Home কানাডা খবর ৮১তম রবীন্দ্র প্রয়াণে রবীন্দ্রনাথের “মুসলমানীর গল্প” নিয়ে পাঠশালার আসরে আসাদ চৌধুরী

৮১তম রবীন্দ্র প্রয়াণে রবীন্দ্রনাথের “মুসলমানীর গল্প” নিয়ে পাঠশালার আসরে আসাদ চৌধুরী

টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৩৮তম ভার্চুয়াল আসরটি আগস্ট মাসের ২০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮১তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে নিবেদিত পাঠশালার এ আসরে, রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘মুসলমানীর গল্প’সহ আরও প্রাসঙ্গিক রচনা নিয়ে আলোচনা করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বাংলাদেশের অগ্রগণ্য কবি আসাদ চৌধুরী?
‘মুসলমানীর গল্প’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের শেষ গল্প। তাঁর মৃত্যুর ছয় সপ্তাহ আগে ২৪-২৫ জুন ১৯৪১ এ রচিত এই গল্পটি নানা কারণে বিশেষ। রবীন্দ্রনাথের পাঠক যখন মূলত অভিজাত ও মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজ এবং হিন্দু জাতীয়বাদী আন্দোলনের যখন প্রবল উত্থান, ঠিক তখন মুসলমান সমাজের প্রচলিত সামাজিক নির্মাণের কাউন্টার-ন্যারেটিভ তিনি হাজির করেছেন ‘মুসলমানীর গল্পে’, যার পরিণতি স¤প্রীতিতে। এটি ছিল সামাজিক এবং একইসঙ্গে রাজনৈতিক ধাক্কা। পলিটিক্যাল রবীন্দ্রনাথকে আমরা ভীষণভাবে খুঁজে পাই এই গল্পে।

উল্লেখ্য, এই গল্পের কাহিনির মতোই সত্য এক ঘটনা ঘটেছিল ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে, খুলনার চুকনগর-গনহত্যার সময়, চুকনগর বধ্যভূমিতে।

খণ্ড বনাম সমগ্র, ধর্মের অচলায়তন, ধর্মবিদ্বেষ জাগিয়ে রাখার রাজনৈতিক-রাষ্ট্রিক দিক, শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ে নিজেদের আবদ্ধ না-রাখা, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর মধ্যে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পর্যায়ে অধিকারের সাম্য প্রতিষ্ঠা, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে স্বার্থভিত্তিক-না বরং সত্যিকার ঐক্য প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় শাস্ত্রমতকে বাহ্য আচারনির্ভরতা থেকে মুক্ত করা, অভিন্নতার বিচারে-না বরং বিরুদ্ধ-বিশ্বাস বা ভিন্নতার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে ঐক্য নির্মাণ, গভীরভাবে জানার ভেতর দিয়ে হিন্দু-মুসলমান পরষ্পরের ভেদ ঘোচানো – অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, সমস্যা-দ্ব›দ্ব ও মিলনের বিষয়গুলো রবীন্দ্রনাথের প্রাচ্য সমাজ, সুবিচারের অধিকার, সদুপায়, ইংরাজ ও ভারতবাসী, হিন্দু ও মুসলমান, কোট বা চাপকান, ব্যাধি ও প্রতিকার, সমস্যা, পূর্ব ও পশ্চিম, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, লোকহিত, ছোটো ও বড়ো, বাতায়নিকের পত্র, মুসলমান ছাত্রের বাঙালা শিক্ষা, মানুষের ধর্মসহ আরো অনেক প্রবন্ধে এসেছে, এসেছে রবীন্দ্রনাথের পত্রসাহিত্যে, এসেছে ‘মুসলমানীর গল্প’ ছাড়াও আরো কয়েকটি ছোটো গল্পে, এসেছে কবিতা-গানে-উপন্যাসে, এসেছে ভাষণে-বক্তৃতায়।
ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভেদ ও অসহিষ্ণুতা, ধর্ম অবমাননার অজুহাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যকার বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের অবস্থানগত সমীকরণ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ দুই বাংলাতেই একইভাবে বিস্তার লাভ করেছে। শুধু দুই বাংলার হিন্দু-মুসলমান না, সারা পৃথিবী জুড়েই নানা ধর্মের নামে হিংসা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের দোহাই দিয়ে সংখ্যালঘু সহ যে কোনো ভিন্নমতের ওপর আক্রমণের এমনিতর সময়ে রবীন্দ্রনাথের আবারো হয়ে ওঠেন আমাদের একান্ত সহায়।
রবীন্দ্রসাহিত্য তথা যে কোনো সাহিত্যেই হিন্দু-মুসলমান দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বোঝার জন্য সমসাময়িক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানাটা খুব জরুরি। কারণ হিন্দু-মুসলমান স¤প্রদায়ের স¤প্রদায়গত পার্থক্যের সঙ্গে একটা উদ্দিষ্ট সময়ের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার গভীর যোগ আছে বলে আমরা জানি। এ প্রসঙ্গে আসাদ চৌধুরী বলেন, “১৯৭১ এ আমি প্রথম অনুভব করেছিলাম হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক। তাও ঠিক না? তারও আগে যখন দাঙ্গা হয় ঢাকাতে তখন আমি শুধু-না, বাংলাদেশের অনেকেই ছিলেন – ওয়াহিদুল হক, সনজিদা খাতুন, কবি জসিমউদ্দিন, শামসুর রাহমান এঁরা ছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আমরা এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে নির্মল সেন, কামাল লোহানী, ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেনন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য এঁরা ছিলেন। সেসময়ের এক গভীর রাতে আমরা লারমানি স্ট্রিটে ব্রাহ্ম সমাজের মানিক চৌধুরীর বাড়ি পাহারা দেবার সময়, সেখানে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সংস্করণের কতগুলো বই দেখেছিলাম। গাছের ওপর দিয়ে আমরা রান্নাঘরের ছাদে গিয়ে বসলাম। সেদিন রাত দুটোর সময় দেখলাম, বাড়িটার উল্টোদিকে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে এক মহিলার। তার পেটের ওপর রক্তের দাগ। তার ওপর একটা বেড়াল কাঁদছে। বেড়ালটা সম্ভবত তার আদরের ছিল। এই দৃশ্য আমাকে এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে কীরকম বিচলিত করেছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তখনই আমার চিন্তার একটা বড়ো প্রসঙ্গ এলো বা এসেছে বলা যেতে পারে। তার আগ পর্যন্তওতো আমরা ছাত্র অবস্থায় ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ এসব শ্লোগান দিয়েছি। মাওলানা ভাসানী যখন অনশন ধর্মঘট করেন তখন চেঁচামেচি করেছি রাস্তাঘাটে। ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ বলে গালাগাল না-দিলে আমাদের পেটের ভাত হজম হতো না। সেসময় নূতন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ হলাম যে তাহলে ধর্মটাই কি আমাদের প্রধান বিরোধ নাকি অন্য কোনো কারণ আছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে আগামাথা কিছুই পেলাম না আর। একটা ইতিহাস আমরা পড়েছি সুলেখা সান্যালের লেখা নবাঙ্কুরে। এরকম দুএকটা উপন্যাস ছাড়া অধিকাংশ বাংলা উপন্যাসের বিষয়বস্তু হচ্ছে অত্যাচারী মুসলমানের, বাংলাদেশের বিপুল হিন্দু জনগোষ্ঠী পশ্চিমবাংলায় বা ভারতের অন্য জায়গায় চলে যায় এসব নিয়ে? পশ্চিমবাংলা থেকে যে এসেছেন এরকম একটি গল্প আমার চোখে পড়েনি আজ পর্যন্ত ঐ অর্থে। ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে শওকত ওসমান সাহেবের কথায়, মাঝে মাঝে টের পেয়েছি। আবদুল মান্নান সৈয়দ মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বলতেন এসব। বলে রাখা ভালো, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমরা সহপাঠী, একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। এবং ১৯৭১ সালে যখন ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ লেখেন আহমদ ছফা, তখন একরকমের চিন্তা হয়েছে আমার। এর আগ পর্যন্ত আমাদের সব চিন্তা হয় কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা বইগুলো থেকে অথবা মুসলিম লিগের দৃষ্টিতে লেখা বইগুলো থেকে। তার ফলে মগজ ধোলাইয়ের একটা ব্যাপার তো হয়েই যায়। আমার ধারণা এটা, ভুলও হতে পারে। এ থেকে বাঁচিয়ে দিলেন কে? বাঁচিয়ে দিলেন মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। এঁরা আমার শিক্ষক। আমরা রবীন্দ্রসাহিত্য পড়েছি এঁদের কাছে। ইসলামের নামে, ধর্মের নামে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী আল বদরদের হাতে নিহত হন। তাঁদের লাশও পাওয়া যায়নি। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী খুব বাকপটু ছিলেন না। তিনি সঞ্চয়িতা পড়াতেন, কবিতা পড়াতেন। একদিন বাসায় গেছি তাঁর। যথারীতি চিড়া ভাজা, মুড়ি ভাজা, চা খাচ্ছি। তিনি আস্তে কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের একটা রেকর্ড ছেড়ে দিলেন গানের। তারপর বললেন, বুঝলে আসাদ, আমি এটাই বলতে চেয়েছিলাম। অথবা সুচিত্রা মিত্রের রেকর্ড ছেড়ে দিয়ে বললেন, বুঝতে পেরেছ তো, আমি এটাই বলতে চেয়েছিলাম। কিছুদিন আগে সালমান রুশদী নিউইয়র্কে বক্তৃতা দেবার সময় শিয়া মতাবলম্বী মাথা বিগড়ানো এক যুবকের হাতে ছুরিকাহত হন। অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা সন্দেহ নেই। তারচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে আমেরিকার সেরা ৫০টা বইয়ের মধ্যে তাঁর ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ ছিল না। এই ঘটনার পর তাঁর বইটি আবার ১৩ নাম্বারে উঠে এসেছে। এবার আমি একটু অন্যদিক থেকে চিন্তা করতে পারি। গোটা পৃথিবীতেই কি ইসলামফোবিয়া কাজ করছে না? এবং এখানে বাতাস দেওয়ার মতো মিডিয়াগুলো কি চুপচাপ আছে একেবারে, নীরিহ হয়ে বসে আছে? হ্যাঁ অত্যন্ত সচেতনভাবে যেমন আমি কানাডার কথা বলতে পারি, নিউজিল্যান্ডের কথা বলতে পারি। এখানকার সরকারগুলো অত্যন্ত বলিষ্ঠতার সঙ্গে যে কোনরকমে সা¤প্রদায়িকতার ইস্যুগুলো প্রতিহত করে। কিন্তু অন্যত্র? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে? সেই ১২০৫-৬ এর দিকে রমজান মাসে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি এলেন। এটা কি গল্পের শুরু? এরপর নবাব সিরাজউদ্দোলার পতন। এর মধ্যে অনেককিছু ঘটছে। হোসেন শাহী আমল, মোঘল আমল, অনেক পরে বাঙালি মুসলমানরা এলেন এ দেশে। আর্য সভ্যতার প্রবেশও যে খুব সহজে ঘটেছে তা না। বিহারে এসে তো অনেক বছর থমকে গিয়েছিল। তারপর নানাভাবে আস্তে আস্তে এই ধর্ম ভেতরে প্রবেশ করে। মানুষের যত রকমের প্রবৃত্তি আছে সেগুলো নিয়ে আমরা একটু বিশ্লেষণ করতে পারি। বখতিয়ার খিলজি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুড়িয়ে দিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এটা একটা দুর্গ। ভাবা যাই হোক না কেন, পুড়িয়ে দিলেন এটা হচ্ছে বাস্তবতা। তারপরে আমাদের এখানে বিভিন্ন রকমের স্তর গেল, চিন্তাভাবনা গেলো। অনেক রকমের হিন্দুর ভাবনা, মুসলমানের ভাবনার সঙ্গে অনেকগুলো ক্ষেত্রে একটু একটু করে আস্তে আস্তে মিলন ঘটল। যেই দিল্লীতে বিভিন্ন ডাইনেস্টি শাসন করেছে, দিল্লীর আশেপাশে কিন্তু অতটা মুসলমান না পূর্বাঞ্চলে এবং পশ্চিমাঞ্চলে এত মুসলমান। বিশেষ করে আজকের বাংলাদেশ, বেঙ্গলে। আমি বেঙ্গল শব্দটা ব্যবহার করব রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে। সোনার বাংলার জায়গায় বেঙ্গল ব্যবহার করতে আমার খুব কষ্ট হবে, তবুও বলব সেখানে কী হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দেখা যাবে, বাংলা ভাষায় চর্চা করলে নরকে যাবে, শুনলেও তাই। বাংলার মুসলমান সেই সুলতান থেকে শাহ গরিবুল্লাহ থেকে কে না জানতেন যে বাংলায় লিখলে পাপ হবে, গুনাহ হবে। সেইখানে বাংলা ভাষা আস্তে আস্তে দাঁড়াচ্ছে। এবং এটা সত্যিই একটা বড়ো ব্যাপার যে, সেই সময়ে বাংলাদেশে একটা রেনেসাঁ হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা আমাদের দেশের মমতাজউদ্দিন তরফদার সাহেব লক্ষ্য করেছেন এবং আরো অনেকে লক্ষ্য করেছেন। যখন আমরা দাঙ্গা করছি তখন, যখন দেশের নামে রাষ্ট্রের নামে আমরা উন্মত্ত হয়ে উঠছি সেইসময় ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাঙালিদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, যতই টুপি-দাড়ি রাখো, যতই টিকি ইত্যাদি রাখো, আসলে বাঙালি তোমরা এক বাঙালি।

“১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গের পর আমরা কী দেখলাম? লর্ড কার্জন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার পথে মুসলমানদেরকে উসকানি দিয়ে কথাবার্তা বলছেন। একটু একটু করে হিন্দু বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটা লেখায় এগুলোর ইশারা আছে। তিনি বলছেন না যে, ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ ওরা চালু করেছে, এটা ওটা করছে, এভাবে কখনোই তিনি বলছেন না। আমরা মনে করি এটা করা হয়েছে বলে, নিজের দিকে টেনে তারপর কথাগুলো বলছেন রবীন্দ্রনাথ এবং পরিষ্কার করে বলছেন যে, যেখানে ঘা সেখানে যদি শত্রু আঘাত দেয় সেখানে শত্রুকে গালাগালি করার আগে নিজের ঘা-টা পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। মেনে নেওয়া ভালো, হিন্দু মুসলমানের সম্পর্কে বিরোধ আছে। অনেকগুলো প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন ইশারায়, কথায়। চিঠিপত্রে লিখেছেন কী সুন্দর করে! আরেকটা কথা আমি বাঙাল বলে, বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে চিরকাল গর্ব করব যে, ১৯০৫ এ রবীন্দ্রনাথ অরন্ধন আহবান করেছিলেন কোলকাতাতে। তিনি তখনও অত বিখ্যাত নন। ঠাকুর বাড়ির ছেলে, সুন্দর গান লেখেন নাটক লিখেন এমন একটা ধারণা আছে। অভিজাত সমাজে, ব্রাহ্মণ সমাজে, এমনকি খৃষ্ট সমাজেও তাঁর যথেষ্ট কদর ছিল তখন। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এত কদর ছিল না তখন তাঁর। রবীন্দ্রনাথ বললেন, না, আজকে কোলকাতায় কোনো চুলা জ্বলবে না। এবং জ্বলেনি। কেন? কারণ বাংলাদেশ ভাগ হয়েছে। তিনি রাখী বাঁধলেন। বিখ্যাত মুসলমানকে তো আর রাস্তায় পাওয়া যায় না। তিনি শ্রমজীবী মুসলমানের হাতে রাখী বেঁধে দিলেন। এবং আমরা জানি যে, আগে থেকেই মুসলমানদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। জীবনের একেবারে প্রথম দিকে লেখা হিন্দু-মুসলমান প্রবন্ধেও তাঁর এই চিন্তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই।”

১৯৪৭ এ দেশভাগ হয়েছিল ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে রেখে। হিন্দু সমাজের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ, মুসলমান স¤প্রদায়ের পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা, শাসকদের কাছাকাছি হিন্দুদের চলে আসা, মুসলমানদের অস্তিত্বহীনতা ও আত্মপরিচয়ের সংকট, পারষ্পরিক অবিশ্বাসে সা¤প্রদায়িকতার বীজ, হিন্দু জাতীয়বাদের উত্থান, ‘অপর’ হিসেবে মুসলমান, ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, মুসলিমদের এতে অন্তর্ভুক্ত না-করা, স্যার সৈয়দ আহমেদের আলিগড় আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন মুসলমান সমাজকে আলোর বৃত্তে নিয়ে আসার প্রয়াস, ১৯ শতকের শেষভাগ থেকে ২০ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত একই অবস্থা, এর সদ্ব্যবহার করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর হাতে জাতীয় কংগ্রেসের বিপরীতে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, অথচ এর ঠিক ১ বছর আগেই লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবে সারা বাংলার হিন্দু-মুসলমানের একযোগে প্রতিবাদ জানানো – এ বিষয়গুলো সামনে আসে দেশভাগের আলোচনায়। ১৯১১ সালে বৃটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব রদ করলেও কার্জনের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা পূর্ণতা পায় ১৯৪৭ এ দেশভাগের মধ্যে। প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান ও ১৯৭১ এ এসে বাংলাদেশ।

সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রসাহিত্যে মুসলমান চরিত্রের সংখ্যা অপেক্ষাকৃতভাবে বেশ কম কিংবা মুসলমান চরিত্র ও মুসলিম অনুসঙ্গ থাকলেও মুসলিম মানসের ছবি পাওয়া যায় কম – এটি এক বাস্তবতা কিন্তু এ বিষয়কে সামনে এনে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এক ধরনের নেতিবাচক নির্মাণও রয়েছে। এ বিষয়ে আসাদ চৌধুরী বলেন, “একটু ভূমিকা দিয়েই বলতে হয়, উপায় নেই। বাঙালি মুসলমানের অধঃপতনের কারণ কী? অনেকে অনেকরকমভাবে চিন্তা করেছেন। এমনকি ইংরেজরা নিজেদের পক্ষে হান্টারকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন মুসলমানরা কেন এত দুঃসহ ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা মারাত্মক কথা বলেছেন জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেছিলেন, প্রচলিত বাংলা বা বাংলা গদ্যের প্রতি বাঙালি মুসলমানের অনীহা তাদের পশ্চাদপদতার একটা অন্যতম বড়ো কারণ। কারণ, চিন্তা করতে হয় গদ্যের ক্ষেত্রে।
জ্ঞানচর্চার অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানেরা অনেক এগিয়ে ছিল বিভিন্ন সময়। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। কিন্তু বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান পিছিয়ে ছিল এবং পশ্চিমা শিক্ষা নেয়নি। প্রথমত আমরা সৈয়দ, আমরা মীর, আমরা শেখ ইত্যাদি ইত্যাদি। মুর্শিদাবাদ শেষ হয়ে যাবার পর ব্যাপারটা টের পেল। তখন অনেক বনেদি মুসলমান অন্য জায়গায় চলে গেছে, এদেশেই থাকেনি। এবং সেই পর্যায়ে এসে রবীন্দ্রনাথ, যেটা আমার কাছে বড়ো বিষয় বলে মনে হয়, মূল জায়গাটা ধরেছেন। তিনি কাজী আবদুল ওদুদকে চিঠি লিখছেন তাঁর গদ্য চর্চার প্রশংসা করে। জসিমউদ্দিন তো ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়ই রয়ে গেলেন। এবং ‘আবদুল্লাহ’ উপন্যাস পড়ে রবীন্দ্রনাথ এত অভিভূত হয়েছিলেন যে বললেন, আমি এই প্রথম মুসলমানদের স্বাদ পাচ্ছি। একটু শিখতে চাচ্ছে যে মধ্যবিত্ত মুসলমান তাঁদের চিনতে পারছেন রবীন্দ্রনাথ। এটা কম কথা না। তার আগে কিন্তু তিনি পারছেন না। এই যে গদ্য চর্চার ক্ষেত্রে, বাংলার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করা, উদাসীনতা, অমনোযোগিতা বাঙালি মুসলমানের এই দিকটি খুব বড়ো করে দেখেছিলেন তিনি। এবং বলতে হয় রাজা রামমোহন রায়ের কথা। আমাদের চিন্তা যাঁর কাছে ঋণী সেই অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, রামমোহন রায় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকার জন্য।

“১৯৪০ সালে কী হচ্ছে? ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গ হয়েছে। কেন হয়েছে? অন্তত ৩/৪ জন নামকরা প্রশাসক বললেন যে, এটা তাঁদের প্রশাসনিক কারণ, প্রশাসনের অসুবিধা, এত বড়ো দেশ, এই কয়টা জেলা এই কয়টা থানা নিয়ে অসম্ভব ইত্যাদি ইত্যাদি। বাংলা ভাগ হলো। বাংলার সঙ্গে যুক্ত হলো আসাম। ওদিকে বিহার, ঊড়িষ্যা রয়েই গেলো। বাঙালি যত যাই হোক না কেন, কী হিন্দু কী মুসলমান, নিজেদেরকে ছাড়া অন্যদেরকে সহজভাবে গ্রহণ করে না। হিন্দুরা বাঙালি মুসলমানকে যতটা সহজভাবে গ্রহন করবে, মহারাষ্ট্র মাদ্রাজের মানুষদের করবে না, যতই ‘ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি’ এসব কথা বলা হোক না কেন। সেই গান্ধী থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু কথা বলেছেন এই নিয়ে। কিন্তু বাঙালি এদিক থেকে অসম্ভবভাবে একমুখা। পূর্ববাংলা-পশ্চিমবাংলা বিরোধ নিয়ে চমৎকার একটা বই হুমায়ুন কবীরের ‘বাংলার কাব্য।’ যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন তিনি বলছেন যে, পূর্ববাংলার নদীগুলো রোবাস্ট, সমুদ্র সান্নিধ্য, পাহাড়টা আছে কাছে, নদী ভাঙে – সবকিছু মিলিয়ে পূর্ববাংলা একটু রোবাস্ট, একটু প্রত্যক্ষ কথাবার্তা বলতে ভালোবাসে এর লোকজন ইত্যাদি। এটা বিস্ময়ের ব্যাপার। বাংলার কাব্য তো আজকে বেরোয়নি, অনেকদিন আগে বেরিয়েছে। সত্য-মিথ্যা আমি আলোচনা করতে চাচ্ছি না। কিন্তু এরকম একটা ভাবনা আছে যে, পশ্চিম বাংলা হচ্ছে একটু ব্রাহ্মণ ওরিয়েন্টেড এবং পূর্ববাংলা কায়স্থ ওরিয়েন্টেড। আমরা দেখব বাংলাদেশের ঢাকা-বিক্রমপুর এই বিরাট অঞ্চল থেকে যতজন পণ্ডিত বেরিয়েছেন – জগদীশ চন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, দীনেশ সেন – এঁদের অধিকাংশই কায়স্থ। এগুলোর একটা প্রভাব হয়তো আছে। এবং উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমরা দেখব, সেই কালীপ্রসন্ন সিংহ অথবা প্যারিচাঁদ মিত্রকে বাদ দিলে বাংলা উপন্যাসে আমরা যাঁদেরকে পাচ্ছি সব ব্রাহ্মণ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ অন্যরা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাঙালি মুসলমানদের ব্যাপারে দুর্বলতা ছিল। সুভাষ চন্দ্র বসু তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে, আপনি কি মনে করেন হিন্দু-মুসলমান মিলন সম্ভব? সুভাষ বসু তখন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। একটুও দেরি না করে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, না, সম্ভব না। এটি শরৎচন্দ্র বলেছেন, এটি তারাশঙ্কর বলেছেন। তাঁরা দুজনই কংগ্রেস করতেন। জেলা কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এঁদের কেউ কেউ। পার্টিশনে আমরা বাংলা ভাগ হয়েছে এটা বলি কিন্তু পাঞ্জাব যে ভাগ হলো এটা আমাদের মনে আসে না। তার কারণ ইংরেজদের কাছে পাঞ্জাব একটা থ্রেট ছিল। যখন ভগৎ সিংকে ফাঁসি দিতে যায়, তিনি তখন পড়ছিলেন ‘ডাস ক্যাপিটাল।’ শিখদের বিশাল ভূমিকা ছিল। এগুলো উড়িয়ে দেওয়া চলবে না। আরো আছেন ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, বিনয়, বাদল, দীনেশ, তিতুমীর। তিতুমীরের কথা একটু বলতে হয়। দাড়ি রেখেছিলেন বলে তাঁর জমিদার তাঁর খাজনার টাকা বাড়িয়ে দেওয়ায় তিনি প্রথম আঘাতটা পান। তিনি কোলকাতা গিয়েছিলেন মামলা করতে। তাঁর মামলা গ্রহন করা হয়নি। তিতুমীরের সেইখান থেকে বিরোধ। বিরোধটা হিন্দুর বিরুদ্ধে না, সেই জমিদার ছিলেন হিন্দু। শরীয়তুল্লাহর ক্ষেত্রেও তাই। বাঙালি মুসলমানের তো দুইটাই আন্দোলন, তিতুমীর আর শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে। আর কোথায়! এবং দুটোই ধর্মভিত্তিক। আবার এক অর্থে বিচার করতে গেলে, সম্পূর্ণ ধর্মভিত্তিকও না।

“পার্টিশনের কথা এলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, কিরণ শঙ্কর রায়, শরৎচন্দ্র বসু এঁদের কথা চলে আসে। তারও অনেক আগে ১৯২৩ এ চিত্তরঞ্জন দাশের বেঙ্গল প্যাক্ট, যেটা কংগ্রেস ছেঁড়া কাগজের মতো ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, রাখেনি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কখনোই মানতে পারেননি যে, মুসলমানদের বাদ দিয়ে আমরা একা ইংরেজকে তাড়াতে পারব। জিন্নাহ প্রথমদিকে রাজি হয়েছিলেন, গান্ধীও প্রথমদিকে রাজি হয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তী অঙ্ক আমাদের সবার জানা। জিন্নাহও বেঁকে বসলেন এবং গান্ধী তো কিরণ শঙ্কর রায়কে রীতিমতো বকাঝকা করলেন। ১৯৪৭ সালের সম্ভবত মে-জুন মাসে একটা বিবৃতি বের হয় কৃষ্ণপ্রিয়া দাশগুপ্তের ‘চেনা কোলকাতার অচেনা ফুটপাথ’ বইতে। সেই সময় বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী কী ভাবছেন তা জানা যায় এই বিবৃতি থেকে। ‘অর্থনীতিগত সংস্কৃতিগত অখণ্ড বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গব্যবচ্ছেদের সিদ্ধান্তে আমরা গভীর বেদনা বোধ করছি? সা¤প্রদায়িক বিচ্ছেদ আজ যত দানবিক আকারেই দেখা দিক না কেন, সেটা সাময়িক, কারণ দেশের মাটিতে সর্বসাধারণের সুখে দুঃখে চাষী ও মজুরদের প্রাণধারণের কঠিন সংগ্রামে, শিল্পী সাহিত্যিকের আত্মবিকাশের ক্ষেত্রে কোথাও তার শিকড় নেই। হিন্দু ও মুসলিম বাঙালির মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের চিরপ্রথার এবং সমাজব্যবস্থার বিভেদ আছে তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না যে তাদের মিলনের ক্ষেত্রও বহুদূর প্রসারিত ও বহু শতাব্দীব্যাপী ও সর্বোপরি এই শর্তটি আজ উভয় স¤প্রদায়ের রক্তের লেখা অক্ষরে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে বিভেদের রাজনীতি, জিঘাংসা ও আত্মহত্যার রাজনীতি এবং হিন্দু ও মুসলমানের সম্মিলিত স্বাধীন বাংলার রাজনীতি মহান সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের রাজনীতিতেই স্পন্দিত নবজীবনের রাজনীতি। হিন্দু-মুসলমান রাষ্ট্রনায়কদের বিভেদগামী ও বিপথগামী নেতৃত্বের ভয়াবহ পরিণাম চোখের সামনে স্পষ্ট দেখেও কি আমরা আমাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের দ্বারা মাউন্টব্যাটেনের রোয়েদাদকে ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে বাংলাকে পুনর্গঠিত পুনরুজ্জীবিত করতে আত্মদানে এগিয়ে আসব না?’ (২৯-৩০ পৃষ্ঠা)। এতে স্বাক্ষর করেছিলেন আবু সায়ীদ আইয়ুব, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শওকত ওসমান, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, ফজলুল হক, হাবীব রহমান, অধ্যাপক নাজমুল করিম, সাংবাদিক সৈয়দ নুরুদ্দীন, সাংবাদিক খায়রুল কবির, কবি মতিউল ইসলাম, ইবনে গোলাম নবী, অধ্যাপক নুরুজ্জামান, নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী, অধ্যাপক মোঃ হাবিবুর রহমান, ফকির আলী, অধ্যাপক আখতার জলিল, কবি গোলাম কুদ্দুস, অধ্যাপক মঈদুল ইসলাম প্রমূখ। এর সঙ্গে চলে আসে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ এবং মুসাদ্দাস-ই-হালি – আলতাফ হোসেন হালির মুসাদ্দাস। অধ্যাপক রাজ্জাক খুব পরিষ্কার করে বলেছেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর এই দুটি সাহিত্য হিন্দু-মুসলমানকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল।”

রবীন্দ্রনাথের গল্পে তথা সমগ্র রবীন্দ্র-সাহিত্যে মুসলিম প্রসঙ্গ প্রাধান্য না পাওয়ার সঙ্গত কারণ ছিল। যদিও তাঁদের চাকর-বাকর খানসামাদের মধ্যে অনেক মুসলিম ছিলেন, ছিলেন আবুল ফজল প্রমুখদের মতো অনেক মুসলিম বন্ধুও, কিন্তু আপামর মুসলমানদের জীবনযাত্রার সঙ্গে একটা সময় পর্যন্ত তেমন পরিচয় ছিল না তাঁর। ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঠাকুর এস্টেটের জমিদারি দেখাশোনার কাজে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর অঞ্চলে কাটিয়েছিলেন। এই পল্লীবাংলার অভিজ্ঞতাই উঠে এসেছে তাঁর ছোটগল্পগুলিতে। মুসলমান সমাজ-মুসলিম পরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এই সময়ে। পূর্ববঙ্গের উক্ত অঞ্চলগুলিতে মুসলমান স¤প্রদায়ের বসবাসই বেশি। কিন্তু মুসলিম সমাজের সমস্যাকে জানতে হলে সমাজের অন্তরের দিক থেকে জানতে হয়। এখানে তার তেমন সুযোগ ছিল না। তাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে সম্পর্ক তা জমিদার ও প্রজার সম্পর্ক—শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক। সেখানে অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশার সমস্যা তো ছিলই। ফলে মুসলিম সমাজের ভেতরের খবর জানা ছিল না তাঁর। এবং তাঁর লেখায় মুসলিম চরিত্র, মুসলিম অনুষঙ্গ থাকলেও সেখান থেকে সামগ্রিক মুসলিম মানসের ছবি খুব বেশি পাওয়া যায় না।
‘মুসলমানীর গল্প’ ছাড়া হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে বাকি গল্পগুলি রচিত হয়েছে উনিশ শতকের শেষ দশকে। জাতীয়তাবাদে উত্তাল তখন বাংলা। কোনও কোনও লেখক তাঁদের লেখায় তুলে ধরছেন হিন্দুদের অতীত গৌরব। সেই হিন্দুয়ানার সময়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই গল্পে মুসলিম চরিত্ররা যতটা সম্মান ও গুরুত্ব পেয়েছে তা উল্লেখ করার মতো। মুসলমান নারীরাও যথেষ্ট মর্যাদা নিয়ে হাজির হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গল্পে। রবীন্দ্রনাথের আগে উনিশ শতকের বেশ কয়েকজন সাহিত্যিকের লেখায় মুসলিম চরিত্র এসেছে। তার অধিকাংশই বাঙালি নয়। রবীন্দ্রনাথের কলমেই মুসলমানদের মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হল। অবাঙালি মুসলমানের পরিবর্তে বাঙালি মুসলমানের আবির্ভাব ঘটল। বাংলা গল্প-উপন্যাসে মুসলিমরা এতদিন ছিলেন ‘যবন’, ‘পরদেশি’, শত্রুভাবাপন্ন, পররাজ্য লুণ্ঠনকারী ইত্যাদি। রবীন্দ্র-রচনায় দেখা গেল এঁরা হিন্দুর প্রতিবেশী, আত্মীয়।

রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসে মুসলমান চরিত্রদের মর্যাদা দিলেও মুসলিম চরিত্র ও সমাজ নিয়ে তিনি যে বিশেষ কিছু লেখেননি এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। এর জন্য তাঁকে অভিযুক্তও হতে হয়েছিল। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের অভিযোগের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, সমাজের অভ্যন্তরীণ তত্তে¡র সংবাদ না জানলে সেই সমাজের কথা লেখা যায় না। তিনি আরও বলেছিলেন, মুসলমান লেখকদেরই এ-সম্বন্ধে লেখা উচিত। অ-মুসলিম কোনও লেখক মুসলমান সমাজ নিয়ে লেখার চেষ্টা করলেও যে সফল হতে পারবেন না এ সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে দেখা যাবে মুসলমান সমাজ নিয়ে বিস্তর গল্প লেখা হবে। কিন্তু তার অধিকাংশই মুসলমান লেখকদের হাতেই। রবীন্দ্রনাথ মুসলিম চরিত্রদের যে উচ্চতায় নিয়ে গেলেন পরবর্তীকালের সাহিত্যে দেখা যাবে তারই প্রতিফলন। বিধর্মী ‘যবন’ নয়, মুসলমানরাও দোষে-গুণে ভরা মানুষ, স্বমহিম চরিত্র – রবীন্দ্রনাথই তা দেখালেন।
স¤প্রদায়গত ছাড়াও শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা নিয়েও সচেতন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমরা তাঁর ‘ঐকতান’ কবিতার কথা জানি। ‘ঐকতান’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জন্মদিনে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা। কবির মৃত্যুর মাত্র চার মাস আগে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ ‘জন্মদিনে’ কাব্যগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যা ‘প্রবাসী’তে কবিতাটি ‘ঐকতান’ নামে প্রথম প্রকাশিত হয়। এ পর্যায়ে ‘ঐকতান’ কবিতাটি বাজিয়ে শোনানো হয়। এ কবিতায় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্য-সাধনার ব্যর্থতা-সাফল্যের হিসেব নিকেষ করতে বসেছেন। এই কবিতা অনেকটা রেট্রোস্পেক্টিভ। তিনি অকপটে নিজের সাহিত্য সাধনার সীমাবদ্ধতা ও অপূর্ণতার কথা প্রকাশ করেছেন। এ বিশাল পৃথিবীর সর্বত্র তিনি প্রবেশদ্বার খুঁজে পাননি। সভ্যতা ভর করে চলছে শ্রমজীবী মানুষের উপর। কিন্তু কবি এদের পাশে কোনো দিন যাননি। এদের থেকে দূরে, সমাজের একটি উচ্চ আসনে বসেছিলেন কবি, সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। সেখানে বসে যে জগৎজীবন তিনি দেখেছিলেন, তা ছিল খণ্ডিত তথা অপূর্ণ। অথচ কবি পরে মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করেছেন ক্ষুদ্র জীবনের সঙ্গে বৃহৎ মানবজীবনের ঐকতানসৃষ্টি করতে না পারলে শিল্পীর গানের পশরা তথা সৃষ্টিসম্ভার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কবি মনে করেন বিচিত্র হয়েও সর্বত্রগামী হতে পারেনি তাঁর সৃষ্টি। আর এ কারণে জীবন সায়াহ্ণে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্তিকা-সংলগ্ন কবির প্রত্যাশা করেছেন এই ‘ঐকতান’ কবিতায়। যিনি শ্রমজীবী মানুষের অংশীদার হবেন, সত্য আর কর্মের মধ্যে গড়বেন আত্মীয়তার বন্ধন।

