আরবিসির অর্থনীতিবিদ ক্লেয়ার ফ্যান বলেছেন, কানাডার হাউজিং মার্কেটে চলমান মন্দা শীঘ্রই মুদ্রাস্ফীতির হারকে টেনে আনতে সাহায্য করবে, কারণ কম বিক্রি এবং কম দাম রিয়েলটর কমিশনে কত টাকা ব্যয় করা হচ্ছে তা কমিয়ে আনে। গত গ্রীষ্মের পর থেকে প্রথমবারের মতো বার্ষিক ভিত্তিতে গত মাসে বাড়ি কেনার সাথে সম্পর্কিত খরচ কমেছে, তিনি উল্লেখ করেছেন।

২০২১ সালের গ্রীষ্মে কানাডার বেশিরভাগ অংশ লকডাউন পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো। বেশিরভাগ লোক টিকাহীন ছিল এবং অর্থনীতির অনেক খাত অকার্যকর অবস্থার মধ্যে পড়েছিল। সেই তুলনায়, বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার বাস্তবে অনুভব করার চেয়েও বড় দেখায়।
উল্লেখ্য, করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে হয়েছে আকাশচুম্বী। এতে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। এরই ধারাবাহিকতায় কানাডায়ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৪০ বছরের মধ্যে বেশি হয়। কানাডার সংবাদমাধ্যম দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইলের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

জানা গেছে, পেট্রোলের দাম বাড়ার কারণেই জুনের মূল্যস্ফীতি বেড়ে আকাশচুম্বী হয়েছে। পরিসংখ্যান বিভাগটি জানায়, প্রতি ঘণ্টায় মজুরি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া গত বছরের একই সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ।
তবে কানাডার মূল্যস্ফীতি প্রায় ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হলেও এখনো যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কিছুটা কম। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক এক শতাংশে, যা ১৯৮১ সালের পর সর্বোচ্চ। এদিকে যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক চার শতাংশে, যা ১৯৮২ সালের পর সর্বোচ্চ। সূত্র : সিবিসি নিউজ