অনলাইন ডেস্ক : বাজারে ঝরঝরে মিহিদানার ১ কেজি লবণের দাম ৩৫ টাকা। যাঁরা অনলাইনে কেনাকাটা করেন, তাঁরা এখনই সুপরিচিত ই-কমার্স সাইটগুলোতে দাম দেখে নিতে পারেন।
আপনার হাতে যে লবণ কেজিপ্রতি ৩৫ টাকায় পৌঁছাচ্ছে, তা চাষ করে বছর বছর লোকসান গুনছেন চাষিরা। ওই এক কেজি লবণে দেড় টাকা মুনাফা করে পরিশোধনকারী কোম্পানি বিক্রি করে ২৫ টাকার কমে। লাভের গুড় আসলে খান খুচরা বিক্রেতারা, কেজিতে ৯ টাকা।
গড়পড়তা একটি পরিবারে রান্না, খাওয়া ও মাছ ধোয়ার কাজে মাসে ৩ কেজির মতো লবণ লাগেই। লবণে খুচরা বিক্রেতার লাভ যদি ৩ টাকায় সীমিত থাকত, তাহলে ১ কেজিতে একটি পরিবারের সাশ্রয় হতো ৬ টাকা। বাংলাদেশে বছরে লবণ কেনাবেচা হয় ১৭৪ কোটি কেজির বেশি। তাহলে ভেবে দেখুন, দেশের মানুষের কত টাকা বাড়তি ব্যয় হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, কোম্পানিগুলো কেন খুচরা বিক্রেতাকে এতটা বেশি মুনাফার সুযোগ দিচ্ছে? এর সমাধান কী? এসব জানিয়ে মাস দুয়েক আগে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। কিন্তু সমাধানের উদ্যোগ ততটা নেই।
লবণ খাতের সমস্যা নিয়ে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দিন বলেন, লবণের বিষয়টি দেখে শিল্প মন্ত্রণালয়। ট্যারিফ কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেটি শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে করণীয় নির্ধারণের জন্য।
চাহিদায় গোলমাল
দেশে জাতীয় লবণ নীতি নামের একটি নীতিমালা রয়েছে। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে অপরিশোধিত লবণের চাহিদা দেখানো হয়েছে ১৭ লাখ টনের কিছু বেশি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এ হিসাব মানে না।
লবণ মিলমালিক সমিতির হিসাবে, দেশে অপরিশোধিত লবণের চাহিদা ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন। নারায়ণগঞ্জ লবণ মিল মালিক গ্রুপের হিসাবে ২৮ লাখ টন। আর বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) হিসাবে ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন।
ট্যারিফ কমিশন অপরিশোধিত লবণের চাহিদা প্রাক্কলন করেছে ২২ লাখ ৩২ হাজার টন। কমিশন বলছে, লবণ নীতিতে রাসায়নিক, ওষুধ, সিরামিক, রং প্রভৃতি নানা শিল্পে লবণের চাহিদা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি পরিতোষ কান্তি সাহা বলেন, চাহিদা কম দেখানো নানা সমস্যার কারণ। চাহিদা কম ও উৎপাদন বেশি দেখানোর ফলে বৈধ পথে লবণ আমদানি করতে দেওয়া হয় না। অবৈধ পথে আসা লবণে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। এতে সরকার রাজস্ব হারায়। আর প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলো বাজার হিস্যা হারায়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) উৎপাদনের যে হিসাব দেয়, তার চেয়ে প্রকৃত উৎপাদন কম হয় বলে মনে করেন মিলমালিকেরা।