আসাদ চৌধুরী বলেন, “ঐকতানের মতো একদম স্পষ্ট করে রবীন্দ্রনাথ খুব কম কবিতাই লিখেছেন। তাঁর কবিতাতে একটু ইশারা আছে, অধিকাংশ কবিতায় চিত্রকল্প বেশি ইত্যাদি। কিন্তু ‘ঐকতান’ মনে হয় যেন একদম নজরুলের লেখা। এত সরাসরি বক্তব্য রবীন্দ্রনাথ সাধারণত দেন না। এটা অনেকটা নজরুলের ভাষায় ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি’র মতো। রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ দুই-তিন বছর খুব কষ্টের। সুভাষ বসুর সঙ্গে গান্ধীজির বিরোধ রবীন্দ্রনাথকে খুবই কষ্ট দিয়েছে। সুভাষ বসু ১৯৪৩ এর অক্টোবর মাসে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। ১০টি দেশ তার স্বীকৃতি দিলো। আমরা ১৯৭১ এর ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি এবং ৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এ ভুটান ও ভারতের সমর্থন পেয়েছিলাম। এটা মনে রাখতে হবে, ততদিনে গ্রামোফোন এসে গেছে, খবরের কাগজের প্রভাব এসে গেছে, রেডিও এসে গেছে, সবাক সিনেমা এসে গেছে। তখন এগুলো এক ধরনের বাস্তবতা নিয়ে এসেছে। দুর্ভিক্ষ আসছে এবং ইংরেজদের পলিসিগুলো একটা কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ পরিষ্কার বুঝতে পারছে কী। কংগ্রেসের জন্ম ১৮৮৫তে। বম্বেতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি। ১৮৮৮ তে মিরাটে স্যার সৈয়দ আহমেদ বললেন, ‘ওয়ান কান্ট্রি টু নেশনস।’ খুব জরুরি ব্যাপার এটা। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করলেন। তিনি মুসলমানদের বললেন যে, আমরা আইসিএস অফিসার হবো, পুলিশ অফিসার হবো, আর্মি অফিসার হবো, আমরা ব্যবসা বানিজ্য করব ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁকে মুসলমানরা কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। এটা নজরুলের কপালেও জুটেছে। আগের কথার জের ধরে বলি, যখন বাংলা কবিতা রবীন্দ্রনাথের পরে তার প্যাটার্ন ফর্ম ইত্যাদির ক্ষেত্রে ৩০ এর যুগের কবিদের হাতে একটা অন্য চেহারা নিচ্ছে, নজরুল সেখানে রবীন্দ্র অনুসারী কাব্যধারায় বিপ্লব এনে দিলেন ১৯২১ এ। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ১৯২১ এ কী কী হচ্ছে আমরা দেখি। একদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, একদিকে শান্তিনিকেতন হচ্ছে – রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার একটা ইন্সটিটিউট হচ্ছে। শঙখ ঘোষের লেখায় আছে, ইকবাল রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলছেন, রবীন্দ্রনাথ ধ্যানী কর্মী ইত্যাদি। নজরুলকে কেন কবির স্নেহভাজন ‘কবি’ কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন বুদ্ধদেব বসুরা চটে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ওপর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন যে, ভারতের মানুষ এই মুহূর্তে যে চিন্তা করে, সেই চিন্তা নজরুলের কবিতায় আছে। আমি ওঁর মতো লিখতে পারলে খুশি হতাম। সমকালীন প্রভাবশালী কবিদের, যেমন বুদ্ধদেব বসুর প্রভাব তো আমাদের মধ্যে প্রচুর, জীবনানন্দ দাশের প্রভাব আমাদের মধ্যে প্রচুর, সুধীন দত্তের প্রভাব কি নেই? এ সমস্ত কিছু অস্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ যখন নজরুল সম্পর্কে এভাবে বলেন, তখন ব্যাপারটা বুঝতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, আমি অসুস্থ হলে আমাকে সুস্থ করে কে? পদ্মা। তিনি সেখানে দেখেছেন হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক। তিনি চিঠিতে, ডাইরিতে পরিষ্কার করে লিখেছেন যে, মুসলমানরা এলে জাজিম তুলে ফেলা হয় এবং কাঠের ওপর মুসলমানরা বসে। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে তা বাতিল করলেন। ইউরোপে রেনেসাঁ, রিফর্মেশন, কাউন্টার রিফর্মেশন, স্টেট বনাম রিলিজিয়ন, ধর্মে ধর্মে বিরোধ, একই ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার মধ্যে বিরোধ, সেভেন ইয়ারস ওয়ার, থার্টি ইয়ারস ওয়ার এসব বহুকিছু হয়েছে। কিন্তু এগুলির সমীকরণ যদি আমরা একটা জায়গায় করি, তাহলে আমরা পাবো রবীন্দ্রনাথকে। তিনি বাউল গান সংগ্রহ করেছেন, কীর্তন থেকে নিয়েছেন। তিনি একেশ্বরবাদী, বিগ্রহ একদম মানেন না। কিন্তু গীতবিতানের নিবেদনের গানে পাই পূজা পর্যায়ের গান। হিন্দু মধ্যবিত্তের চিন্তার যে প্যাটার্ন সেটিকে মান্য করেই রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যচর্চা করেছেন। মণিপুরী আদিবাসী নাচকে তিনি চিত্রাঙ্গদায় রূপ দিলেন। ভাবা যায়, রবীন্দ্রনাথ কত দূরে গেছেন! বাংলা গদ্যে কী অসাধারণ কীর্তি তাঁর ‘শেষের কবিতা!’ রবীন্দ্রনাথ সেখানে বারবার একই জিনিস দেখছেন। তিনি সংঘাত দেখছেন, সংঘাতের মধ্যে ঐক্যটাকে আবিষ্কার করছেন। মানুষের মনের মধ্যে, ভেতরের ভেতরে জাগতিক সবকিছু মিলিয়ে যে একটা সত্তা তৈরি হয়, সেই সত্তাকে বোঝার চেষ্টা করছেন। হিন্দু-মুসলমান আলাদা বলে কিছু দেখছেন না। তিনি মানবসভ্যতাকে একটা স্তরে নিয়ে দেখছেন। তিনি বিজ্ঞানমনষ্ক কতখানি যে, পৃথিবীর আদিম ইতিহাস, বিজ্ঞানের ইতিকথা ইত্যাদি লেখা শুরু করলেন। ছবি আঁকা শুরু করলেন বৃদ্ধ বয়সে। ভারতের একজনমাত্র শিল্পীর ছবি পৃথিবীতে ১০০টি শ্রেষ্ঠ ছবির মধ্যে স্থান পেয়েছে। তিনি মকবুল ফিদা হুসেন না, রামকিঙ্করও না, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি চিরকাল সুন্দরের উপাসনা করেছেন। ছোটোগল্পেও রবীন্দ্রনাথ কী অসাধারণ! মোপাসাঁ, চেকভের মতোই শক্তিশালী এক লেখক। গোরার লেখক রবীন্দ্রনাথ টমাস মান, দস্তয়েভস্কি কিংবা টলস্টয়ের চেয়ে বিন্দুমাত্র কম না। রবীন্দ্রনাথের নাটক রক্তকরবী, ডাকঘর কী অসাধারণ সৃষ্টি!”

রবীন্দ্রনাথ সুদীর্ঘ জীবনকালে একটা সময় গোঁড়া হিন্দুত্ববাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন। এই সময়ের ব্যাপ্তি খুব বেশি না যদিও। নববর্ষ, ব্রাহ্মণ, মাঃভৈ প্রবন্ধ, শিবাজী উৎসব কবিতা সেই সময়ের লেখা। হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা, ব্রাহ্মণত্বের মহিমা কীর্তন, প্রাচীন ভারতের সহমরণ ব্যবস্থায় হিন্দু সতী নারীর অসাধারণ পতিপ্রেম এসব নিয়েও তখন লিখেছেন তিনি। কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে তাঁর বিশ্বাস ও অবস্থানের ধারাবাহিক রূপান্তর আমরা দেখি। ব্রাহ্মণ্যবাদের মহিমা কীর্তন থেকে উপনিষদের ঈশ্বর, সেখান থেকে স্বাতন্ত্র্য রেখে সব ধর্মের সহাবস্থান, একসময় – সংশয়বাদী-অজ্ঞেয়বাদী হিসেবে আমরা পাই তাঁকে। এমনকি পরিণত বয়সে নাস্তিকতার একটা জায়গাও আমরা দেখতে পাই – যার প্রতিফলন পাই গোরাতে, মুসলমানীর গল্পে, অনেক প্রবন্ধে এবং আরো নানা লেখায়।

রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’র পর ‘ঘরে বাইরে’ লিখেছেন। গোরা শেষ হচ্ছে সবার ভারতবর্ষে গিয়ে, যেখানে কেউ ‘অপর’ নেই। সবাইকে ‘আত্ম’র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। একটা অন্তর্ভুক্তির আদর্শের ভারত যেটা রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ কবিতায় আছে। ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় পাই – ‘কেহ নাহি জানে কার আহবানে কত মানুষের ধারা, দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা। পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার, দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে। তপস্যাবলে একের অনলে বহুরে আহুতি দিয়া, বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া।’ অর্থাৎ নানা লোক যুগ যুগ ধরে এসে একটা জাতি গড়ছে। কেউ এখানে ‘আদার’ বা ‘অপর’ না। সবাই এখানে আত্ম’র মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এই কবিতায় আমরা ‘গোরা’ উপন্যাসের শেষটা খুঁজে পাই। ১৯০৭ এ রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলন থেকে বেরিয়ে এসে যখন ‘গোরা’ লিখছেন, তখন তিনি একটা ইনক্লুসিভ ভারতবর্ষের কথা ভাবছেন। কারণ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে গিয়ে তিনি দেখেন, আমরা বাইরের মিলনটা করতে চাইছি, ভেতরের মিলন করিনি। সেখান থেকে সূত্র নিয়ে উনি ‘ঘরে বাইরে’ লিখেন, যেখানে ইনক্লুসিভ ভারতবর্ষ থেকে বেরিয়ে উনি জাতীয়তার চেয়ে ঊর্ধ্বে স্থান দিচ্ছেন মানবতাকে, সভ্যতাকে, সত্যকে, জীবনের বৃহত্তর সত্যকে। ‘ঘরে বাইরে’ এসেছে ‘গোরা’র ধারাবাহিকতায়। রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘গোরা’তে মনে হচ্ছে, অন্তর্ভুক্তি যদি আমরা সম্পন্ন করতে পারি, তবে জাতীয়তাবাদের ইতিবাচকতা আছে। জাতীয়তাবাদ একটা ইতিবাচক ভূমিকায় দাঁড়াবে, জাতীয়তাবাদ একটা মুক্তির পথ দেখাবে। কিন্তু ‘ঘরে বাইরে’তে গিয়ে উনি দেখতে পাচ্ছেন, জাতীয়তাবাদ শেষ পর্যন্ত পশুত্বের দিকে নিয়ে যায়। ‘ঘরে বাইরে’তে শক্তির ইঙ্গিত আছে যা শেষ পর্যন্ত সত্যের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ায়, সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, যা ‘ঘরে বাইরে’র চন্দ্রনাথ চরিত্রের মুখে বারবার ফিরে আসে এবং নিখিলেশের কথার মধ্যেও ফিরে আসে। ১৯০৭-০৯ সময়ে ‘গোরা’র রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘ঘরে বাইরে’তে গিয়ে জাতীয়তাবাদের ভেতরের সমস্যাটুকু অনুধাবন করেছেন। মানে গোরা যদি তার অবস্থানেই থাকে তাহলে কিন্তু সে সন্দীপ হয়ে যাবে। আর গোরা যদি ওখানে না থাকে, তবে তাকে নিখিলেশ হতে হবে। কারণ নিখিলেশের মধ্যে গরিব মুসলিম চাষাদের জন্য দুঃখ আছে, স্বদেশকে জাগানোর কথা আছে। অর্থাৎ ‘গোরা’ থেকে ‘ঘরে বাইরে’তে রবীন্দ্রনাথের আরেকটা অতিক্রমণ হচ্ছে। পরে এর থেকেও আরো উত্তরণ ঘটে জীবনের শেষদিকে। তিনি এক জায়গায় বলেছিলেন, আমাকে একটা জায়গায় স্থির করে রেখো না। কাজেই গতিধারার সমগ্র নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে হবে, সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে দেখতে হবে।

গোরা, ঘরে বাইরে, চার অধ্যায় – এই উপন্যাস তিনটির বাইরে চতুরঙ্গ উপন্যাসে দেখি, ঠাকুরদা ঈশ্বরকে অস্বীকার করছেন। তিনি বলছেন, যদি ঈশ্বর থাকে তো উনিই আমার ভাবনাচিন্তা তৈরি করেছেন। সেই ভাবনাচিন্তা দিয়েই দেখছি ঈশ্বর নেই। মানে ঈশ্বরই ঠিক করে দিচ্ছেন, ঈশ্বর নেই। এরকম একটা নাস্তিকতার জায়গাও আমরা চতুরঙ্গে দেখি।
আবার রবীন্দ্রনাথকে শুধুমাত্র উপন্যাসে না রেখে অন্য সৃষ্টিতে গেলে দেখা যায়, তিনি বঙ্কিমের বন্দে মাতরম সুর করেছেন। উল্লেখ্য, রামমোহন রায়ের ঈশ্বর ঠিক গাছের তলায় বা গুহায় বসে সাধনা করে পাওয়া না, তাঁর ঈশ্বর জ্ঞানের দ্বারা পাওয়া, জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জিত ঈশ্বর। রামমোহনের ঈশ্বর কোনো প্রার্থনা চান না। ঈশ্বর তাঁর কাছে সবসময় ‘তিনি’। ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে তিনি ডাকছেন সহপথিক ভারতবাসীকে, দেশকে দেখছেন, দেশকে উন্নত করা, ধর্ম সংস্কার করা ইত্যাদি ভাবছেন। ঈশ্বর আমাকে সুকৃতি দেবেন, আমার মঙ্গল করবেন, সেটা না। এটা পরবর্তীতে পালটে যায়। বঙ্কিমচন্দ্রে এসে দেখছি, দেশ আর প্রতিমা এক হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলছেন, ‘তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।’ রবীন্দ্রনাথও প্রথম অবস্থায় বন্দে মাতরমের সুর করেন। কিন্তু পরে তিনি এখানটায় থাকেননি। তিনি দেশকে দেখেন ঘরের মা’য়ে। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের পরতে পরতে আমরা ঘরের মা’কে পাই। পরবর্তীতে দেশ হয়ে ওঠে বিশ্ব মা – ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা। তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।’ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেন, ‘সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি’। এই যে জাতীয়তাবাদ যেখানে আমার দেশকে সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হতে হবে, সারা পৃথিবী এর প্রজা হবে। রবীন্দ্রনাথ এর উত্তরে বলছেন, ‘জানি নে তোর ধনরতন, আছে কিনা রানীর মতন। শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে।’ অর্থাৎ মা তো মা। তাকে ভালোবাসতে হলে তাকে রানি হতে হবে না। ঐখান থেকেও তিনি বেরিয়ে এসে বলছেন, ‘হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’ সেই মানুষটাই বলছেন, ‘বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে’ কিংবা ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।’ এবং সবশেষে বলছেন ‘ঐ মহামানব আসে।’ তখন কিন্তু দেশ, জাতি নেই। এই মহামানব কোনো মানুষ না। এটা একটা মানব দল, এটা একটা বিপ্লবাত্মক কথা। এই মহামানব অবতার না। এখানে বলা হচ্ছে মানব অভ্যুদয়ের কথা। রবীন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রনাথ, কেশব সেন, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ হয়ে আবার রামমোহনেই ফিরে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে কোনো বিশেষ ধর্মের স্থান নেই কিন্তু একেশ্বরের সাধনা আছে। ওখানে সব ধর্মের উৎসবই পালিত হয়।

