ফারহানা আজিম শিউলী : ৪৩তম অন্টারিও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়ে গেল গত ২রা জুন ২০২২, বৃহস্পতিবার। মিডিয়া ও সা¤প্রতিক অপিনিয়ন পোলের পূর্বানুমান অনুযায়ী ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দল ৮৩ আসন নিয়ে বিজয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করতে যাচ্ছে এবং নিউ ডেমোক্র্যাটরা ৩১ আসন নিয়ে গতবারের মতোই থাকছে অফিসিয়াল অপজিশন হিসেবে। এবার প্রিমিয়ার বা মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন কনজারভেটিভ দলনেতা, গতবারের প্রিমিয়ার ডাগ ফোর্ড। ওদিকে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ডলি বেগম, যেটি অনেক বিচারেই বাংলাদেশি-কানাডিয়ানদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

২রা জুন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে ভোট গ্রহণ। ইলেকশন অন্টারিওর তথ্যসূত্রে জানা যায়, এক মিলিয়নেরও বেশি নাগরিক অর্থাৎ মোট ভোটারের ৯.৯২% এবার ভোট দেন অ্যাডভান্স পোলে। আর ভোটিং কিট পাঠানো হয়েছে ১,২৬,১৩৫ জনকে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫,২০২। ভোট দিয়ে এই কিট জমা দেবার শেষ সময় ছিল ভোটের দিন বিকেল ৬টা। এবার ভোটার টার্নআউটের সংখ্যা ছিল ৪৩.৫৩%।

১৯টি রাইডিং এ কারিগরি ত্রæটির জন্য ভোট দেরিতে শুরু হওয়ায় ভোটদানের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিল সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা পর্যন্ত। বর্ধিত সময়সীমার রাইডিংগুলো হচ্ছে: অ্যালগোমা-ম্যানিটৌলিন, ব্র্যান্টফোর্ড-ব্র্যান্ট, কেমব্রিজ, ডন ভ্যালি ওয়েস্ট, ইটোবিকো সেন্টার, ফ্ল্যামবরো-্গ্লানব্রুক, মিসিসগা ইস্ট-কুকসভিল, মিসিসগা-লেইকশোর, ঔকভিল, অটোয়া-ভ্যানিয়ের, প্যারি সাউন্ড-মাসকোকা, পার্থ-ওয়েলিংটন, সার্নিয়া-ল্যাম্বটন, সিমকো নর্থ, থান্ডার বে-অ্যাটিকোকান, ইউনিভার্সিটি-রৌজডেইল, হুইটবি, ইয়র্ক সেন্টার, কিউইটিনুং। কয়েকটি ভোটকেন্দ্র আবার শেষ মুহূর্তে স্থানান্তর হয়েছে। কারিগরি ত্রুটির জন্য রাজনৈতিক দলগুলো ড্যাটা-বেইজে প্রবেশ করতে পারেনি ভোট শুরু হবার কিছু সময় পর পর্যন্ত। এছাড়া ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।

অন্টারিও প্রদেশের মোট নির্বাচনী এলাকা বা রাইডিং ১২৪টি। এগুলো ৯টি বৃহত্তর এলাকা ও রিজিওনের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে ইস্টার্ন অন্টারিওর রাইডিং ৮টি; অটোয়ার ৮টি; সেন্ট্রাল অন্টারিওর ৯টি; ৯০৫ বেল্ট এর ডার্হাম, পিল ও ইয়র্ক রিজিওনের যথাক্রমে ৫, ১২ ও ৯টি; টরন্টোর স্কারবরো, নর্থ ইয়র্ক, সেন্ট্রাল টরন্টো ও ইস্ট ইয়র্ক এবং ইটোবিকো অ্যান্ড ইয়র্ক রিজিওনের যথাক্রমে ৬, ৬, ৮ ও ৫টি; হ্যামিলটন-হ্যালটন-নায়াগ্রার হ্যাল্টন, হ্যামিলটন ও নায়াগ্রা রিজিওনের যথাক্রমে ৪, ৫ ও ৪টি; মিডওয়েস্টার্ন অন্টারিওর ১২টি, সাউথওয়েস্টার্ন অন্টারিওর ১০টি, নর্দার্ন অন্টারিওর নর্থইস্টার্ন অন্টারিও ও নর্থওয়েস্টার্ন অন্টারিও রিজিওনের যথাক্রমে ৯ ও ৪টি। এর মধ্যে ৬৩টি আসন পেলে মেজরিটি সরকার গঠন করা যাবে। প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ জিতেছে ৮৩, এনডিপি ৩১, লিবারেল ৮, গ্রিন পার্টি ১ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ১ আসনে।