ট্যারিফ কমিশনের পর্যালোচনাও বলছে, বিসিকের হিসাব সঠিক নয়। কমিশনের হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতি কানিতে গড় উৎপাদন ২৫০ মণ ধরে সাড়ে ১৩ লাখ টন হয়েছে। আর ৩০০ মণ ধরে উৎপাদন হয়েছে সর্বোচ্চ সোয়া ১৬ লাখ টন। অবশ্য বিসিকের হিসাবে উৎপাদন ছিল আরও দুই লাখ টন বেশি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, মিলমালিকদের একাংশ সব সময় আমদানির সুযোগ চায়। আমদানি করলে চাষিরা বাঁচতে পারবেন না। এখন কি চাষিরা বাঁচতে পারছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সোডিয়াম সালফেট ও শিল্প লবণের নামে ভোজ্য লবণ আমদানি ঠেকাতে হবে।
ভুতুড়ে আমদানি
চাষিদের সুরক্ষা দিতে দেশে ভোজ্য লবণ আমদানি নিষিদ্ধ। উৎপাদন কম হলে মাঝেমধ্যে আমদানির সুযোগ দেয় সরকার। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, লবণ দুভাবে আমদানি হয়ে বাজারে চলে আসছে। একটি পথ হলো, রাসায়নিক কারখানার নামে আমদানি করা লবণ বাজারে ছেড়ে দেওয়া। আরেকটি পথ হলো, সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে ভোজ্য লবণ হিসেবে বাজারে ছেড়ে দেওয়া।
ভোজ্য লবণ আমদানিতে করভার ৮৯ শতাংশ। ওষুধশিল্পের জন্য লবণ আমদানিতে করভার ৩৭ শতাংশ। আর শিল্প লবণে (কস্টিক সোডাসহ অন্যান্য) ছিল ৩১ শতাংশ, এবারের বাজেটে যা ৪৩ শতাংশ করা হয়েছে। ওষুধশিল্পের জন্য আনা লবণ এ খাতে কোনো সমস্যা তৈরি করছে না বলে উল্লেখ করছেন মিলমালিকেরা। তাঁরা বলছেন, কস্টিক সোডা তৈরির নামে লবণ এনে বাজারে ছাড়ছেন অনেকে।
শিল্প লবণের নামে ভোজ্য লবণ আমদানি হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনেও। বলা হয়েছে, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এ লবণ আমদানি বেড়ে যায়। শিল্প লবণের নামে ভোজ্য লবণ আমদানি করতে পারলে অধিক মুনাফা করা সম্ভব। এটা ঠেকাতে কমিশনের সুপারিশ হলো, ভোজ্য লবণের শুল্ক আরও বাড়িয়ে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আমদানি উন্মুক্ত করে দেওয়া। এতে সরকার রাজস্ব পাবে। যেহেতু বাড়তি শুল্কে আমদানি খরচ বেশি পড়বে, সেহেতু চাষিরাও সুরক্ষিত থাকবেন।
বাজারে সুপরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর নাম ও মোড়কের নকশায় ভ্যাকুয়াম ইভাপোরেশন পদ্ধতিতে পরিশোধিত সাদা, ঝরঝরে মিহিদানার অনেক ব্র্যান্ডের লবণ অহরহ বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু সেই সব মিলের ভ্যাকুয়াম ইভাপোরেশন পদ্ধতিতে পরিশোধন কারখানাই নেই। মিলমালিকদের অভিযোগ, এসব মিল ধরা খুব সহজ। কিন্তু কেউ ব্যবস্থা নেয় না।
মোল্লা সল্টের মহাব্যবস্থাপক মো. আবদুল মান্নান বলেন, দেশে পাঁচটি কোম্পানির ভ্যাকুয়াম ইভাপোরেশন কারখানা রয়েছে। এর বাইরে অনেকগুলো ব্র্যান্ড কীভাবে ভ্যাকুয়াম ইভাপোরেশন পদ্ধতিতে প্রক্রিয়া করা লবণ বিক্রি করে?