আসাদ চৌধুরী বলেন, “‘ঐকতান’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, চালাকি দিয়ে মহৎ কাজ হয় না। মিথ্যা মজদুরি কখনো টেকে না। তিনি সেই জায়গায় যেতে চেয়েছেন। অনেকেই তো নোবেল পুরষ্কার পেলেন। কোন কবিকে নিয়ে এমন হৈচৈ হয় গোটা পৃথিবীময়? রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হয়। কেন হয়? রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানের। শৈশবেই রবীন্দ্রনাথ পাহাড় দেখতে গিয়েছিলেন তাঁর বাবার সঙ্গে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ফার্সি সাহিত্যের সমঝদার আদমি। রামমোহন রায়ের আরবি, ফার্সি ছিল মাতৃভাষার মতো? রবীন্দ্রনাথ সীমার মাঝে অসীমকে অনুভব করতে পেরেছিলেন সেই অতি অল্প বয়সেই। ১৭-১৮ বছর বয়সে বিলেতে গিয়ে পশ্চিমা সঙ্গীতকে অনুভব করার চেষ্টা করলেন। পশ্চিমা লোকসংগীত তাঁর গানে ব্যবহার করা শুরু করলেন। রবীন্দ্রনাথ দুহাত দিয়ে নিতে জানতেন এবং বড়ো কবি বড়ো শিল্পী কতটুকু নেবেন আর কতটুকু নেবেন না এটা তাঁদের চেয়ে ভালো আর কেউ জানেন না। রবীন্দ্রনাথ এটা জানতেন। দুহাত ভরে নিয়েছেন তিনি। কর্ণাটকী সঙ্গীত থেকে নিয়েছেন। এবং ভারতীয় সঙ্গীতের যেখানে বাধ্যবাধকতা সেখান থেকে মুক্তির আনন্দ উপভোগ করেছেন। আধুনিক গান রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই ধরে বসে আছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন কীর্তন করেন, সেখানে শুধু রাধাকৃষ্ণ আসেন না। বাংলা ভাষাতত্ত¡, শব্দতত্ত¡, সঙ্গীতচিন্তা এগুলো প্রত্যেকটা শাখাকে আলাদা আলাদা করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার দ্বারা সম্বৃদ্ধ করেছেন। প্রথমদিকে আমরা দেখব রবীন্দ্রনাথ বছরে ২০টা ৩০টা করে ব্রহ্মসংগীত লিখছেন। পূজা পর্যায়ের গানগুলো ঐ সময়কার। শেষের ৩ বছরে একটিও ব্রহ্মসংগীত আমরা পাইনি। নজরুলের কথা বলেছি, ইকবালের কথা বলেছি। রবীন্দ্রনাথ ইকবাল পড়েছেন ইংরেজি অনুবাদ থেকে। অমিয় চক্রবর্তী এ নিয়ে লিখেছেন এবং শঙখ ঘোষ এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। শঙখ ঘোষ অনুবাদও করেছেন। আমাদের এখানে যখন ইকবালকে নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে, চল্লিশের পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, তখন তার মধ্যে অন্যরকমের উন্মাদনা ছিল। ইকবাল যে অনেক বড়ো কবি এটা রবীন্দ্রনাথ বুঝতে একটুও দেরি করেননি। একবার মাত্র লাহোরে রবীন্দ্রনাথের এবং ইকবালের দেখা হওয়ার কথা থাকলেও দেখা হয়নি। ইকবাল লাহোর ছেড়ে শিয়ালকোট চলে গিয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কেন দেখা করেননি এটা তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এক শহরে দুই কবির থাকা ঠিক না। আমাদের ওয়াহাবীপন্থীরা কি রুমী, হাফিজের সুফী ভাবধারার দিকে যান? শত শত কাবার চেয়ে একটি মন অনেক বড়ো। এ কথা এখন কারো বলার সাহস নেই। রবীন্দ্রনাথ ঐ জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন। আমরা পারছি না গোঁয়ার্তুমির জন্যে, জেদের জন্যে, অহঙ্কারের জন্যে। নবী করিমকে নিয়ে অনেকগুলো টুকরো টুকরো লেখা আছে রবীন্দ্রনাথের। একটা লেখাতেই দুজায়গায় নবীর নাম উল্লেখ আছে। মোহাম্মদ শব্দটি আছে। এবং প্রতিবার নবীর জন্মদিনে অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। কিন্তু মোহাম্মদ নামটি লেখেননি সেখানে। এড়িয়ে গেছেন। ‘মুসলমানীর গল্প’ লেখার অল্প কিছুকাল পরেই রবীন্দ্রনাথ মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরেই হচ্ছে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং, নোয়াখালিতে দাঙ্গা হচ্ছে।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৯৫টি ছোটোগল্পের একটি – মুসলমানীর গল্প। এই গল্প ছাড়াও দালিয়া (১৮৯১), রীতিমতো নভেল (১৮৯২), কাবুলিওয়ালা (১৮৯২), সমস্যাপূরণ (১৮৯৩), ক্ষুধিতপাষাণ (১৮৯৫), দুরাশা (১৮৯৮), মুকুট, শাস্তি ইত্যাদি গল্পেও মুসলমান চরিত্র ও মুসলিম অনুসঙ্গ এসেছে। এর মধ্যে ‘সমস্যাপূরণ’ ও ‘মুসলমানীর গল্পে’ এসেছে বাঙালি মুসলমানের প্রসঙ্গ। অন্যান্য গল্পে অবাঙালি মুসলমান। সেগুলির পটভূমিও বহির্বঙ্গ। এ গল্পগুলোর মূল সুর হিন্দু-মুসলিম মিলন। ‘সমস্যাপূরণ’ গল্পটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে বেশ আধুনিক। ধর্মনিষ্ঠ ‘অতিশয় সচ্চরিত্র’ হিন্দু জমিদারের সঙ্গে মুসলমান নারীর নিষিদ্ধ প্রণয়-সম্পর্কের কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ এই গল্পে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘ক্ষুধিত পাষাণ।’ অতীতের মুসলিম হারেমের প্রসঙ্গ এসেছে এ গল্পে। ‘দুরাশা’ গল্পে হিন্দু পুরুষের প্রতি মুসলমান কন্যার প্রেম কাহিনি মূর্ত হয়েছে। আসাদ চৌধুরী বলেন, “ক্ষুধিত পাষাণের ‘সব ঝুট হ্যায়।’ সব মিথ্যা। এটা সেই সময়কার কী অসাধারণ রবীন্দ্র-অনুভূতি! এটি বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকিয়েও কি মনে হয় না? ইউক্রেনের দিকে তাকিয়ে, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের দিকে তাকিয়ে, সিরিয়ার শিশুদের দিকে তাকিয়ে?”

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ঋতুপত্র পত্রিকায় আষাঢ় সংখ্যায় ‘মুসলমানীর গল্প’ প্রথম প্রকাশিত হয়। তিনি গল্পটির সংশোধন করে যেতে পারেননি। শেষদিকের অনেক কবিতা গল্পের মতো এটাও ছিল শ্রæতিলিখন। ‘বদনাম’ ‘প্রগতিসংহার’ প্রভৃতি শ্রুতিলিখন গল্পে রবীন্দ্রনাথ নিজ হাতে সংশোধন সংযোজন করেছিলেন কিন্তু ‘শেষ পুরস্কার’ (রচনা ৫-৬ মে ১৯৪১) এবং ‘মুসলমানীর গল্প’র ভাগ্যে রবীন্দ্রনাথের হাতের সংশোধনী জোটেনি। তাই ঋতুপত্রে গল্পটি ‘খসড়া’ হিসেবে প্রকাশিত হয়। খসড়া আকারে মুখে মুখে প্রতিমা দেবীকে বলেছিলেন তিনি।
গল্পের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তখন অরাজকতার চরগুলো কণ্টকিত করে রেখেছিল রাষ্ট্রশাসন, অপ্রত্যাশিত অত্যচারের অভিঘাতে দোলায়িত হত দিনরাত্রি। দুঃস্বপ্নের জাল জড়িয়ে ছিল জীবনযাত্রার সমস্ত ক্রিয়াকর্মে। গৃহস্থ কেবলই দেবতার মুখে তাকিয়ে থাকত, অপদেবতার কাল্পনিক আশঙ্কায় মানুষের মন থাকত আতঙ্কিত। মানুষ হোক আর দেবতাই হোক কাউকে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল।’

রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘বর্তমানকালে হিঁদুয়ানির পুনরুত্থানের যে-একটা হাওয়া উঠিয়াছে তাহাতে সর্বপ্রথমে ঐ অনৈক্যের ধুলা, সেই প্রাদেশিক ও ক্ষণিক তুচ্ছতাগুলিই উড়িয়া আসিয়া আমাদিগকে আচ্ছন্ন করিয়াছে।’ নব্য হিন্দু জাতীয়বাদের পুনরুদ্ধারে হিন্দু-মুসলমান স¤প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ মেলবন্ধনের প্রক্রিয়া বিঘিœত হবে, তা সঠিকভাবেই নির্ণয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর সেজন্যই বোধহয় তাঁর ছোটগল্পগুলিতে পারষ্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের ঐতিহ্য নির্মানের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ‘মুসলমানীর গল্প’টি রচিত হয়েছিল ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের ২৪ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন প্রবল বেগে চলমান। জার্মান নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিরুদ্ধে বৃটিশ নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের ভয়াবহ এ যুদ্ধটি শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। জার্মান নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনীর প্রধান অ্যাডলফ হিটলারের বিরুদ্ধে বৃটিশ নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনীকে তখন বলা হতো মিত্রবাহিনী বা মিত্রশক্তি। গোটা ভারত তখন বৃটিশ সরকারের শাসনাধীন এবং বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনটিও তখন একেবারেই তুঙ্গে। এই আন্দোলনের পাশাপাশি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিকে নিয়ে আর একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবী নিয়ে ভারতীয় কংগ্রেসের সমান্তরাল আর একটি আন্দোলন গড়ে তোলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে ‘মুসলিম লীগ’ নামের একটি রাজনৈতিক দল। এ ধরনের রাজনৈতিক এবং সামরিক জটিলতম একটি পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এ প্রেক্ষিতটিকে বিবেচনা করেই ভারতের হিন্দু এবং মুসলমান স¤প্রদায়ের মধ্যে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সেতুবন্ধ রচনার জন্যেই মুসলমান ‘হবির খাঁ’ চরিত্রটি উভয় স¤প্রদায়ের স¤প্রীতির প্রতীক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। এই গল্পে তিনি ভারতবর্ষের অসা¤প্রদায়িক চেতনা নির্মাণে মুসলমানদের অবদান অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন। আর জাতির সংকট মুহূর্তে এটি তুলে ধরাই ছিল তাঁর লেখক দায়। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয়-ঐতিহাসিক-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার সুগভীর উপলব্ধি এবং স¤প্রীতির গল্প ‘মুসলমানীর গল্প’ – এই দুইয়ের স্পষ্ট যোগ আমরা দেখতে পাই।
আসাদ চৌধুরী বলেন, “১৯১৯ এ ভারতবিধি আইন, ১৯৩৫ এ ভারতবিধি আইন, এই প্রত্যেকটা আইনই ছিল একটু মুসলমানের দিকে তাকিয়ে, স্বতন্ত্র নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে। মুসলমানরা আলাদা ভোট দেবে। এর ফলে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, বেঙ্গলে কোনো হিন্দুর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব না। উল্লেখ্য, বেঙ্গলের প্রধানমন্ত্রীকে তখন প্রধানমন্ত্রীই বলা হতো? বাংলা তো বরাবরই একটু এগিয়ে থাকা সমাজ। ততদিনে লাহোর প্রস্তাব এসে গেছে, পাকিস্তানের জন্য জনমত তৈরি হয়েছে, শেরে বাংলার রাজনৈতিক অবস্থান দাঁড়িয়েছে, জিন্নাহ তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ৪৬ থেকে ৫৪ পর্যন্ত আমরা দেখব, শেরে বাংলা চুপচাপ আছেন। আবুল মনসুর আহমদ সাহেব ১৯৪৭ সালে তাঁর এক হিন্দু বন্ধুকে বলেছিলেন, তোমরা তো লড়াই করছ মুসলমান আর ইংরেজের বিরুদ্ধে, আর আমরা লড়াই করছি তোমাদের, ইংরেজদের এবং কাঠমোল্লাদের বিরুদ্ধে। এখনও বাংলাদেশে এই মৌলবাদীদের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। এর কিছুটা ঢেউ ভারত থেকেও আসে এটা মানতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ ১৯৪১ সালে চলে গেলেন। তার ৫ বছর পর কোলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়। এবং ইতিহাসবিদরা খুব একটা বলেন না যে, রশিদ আলী দিবস হয়েছিল। বম্বেতে নেভির কর্মকর্তারা বিপ্লব করেছিলেন, বিদ্রোহ করেছিলেন। গান্ধী বলেন, ‘আনহোলি অ্যালায়েন্স অফ হিন্দু-মুসলিম।’ ভাবা যায়! কেন ‘আনহোলি অ্যালায়েন্স?’ তখন আজাদ হিন্দ ফৌজকে ফাঁসিতে ঝোলাবে। আমরা দেখেছি ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি ঠেকাতে বৃটিশ সরকারকে অনুরোধ করতে গান্ধীজির পায়ে পর্যন্ত পড়েছেন সুভাষ বসু। গান্ধীজি একদম শেষ মুহূর্তে অনুরোধ করেন এবং ভগৎ সিং এর ফাঁসি হয়ে যায়? ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলছেন, ‘উর্দু বহিয়া আনিবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মরণ। রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসাবাণিজ্য ইত্যাদি সব বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয় পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র।’ এটা ১৯৫০ এর জুলাই মাসে লেখা। ধীরেন দত্ত তখন কেবল উত্থাপন করলেন করাচিতে তিনি বাংলায় কথা বলতে চান। রাষ্ট্রভাষা না, শুধু কথা বলতে চান সংসদে। তাঁকে বলতে দেওয়া হয়নি। ভারত আর রাশিয়ার দালাল বলা হয়েছিল তাঁকে। বাংলাদেশের পক্ষে যখনই কেউ দাঁড়িয়েছে তাঁকে ভারত অথবা রাশিয়ার দালাল হতে হয়েছে। মণি সিংহ, মওলানা ভাসানী সবাইকেই এই অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়েছে। অথচ ৫১র দিকে শেখ মুজিবুর রহমান মণি সিংহকে বলেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হবে।”

‘মুসলমানীর গল্প’র গল্পটা এমন – মাতৃপিতৃহারা অতিশয় সুন্দরী কমলা ব্রাহ্মণ পিতৃব্যের ঘরে প্রতিপালিত হয়ে আসছিল। বিয়ের পরে পতিগৃহে যাওয়ার সময় ডাকাত দলের কবলে পড়ে সে। সেখানে হবির খাঁ নামক এক প্রভাবশালী ধর্মপ্রাণ মুসলিমের হস্তক্ষেপে ডাকাত দলের হাত থেকে কমলা মুক্তি পায়। কিন্তু জাত খোয়ানোর অভিযোগে পিতৃব্য-গৃহে আশ্রয় জোটে না। তার কাকা-কাকি তাকে ঘরে ফিরে নিতে অস্বীকার করে বলেন, ‘উপায় নেই মা! আমাদের যে হিন্দুর ঘর, এখানে তোমাকে কেউ ফিরে নেবে না, মাঝের থেকে আমাদেরও জাত যাবে।’ অগত্যা উপায় না দেখে কমলা হবির খাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। প্রথমে কমলা ইতস্তত করলে হবির খাঁ বলেন, ‘বুঝেছি, তুমি হিন্দু ব্রাহ্মণের মেয়ে, মুসলমানের ঘরে যেতে সংকোচ হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো – যারা যথার্থ মুসলমান, তারা ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণকে সম্মান করে, আমার ঘরে তুমি হিন্দুবাড়ির মেয়ের মতোই থাকবে।’ হবির খাঁর আট-মহলা বাড়ির এক মহলে আছে শিবের মন্দির আর হিন্দুয়ানির সমস্ত ব্যবস্থা। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘এই বাড়ি সম্বন্ধে পূর্বকালের একটু ইতিহাস ছিল। এই মহলকে লোকে বলত রাজপুতানীর মহল। পূর্বকালের নবাব এনেছিলেন রাজপুতের মেয়েকে কিন্তু তাকে তার জাত বাঁচিয়ে আলাদা করে রেখেছিলেন। সে শিবপূজা করত, মাঝে মাঝে তীর্থভ্রমণেও যেত। তখনকার অভিজাত বংশীয় মুসলমানরা ধর্মনিষ্ঠ হিন্দুকে শ্রদ্ধা করত। সেই রাজপুতানী এই মহল থেকে যত হিন্দু বেগমদের আশ্রয় দিত, তাদের আচার-বিচার থাকত অক্ষুণ্ন। শোনা যায় এই হবির খাঁ সেই রাজপুতানীর পুত্র।’ হবির খাঁ মায়ের ধর্ম না নিলেও মায়ের প্রতি তার ছিল অসীম শ্রদ্ধা। কমলা হবির খাঁর ছেলের প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করে মুসলমান হয়ে যায়। কমলা হবির খাঁকে বলে, ‘বাবা, আমার ধর্ম নেই, আমি যাকে ভালোবাসি সেই ভাগ্যবানই আমার ধর্ম। যে ধর্ম চিরদিন আমাকে জীবনের সব ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে, অবজ্ঞার আস্তাকুঁড়ের পাশে আমাকে ফেলে রেখে দিয়েছে, সে ধর্মের মধ্যে আমি তো দেবতার প্রসন্নতা কোনো দিন দেখতে পেলুম না। সেখানকার দেবতা আমাকে প্রতিদিন অপমানিত করেছে সে কথা আজও আমি ভুলতে পারি নে। আমি প্রথম ভালোবাসা পেলুম, বাপজান, তোমার ঘরে। জানতে পারলুম। হতভাগিনী মেয়েরও জীবনের মূল্য আছে। যে দেবতা আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন সেই ভালোবাসার সম্মানের মধ্যে তাকেই আমি পুজো করি, তিনিই আমার দেবতা- তিনি হিন্দুও নন, মুসলমানও নন । তোমার মেজো ছেলে করিম, তাকে আমি মনের মধ্যে গ্রহণ করেছি – আমার ধর্মকর্ম ওরই সঙ্গে বাধা পড়েছে। তুমি মুসলমান করে নাও আমাকে, তাতে আমার আপত্তি হবে না। আমার না হয় দুই ধর্মই থাকল।’

এই ঘটনার কিছুদিন পরে কমলার কাকার দ্বিতীয় মেয়ে সরলার বিয়ের সময় একই ঘটনা ঘটে। সেদিন হবির খাঁ ছিলেন না, কমলা তাঁর ভার তুলে নিয়েছিল কাঁধে। কন্যাপক্ষরা যখন কন্যাকে পালকির মধ্যে ফেলে রেখে পালালো, তখন তাদের মাঝখানে দেখা দিল হবির খাঁয়ের অর্ধচন্দ্রআঁকা পতাকা বাঁধা বর্শার ফলক। সেই বর্শা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন নির্ভয়ে এক নারী। সরলাকে তিনি বললেন, ‘বোন তোর ভয় নেই। তোর জন্য আমি তার আশ্রয় নিয়ে এসেছি যিনি সকলকে আশ্রয় দেন। যিনি কারো জাত বিচার করেন না।’ কাকা-কাকির বাড়িতে বোন সরলাকে ফিরিয়ে দিয়ে কমলা তাদের স্মরণ করিয়ে দেন, ‘আমার বোন যদি কখনো দুঃখে পড়ে তবে মনে থাকে যেন তার মুসলমান দিদি আছে, তাকে রক্ষা করার জন্য।’

রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে এই হলো ভারতবর্ষ, এই হলো হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক। মুসলমান দিদির রক্তে যেমন হিন্দু বোনের রক্তের সম্পর্ক আছে, তেমন হিন্দু বোনের রক্ষায় মুসলমান বোনের ভূমিকা আছে। তাঁর মতে, হিন্দুর জাতপাতের ছোঁয়াছুঁয়ির বেড়া ভেঙে দিয়ে মুসলমানরা এই ভারতকে মানবিক ভারতের দিকে অগ্রসর করতে ভূমিকা রেখেছিল। এদেশকে গড়তে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, ‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান।’