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী মূল ৪টি দল হচ্ছে: প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টি অফ অন্টারিও (পিসি), অন্টারিও নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), অন্টারিও লিবারেল পার্টি ও গ্রিন পার্টি অফ অন্টারিও। গত ৫০ বছরে প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভরা ক্ষমতায় ছিল ২৫ বছর। অন্টারিওর সাবেক ৯জন প্রিমিয়ারের মধ্যে ৫জন ছিলেন এই দলের। ওদিকে ১৯৭২ সাল থেকে লিবারেলরা ক্ষমতায় ছিল মোট ২০ বছর। এই সময়কালে ৩জন ভিন্ন ভিন্ন প্রিমিয়ার ছিলেন লিবারেল দলের। আর বব রে’র নেতৃত্বে এনডিপি একবারই সরকার গঠন করেছে ১৯৯০ সালে। ১৯৯৫ সালের নির্বাচনে এনডিপির অবস্থান নেমে আসে তৃতীয় স্থানে এবং তা অব্যাহত থাকে ২০১৮ পর্যন্ত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই দল অফিসিয়াল অপজিশন হিসেবে নির্বাচিত হয়।

মূল ৪টি ছাড়াও আরো ২১টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে এবারের অন্টারিও প্রাদেশিক নির্বাচনে। বাকি দলগুলো হচ্ছে: অন্টারিও অ্যালায়েন্স, কানাডিয়ান’স চয়েস পার্টি, কনসেনসাস অন্টারিও, অন্টারিও সেন্ট্রিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি অফ কানাডা (অন্টারিও), ইলেকটোরাল রিফর্ম পার্টি, ফ্রিডম অফ চয়েস পিস অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি, ফ্রিডম পার্টি অফ অন্টারিও, অন্টারিও লিবার্টারিয়ান পার্টি, অন্টারিও মডারেট পার্টি, নর্দার্ন অন্টারিও পার্টি, নিউ বøæ পার্টি অফ অন্টারিও, নান অফ দ্য এবাভ পার্টি, পিপল’স প্রগ্রেসিভ কমন ফ্রন্ট অফ অন্টারিও, পিপলস পার্টি অফ কানাডা, পাবলিক বেনিফিট পার্টি অফ অন্টারিও, অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল কনফেডারেশন অফ রিজিওনস পার্টি, দ্য পিপলস পলিটিক্যাল পার্টি, পার্টি ফর পিপল উইথ স্পেশাল নিডস, পপ্যুলিস্ট পার্টি অন্টারিও, স্টপ দ্য নিউ সেক্স-এড এজেন্ডা ও অন্টারিও পার্টি। মূল ৪টি দলের বাইরে এই দলগুলোর মধ্যে আলোচনায় ছিল নিউ বøæ পার্টি ও অন্টারিও পার্টি।

নির্বাচনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, সবকয়টি রাইডিং এ অর্থাৎ ১২৪টিতেই প্রার্থী ছিল মূল ৪টি দলের বাইরে একমাত্র নিউ বøæ পার্টি অফ অন্টারিওর। বাকি দলগুলোর মধ্যে উল্লেখ করার মতো প্রার্থী দিয়েছে অন্টারিও পার্টি। এদের প্রার্থীরা লড়েছে ১০৫টি আসনে। স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ৪১জন। স্বতন্ত্রসহ সব দল মিলিয়ে প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৯০১জন। এর মধ্যে ৩টি আসনে লিবারেল প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। প্যারি সাউন্ড-মাসকোকা ও চ্যাথাম-কেন্ট-ল্যামিংটন এই ২টি আসনে হোমোফোবিক মন্তব্যের জন্য দলগতভাবে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এবং টিম্মিন্স রাইডিং এ ‘টেকনিকেল ইস্যু’তে লিবারেলদের প্রার্থী দেওয়া হয়নি। অটোয়া ওয়েস্ট-নেপিয়ান এ একজন নিউ বøæ প্রার্থীর প্রার্থীতা বাতিল হয়েছে।

কনজারভেটিভ দলনেতা ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ডাগ ফোর্ড ইটোবিকো অ্যান্ড ইয়র্ক রিজিওনের ইটোবিকো নর্থ রাইডিং থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছেন। লিবারেল প্রার্থী জুলি লিউটেটকে বড় ব্যবধানে পরাজিত করেছেন তিনি। তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করতে যাচ্ছে এবং তিনিই আগামী ৪ বছরের জন্য অন্টারিওর প্রিমিয়ার। ডাগ ফোর্ড কনজারভেটিভ দলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৮ সালে। এবারের নির্বাচনে কনজারভেটিভরা ৪০.৮৮% পপুলার ভোট পেয়েছে, যা গতবারের নির্বাচনের চেয়ে কিছুটা বেশি, যদিও এবার ভোটার টার্নআউটের সংখ্যা ২০১৮র নির্বাচনের চেয়ে বেশ কম। গত নির্বাচনে তারা ৭৬টি আসনে বিজয়ী হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করেছিল। এবারের আসনসংখ্যা ৮৩টি। অর্থাৎ গতবারের চেয়ে ৭টি আসন বেশি পেয়েছে এবার কনজারভেটিভরা।