চাষিদের লাভ নেই
বাংলাদেশ মূলত ভারত থেকে লবণ আমদানি করে। এক কেজি লবণ আমদানিতে ভারতে দাম পড়ে (এফওবি) ৯০ পয়সা থেকে ১ টাকা ২০ পয়সা। সব ধরনের কর ও খরচ দিয়ে এ লবণ কারখানায় পৌঁছাতে খরচ দাঁড়ায় কেজিপ্রতি ৬ টাকার কিছু কম।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, দেশে এক কেজি লবণের উৎপাদন খরচ ৫ টাকা ৬৭ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৮৭ পয়সা। ভারতে যেখানে দামই কেজিপ্রতি ১ টাকার আশপাশে, সেখানে বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ এত বেশি কেন, তার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে।
কমিশন বলছে, লবণ উৎপাদন ব্যয়ের ৪১ শতাংশই জমির ভাড়া। অবশ্য ভাড়ার পরিমাণ লবণের দামের সঙ্গে ওঠানামা করে। ভালো দাম দেখলে মালিকেরাও জমির ভাড়া বাড়িয়ে দেন।
দেশের কক্সবাজার জেলায় মূলত সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদিত হয়। এর সঙ্গে জড়িত ৪০ হাজারের বেশি চাষি। লবণ চাষি কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কায়সার ইদ্রিস বলেন, চাষিরা লবণ চাষ করে কোনো লাভ করতে পারছেন না। বিদেশ থেকে শিল্প লবণের নামে ভোজ্য লবণ এনে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। তাই চাষিরা উৎপাদন খরচের কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কয়েক বছর ধরে এই অবস্থা চলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ভোক্তার পকেট কাটা
দেশে তিন পদ্ধতিতে লবণ পরিশোধিত হয়। ভ্যাকুয়াম ইভাপোরেশন, মেকানিক্যাল ও সনাতনী পদ্ধতি। তিন পদ্ধতিতে পরিশোধিত লবণ বিক্রিতে খুচরা বিক্রেতাদের মুনাফা করার সুযোগ দেওয়া হয় কেজিপ্রতি ৯ থেকে ১২ টাকারও বেশি। মুনাফার হার ৩৯ থেকে ৮৭ শতাংশ।
আসুন দেখে নিই ৭ টাকার লবণ কীভাবে ৩৫ টাকা হয়। ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে, কোম্পানিগুলো ১ কেজি অপরিশোধিত লবণ কেনে ৭ টাকায়। প্রসেস লস হিসাব করে ১ কেজি পরিশোধিত লবণ উৎপাদনে ১২ টাকার অপরিশোধিত লবণ লাগে। এরপর অন্যান্য উপকরণ, পরিচালন ও আর্থিক ব্যয় মিলিয়ে প্রতি কেজি ভ্যাকুয়াম ইভাপোরেশন পদ্ধতিতে পরিশোধিত লবণের উৎপাদন খরচ ২৩ টাকা ৩৩ পয়সা।
মিলমালিকের মুনাফা ১ টাকা ৪৭ পয়সা ও পরিবেশকের লাভ ১ টাকা ২০ পয়সা। আর খুচরা বিক্রেতা লবণ কেনেন ২৬ টাকা দরে। মোড়কে লেখা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) ৩৫ টাকা। এর ফলে খুচরা বিক্রেতা মুনাফার সুযোগ পান কেজিপ্রতি ৯ টাকা।
মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে পরিশোধিত লবণের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩২ টাকা। এ ক্ষেত্রে খুচরা বিক্রেতার মুনাফার সুযোগ থাকে কেজিপ্রতি ১২ টাকা ৪০ পয়সা। আর সনাতনী পদ্ধতিতে পরিশোধিত লবণের খুচরা মূল্য লেখা থাকে কেজিপ্রতি ২৫ টাকা। বিক্রেতারা কেজিতে মুনাফার সুযোগ পান ১১ টাকার কিছু বেশি।
অবশ্য বড় বাজার ও বড় দোকানে সর্বোচ্চ মূল্যের চেয়ে কিছু কম দামে বিক্রি করা হয়। তবে পাড়ার মুদি দোকান ও বাকিতে কেনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যই রাখেন বিক্রেতারা।
খুচরা বিক্রেতারা এত বেশি মুনাফার সুযোগ পান কোম্পানির কারণে। তারাই খুচরা মূল্য বেশি লেখে। কেন, তার পেছনেও কারণ অবৈধ আমদানি। সুপরিচিত একটি কোম্পানির একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, শিল্প লবণের নামে আনা ভোজ্য লবণ কেজিপ্রতি ১৫ টাকা লাভের সুযোগ দিয়ে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। সুপরিচিত কোম্পানি যদি সেটা ৩ টাকায় নামিয়ে আনে, তাহলে কোনো খুচরা বিক্রেতা তাঁর লবণ দোকানে রাখবেন না।
এ বিষয়ে ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ হলো, লবণ পরিশোধনকারীদের নির্দেশনা দিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের মুনাফা কমিয়ে দিয়ে লবণের দাম কমানো সম্ভব।
ট্যারিফ কমিশন প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিল ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে। কমিশন এ বিষয়ে গণশুনানিরও আয়োজন করেছিল। প্রতিবেদনের পর সমস্যার সমাধানে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? জানতে চাইলে কনফিডেন্স সল্টের মহাব্যবস্থাপক মো. শামসুদ্দিন বলেন, ‘আমাদের আর কিছুই জানানো হয়নি। সমস্যার সমাধানও হয়নি।’