এই গল্পে বংশীবদনের ভাইয়ের মেয়ে কমলাকে ডাকাতদলের কবল থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে হবির খাঁ বংশীবদনের বাড়ীতে পৌঁছে দেবার পর কমলা তার কাকার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘কাকামণি, আমাকে তুমি ত্যাগ কোরো না।’ কাকার উত্তরটি ছিল, ‘উপায় নেই মা! আমাদের যে হিন্দু ঘর, এখানে তোমাকে কেউ ফিরে নেবে না, মাঝের থেকে আমাদেরও জাত যাবে।’ এ কথাটি বলার আগে আরও এক কাঠি ওপরে উঠে কাকী তার স্বামী এবং কমলাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘দূর করে দাও অলক্ষ্ণীকে। সর্বনাশিনী, বেজাতের ঘর থেকে এসেছিস আবার, তোর লজ্জা নেই!’ স্ত্রীর এ কথা শুনবার পর কাকা আর কমলাকে গ্রহণ করেন নি। কমলা বাধ্য হয়েছিলো হবির খাঁর সাথে আবার তার বাড়িতেই ফিরে যেতে। কিন্তু মেহেরজানরূপী কমলা যখন কাকার কন্যা সরলাকে ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করে কাকার বাড়িতে গিয়ে কাকার কাছে পৌঁছে দিল তখন কাকা অথবা কাকী কেউই কিন্তু সরলাকে ফিরিয়ে দিলো না। কমলা ফিরে আসবার পর কমলাকে উদ্দেশ্য করে কাকী যখন বলে ওঠেন, ‘সর্বনাশিনী, বেজাতের ঘর থেকে এসেছিস আবার, তোর লজ্জা নেই!’ তখন মুসলমান হবির খাঁ হয়ে ওঠেন ‘বেজাত’। কিন্তু মুসলমান মেহেরজান যখন সরলাকে কাকা, কাকীর কাছে পৌঁছে দেয় তখন মেহেরজান আর ‘বেজাত’ থাকে না, সে জাতে উঠে যায়। কারণ সরলা কাকা-কাকীর কন্যা যা কমলা ছিলো না। সামাজিক বিধি বিধানের প্রযোজ্যতার ক্ষেত্রে এই যে পক্ষপাতিত্ব – এই সংকীর্ণতার দিকটি প্রকটভাবে উন্মোচন করা এ গল্পটির একটি বিশেষ দিক।

‘গোরা’য় বিনয়ের মধ্যে যেমন রবীন্দ্রনাথকে কিছুটা পাওয়া যায়, অনেকটুকু পাওয়া যায় ‘ঘরে বাইরে’র নিখিলেশ চরিত্রে, ঠিক তেমনি এই গল্পে হবির খাঁ চরিত্রের মধ্য দিয়ে যেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই কথা বলেছেন। একাশি বছরের প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ নিজের চিন্তা বোধ বিশ্বাস আরোপ করেছেন হবির খাঁ চরিত্রে। হবির খাঁ কোনো বিপ্লবী বা সমাজ সংস্কারক নন, তাঁর আশ্রয়ে হিন্দু মুসলমান জাত রক্ষা করে, হিন্দু মুসলমানের ছোঁয়া বাঁচিয়ে সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারে। আমরা জানি, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সব ধর্মের মানুষের সহ-অবস্থান রবীন্দ্রনাথের সুদীর্ঘকালের একান্ত কামনা। অনেক প্রবন্ধ, চিঠিতে তাঁর এই আর্তি ঝরে পড়েছে। এই সহ-অবস্থানের পথে অন্যতম প্রধান বাধা যে হিন্দুদের জাত সমস্যা সে কথাও তাঁর মতো করে এত অকপটে, প্রচুর পরিমাণে অন্য কোনো লেখক বলেছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই।

আসাদ চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশের কংগ্রেস তখন দিল্লীমুখী, বাংলাদেশের মুসলিম লীগ তখন দিল্লীমুখী। উর্দু-হিন্দির বলয়ে আটকানো দুই পক্ষ এবং বাঙালির অবস্থা তখন টলটলায়মান। চলচ্চিত্র তখন তুঙ্গে, গ্রামোফোন তুঙ্গে, সবকিছু তুঙ্গে। রাজনীতিতে একধরনের সুস্থতা খুঁজে বেড়াতে হয় তখন। আমরা বড়ো কোনো মুসলিম চরিত্র ৩০ এর যুগের মুসলিম ঔপন্যাসিকের হাতে পাই না কিন্তু রবীন্দ্রনাথে পাই। তাহলে অন্যরা হয়তো উপেক্ষা করেছেন অথবা সাহস পাননি লিখতে বঙ্কিমচন্দ্রের অবস্থা দেখে।”

দুই ধর্মের সহাবস্থান ঐতিহাসিকভাবে আমাদের মধ্যে আছে। সিনক্রেটিক রিলিজিওনের ব্যাপারটাও আমাদের ঐতিহাসিকভাবে আছে। যেমন সুন্দরবনে ধর্ম নির্বিশেষে বনবিবির পূজা করে থাকেন সবাই। ব্রাহ্মধর্মেও অনেকটাই আছে। আবার ধর্ম ও জাতি আলাদা হলেও অনেকক্ষেত্রেই তা মিলে-মিশে একাকার। প্রাবন্ধিক গবেষক সুধীর চক্রবর্তী একটি লেখায় তাঁর চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন। সুধীরবাবুর গাড়ির ড্রাইভার মন্টু গতরখাটা গরিব খৃষ্টান। একদিন বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় একটা সরু পথে গাড়ি ঢুকিয়ে মন্টু একটি মন্দির প্রাঙ্গনে নিয়ে আসে। আয়েসপুরে নদীয়ার রাজার প্রতিষ্ঠিত মদনগোপাল মন্দির। সুধীরবাবুর কথায়, “আমার দেবদ্বিজে ভক্তি নেই তাই নন্দনের অভিবন্দনা করি। কিন্তু খ্রিশ্চান মন্টু দোকান থেকে বাতাসা কদমা খই মুড়কি কিনে খুরি করে মন্দিরে উঠে পুজো দেয় ভক্তিভরে, তারপরে চরণামৃত চেয়ে নিয়ে মুখে এনে দেয়, মাথায় রাখে। তারপরে প্রসন্ন মুখে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে। হতবাক আমি তাকে জিগ্যেস করি, ‘তুমি মদনগোপালের ভক্ত বুঝি?’ ‘হ্যাঁ, খুব জাগ্রত দেবতা জানেন? এখানে মানসিক করলে তা পূর্ণ হয়।’ ‘তুমি কোনো মান্?সা করেছ নাকি?’ ‘সেই জন্যেই তো আসা স্যার। প্রত্যেক সপ্তায় আসি, মাছ মাংস খাই না।’ জিগ্যেস করতে নেই, তবু জানতে ইচ্ছে করে ‘কী চাও তুমি মদনগোপালের কাছে?’ নতমুখে কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে সে বলল, ‘তাঁকে বলেছি যেন আমার এই ড্রাইভারি জীবনটা বদলে উনি একটা মানুষের মতো কাজে লাগিয়ে দেন। তাহলে বউয়ের নার্ভ ভালো থাকবে, মেজ মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাবে না—সংসার করব মন দিয়ে। দেখবেন, মান্?সা পূর্ণ হবেই।’ হিন্দু দেবতার প্রতি এই খ্রিস্টভজনাকারীর দৃঢ় আস্থা আর প্রত্যয় দেখে অবাক হয়ে বললাম, ‘তুমি তো খ্রিশ্চান, আমাদের দেবতাদের মানো?’ সে গভীর স্বরে বলল, ‘কেন মানব না বলুন, আমার ঠাকুরদার বাবা পর্যন্ত তো ছিলেন হিন্দু। আমরাও তাই নয় কি? ধর্ম পাল্টেছে বলে কি জাত গিয়েছে?’” মন্টুর জাত যায়নি নিশ্চয়ই। সে আজও বাঙালি। কিন্তু তার কাছে বাঙালি আর হিন্দু একাকার হয়ে গেছে। সে খৃষ্টান হয়েও সত্তার গভীরে বাঙালি হিন্দু হয়েই আছে। একটা সময় পর্যন্ত ধর্মান্তরিত বহু মুসলমানের মধ্যে এই বোধ ক্রিয়াশীল ছিল।

তেরো শতকের গোড়ায় ল²ণ সেনের রাজত্বকালে, দাসবংশীয় সুলতান কুতবউদ্দিন আইবকের সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করবার সময় থেকে বাংলায় ইসলাম ধর্মের বিস্তার শুরু হয়। বহু মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন। বহু ক্ষেত্রে ধর্মান্তরিত মুসলমানরা তাঁদের বংশানুক্রমিক বৃত্তিও ত্যাগ করেননি। আচার আচরণ ধর্ম বিশ্বাসও ছাড়তে পারেননি। সামাজিকভাবে আত্মীয়তা অনুভব করেছেন হিন্দুদের সঙ্গে। মুসলমানরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে হিন্দুদের অনুকরণও করেছেন। ফলে বাংলার মুসলমান পরিবারের বহু রীতি-নীতির সঙ্গে হিন্দুদের রীতি-নীতির মিল পাওয়া যায়। বহু বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করার ফলেও এমনটা হয়। আজও বহু হিন্দু পিরের থানে সিরনি মানত করেন। সমাজের নিচুতলায় দুই ধর্মের মানুষের সহাবস্থান থাকলেও বৃহত্তর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যবধানটাও বিস্তর। প্রাক-ঔপনিবেশিক সময় থেকে দুই স¤প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ স্পষ্ট। দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে দেশভাগ, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়া, বৈষম্য – সবমিলিয়ে বাংলার মুসলমানদের যাপন প্রক্রিয়া, জীবনসংগ্রামের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের বিস্তর ব্যবধান।
একটা ভ্রান্ত-বোধ থেকেই মুসলমানদের বাঙালি বলে স্বীকার করতে চান না বহু মানুষ। হিন্দু মুসলমান উভয় স¤প্রদায়ের মধ্যেই এই ধারণা এখনও বদ্ধমূল। ‘বাঙালি মুসলমান’ বা ‘মুসলমান বাঙালি’ শব্দ ব্যবহারে উষ্মা প্রকাশ করেন অনেকেই। মুসলিমরা বাইরে থেকে এখানে এসেছেন। অর্থাৎ সকল মুসলমানের পূর্বপুরুষরা বহিরাগত – অবাঙালি। এরকম ভাবনা লালন করেন বহু মুসলমানরাও। নানান তর্ক-বিতর্ক থাকলেও একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে বাংলার অধিকাংশ মুসলমানই ধর্মান্তরিত নি¤œ বর্ণের হিন্দু। কিছু বৌদ্ধও। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস, মণ্ডল, মল্লিক, সরকার, নাহার, চৌধুরী, মজুমদার প্রভৃতি উপাধির প্রচলন তাঁদের প্রাক্?-ইসলাম হিন্দু বাঙালি জীবনের সাক্ষ্য বহন করে। বাঙালি মুসলমানের বাঙালি হিসেবে পরিচিত হওয়ার প্রবণতা বিশেষভাবে দেখা যায় দেশভাগের পর। তার আগে এই পরিচয় তারা ভুলে গেছিল বা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাইরের আক্রমণে ভুল ভাঙল তাঁদের। পশ্চিম পাকিস্তানের জোর করে উর্দু চাপানোর চেষ্টা জাগিয়ে দিল তাঁদের জাতিসত্তাকে। আক্রান্ত বাংলাভাষাকেই আঁকড়ে ধরলেন সেখানকার বাঙালি। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যে ইতিহাস তার মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তা খোঁজার পরিচয়।

আসাদ চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান কনভার্টেড। নিম্নশ্রেণির হিন্দু থেকে অথবা বৌদ্ধ থেকে, কিছু ব্রাহ্মণ থেকেও হয়েছে কোনো সন্দেহ নেই। আহমদ ছফার এক উপন্যাসে আছে, হিন্দু থেকে মুসলিম হওয়া একজনকে বলা হতো ড্যাডা। এদেরও মানসিকতার অনেক ব্যাপার আছে। বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন সময়ে। এরা উর্দু বলার চেষ্টা করেছে, এরা মাথায় পাগড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছে, এরা অনেককিছু করার ভান করেছে যে, আমরা বাঙালি না। এখনো কিন্তু অনেকে বাঙালি না এটা বলতে পারলে আনন্দ উপভোগ করেন। কোত্থেকে এসেছেন। বংশমর্যাদার বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছেন। মুসলিম লীগ কারা করেছেন? করেছেন নবাব সাহেবরা, নবাবজাদারা, বিত্তবান মুসলমানরা। আমার বাবা এমএলএ ছিলেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন গনশক্তি পত্রিকার সম্পাদক। এটা আবদুল গাফফার চৌধুরী ও দৈনিক বাংলার সাংবাদিক খালেক সাহেবের কাছ থেকে শুনেছি। ১৯৪৭ এ সেই সাক্ষাৎকারে আমার বাবা বলেছেন, ‘এটা সাধারণ গরিব মুসলমানের জন্য না। পাকিস্তান হচ্ছে বিত্তবান মুসলমানদের জন্য, নবাবজাদাদের জন্য।’ ১৯৪৭ সালের পর দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে যে পাকিস্তান সেটা ভাঙলো কিন্তু ভাষার কারণে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ সমস্ত স্রোতকে এক জায়গায় এনে দিয়েছিল। এবং বাঙালি নিজেকে চিনতে পেরেছিল এই ভাষাকে বোঝার মাধ্যমে এবং এইজন্যেই জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাকের কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি মুসলমান বাংলা গদ্য অনেক পরে গ্রহণ করেছে। ১৯৪৭ এ পাকিস্তান, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট জিতে গেল। তারপর একচেটিয়া বাঙালির অভিযাত্রা রাজনৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে। আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার, আমরা কেন ভারতের দিকে তাকিয়ে আছি? ১৯৪৭ এর পরে বাঙালি বেরিয়ে এসেছে তার ভাষাকে কেন্দ্র করে। ভাষাকে কেন্দ্র করে নিজেকে জানতে গিয়ে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সামাজিক অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হয়েছে বাঙালি। ৫৪ তে এসে আমরা দেখব যে, সব স্রোত কিন্তু এক জায়গায় মিশেছে। অবিসংবাদিত কৃষক নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অনেক কীর্তি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যুক্তবাংলার জন্য শেষ পর্যন্ত থেকে গেলেন কোলকাতাতে এবং নারায়ণগঞ্জ এলে সেখান থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। ১৯৫২র ২২শে ফেব্রæয়ারি শেখ মুজিবকে এক চিঠিতে তিনি লিখেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে উর্দু শিখতে হবে।’ সা¤প্রতিক প্রকাশিত বই ‘সোহরাওয়ার্দী ভার্সাস বঙ্গবন্ধু’তে এটি পাওয়া যায়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা যখন নিচ্ছেন মাওলানা ভাসানী, তখন সোহরাওয়ার্দী চিঠিতে লিখেছেন, ‘তোমরা কি চাও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হোক?’ এবং যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী তখন অনেকগুলো ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চিন্তার ক্ষেত্রে তার ভিন্নতা দেখা দিচ্ছে। এই কথাগুলো বলার কারণ, বাঙালি মুসলমান হঠাৎ করে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ চায়নি। পাকিস্তান চাইতেও তার দীর্ঘ সময় লেগেছে। যেটা ইউপির লোকেরা চেয়ে বসে আছে। এবং ভারতের রাজনীতি হচ্ছে উর্দু বলয় এবং হিন্দি বলয় বাংলা বলয়কে কীভাবে চেপে রাখবে। সুভাষ বসু একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি নির্বাচন করে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। চিরকাল কংগ্রেস নমিনেশন দিয়েছে। এবং চিত্তরঞ্জন দাশের বেঙ্গল প্যাক্ট যার সঙ্গে মতিলাল নেহরুও যুক্ত ছিলেন তিনিও অস্বীকার করলেন। মানে পুরো কংগ্রেস বেঙ্গল প্যাক্টকে অস্বীকার করলেন। এবং শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সবচে বেশি আন্দোলন করেছে বাংলা ও পাঞ্জাব। আন্দামান বাংলা ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের দিয়েই ভরা হয়েছিল। কার্জন তবু বাংলা ভাগ করেছিলেন কিন্তু মাউন্টব্যাটেন পাঞ্জাবও ভাগ করলেন। পাঞ্জাবকে আরো একটা ভাগ করে হরিয়ানাও করা হলো। এই কথাগুলো বলার কারণ, রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে গেলে, সমকালীন রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ থেকেই রসদ নিতে হবে।”
উল্লেখ্য, এই গল্পের মতোই সত্য এক ঘটনা ঘটেছিল ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে, খুলনার চুকনগর-গনহত্যার সময়, চুকনগর বধ্যভূমিতে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ২ মাসের মাথায়, ১৯৭১ এর ২০ মে বৃহস্পতিবার, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত চুকনগরে ঘটে ইতিহাসের এক নৃশংস ঘটনা। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রাণ হারায় ১২০০০ এর মতো মানুষ। ৭১ এর এপ্রিল ও মে মাসে দক্ষিণাঞ্চলের হিন্দুদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন মাত্রা ছাড়ায়। খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর, বরিশাল ও ঝালকাঠির অসংখ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী খুলনার ডুমুরিয়া হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছে শরণার্থী হতে চুকনগর আসে। সীমান্তে পৌঁছাতে হলে ভদ্রা নদী দিয়ে নৌকায় ডুমুরিয়া, তারপর সাতক্ষীরা হয়ে সীমান্ত পাড়ি। মানুষের ঢল নামে চুকনগরে, সাতক্ষীরা ও যশোর সীমান্তমুখী মানুষের। চুকনগর বাজার ৩ দিক দিয়ে নদীবেষ্টিত। ভদ্রা নদী। ১৮ ও ১৯ মে জনস্রোত নামে সেখানে। আটলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন ও ভদ্রা নদীর খেয়াঘাটের ইজারাদার অবাঙালি বিহারী শামসুদ্দিন খাঁ শান্তিবাহিনীর সদস্য ছিলেন। ১৯শে মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাতক্ষীরা ক্যাম্পে জানিয়ে দেন তারা। তখন চুকনগরের পাতখোলা বিল, চুকনগরের কাঁচাবাজার, কাপুড়িয়া পট্টি, গরুহাটা, বাজারের কালী মন্দির, বটতলায় ঢল মানুষের। পরদিনই সীমান্ত পাড়ি দিত তারা। ২০ মে বেলা সাড়ে ১১টায় আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। এর প্রথম শিকার মালতিয়া গ্রামের কৃষক চিকন আলী, তারপর সুরেন্দ্রনাথ কুন্ডু। এরপর পাকবাহিনী পাতখোলা বাজারে ঢুকে গণহারে নিরীহ মানুষদের লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তারা বিভক্ত হয়ে একদল পাতখোলা বিল থেকে চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, চুকনগর স্কুল, মালতিয়া, রায়পাড়া, দাসপাড়া, তাঁতিপাড়া এলাকা এবং আরেক দল ভদ্রা ও ঘ্যাংরাইল নদীর পাড়ে জড়ো হওয়া মানুষের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। ভদ্রা নদীর জল সেদিন রঞ্জিত হয়েছিল মানুষের লাল তরতাজা রক্তে। অগণিত লাশের কারণে ভদ্রার অনেক জায়গায় নৌপথ আটকে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যারা সাঁতরে নদীর অপর পারে গিয়েছিলেন, সেদিন তারাই শুধু বাঁচতে পেরেছিলেন। বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া পাকবাহিনীর এই গণহত্যা থামে বিকেল ৩টায়, যখন তাদের গুলি ফুরিয়ে যায়। ভদ্রা নদীতে লাশ ফেলার দায়িত্ব দেয়া হয় অনেককে। প্রতি লাশের জন্য ৫০ পয়সা দেয়া হবে এমন ঘোষণাও দেয়া হয়।