এনডিপি দলনেতা অ্যান্ড্রিয়া হোরওয়াথ হ্যামিলটন-হ্যাল্টন-নায়াগ্রার হ্যামিল্টন রিজিওনের হ্যামিল্টন সেন্টার রাইডিং থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কনজারভেটিভ প্রার্থী সারা বোখারিকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি একটানা ৪ বার এই আসন থেকে নির্বাচিত এমপিপি। ২০০৪ এর নির্বাচন থেকে ২০২২ এর নির্বাচনের প্রতিটিতে বিজয়ী তিনি। অ্যান্ড্রিয়া হোরওয়াথ ২০০৯ সাল থেকে এনডিপি দলের নেতা। গত প্রাদেশিক নির্বাচনে এনডিপি ৪০ আসনে জয়ী হয়েছিল। এবারে তারা গতবারের চেয়ে ৯টি আসন কম পেয়ে ৩১ আসনে বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রাদেশিক সংসদের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে থাকছে। এবারের নির্বাচনে এনডিপি পপুলার ভোট পেয়েছে ২৩.৭৩%। এবারে তারা আসন হারিয়েছে মূলত কনজারভেটিভদের কাছে। এর মধ্যে টিম্মিন্স রাইডিং এ গিলস্ বিসন গত ৩ দশক ধরে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কিন্তু এবার তিনি (২৯.৫%) কনজারভেটিভ প্রার্থী জর্জ পিরির (৬৪.৯%) কাছে বড়ো ব্যবধানে পরাজিত হন। আর থান্ডার বে-অ্যাটিকোকান রাইডিং এ ১৯৮৫ সালের পর এই প্রথম আবার কনজারভেটিভ প্রার্থী কেভিন হল্যান্ড জেতেন এনডিপির প্রার্থী জুডিথ ফারেলকে হারিয়ে। বিসন ও ফারেল ছাড়াও গতবারের নির্বাচিত এনডিপির এমপিপিদের মধ্যে ফায়সাল হাসান, গুররাতান সিং, সারা সিং এবং গতবার নির্বাচিত লিবারেল এমপিপি আমান্ডা সিমার্ড ও কনজারভেটিভ এমপিপি জেরেমি রবার্টস এবার পরাজিত হয়েছেন।

এবারে নির্বাচিত হবার পর, ১৩ বছর ধরে এনডিপি দলকে নেতৃত্ব দেওয়া অ্যান্ড্রিয়া দলনেতার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপরই এক আবেগঘন বক্তৃতায় তিনি বলেন, “ইটস টাইম ফর মি টু পাস দ্য টর্চ।”
৯০৫ বেল্ট এর ইয়র্ক রিজিওনের ভন-উডব্রিজ রাইডিং থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে লিবারেল নেতা স্টিভেন ডেল ডুকা (৩৫.১%) কনজারভেটিভ প্রার্থী মাইকেল টিবোলোর কাছে (৫৩.৮%) বড়ো ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। গত প্রদেশিক নির্বাচনেও ডেল ডুকা পরাজিত হন একই প্রার্থীর কাছে। লিবারেল দল এবার পেয়েছে ৮টি আসন। এবারের নির্বাচনে লিবারেলরা পপুলার ভোট পেয়েছে ২৩.৭৬%। গতবার লিবারেলদের আসন সংখ্যা ছিল ৭টি। গতবার নির্বাচনের পর হারানো অফিসিয়াল পার্টি স্ট্যাটাস এবারও পুনরুদ্ধার করতে পারেনি লিবারেলরা ডেল ডুকার নেতৃত্বে। এবার ১২টি আসন পেলেই পার্টি স্ট্যাটাস ফিরে পেত তারা। ২০২০ এ প্রথমবারের কোভিড লকডাউনের সময়ে, ৭ই মার্চে ডেল ডুকা লিবারেলদের দলনেতা নির্বাচিত হন। তিনি শেষবারের লিবারেল সরকারের সময় ট্রান্সপোর্টেশন মিনিস্টার ও মিনিস্টার অফ ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এবারের ফলাফলের পর পার্টি প্রধান থেকে ডেল ডুকা সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

গ্রিন পার্টি প্রধান মাইক শ্রেইনার সাউথওয়েস্টার্ন অন্টারিও রিজিওনের গুয়েল্ফ রাইডিং থেকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন। পিসি প্রার্থী পিটার ম্যাকশেরিকে (২০.৪%) অনেক বড়ো ব্যবধানে (৫৪.৫%) পরাজিত করেছেন তিনি। ২০১৮ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি প্রদেশের প্রথম গ্রিন দল থেকে এমপিপি নির্বাচিত হন। ঐ একই সময়ে বৃটিশ কলম্বিয়া ও আটলান্টিক কানাডাতেও গ্রিন পার্টির উত্থান লক্ষ্য করা যায়। শ্রেইনার ২০০৯ সাল থেকে গ্রিন পার্টিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দলনেতা হিসেবে এটি শ্রেইনারের টানা ৫ম নির্বাচন। এবারে গ্রিন পার্টি শ্রেইনারের আসনটিতেই শুধু বিজয়ী হয়েছে এবং পপুলার ভোট পেয়েছে ৫.৯৮%।

বøæ পার্টির জিম কারাহালিওস মিডওয়েস্টার্ন অন্টারিওর কিচেনার-কনেসটোগা রাইডিং এর পার্থী ছিলেন। এ আসনে গতবারের বিজয়ী প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির মাইক হ্যারিস জুনিয়র আবারও জয়ী হন? জিম ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ব্লু পার্টির নেতা। দলটির জন্মও সেই বছরে।

অন্টারিও পার্টির নেতা ডেরেক স্লোয়ান হ্যাস্টিংস-লেনক্স অ্যাডিংটন রাইডিং থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন। কনজারভেটিভ প্রার্থী অনেক ব্যবধানে জয়ী হন এই আসনে। স্লোয়ানের স্থান ৪র্থ। ওদিকে সাউথওয়েস্টার্ন অন্টারিওর চ্যাথাম-কেন্ট-ল্যামিংটন রাইডিং এ গতবারের বিজয়ী অন্টারিও পার্টির রিক নিকোলসকে হারিয়ে এবার বিজয়ী হন কনজারভেটিভ দলের ট্রেভর জোন্স, ২য় স্থানে এনডিপির ব্রক ম্যাকগ্রেগর। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দল অন্টারিও পার্টিকে ২০২১ এর ডিসেম্বর থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডেরেক স্লোয়ান।

স্বতন্ত্র প্রার্থী ববি অ্যান ব্রাডি সাউথওয়েস্টার্ন অন্টারিও রিজিওনের হাল্ডিমান্ড-নরফোক রাইডিং থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। ব্রাডি এই রাইডিং এর প্রাক্তন এমপিপি টবি ব্যারেটের এক্সিকিউটিভ এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন। এ আসনে পিসির প্রার্থি হাল্ডিমান্ড কাউন্টি মেয়র কেন হিউইট। তিনি ২য় স্থান অধিকার করেন। ব্রাডি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতে ইতিহাস গড়েছেন।

ওদিকে টানা চার বছর এমপিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশের মেয়ে ডলি বেগম। ২০১৮-২০২২ এই সময়কালে, ৪২তম অন্টারিও প্রাদেশিক পরিষদের সংসদে। কানাডায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রথম নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তিনি। এ বছর আবারো তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন টরন্টোর স্কারবরো রিজিওনের স্কারবরো সাউথওয়েস্ট নির্বাচনী এলাকা থেকে। কানাডার তিন স্তরের সরকার পদ্ধতির কোনো আইন পরিষদে ডলি বেগমই প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি। ২০১৮ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি প্রথম জয়ী হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের চেয়ে এবারে বেশি হারে ভোট পেয়ে, বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন তিনি। স্কারবরো সাউথওয়েস্ট নির্বাচনী এলাকায় প্রদত্ত মোট ভোটের প্রায় ৪৭.১ শতাংশ ভোটারের ম্যান্ডেট পেয়েছেন ডলি বেগম। ২০১৮ সালে তিনি পেয়েছিলেন ঐ আসনে প্রদত্ত মোট ভোটের ৪৫.৬৬ শতাংশ। ঐ আসনে ডলি বেগমের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী ব্রেট স্নিডার পেয়েছেন ২৭.৯ শতাংশ ভোট।

ফেডারেল নির্বাচনেই বাংলাদেশিদের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ বেশ কম। প্রাদেশিক নির্বাচনে সেটা আরো কম? কিন্তু কানাডার মূলধারার রাজনীতিতে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশিদের আগ্রহ বেড়েছে অনেকটা ডলির কারণে। অর্থাৎ অন্তত একটি রাইডিং এর ভোটিং আচরণের ইতিবাচক মেরুকরণ ঘটেছে ডলিকে উপলক্ষ্য করে। অনেক তরুণ ভলান্টিয়ার দেখা গেছে ডলির নির্বাচনী প্রচারণায়। অপেক্ষাকৃতভাবে নবীনরা রাজনীতিতে উৎসাহী হয়ে উঠছেন ডলিকে দেখে। এমনকি ইটোবিকো-লেইকশোর রাইডিং এ এনডিপির প্রার্থী ফারহিন আলিম তো প্রকাশ্যেই বলেছেন – ডলি তাঁর অনুপ্রেরণা।