এই গণহত্যার পরেরদিন ২১ মে সকালে বর্তমান চুকনগর কলেজের সামনে পাতখোলা বিলে বাবা চিকন আলী মোড়লের লাশ খুঁজতে গিয়েছিলেন মালতিয়া গ্রামের কৃষক এরশাদ আলী মোড়ল। এ সময় লাশের স্তুপের মধ্যে মৃত মায়ের স্তন থেকে দুধপানরত ৬ মাসের এক শিশুকন্যাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে যান। তিনি শিশুটির নাম রেখেছিলেন সুন্দরী। এদিকে সুন্দরীর মায়ের কপালে সিঁদুর ও হাতের শাঁখা দেখেছিলেন এরশাদ আলী মোড়ল। তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী হিসেবে এক হিন্দু পরিবারেই বড় করিয়েছেন তাঁকে; বিয়েও দিয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বী পাত্রের সঙ্গে।

চুকনগরে ভদ্রা নদী ৫১ বছর আগে ১৯৭১ এর ২০ মে হয়েছিল রক্তগঙ্গা, যাকে অসহায়ভাবে বহন করতে হয়েছিল ১২ হাজার লাশ। চুকনগর গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘চুকনগর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ।’ এ পর্যায়ে ভদ্রা নদী, স্মৃতিস্তম্ভ এবং সুন্দরী বালা ও এরশাদ আলীর ছবি দেখানো হয়। উল্লেখ্য, শঙ্কর সাঁওজাল চুকনগরের বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে একটি গীতিনাট্য নির্মান করেছেন।

‘সমস্যা পূরণ’ গল্পে হিন্দু জমিদারের সঙ্গে মুসলিম নারীর প্রণয়, দুরাশা গল্পে নবাবজাদীর সঙ্গে ব্রাহ্মণ কেশরলালের প্রণয় এবং মুসলমানীর গল্পে হবির খাঁ অভিজাত মুসলিম এবং কমলা ব্রাহ্মণের সন্তান, কমলার প্রেমিক করিম অভিজাত মুসলিম। কিন্তু চুকনগরের সুন্দরী বালা এবং এরশাদ আলী দুজনই অন্ত্যজ-প্রান্তিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছেন। ফলে মুসলমানীর গল্পের ৩০ বছর পর বাংলাদেশে আমরা সেই গল্পের আদলেই বাস্তব ঘটনা প্রত্যক্ষ করি, যা অন্য আরেক ন্যারেটিভ নিয়ে আসে আমাদের সামনে। মুসলমানদের উদারতার কথা বলতে গিয়ে গল্পের কথক রবীন্দ্রনাথ ‘মুসলমানীর গল্প’তে বলছেন, ‘তখনকার বংশীয় মুসলমানেরা ধর্মনিষ্ঠ হিন্দুকে শ্রদ্ধা করত।’ ছোট বংশীয় বা অবংশীয় মুসলমানরা কী করত বা করে এবং তখনকার দিনে কম ধর্মনিষ্ঠ হিন্দুদের সঙ্গে বংশীয় বা অবংশীয় মুসলামনেরা কেমন আচরণ করত বা করে তার জবাবও আমরা পেয়ে যাই চুকনগরের সুন্দরী বালা ও এরশাদ আলীর বাস্তব কাহিনিতে।

আসাদ চৌধুরী বলেন, “চুকনগরের হত্যাযজ্ঞ অনেক দেরিতে হলেও জেনোসাইডের স্বীকৃতি পেয়েছে। একই ধরনের ঘটনা আমি দেখেছি কোটালিপাড়ায়। আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন কবি তপন বাগচী এক ভাষ্কর্য উদবোধন করতে। সেখানে প্রচুর গনহত্যা হয়। সেখানে একটা মেয়ে এলো এক ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটার মাথার একটা দিক মনে হয় কেটে ফেলেছে কেউ। ছেলেটা মায়ের দুধ এবং রক্ত একসঙ্গে খাচ্ছিল। ছেলেটা তখনও অপ্রকৃতস্থ। সে তখন থেকেই এক দিদির কাছে মানুষ হয়েছে। আমি অত্যন্ত জোর দিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে বলতে চাই, আমাদের কৃষিজীবী, শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে যে মনুষ্যত্ব স্বাভাবিকভাবে বিরাজ করে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে, আমাদের শিক্ষিত শ্রেণির মানুষের মধ্যে সুবিধাবাদী মুহূর্তে, সুবিধাবাদী সময়ে এসবের নানারকম রূপান্তর ঘটে। কিন্তু যে কোনো পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মূল্যায়নের ভূমিকা এক। সুন্দরী বালা যাঁর হাতে বড়ো হলেন, তিনি কিন্তু একজন মুসলমান। কতবার চেষ্টা করেছে এদের সঙ্গে বিরোধ লাগাবার জন্য, পারেনি। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অসংখ্য গল্প আছে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার ওপর। সৃজনশীল লেখকরা এই জায়গাটা ছুঁয়েছেন।”

গোরার এক ধরনের স¤প্রসারণ বলা যায় ‘মুসলমানীর গল্প’কে। ‘গোরা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দীর্ঘতম উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘গোরা’। আবার কারো মতে, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের নামই ‘গোরা’। তবে এসব ছাপিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের নজরে আসে — ২০২০ সালে দিল্লীর উপকণ্ঠে সংগ্রামরত কৃষকদের বিক্ষোভ সমাবেশে এক বৃদ্ধ পাঞ্জাবি কৃষকের হাতে হিন্দী অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’। ‘গোরা’তে পাই ঊনবিংশ শতকের ধর্ম-আন্দোলনের ভেতরের নানা ন্যারেটিভের দ্ব›দ্ব-সংঘাত ও হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের উত্থান। ‘ঘরে বাইরে’তে পাই জাতীয়তাবাদের নানা ন্যারেটিভের বিতর্কের আবহ ও সংকীর্ণ স্বাদেশিকতার সমালোচনা। ‘চার অধ্যায়ে’ পাই তথাকথিত বিপ্লববাদ নিয়ে ন্যারেটিভ ও সংগ্রামের নানা পন্থা। ৩টি উপন্যাসই আত্মজৈবনিক, আবার একইসঙ্গে এই উপন্যাসত্রয়ী সময়ের দলিল ও ঐতিহাসিক অ্যাকাউন্টও। প্রতিটিতেই আমরা ‘আরগুমেন্টেটিভ বেঙ্গলি মাইন্ড’ খুঁজে পাই, খুঁজে পাই নারীবাদও।

গোরার জন্ম সিপাহি বিদ্রোহের সময়। এর ১৯-২০ বছর বাদে গোরা পরিণত, প্রাপ্তবয়ষ্ক বা কলেজ পড়ুয়া ছেলে হয়েছে। তবে ধরা যায় যে, মোটামুটি ১৮৬৮-৬৯ থেকে ১৮৮০-৮৫ এইরকম একটা সময়পর্বকে ‘গোরা’য় তুলে আনা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৪-৫ এই সময়ে ‘গোরা’ উপন্যাসটির কথা ভাবছেন। মানে এটি জায়মান হচ্ছে তাঁর ভেতরে। তিনি ১৯০৭-১৯০৯ এই সময়ে প্রবাসী পত্রিকাতে ‘গোরা’ ধারাবাহিকভাবে লিখেন এবং ১৯১০ সালে সেটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। ঐ সময়টা বিশেষ করে ১৮৯০ থেকে ১৯১০ রবীন্দ্রনাথের জীবনের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। ঐ সময়টা তাঁর নিজের প্রচুর ভাঙা-গড়া হচ্ছে। তিনি নানাধরণের ভাবধারা ও চিন্তাভাবনার সংস্পর্শে আসছেন, প্রভাবিত হচ্ছেন, প্রভাব মুক্ত হচ্ছেন আবার একটার সাথে আরেকটার থিসিস-অ্যান্টিথিসিস হয়ে একধরনের সিন্থেসিস হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ মানুষটারও হয়ে ওঠার একটা বিরাট পর্ব হচ্ছে ১৮৯০ থেকে ১৯১০ সময়কাল। ফলে ‘গোরা’ উপন্যাস তাঁর হয়ে ওঠারও একটা দর্পণ।

গোরা উপন্যাসের গল্পটা কোলকাতা শহরের উচ্চ বর্ণের দুটি পরিবার ঘিরে। একটি কট্টর হিন্দু, আরেকটি কট্টর ব্রাহ্ম পরিমণ্ডলে গল্পের শুরু। পরে গল্পটা বিস্তৃত হতে থাকলে অন্ত্যজ চরিত্রের দেখা মেলে। উপন্যাসে দেখা যায়, গোরা কট্টর হিন্দুয়ানিকে ধরে রেখেছে অথচ গ্রামবাংলায় অন্ত্যজ পরিমণ্ডলে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ এক নাপিত পরিবার কী অবলীলাক্রমে সেই সংস্কার ভেঙে অপর ধর্মের এক শিশুকে মানুষ করছে। এখানে একটা দেখার বিষয় যে, গোরার পরিবারে গোরা একজন আইরিশ খৃষ্টান দম্পতির সন্তান যে বেড়ে উঠছে এক নৈষ্টিক হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। আবার দেখা যাচ্ছে এক অন্ত্যজ শ্রেণির হিন্দু পরিবার এক মুসলিম সন্তানকে প্রতিপালন করছে। একটি পরিবারে অন্য ধরনের সন্তান এটি উপন্যাসের এক চিত্তাকর্ষক দিক।

‘গোরা’ একজোড়া মানব-মানবীর প্রেমের গল্প। এটা সত্যি, ‘গোরা’য় প্রেম আছে। গোরার সঙ্গে সুচরিতা ও বিনয়ের সঙ্গে ললিতা প্রেমে জড়িয়ে পড়ে এবং প্রেমটাই শেষ পর্যন্ত সত্যে রূপ পায়। কিন্তু পুরো উপন্যাসে তার্কিকতার এক বিশাল পরিমণ্ডলে চরিত্রগুলোর ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে প্রেম একটা রূপ পায়, যেদিকটা উপন্যাসটি নিয়ে অনেকের ব্যাখ্যায় অনুপস্থিত।
ঊনবিংশ শতকের নবজাগরনের আন্দোলন শুধু কোলকাতা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না। আবুল হাসান চৌধুরী বলছেন, কোলকাতা শহরে যখন নবজাগরণ আন্দোলন হচ্ছে, তখন সমান্তরালে গ্রামবাংলায় একটা নবজাগরণ হচ্ছিল কুষ্টিয়ায় লালন সাঁইয়ের নেতৃত্বে এবং এই দুটো নবজাগরণ একটা আরেকটার খবর জানতো না। শুধু একজন জানতেন এই দুটোর খবর। তিনি রবীন্দ্রনাথ। তিনি দুটোর সেতু ছিলেন। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানটির মাধ্যমে গোরায় তিনি একটি অনুপস্থিত সংলাপ ধরিয়ে দিয়েছেন, অন্ত্যজদের কণ্ঠও। লালনের গানের একটা পদ আছে – অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই। এই কথাও গোরার এক সংলাপে আছে, সাকার এবং নিরাকারের তর্কে। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলো বিষয় ভেঙেছেন। কোলকাতার উচ্চবর্ণের পরিসর থেকে ভেঙে গোরা শহরবাসী অন্ত্যজ নন্দর কাছে গেছে, গ্রামবাসী অন্ত্যজ হিন্দু নাপিত, শহরের মুসলিম ফলওয়ালা থেকে গ্রামের মুসলিম পর্যন্ত গেছে। এবং এই গান দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কোথাও একটা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ঐটা যখন কোলকাতা শহরে ঘটছে একইসঙ্গে কুষ্টিয়াতেও একটা ঘটনা ঘটছে। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৭ এ যখন ‘গোরা’ লিখছেন তখন উনি পূর্ববাংলার ব্যাপারটা জানতেন। তাই তিনি সব ভাব আন্দোলনকে ‘গোরা’য় এনেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ‘আত্মপরিচয়’ প্রবন্ধে বলেছেন, একদিন তো এমনও হতে পারে, একটা পরিবারে একটা সন্তান হয়ত ব্রাহ্ম, একটা সন্তান হিন্দু, একটা সন্তান মুসলিম, একটা সন্তান খৃষ্টান। বহু ধরনের বিশ্বাস নিয়ে একটি পরিবার। ‘গোরা’ উপন্যাসে এটা বারবার ঘটেছে। যেমন কৃষ্ণদয়ালের নৈষ্টিক ব্রাহ্মণ পরিবারে এক আইরিশ ছেলে, হিন্দু নাপিতের ঘরে এক মুসলিম সন্তান। আবার ওদিকে ব্রাহ্ম ও হিন্দুর বিয়ে, ললিতার সঙ্গে বিনয়ের। কী মতে হবে? মতটাকে বড়ো না করে মানুষটাকে বড়ো করা, ধর্মবিশ্বাসের চেয়েও মানুষকে বড়ো করে দেখা, মতাভিমতের চেয়েও মানুষকে বড়ো করে দেখা – উপন্যাসের প্রধান সুরটা এখানেই, যেখানে শেষ পর্যন্ত মানুষগুলো বড়ো হয়েছে।

গোরা উপন্যাসের এক পর্যায়ে গোরা পরেশবাবুকে বলছে, ‘আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু মুসলমান খৃস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই – যার মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে, কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না – যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।’ গল্পের একদম শেষদিকে গোরা যখন নিজ জন্ম-পরিচয় জানতে পারে, আচারের অসারতা বুঝতে পারে, তখন সে বলে, ‘আমি যা দিনরাত্রি হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি। আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।’ গোরায় হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যে ধর্ম সেবারূপে, প্রেমরূপে, করুণারূপে, আত্মত্যাগরূপে এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধারূপে সকলকে শক্তি দেয়, প্রাণ দেয়, কল্যাণ দেয়, কোথাও তাহাকে দেখা যায় না। যে আচার কেবল রেখা টানে, ভাগ করে, পীড়া দেয়, যাহা বুদ্ধিকেও কোথাও আমল দিতে চায় না, যাহা প্রীতিকেও দূরে খেদাইয়া রাখে, তাহাই সকলকে চলিতে-ফিরিতে উঠিতে-বসিতে সকল বিষয়েই কেবল বাধা দিতে থাকে।’ এবং মুসলমানদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘মুসলমানদের মধ্যে সেই জিনিসটি আছে যাহা অবলম্বন করিয়া তাহাদিগকে এক করিয়া দাঁড় করানো যায়।ৃ ধর্মের দ্বারা মুসলমান এক, কেবল আচারের দ্বারা নহে। এক দিকে যেমন আচারের বন্ধন তাহাদের সমস্ত কর্মকে অনর্থক বাঁধিয়া রাখে নাই, অন্য দিকে তেমনি ধর্মের বন্ধন তাহাদের মধ্যে একান্ত ঘনিষ্ঠ। তাহারা সকলে মিলিয়া এমন একটি জিনিসকে গ্রহণ করিয়াছে যাহা ‘না’-মাত্র নহে, যাহা ‘হাঁ’; যাহা ঋণাত্মক নহে, যাহা ধনাত্মক; যাহার জন্য মানুষ এক আহ্বানে এক মুহূর্তে একসঙ্গে দাঁড়াইয়া অনায়াসে প্রাণবিসর্জন করিতে পারে।’ গোরার এই প্রত্যেকটি বিষয়ের উপস্থিতি আমরা ‘মুসলমানীর গল্প’তেও দেখি। এ পর্যায়ে গোরার এ চুম্বক অংশগুলো টেম্পলেট আকারে স্থিরচিত্র হিসেবে দেখানো হয়।

আসাদ চৌধুরী বলেন, “ধর্মীয় সংস্কারের ঊর্ধ্বে মানুষের যে নিজস্ব বৃত্তি বা মানবধর্ম এবং একইসঙ্গে ভারতীয়তাবাদ – এই আছে গোরায়। আমি জাতীয়তাবাদ বলতে চাইছি না। কারণ এর সঙ্গে ধর্মের মিশ্রণ ছিল। রবীন্দ্রনাথ কয়েকটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতেন যেমন নেশন, রিলিজিয়ন। তিনি নেশনকে বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে শান্তিনিকেতন একটা আশ্রম করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আশ্রম না হয়ে হয়ে গেল বিশ্বভারতী। সেখানে সঙ্গীত, চিত্রকলা, নৃত্য পাঠ্য। সবকিছুকে ধারণ করা, বৈপরীত্যকে ধারণ করা এবং তার মধ্যে নিজের সত্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম ছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথ এতো বড়ো। রবীন্দ্রনাথ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন, হিন্দু মুসলমানের বিরুদ্ধে যেটা করে সেটা হচ্ছে নিতান্তই আচার, ধর্ম না।”