বিগত প্রাদেশিক পরিষদে ডলি বেগমের সক্রিয়, কার্যকর ও অগ্রগামী ভূমিকা এবারেও ডলির জয়ী হবার ক্ষেত্রে মূখ্য অবদান রেখেছে। উল্লেখ্য, ডলি গত সংসদে বিরোধী দলে থেকে কাজ করেছেন, আপহিল ট্র্যাভেল করেছেন। আরেকটি বিষয়ও উল্লেখের দাবি রাখে। পুরো কানাডায় এই অন্টারিও প্রদেশ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি স্কারবরো রাইডিংও। খুব ঘন বসতিপূর্ণ এই এলাকা। পুরো কানাডার এক তৃতীয়াংশ মানুষ বাস করে অন্টারিওতে এবং অন্টারিওর একটা বিশাল অংশের মানুষ বাস করে স্কারবরো-সাউথওয়েস্ট এলাকায়। এবং এই এলাকার অধিবাসীরা অনেক খাতেই তুলনামূলকভাবে বঞ্চিত। ফলে এই এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে ডলির ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

হাউজিং আমাদের কমিউনিটির অন্যতম প্রধান ইস্যু, প্রভিন্সেরও। এর মধ্যে আছে – রেন্টাল ইস্যু, নতুন ইমিগ্র্যান্ট পরিবারের বাড়ি কেনা, সোশ্যাল হাউজিং ইত্যাদি। এসব নিয়ে গত ৪ বছরে কয়েকটা বিল পার্লামেন্টে এনেছেন ডলি। অন্য দেশে বসবাসকারী নন-ডোমেস্টিক কানাডিয়ানদের বাড়ি কেনা নিয়েও তিনি বিল এনেছেন সংসদে।

স্কারবরোর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কাজ করেছেন ডলি। স্বাস্থ্যসেবা বাড়ানো, ইমার্জেন্সির সুযোগ বাড়ানো ও হিউম্যান রিসোর্স বাড়ানো এসব নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। উল্লেখ্য খুব স¤প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেইন্ড প্রফেশনালদের জন্য বিল ৯৮ সফলভাবে পাশ করেছেন ডলি। অ্যাক্টটির নাম – ফেয়ারনেস ফর অন্টারিও’স ইন্টারন্যাশনালি ট্রেইন্ড ওয়ার্কার্স অ্যাক্ট। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ট্রেইন্ড প্রফেশনালরা অনেক বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেও আমাদের কমিউনিটিতে অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছেন না। যেমন একজন ডাক্তার তাঁর স্বীয় পেশায় কাজ করতে পারছেন না বা সুযোগ পাচ্ছেন না। বিল ৯৮ ইন্টারন্যাশনাল ট্রেইন্ড প্রফেশনালদের সে সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরাও অন্তর্ভুক্ত হবেন।

ট্রাঞ্জিট সেক্টর নিয়ে কাজ করেছেন ডলি। স্কারবরো সাউথওয়েস্টে অর্থাৎ ডলির নির্বাচনী এলাকায় নতুন সাবওয়ে সার্ভিস আসছে বলে অনেক বাস স্টপ ও বাস সার্ভিস বন্ধ করা হয়েছে। আগে অপারেটিং ফান্ডিং দেওয়া হতো ৫০। এটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটাকে আগের মতো ফিরিয়ে আনতে ও বাস সার্ভিসের স্বল্পতায় যাতায়াত সুবিধাজনক করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। আমরা জানি, গাড়ির ইন্সুরেন্স টরন্টোতে সর্বোচ্চ। পোস্টাল কোডের ওপর ভিত্তি করে অটো ইন্সুরেন্স এর বিপরীতে সংসদে সেকেন্ড রিডিং পাস হয়েছে। ডলি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন এ বিষয়ে। সুখের বিষয়, স্কারবরো এবং ব্র্যাম্পটনের কনজারভেটিভ এমপিপিরাও এই পোস্টাল বৈষম্য দূর করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন শেষ পর্যন্ত।

গাড়ি চুরি, সড়ক দুর্ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এসব আমাদের কমিউনিটি সহ গোটা অন্টারিওরই সা¤প্রতিক কন্সার্ন। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে বাংলাদেশি কমিউনিটির সন্তানরা। এই রোড সেফটি যা ট্রাঞ্জিট ও রোড এর সঙ্গে সম্পর্কিত, সেই সম্পর্কিত বিলও ডলি সংসদে এনেছেন। অবৈধ অস্ত্র নিয়েও বিল আনা হয়েছিল সংসদে কিন্তু পাশ হয়নি। এতেও ডলির সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

ডলি আর্লি লার্নিং ও চাইল্ড কেয়ারের ভোকাল ক্রিটিক, আমরা জানি। বাংলাদেশের বিশেষ দিবসগুলো পালনে প্রাদেশিক পরিষদকে উদ্বুদ্ধ করেছেন ডলি। পোস্ট সেকেন্ডারি পর্যায়ে স্টুডেন্টদের জন্য ফুড সিকিউরিটি প্রোগ্রাম ইনিশিয়েট করেছেন ডলি স্কারবরো এলাকায়, মিনিস্ট্রি অফ কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সার্ভিসেস এর সঙ্গে একযোগে কাজ করে। লং টার্ম কেয়ার হোম ও রিটায়ারমেন্ট হোমগুলোতে সিনিয়রদের প্রয়োজনীয় কেয়ারের সাপোর্টের ব্যাপারে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন স্কারবরো সাউথওয়েস্টের পরিবেশ সুরক্ষায়।
কোভিডের সময় হার্ড হিট এরিয়া ছিল স্কারবরো সাউথওয়েস্ট। এটি ছিল হার্ডেস্ট হিট রিজিওনের অন্যতম, যার কোভিড পজিটিভিটির হার ছিল সর্বোচ্চ। ডলি তখন ভ্যাক্সিন একুইটি নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। ভাঙা রেকর্ডের মতো সংসদে বারবার বলেছেন এই বিষয়ে। একুইটেবল, কম্প্রিহেনসিভ ও ফাস্টার ভ্যাক্সিন রোল-আউট প্ল্যান নিয়ে কাজ করেছেন তিনি।
ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্য লোকাল ভিসা প্রসেসিং নিয়ে কাজ করছেন ডলি।
মেটারনাল মেন্টাল হেলথ নিয়ে বলেছেন, বিল ১৭৬ এনেছেন সংসদে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন ‘অন্টারিও স্মল বিজনেস রিলিফ গ্র্যান্ট’ এর। কনজিউমার প্রটেকশন অ্যাক্ট বা অন্টারিও কনজ্যুমার ওয়াচডগস অ্যাক্ট এর ওপর কাজ করেছেন। বিল ৭৭ এনেছেন এই বিষয়ে। অ্যাফোর্ডেবল চাইল্ডকেয়ার নিয়ে সংসদে প্রস্তাব এনেছেন।

উল্লেখ্য, ডলির ভূমিকা ব্যাপ্ত ছিল তাঁর রাইডিং এর বাইরেও। সার্বিকভাবে ইমিগ্র্যান্ট ও জনগণের স্বার্থ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সংসদের বাইরেও কখনো প্রিমিয়ার অফিসের সঙ্গে, কখনো লোকাল ককাসের সঙ্গে। তাঁর অফিস থেকে সমাধানযোগ্য না হলে রিসোর্স বেইজ করে দিয়েছেন অনেক ব্যাপারে যেসব হয়ত মিউনিসিপ্যাল ইস্যু, যেটা ব্যক্তি বা দল কাউন্সিলরের সঙ্গে সমাধান করবেন কমিউনিটি অর্গানাইজেশনের সাহায্য নিয়ে। তিনি সুন্নাতুল জামাত মসজিদের মুসল্লিদের সুবিধার্থে, সিটির সঙ্গে কাজ করে ট্রাফিক লাইটের ব্যবস্থাসহ আরো অনেক কাজ করেছেন কমিউনিটির জন্য। এসবের অনেক ক’টাই তাঁর সরাসরি কাজ ছিল না।

এসবের বাইরেও আগামীতে চাইল্ড কেয়ার ও আর্লি চাইল্ডহুল এডুকেটরদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় জানিয়েছেন ডলি। প্রত্যয় জানিয়েছেন হেলথ কেয়ার, হাউজিং, পরিবেশ, ভ্যাক্সিনসহ আরো অনেক ইস্যুতে স্কারবরো এলাকার বৈষম্য দূর করার।
কমিউনিটির মেয়ে বলে যেই সমর্থন-সহযোগিতা-ভালোবাসা পেয়েছেন ডলি, সেটাকে তিনি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন তিনক, ফর গ্র্যান্টেড নেননি। ডলি আগাম প্রতিশ্রুতি করেন না। তিনি কর্মে বিশ্বাসী। এবং তাঁর কর্মই তাঁকে এলাকার মানুষের কাছে আস্থাভাজন করে তুলেছে, মানুষকে ভোট দিতে আগ্রহী করেছে। যার ফলশ্রæতিতে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন।