রবীন্দ্রনাথ যে কাজটি উপন্যাসে, ছোটোগল্প কিংবা কবিতায় ততটা ব্যাপ্তভাবে করেননি, কিন্তু প্রবন্ধে নানাসময়ে নানাভাবে তিনি হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের গভীরে প্রবেশ করেছেন, আমরা জানি। সেরকম কয়েকটি প্রবন্ধের নাম করা যেতে পারে – প্রাচ্য সমাজ, সুবিচারের অধিকার, সদুপায়, ইংরাজ ও ভারতবাসী, হিন্দু ও মুসলমান, কোট বা চাপকান, ব্যাধি ও প্রতিকার, সমস্যা, পূর্ব ও পশ্চিম, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, লোকহিত, ছোটো ও বড়ো, বাতায়নিকের পত্র, মুসলমান ছাত্রের বাংলা শিক্ষা, মানুষের ধর্ম ইত্যাদি। এ প্রবন্ধগুলোর সময়কাল ১৮৯১-১৯২৩। এই প্রবন্ধগুলোতে রবীন্দ্রনাথ মূলত – ১) খণ্ড বনাম সমগ্র ২) ধর্মের অচলায়তন ৩) হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ধর্মবিদ্বেষ জাগিয়ে রাখতে প্রশাসন ও রাষ্ট্রের ভূমিকা/ প্রধান দুই ধর্মীয় স¤প্রদায়ের অনৈক্যকে বিরোধে পরিণত করে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল ৪) ধর্মীয় সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর মধ্যে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পর্যায়ে অধিকারের সাম্য প্রতিষ্ঠা/ হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক শক্তির সমকক্ষতা ৫) শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ে নিজেদের আবদ্ধ না-রাখা/ আত্ম-পর তৈরি না-করা ৬) হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে স্বার্থভিত্তিক না বরং সত্যিকার ঐক্য প্রতিষ্ঠা/হিন্দু-মুসলমান একে অন্যকে আনুষঙ্গিক মনে না-করে সঙ্গী হয়ে ওঠা ৭) ধর্মীয় শাস্ত্রমতকে বাহ্য আচারনির্ভরতা থেকে মুক্ত করা ৮) ভেদ ঘুচিয়ে এক হওয়া না বরং ভেদ রক্ষা করেই মিলন/অভিন্নতার বিচারে না বরং বিরুদ্ধ বিশ্বাস বা ভিন্নতার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে ঐক্য নির্মাণ ৯) গভীরভাবে জানার ভেতর দিয়েই হিন্দু-মুসলমান পরষ্পরের ভেদ ঘোচানো – এ বিষয়গুলো সামনে এনেছেন।

আসাদ চৌধুরী বলেন, “রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে দেখা যায়, রাজনীতির আলোকে না, ধর্মীয় গোঁড়ামির আলোকে না, তিনি হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বুঝতে চেয়েছিলেন সমস্তকিছু মিলিয়ে সামগ্রিকতায়। আজ রবীন্দ্রনাথের গান জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে তিনটি দেশে গাওয়া হয়। বাংলার বড়ো অংশ জুড়ে গাওয়া হয় ‘আমার সোনার বাংলা।’ এবং এটা অর্জন করতে হয়েছে ভাষাকে কেন্দ্র করে। এটা খুব বড়ো একটা ব্যাপার। আমাদের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া এবং বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতা পাওয়া। কোলকাতায় গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, কবিগুরু আপনি বলেছিলেন, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি। আজ দেখেন, বাঙালি মানুষ হয়েছে। আমার এখন হাত জোড় করে বলতে ইচ্ছে হয়, বাংলাদেশি হবার বহু টালবাহানা হয়েছে, এবার বরং বাঙালি হও। গুরুসদয় দত্তের কথায় – বিশ্বমানব হবি যদি, কায়মনে বাঙালি হ।”

হিন্দু-মুসলমান প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘যে-দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোনো বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেইটেকেই সহজ প্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি। যে দেশে ধর্মই সেই বুদ্ধিকে পীড়িত করে রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি কি সে-দেশকে বাঁচাতে পারে।’… ‘হিন্দুসমাজে আচার নিয়েছে ধর্মের নাম। এই কারণে আচারের পার্থক্যে পরস্পরের মধ্যে কঠিন বিচ্ছেদ ঘটায়। মৎস্যাশী বাঙালিকে নিরামিষ প্রদেশের প্রতিবেশী আপন বলে মনে করতে কঠিন বাধা পায়। সাধারণত বাঙালি অন্য প্রদেশে গিয়ে অভ্যস্ত আচারের ব্যতিক্রম উপলক্ষ্যে অবজ্ঞা মনের মধ্যে পোষণ করে। যে চিত্তবৃত্তি বাহ্য আচারকে অত্যন্ত বড়ো মূল্য দিয়ে থাকে তার মমত্ববোধ সংকীর্ণ হতে বাধ্য।’… ‘ধর্ম আমাদের মেলাতে পারেনি, বরঞ্চ হাজারখানা বেড়া গড়ে তুলে সেই বাধাগুলোকে ইতিহাসের অতীত শাশ্বত বলে পাকা করে দিয়েছে।’… ‘ধর্মমত ও সমাজরীতি সম্বন্ধে হিন্দু-মুসলমানে শুধু প্রভেদ নয়, বিরুদ্ধতা আছে, এ কথা মানতেই হবে। অতএব আমাদের সাধনার বিষয় হচ্ছে, তৎসত্তে¡ও ভালোরকম করে মেলা চাই। এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ আমাদের না হলে নয়। কিন্তু এর একান্ত আবশ্যকতার কথা আমাদের সমস্ত হৃদয়মন দিয়ে আজও ভাবতে আরম্ভ করি নি।’… ‘নানা উপলক্ষ্যে এবং বিনা উপলক্ষ্যে সর্বদা আমাদের পরস্পরের সঙ্গ ও সাক্ষাৎ-আলাপ চাই। যদি আমরা পাশাপাশি চলি, কাছাকাছি আসি, তা হলেই দেখতে পাব, মানুষ ব’লেই মানুষকে আপন ব’লে মনে করা সহজ। যাদের সঙ্গে মেলামেশা নেই তাদের সম্বন্ধেই মত প্রভৃতির অনৈক্য অত্যন্ত কড়া হয়ে ওঠে, বড়ো হয়ে দেখা দেয়। যখনই পরস্পর কাছাকাছি আনাগোনার চর্চা হতে থাকে তখনই মত পিছিয়ে পড়ে, মানুষ সামনে এগিয়ে আসে।’ রবীন্দ্রনাথের মুসলমানকে কাছ থেকে দেখা এবং তাঁদের জানা পূর্ববঙ্গে জমিদারি সামলাতে গিয়ে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি দেখাশোনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে মুসলমান প্রজাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশতে হয়েছে। তিনি সেই অভিজ্ঞতাও বর্ণনা করেছেন এই প্রবন্ধে। ‘আমার অধিকাংশ প্রজাই মুসলমান। কোরবানি নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্রবল তখন হিন্দু প্রজারা আমাদের এলাকায় সেটা সম্পূর্ণ রহিত করবার জন্য আমার কাছে নালিশ করেছিল। সে নালিশ আমি সংগত বলে মনে করিনি, কিন্তু মুসলমান প্রজাদের ডেকে যখন বলে দিলুম কাজটা যেন এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যাতে হিন্দুদের মনে অকারণে আঘাত না লাগে, তারা তখনই তা মেনে নিল। আমাদের সেখানে এ পর্যন্ত কোনো উপদ্রব ঘটে নি। আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ, আমার সঙ্গে আমার মুসলমান প্রজার সম্বন্ধ সহজ ও বাধাহীন।’… ‘এ কথা আশা করাই চলে না যে, আমাদের দেশের ভিন্ন ভিন্ন সমাজের মধ্যে ধর্মকর্মের মতবিশ্বাসের ভেদ একেবারেই ঘুচতে পারে। তবুও মনুষ্যত্বের খাতিরে আশা করতেই হবে, আমাদের মধ্যে মিল হবে। পরস্পরকে দূরে না রাখলেই সে মিল আপনিই সহজ হতে পারবে। সঙ্গের দিক থেকে আজকাল হিন্দু-মুসলমান পৃথক হয়ে গিয়ে সা¤প্রদায়িক অনৈক্যকে বাড়িয়ে তুলেছে, মনুষ্যত্বের মিলটাকে দিয়েছে চাপা। আমি হিন্দুর তরফ থেকেই বলছি, মুসলমানের ত্রুটিবিচারটা থাক্? — আমরা মুসলমানকে কাছে টানতে যদি না পেরে থাকি তবে সেজন্যে যেন লজ্জা স্বীকার করি। অল্পবয়সে যখন প্রথম জমিদারি সেরেস্তা দেখতে গিয়েছিলুম তখন দেখলুম, আমাদের ব্রাহ্মণ ম্যানেজার যে তক্তপোষে গদিতে বসে দরবার করেন সেখানে এক ধারে জাজিম তোলা, সেই জায়গাটা মুসলমান প্রজাদের বসবার জন্যে; আর জাজিমের উপর বসে হিন্দু প্রজারা। এইটে দেখে আমার ধিক্কার জন্মেছিল।’

১৯২০-২১ সালে সালে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে মাওলানা মহম্মদ আলী ও গান্ধীজীর নেতৃত্বে হিন্দু-মুসলমানের পুনর্মিলনের একটা উদ্যোগ শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, এ মিলন স্থায়ী হবে না। ‘সমস্যা’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, ‘একটি প্রধান সমস্যা হিন্দু-মুসলমান সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান এত দুঃসাধ্য তার কারণ দুই পক্ষই মুখ্যত আপন আপন ধর্মের দ্বারাই অচলভাবে আপনাদের সীমানির্দেশ করেছে। সেই ধর্মই তাদের মানববিশ্বকে সাদা কালো ছক কেটে দুই সুস্পষ্ট ভাগে বিভক্ত করেছে– আত্ম ও পর। সংসারে সর্বত্রই আত্মপরের মধ্যে কিছু পরিমাণে স্বাভাবিক ভেদ আছে। সেই ভেদের পরিমাণটা অতিমাত্রায় হলেই তাতে অকল্যাণ হয়।’… ‘‘ভারতবর্ষের কল্যাণ যদি চাই হিন্দু মুসলমানের কেবল যে মিলিত হতে হবে তা নয়, সমকক্ষ হতে হবে। সমকক্ষতা তাল-ঠোকা পালওয়ানি ব্যক্তিগত সমকক্ষতা নয়, উভয় পক্ষের সামাজিক সমকক্ষতা।’

খ্যাতনামা জমিদার শ্রীযুক্ত সৈয়দ নবাব আলি চৌধুরী মহাশয় রচিত বাংলা শিক্ষা সম্বন্ধে একটি উর্দু প্রবন্ধের ইরেজি ভাষ্যের রবীন্দ্রনাথকৃত পর্যালোচনার নাম ‘মুসলমান ছাত্রের বাংলা শিক্ষা।’ এই প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, ‘স্বধর্মের সদুপদেশ এবং স্বজাতীয় সাধুদৃষ্টান্ত মুসলমান বালকের পক্ষে একান্ত আবশ্যক, এক কথা কেহই অস্বীকার করিবেন না। আমরা আরও বলি মুসলমান শাস্ত্র ও সাধুদৃষ্টান্তের সহিত পরিচয় হিন্দু বালকদের শিক্ষার অবশ্যধার্য অঙ্গ হওয়া উচিত।’… ‘বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান যখন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, পরস্পরের সুখ-দুঃখ নানা সূত্রে বিজড়িত, একের গৃহে অগ্নি লাগিলে অন্যকে যখন জল আনিতে ছুটাছুটি করিতে হয়, তখন শিশুকাল হইতে সকল বিষয়েই পরস্পরের সম্পূর্ণ পরিচয় থাকা চাই। বাঙালি হিন্দুর ছেলে যদি তাহার প্রতিবেশী মুসলমানের শাস্ত্র ও ইতিহাস এবং মুসলমানের ছেলে তাহার প্রতিবেশী হিন্দুর শাস্ত্র ও ইতিহাস অবিকৃতভাবে না জানে তবে সেই অসম্পূর্ণ শিক্ষার দ্বারা তাহারা কেহই আপন জীবনের কর্তব্য ভালো করিয়া পালন করিতে পারিবে না।’… ‘ইংরাজি শিক্ষার যেরূপ প্রচলন হইয়াছে, তাহাতে ইংরাজের ইতিহাস, সমাজতত্ত¡, আচার-বিচার আমাদের কাছে লেশমাত্র অগোচর থাকে না; অথচ তাহারা বহুদূরদেশী এবং মুসলমানরা আমাদের স্বদেশীয়, এবং মুসলমানদের সহিত বহুদিন হইতে আমাদের রীতিনীতি পরিচ্ছদ ভাষা ও শিল্পের আদান-প্রদান চলিয়া আসিয়াছে। অদ্য নূতন ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে আত্মীয়ের মধ্যে প্রতিবেশীর মধ্যে ব্যবধান দাঁড়াইয়া গেলে পরম দুঃখের কারণ হইবে। বাঙালি মুসলমানের সহিত বাঙালি হিন্দুর রক্তের সম্বন্ধ আছে, এ কথা আমরা যেন কখনো না ভুলি।’

হিন্দু আর মুসলমানের পার্থ্যক্যের বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ শতকের প্রথমার্ধটি ছিল এই দুই স¤প্রদায়ের মুখোমুখি রাজনীতির ইতিহাস। উগ্র-সা¤প্রদায়িক রাজনীতির সেই যুগে খুব কম মানুষই ভবিষ্যতের মিলনে আশা রেখেছিলেন, কেউ কেউ অমিলটাকে ধামাচাপা দিয়ে রাজনৈতিক জোড়াতালির সুবিধার পক্ষে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মুসলমানের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের আকাঙ্ক্ষাকে সবসময় মূল্য দিয়েছেন, কিন্তু মিলন তার কাছে অসম্ভব কল্পনা ছিল না। তার পথও তিনি দেখেছেন। ছোটো ও বড়ো প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘কিন্তু বিশেষ শাস্ত্রমতের অনুশাসনে বিশেষ করিয়া যদি কেবল বিশেষ পশুহত্যা না করাকেই ধর্ম বলা যায় এবং সেইটে জোর করিয়া যদি অন্য ধর্মমতের মানুষকেও মানাইতে চেষ্টা করা হয়, তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিরোধ কোনোকালেই মিটিতে পারে না। নিজে ধর্মের নামে পশুহত্যা করিব অথচ অন্যে ধর্মের নামে পশুহত্যা করিলেই নরহত্যার আয়োজন করিতে থাকিব, ইহাকে অত্যাচার ছাড়া আর কোনো নাম দেওয়া যায় না। আমাদের আশা এই যে, চিরদিন আমাদের ধর্ম আচারপ্রধান হইয়া থাকিবে না। আরো একটি আশা আছে, একদিন হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দেশহিতসাধনের একই রাষ্ট্রীয় আইডিয়াল যদি আমাদের রাষ্ট্রতন্ত্রে বাস্তব হইয়া উঠে তবে সেই অন্তরের যোগে বাহিরের সমস্ত পার্থক্য তুচ্ছ হইয়া যাইবে।’

রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা বিষয়ক অনেক প্রবন্ধে জোর দিয়েছেন স্বাতন্ত্র্য রেখে এক হবার ওপর এবং মনে করিয়ে দিয়েছেন বারবার – একাকার হওয়া এবং এক হওয়া এক না। এরই প্রতিধ্বনি আমরা পাই তাঁর ‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধে। তিনি লিখছেন, ‘একান্ত মিলনেই যে সবলতা এবং বৃহৎ হইলেই যে মহৎ হওয়া যায় একথা এখনকার কথা নহে। আসল কথা, পার্থক্য যেখানে সত্য, সেখানে সুবিধার খাতিরে, বড়ো দল বাঁধিবার প্রলোভনে তাহাকে চোখ বুজিয়া লোপ করিবার চেষ্টা করিলে সত্য তাহাতে সম্মতি দিতে চায় না । চাপা-দেওয়া পার্থক্য ভয়ানক একটা উৎপাতক পদার্থ, তাহ কোনো-না-কোনো সময়ে ধাক্কা পাইলে হঠাৎ ফাটিয়া এবং ফাটাইয়া একটা বিপ্লব বাধাইয়া তোলে। যাহারা বস্তুতই পৃথক, তাহাদের পার্থক্যকে সম্মান করাই মিলন রক্ষার সদুপায়।’… ‘আজ পরম্পরের সংঘাতে সমস্ত পৃথিবীতেই একটা জাগরণ সঞ্চারিত হইয়াছে বলিয়া বিকাশের অনিবার্য নিয়মে মনুষ্য-সমাজের স্বাভাবিক পার্থক্যগুলি আত্মরক্ষার জন্য চতুর্দিকে সচেষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। আপনাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করিয়া অন্যের সঙ্গে একেবারে মিলিয়া গিয়া যে বড়ো হওয়া তাহাকে কোনো জাগ্রৎসত্তা বড়ো হওয়া মনে করিতেই পারে না। যে ছোটো সেও যখনই আপনার সত্যকার স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সচেতন হইয় উঠে তখনই সেটিকে বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য প্রাণপণ করে-ইহাই প্রাণের ধর্ম। বস্তুত সে ছোটো হইয়াও বঁচিতে চায়, বড়ো হইয়া মরিতে চায় না।’… ‘স্বাতন্ত্র্যের গৌরববোধ জন্মিলেই মানুষ দুঃখ স্বীকার করিয়াও আপনাকে বড়ো করিয়া তুলিতে চাহিবে। বড়ো হইয়া উঠিলে তখনই পরম্পরের মিলন সত্যকার সামগ্রী হইবে। দীনতার মিলন, অধীনতার মিলন, এবং দায়ে পড়িয়া মিলন গোঁজামিলন মাত্র।’… ‘আমাদের দেশে ভারতবর্ষীয়দের মধ্যে রাষ্ট্রী ঐক্যলাভের চেষ্টা যখনই প্রবল হইল, অর্থাৎ যখনই নিজের সভা সম্বন্ধে আমাদের বিশেষভাবে চেতনার উদ্রেক হইল তখনই আমরা ইচ্ছা করিলাম বটে মুসলমানদিগকেও আমাদের সঙ্গে এক করিয়া লই, কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য হইতে পারিলাম না। এক করিয়া লইতে পারিলে আমাদের সুবিধা হইতে পারিত বটে, কিন্তু সুবিধা হইলেই যে এক করা যায় তাহা নহে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে একটি সত্য পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই। প্রয়োজনসাধনের আগ্রহবশত সেই পার্থক্যকে যদি আমরা না মানি তবে সেও আমাদের প্রয়োজনকে মানিবে না।’… ‘হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে
এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমানকে যখন আহবান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায় বলিয়া ডাকিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া অনুভব করি নাই, আনুষঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। যেখানে দুইপক্ষের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে সেখানে যদি তাহারা শরিক হয়, তবে কেবল ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বন্ধন থাকে যতদিন বাহিরের কোনো বাধা অতিক্রমের জন্য তাহাদের একত্র থাকা আবশ্যক হয় – সে আবশ্যকটা অতীত হইলেই ভাগবাঁটোয়ারার বেলায় উভয় পক্ষেই ফাঁকি চলিতে থাকে।’… ‘এখন জগৎ জুড়িয়া সমস্যা এ নহে যে কী করিয়া ভেদ ঘুচাইয়া এক হইব কিন্তু কি করিয়া ভেদ রক্ষা করিয়া মিলন হইবে। সে কাজটা কঠিন কারণ সেখানে কোন প্রকার ফাঁকি চলে না সেখানে পরস্পরকে পরস্পর জায়গা ছাড়িয়া দিতে হয়। সেটা সহজ নহে কিন্তু যেটা সহজ সেটা সাধ্য নহে পরিণামের দিকে দেখিলে দেখা যায় যেটা কঠিন সেটাই সহজ।’… ‘আজ আমাদের দেশে মুসলমান স্বতন্ত্র থাকিয়া নিজের উন্নতি সাধনের চেষ্টা করিতেছে। তাহা আমাদের পক্ষে যতই অপ্রিয় এবং তাহাতে আমাদের আপাত যতই অসুবিধা হউক একদিন পরস্পরের যথার্থ মিলন সাধনের পক্ষে ইহাই প্রকৃত উপায়। ধনী না হইলে দান করা কষ্টকর; মানুষ যখন আপনাকে বড় করে তখনি আপনাকে ত্যাগ করিতে পারে। যতদিন অভাব ও ক্ষুদ্রতা ততদিনই তাহার ঈর্ষা ও বিরোধ। ততদিন সে যদি সে আর কাহারো সাথে মেলে তবে দায়ে পড়িয়া মেলে – সে মিলন কৃত্রিম মিলন। ছোট বলিয়া আত্মলোপ করাটা অকল্যাণ, বড় হইয়া আত্মবিসর্জন করাটাই শ্রেয়।’… ‘আধুনিক কালের শিক্ষার প্রতি সময় থাকিতে মনোযোগ না করায় ভারতবর্ষের মুসলমান হিন্দুর চেয়ে অনেক পিছনে পড়িয়াছে। সেখানে তাহাকে সমান করিয়া লইতে হইবে। সে বৈষ্যমটি দূর করিবার জন্য মুসলমান সকল বিষয়েই হিন্দুর চেয়ে বেশী দাবী করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহাদের এই দাবীতে আমাদের আন্তরিক সম্মতি থাকাই উচিত। পদ-মান-শিক্ষায় তাহারা হিন্দুর সমান হইয়া উঠে ইহা হিন্দুর পক্ষেই মঙ্গলকর।’