এবারের অন্টারিও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ডলি বেগম সহ মোট ৩জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এনডিপি থেকে ডলি বেগম ছাড়াও ইটোবিকো-লেইকশোর থেকে এনডিপির ফারহিন আলিম ও ওকভিল নর্থ-বারলিংটন থেকে লিবারেল পার্টির প্রার্থী কানিজ মৌলি ছিলেন ভোটের লড়াইয়ে। এঁরা তিনজনই অর্থাৎ ডলি বেগম, কানিজ মৌলি ও ফারহিন আলিম প্রতিনিধিত্ব করেছেন দুটো ঐতিহাসিকভাবে ইগনোরড গ্রæপকে। এক, রেসিয়ালাইজড বা কালার্ড বা ভিজিবল মাইনরিটির নারী ও দুই, ইমিগ্র্যান্ট ব্যাকগ্রাউন্ড এর নারী – এই দুটো ডেমোগ্রাফিক সেক্টর ঐতিহাসিকভাবে কানাডার ট্র্যাডিশনাল রাজনীতিতে আন্ডাররেপ্রেজেন্টেড, পার্লামেন্টে তো বটেই। সেদিক থেকে শুধু বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বলে না, ঐতিহাসিকভাবে আন্ডার রেপ্রেজেন্টেড সেগমেন্টকে প্রতিনিধিত্ব করবার জন্যও তাঁদের প্রার্থীতা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।

কানিজ মৌলি ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস সেক্টরে কর্মরত। তিনি বে স্ট্রিটের একজন সফল ম্যানেজমেন্ট প্রফেশনাল এবং বোর্ড অফ ট্রেড এর মনোনীত সেরা ৪০ এর একজন। “দ্য স্টার” এ মে মাসের ১০ তারিখে লেখা হয়েছে – Oakville North-Burlington Liberal candidate no stranger to politics কথাটা সর্বাংশেই সত্যি। ছোটো থাকতে মৌলি বাবা-মা’র সঙ্গে চলে আসেন কানাডায়। হাই স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে অন্টারিও ইয়াং লিবারেলদের পলিটিক্যাল অর্গানাইজার এবং পলিসি ডিরেক্টর ছিলেন। থান্ডার বে’র লেইকহেড ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে ছিলেন পুরোদস্তুর রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট। তখন তিনি রাজনীতিতে নারীদের প্রতিনিধিত্বের অভাব অনুভব করেন। লেইকহেড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ক্লাবে তিনিই ছিলেন একমাত্র ‘ফিমেল পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট অফ কালার।’ তারপর তিনি যুক্ত হন অন্টারিও পাবলিক সার্ভিসে। কুইন্স পার্কে দুইজন কেবিনেট মিনিস্টারের উপদেষ্টা বা অ্যাডভাইজর হিসেবে কাজ করেছেন, যে কাজ ছিল একাধারে রাজনৈতিক ও ব্যুরোক্রেটিক। সবশেষে ক্যারিয়ার গড়েন তিনি প্রাইভেট সেক্টরে। মৌলির অন্যতম ফোকাস – ডাইভার্সিটি ও ইনক্লুশন ইস্যু এবং উইমেন ইন পলিটিক্স।

ইমিগ্র্যান্ট ওয়ার্কিং ক্লাস পরিবারের সন্তান মৌলি। তাঁর পড়াশোনার সময় লিবারেল সরকার ছিল ক্ষমতায়। লিবারেলদের শিক্ষানীতি ও ইনক্লুসিভ পলিসির কারণে অন্য অনেকের মতো তিনিও উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু প্রদেশে কনজারভেটিভ ফোর্ড সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে যে বরাদ্দ-হ্রাস শুরু হয়, তখন তিনি একজন সন্তানসম্ভবা হিসেবে প্রভিন্সের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন অনাগত সন্তানের কথা ভেবে।
রাজনীতি, ব্যুরোক্রেসি, প্রাইভেট সেক্টর, পাবলিক সেক্টর- বিভিন্ন সেক্টরের পার্স্পেক্টিভ রাজনীতির ডিসিশন মেকিং এ কুইন্সপার্কে তিনি আনতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন নির্বাচনী প্রচারণায়। কানিজ মৌলি হ্যামিলটন-হ্যাল্টন-নায়াগ্রার হ্যাল্টন রিজিওনের ঔকভিল নর্থ-বারলিংটন থেকে লিবারেল প্রার্থী ছিলেন। এই আসনে কানিজ মৌলি প্রদত্ত ভোটের মধ্যে ৩৫.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। বিজয়ী প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ প্রার্থী এফি ট্রিয়ানটাফিলোপাওলস পেয়েছেন ৪৭.৩ শতাংশ ভোট।

আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী ফারহিন আলিম বয়সে তুলনামূলকভাবে নবীন। তিনি নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