‘প্রাচ্য সমাজ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘য়ুরোপে এসিয়ায় প্রধান প্রভেদ এই যে, য়ুরোপে মনুষ্যের একটা গৌরব আছে, এসিয়াতে তাহা নাই। এই হেতু এসিয়ায় বড়ো লোককে মহৎ মনুষ্য বলে না, একেবারে দেবতা বলিয়া বসে; কিন্তু য়ুরোপের কর্মপ্রধান দেশে প্রতিদিনই মনুষ্য নানা আকারে আপনার ক্ষমতা প্রকাশ করিতেছে, সেইজন্য তাহারা আপনাকে নগণ্য, জীবনকে স্বপ্ন এবং জগৎকে মায়া মনে করিতে পারে না। প্রাচ্য খৃষ্টীয় ধর্মের প্রভাবে য়ুরোপীয়দের মনে মধ্যে মধ্যে বিপরীত ভাব উপস্থিত হইলেও তাহা প্রবল কর্মের স্রোতে ভাসিয়া যায়। তাই সেখানে রাজার একাধিপত্য ভাঙিয়া আসে, পুরোহিতের দেবত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উপস্থিত হয় এবং গুরুবাক্যের অভ্রান্তিকতার উপরে স্বাধীনবুদ্ধি জয়লাভ করে।’… ‘আমাদের পূর্বাঞ্চলে প্রবলা প্রকৃতির পদতলে অভিভূতভাবে বাস করিয়া প্রত্যেক মানুষ নিজের অসারতা ও ক্ষুদ্রতা অনুভব করে; এইজন্য কোনো মহৎ লোকের অভ্যুদয় হইলে তাঁহাকে স্বশ্রেণী হইতে সম্পূর্ণ পৃথক করিয়া দেবতা-পদে স্থাপিত করে। তাহার পর হইতে তিনি যে-কয়টি কথা বলিয়া গিয়াছেন বসিয়া বসিয়া তাহার অক্ষর গণনা করিয়া জীবনযাপন করি; তিনি সাময়িক অবস্থার উপযোগী যে-বিধান করিয়া গিয়াছেন তাহার রেখামাত্র লঙ্ঘন করা মহাপাতক জ্ঞান করিয়া থাকি। পুনর্বার যুগান্তরে দ্বিতীয় মহৎলোক দেবতাভাবে আবির্ভূত হইয়া সময়োচিত দ্বিতীয় পরিবর্তন প্রচলিত না করিলে আমাদের আর গতি নাই। আমরা যেন ডিম্ব হইতে ডিম্বান্তরে জন্মগ্রহণ করি। একজন মহাপুরুষ প্রাচীন প্রথার খোলা ভাঙিয়া যে-নূতন সংস্কার আনয়ন করেন তাহাই আবার দেখিতে দেখিতে শক্ত হইয়া উঠিয়া আমাদিগকে রুদ্ধ করে। পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হইয়া নিজের যতেœ নিজের উপযোগী খাদ্যসংগ্রহ আমাদের দ্বারা আর হইয়া উঠে না। মহম্মদ প্রাচীন আরব কুপ্রথা কিয়ৎপরিমাণে দূর করিয়া তাহাদিগকে যেখানে দাঁড় করাইলেন তাহারা সেইখানেই দাঁড়াইল, আর নড়িল না। কোনো সংস্কারকার্য বীজের মতো ক্রমশ অঙ্কুরিত হইয়া যে পরিপুষ্টতা লাভ করিবে, আমাদের সমাজ সেরূপ জীবনপূর্ণ ক্ষেত্র নহে। মনুষ্যত্বের মধ্যে যেন প্রাণধর্মের অভাব। এইজন্য উত্তরোত্তর উৎকর্ষ লাভ না করিয়া বিশুদ্ধ আদর্শ ক্রমশই বিকৃতি লাভ করিতে থাকে। যেমন পাখি তা’ না দিলে ডিম পচিয়া যায়, সেইরূপ কালক্রমে মহাপুরুষের জীবন্ত প্রভাবের উত্তাপ যতই দূরবর্তী হয় ততই আবরণবদ্ধ সমাজের মধ্যে বিকৃতি জন্মিতে থাকে।’

‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনোমতেই নিষ্কৃতি নাই। আর মিথ্যা কথা বলিবার কোনো প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নয়। আমরা বিরুদ্ধ। আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখদুঃখে মানুষ; তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন-একটি পাপ আমরা পোষণ করিয়াছি যে, একত্রে মিলিয়াও আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই। এ পাপকে ঈশ্বর কোনোমতেই ক্ষমা করিতে পারেন না।’ ৃ ‘আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমানে বসে না, ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়। তর্ক করিবার বেলায় বলিয়া থাকি, কী করা যায়, শাস্ত্র তো মানিতে হইবে। অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার তো কোনো বিধান দেখি না। যদি-বা শাস্ত্রের সেই বিধানই হয় তবে সে শাস্ত্র লইয়া স্বদেশ-স্বজাতি-স্বরাজের প্রতিষ্ঠা কোনোদিন হইবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই। তাহারা যাহাদিগকে ¤েøচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেছে সেই ¤েøচ্ছের অবজ্ঞা তাহাদিগকে সহ্য করিতে হইবেই।’ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী রাজনীতিতে মুসলমান সমাজের সংশ্লিষ্টতা বোধ না করাটা যুক্তিহীন ছিল না, বরং তার কার্যকারণ সমাজ বাস্তবতার মাঝেই বিরাজমান ছিল, সেই অবিশ্বাস্যপ্রায় উপলদ্ধিটা রবীন্দ্রনাথের মাঝে আমরা পাই। এই প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথ আরো বলছেন, ‘যাহাদিগকে আমরা ‘চাষা বেটা’ বলিয়া জানি, যাহাদের সুখদুঃখের মূল্য আমাদের কাছে অতি সামান্য, যাহাদের অবস্থা জানিতে হইলে আমাদিগকে গবর্মেন্টের প্রকাশিত তথ্যতালিকা পড়িতে হয়, সুদিনে দুর্দিনে আমরা যাহাদের ছায়া মাড়াই না, আজ হঠাৎ ইংরেজের প্রতি স্পর্ধা প্রকাশ করিবার বেলায় তাহাদের নিকট ভাই-সম্পর্কের পরিচয় দিয়া তাহাদিগকে চড়া দামে জিনিস কিনিতে ও গুর্খার গুঁতা খাইতে আহবান করিলে আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহ জন্মিবার কথা। সন্দেহ জন্মিয়াও ছিল। কোনো বিখ্যাত ‘স্বদেশী’ প্রচারকের নিকট শুনিয়াছি যে, পূবর্বঙ্গে মুসলমান শ্রোতারা তাঁহাদের বক্তৃতা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিয়াছে যে, বাবুরা বোধ করি বিপদে ঠেকিয়াছে। ইহাতে তাঁহারা বিরক্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু চাষা ঠিক বুঝিয়াছিল। বাবুদের স্নেহভাষণের মধ্যে ঠিক সুরটা যে লাগে না তাহা তাহাদের বুঝিতে বিলম্ব হয় নাই। উদ্দেশ্যসাধনের উপলক্ষে প্রেমের সম্বন্ধ পাতাইতে গেলে ক্ষুদ্র ব্যক্তির কাছেও তাহা বিস্বাদ বোধ হয়, সে উদ্দেশ্য খুব বড়ো হইতে পারে, হউক তাহার নাম ‘বয়কট’ বা ‘স্বরাজ’, দেশের উন্নতি বা আর-কিছু। মানুষ বলিয়া শ্রদ্ধাবশত ও স্বদেশী বলিয়া স্নেহবশত আমরা যদি সহজেই দেশের জনসাধারণকে ভালোবাসিতাম, ইংরেজি শিক্ষায় আমাদের পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদ না ঘটাইয়া মিলনকে যদি দৃঢ় করিতে পারিত, তাহাদের মাঝখানে থাকিয়া তাহাদের আপন হইয়া তাহাদের সর্বপ্রকার হিতসাধনে যদি আমাদের উপেক্ষা বা আলস্য না থাকিত, তবে আজ বিপদ বা ক্ষতির মুখে তাহাদিগকে ডাক পাড়িলে সেটা অসংগত শুনিতে হইত না।’… ‘হিন্দু-মুসলমান এক হইলে পরস্পরের কত সুবিধা একদিন কোনো সভায় মুসলমান শ্রোতাদিগকে তাহাই বুঝাইয়া বলা হইতেছিল। তখন আমি এই কথাটি না বলিয়া থাকিতে পারি নাই যে, সুবিধার কথাটা এ স্থলে মুখে আনিবার নহে; দুই ভাই এক হইয়া থাকিলে বিষয়কর্ম ভালো চলে, কিন্তু সেইটেই দুই ভাই এক থাকিবার প্রধান হেতু হওয়া উচিত নহে। কারণ, ঘটনাক্রমে সুবিধার গতি পরিবর্তন হওয়াও আশ্চর্যকর নহে। আসল কথা, আমরা এক দেশে এক সুখদুঃখের মধ্যে একত্রে বাস করি, আমরা মানুষ, আমরা যদি এক না হই তবে সে লজ্জা, সে অধর্ম। আমরা উভয়েই এক দেশের সন্তান, আমরা ঈশ্বরকৃত সেই ধর্মের বন্ধনবশত, শুধু সুবিধা নহে, অসুবিধাও একত্রে ভোগ করিতে প্রস্তুত, যদি না হই তবে আমাদের মনুষ্যত্বে ধিক্। আমাদের পরস্পরের মধ্যে, সুবিধার চর্চা নহে, প্রেমের চর্চা, নিঃস্বার্থ সেবার চর্চা যদি করি তবে সুবিধা উপস্থিত হইলে তাহা পুরা প্রহণ করিতে পারিব এবং অসুবিধা উপস্থিত হইলেও তাহাকে বুক দিয়া ঠেকাইতে পারিব।’

‘পূর্ব ও পশ্চিম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘আমরা মনে করি জগতে স্বত্বের লড়াই চলিতেছে, সেটা আমাদের অহংকার; লড়াই যা সে সত্যের লড়াই।’… ‘আমরা বৃহৎ ভারতবর্ষকে গড়িয়া তুলিবার জন্য আছি। আমরা তাহার একটা উপকরণ। কিন্তু উপকরণ যদি এই বলিয়া বিদ্রোহ প্রকাশ করিতে থাকে যে আমরাই চরম, আমরা সমগ্রের সহিত মিলিব না, আমরা স্বতন্ত্র থাকিব, তবে সকল হিসাবেই ব্যর্থ হয়।’
‘বাতায়নিকের পত্র’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, নিজেরা বিভেদ করে দূর্বলতা করে রাখলে বিদেশী শক্তি বা তৃতীয় পক্ষ তো সেটা কাজে লাগাবেই।

‘সুবিচারের অধিকার’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, মুসলমান-হিন্দুর মধ্যে ধর্মবিদ্বেষ জাগিয়ে রাখতে প্রশাসন ও রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে। দুই প্রধান স¤প্রদায়ের অনৈক্যকে বিরোধে পরিণত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল নিয়ে। বলেছেন, সরকার কোনো স¤প্রদায়কে কোলে টানলে বা আকস্মিক বাৎসল্য দেখালে খুশি হবার কারণ নেই। এবং শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে না-পারলে সুবিচার আকর্ষণ করা কঠিন।
‘সদুপায়’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, বিলাতি পণ্য বয়কটকে প্রধান করে তুলে আসল কাজ বাংলাকে হিন্দু-বাংলা ও মুসলমান বাংলা করতে না-দেওয়াটাকে গৌণ করা হয়েছিল এবং ভাগকে ত্বরান্বিত করা হয়েছিল। নিম্নশ্রেণির প্রজাদের ভালো মন্দ বিচার করা হয়নি। মুসলমান ও নিম্ন শ্রেণির হিন্দুদের দলন করা হয়েছিল।

‘কোট বা চাপকান’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, পোশাক থেকে শুরু করে সঙ্গীত কোনোটাই মুসলমান বা হিন্দুর একার কৃতিত্ব না। অবিমিশ্র কিছু নেই। আরেক জায়গায় লিখছেন, হিন্দু-মুসলমান ধর্মে না মিললেও জনবন্ধনে মিলবে।

এ পর্যায়ে প্রবন্ধগুলোর উল্লেখিত অংশ টেম্পলেট আকারে স্থিরচিত্র হিসেবে দেখানো হয় এবং আলোচক আসাদ চৌধুরী প্রবন্ধগুলোর উদ্ধৃত অংশের সম্পূরক আলোচনা করেন। এরপর প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা হয় ১৯৯০ সালে প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত, ভূঁইয়া ইকবালের ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’ বইটির কথা। এতে প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ তো সংকলিত রয়েছেই, একইসঙ্গে বইটিকে রবীন্দ্রনাথের গোটা জীবনে মুসলিম সমাজ ও মুসলিম সাহিত্যিকদের সঙ্গের জার্নির একটা দারুণ এন্থলজি বলা যেতে পারে। আরো উল্লেখ করা হয় বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৮২ সালে প্রকাশিত আসাদ চৌধুরীর ‘কোন অলকার ফুল’ বইয়ের ‘রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি-চর্চার এক দিক’ আর ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’ প্রবন্ধের কথা। এ প্রসঙ্গে আসাদ চৌধুরী বলেন, “১৯৬৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে শিক্ষকতার সময় আমার এক ছাত্র আমাকে বললেন, রবীন্দ্রনাথ কী লিখেছেন মুসলমানদের জন্য? তখন আমি এই বইয়ের ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’ প্রবন্ধটা লিখি। এটা আমার জীবনের দ্বিতীয় কি তৃতীয় প্রবন্ধ। আমি মূলত ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও আমার শিক্ষক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর লেখা ও অন্য অনেক সূত্র ঘেঁটে সাধু ভাষায় এই প্রবন্ধ লিখি। যে কারণে মৈত্রেয়ী দেবীর ধারণা হয়েছিল যে আমি একজন বয়ষ্ক মানুষ। এরপরও আমি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় লিখেছি।”

অনেক চিঠিতে, ভাষণে ও বক্তৃতায়ও রবীন্দ্রনাথ এই হিন্দু-মুসলমানের বিষয়ে লিখেছেন। ১৯২২ সালে কালিদাস নাগ বিলেত থেকে চিঠি লিখে জানতে চাইলেন, হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান কি? চিঠির জবাবে কবি লিখলেন, ‘খিলাফত উপলক্ষে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে, হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারেনি। আচার হচ্ছে মানুষের সম্বন্ধের সেতু, সেখানেই পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে।…অন্য আচার অবলম্বীদের অশুচি বলে গণ্য করার মত মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছুতেই নেই।’ চিঠির শেষে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসবো।’ রবীন্দ্রনাথ যথার্থই মনে করতেন হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ দূর হতে পারে মেলামেশা চেনাজানার মধ্যে দিয়ে। সেটাই একমাত্র পথ। কবি বিশ্বভারতী পরিষদে ১৩৩২ সনে এক বক্তৃতায় বলছেন, ‘যে অন্ধকারে ভারতবর্ষে আমরা পরস্পরকে ভালো দেখতে পাইনে সেইটাই আমাদের সকলের চেয়ে দুর্বলতার কারণ। …ভারতবর্ষের সেই রাত্রি চিরন্তন হয়ে রয়েছে। মুসলমান বলতে কী বোঝায় তা সম্পূর্ণ করে আপনার করে অর্থাৎ রামমোহন রায় যেমন করে জানতেন, তা খুব অল্প হিন্দুই জানেন। হিন্দু বলতে কী বোঝায় তাও বড়ো করে আপনার করে, দারাশিকো একদিন যেমন করে বুঝেছিলেন, অল্প মুসলমানই জানেন। অথচ এই রকম গভীর ভাবে জানার ভিতরেই পরস্পরের ভেদ ঘোছে।’
একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ যেমন বারবার তার ধর্মগ্রন্থের কাছে ফেরত যায়, তেমনি আবহমান অসা¤প্রদায়িক বাঙালিকে বারবার ‘গোরা’র কাছে ফিরতে হবে, ফিরতে হবে ‘মুসলমানীর গল্পে’র কাছে। আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮১তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে নিবেদিত পাঠশালার আসরে আলোচক কবি আসাদ চৌধুরীর আন্তরিক ও প্রাঞ্জল আলোচনা দর্শক-শ্রোতারা উপভোগ করেন। এই আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।

Exit mobile version