ফারহিন হাইস্কুল টিচার। তিনি ‘ইংলিশ অ্যাজ এ সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ (ESL) এর শিক্ষক। যার ফলে প্রতিনিয়তই তিনি সংস্পর্শে আসেন নতুন ইমিগ্র্যান্ট ছাত্রছাত্রীদের। নির্বাচনে তাঁর প্রার্থীতায় এটাও এক মাত্রা যোগ করেছে।

ফারহিন রক্ষণশীল ফোর্ড সরকারের শিক্ষাখাতে সংকোচন নীতির প্রত্যক্ষ শিকার। এই সরকারের সময় চাকরি হারান তিনি। লে অফ পিরিয়ডে সাবস্টিটিউট টিচিং না-করে তিনি চলে যান নিউজিল্যান্ডে পড়াতে ও ভ্রমণ করতে। তিনি যাবার কয়েকমাসের মধ্যেই শুরু হয় করোনা অতিমারি। অতিমারির সময়ে জাসিন্ডা আর্ডেনের নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ড আবির্ভূত হয় বিশ্বজুড়ে রীতিমতো আইকনিক দেশ হিসেবে। ফারহিন সেটি প্রত্যক্ষ করেন এবং জাসিন্ডা আর্ডেনের সময়োপযোগী নেতৃত্বে মুগ্ধ হন, প্রভাবিত হন, অনুভব করেন প্রগতিশীল নেতৃত্বের গুরুত্ব। নিউজিল্যান্ডের ইলেকটোরাল রিফর্ম, রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃতভাবে নবীনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বা youthquake ও তিনি লক্ষ্য করেন সেই সময়। অতিমারি চলাকালেই তিনি কানাডা ফিরে আসেন। একসময় চাকরিতে স্থিত হন। এবং করোনাকালীন সময়ে কয়েকটি বিষয়ে তিনি বিচলিত হন। প্যান্ডেমিকে স্কুলে ছাত্রছাত্রী ও তাদের পরিবারের দুর্দশা দেখেন তিনি কাছ থেকে। ছাত্রছাত্রীরা মূলত নতুন ইমিগ্র্যান্ট পরিবারের, নিম্ন আয়ের পরিবারের। তাদের বাবা-মা ফ্যাক্টরিতে বা এধরনের জায়গায় কাজ করেন। তাদের পেইড সিক লিভ ছিল না। তারা সারভাইভ্যালের জন্য ভাইরাস বহন করেও কাজে গেছেন, ফলে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন তারাই বেশি। এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীদের পেইড সিক লিভ দিতেও ফোর্ড সরকার ৪০০ দিনের বেশি সময় নিয়েছে। ওদিকে তাঁর রাইডিং এর কনজার্ভেটিভ এমপিপি ৩ দফা ভোট দিয়েছেন পেইড সিক লিভ এর বিরুদ্ধে। আর ফারহিন দেখছিলেন ছাত্রছাত্রী ও তাদের পরিবারের দুর্দশা। এছাড়াও স্কুল এবং শিক্ষকেরা খুব নাজুকভাবে ইকুইপড ছিল যার ফলে বারবার এবং অনাকাঙ্খিত শাটডাউন হয়েছে। প্যান্ডেমিককালে দীর্ঘসূত্রিতাসহ সার্বিকভাবেই নেতৃত্বের শূন্যতা অনুভূত হয়েছে ফারহিন আলিমের কাছে। কাজেই, নিউজিল্যান্ডে থাকাকালীন অভিজ্ঞতা ও দেশে ফিরে শিক্ষক হিসেবে করোনাকালীন অভিজ্ঞতা এই বিষয়গুলো ক্যাটালিস্টের মত দাঁড়ায় ফারহিনের রাজনীতিতে আসা, এনডিপিতে যোগ দেওয়া ও নির্বাচনে প্রার্থীতার। ফারহিনের শ্লোগানই ছিল – স্টপ ডাগ ফোর্ড।
ইটোবিকো ইয়র্ক এর ইটোবিকো-লেইকশোর রাইডিং এর এনডিপি প্রার্থী ফারহিন আলিম প্রদত্ত ভোটের মধ্যে ১৭.৬ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান পেয়েছেন। বিজয়ী প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ প্রার্থী ক্রিস্টিন হোগার্থ পেয়েছেন ৩৭.৭ শতাংশ। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দ্বিতীয় স্থানে থাকা লিবারেল পার্টির প্রার্থী লি ফেয়ারক্লাফ পেয়েছেন ৩৬ শতাংশ ভোট।

৪৩তম অন্টারিও প্রাদেশিক পরিষদের এই নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানিজ মৌলি ও ফারহিন আলিম জয়ী হতে না পারলেও উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়েছেন। উল্লেখ্য, কানিজ মৌলি ও ফারহিন আলিম এবারই প্রথম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

এবারের নির্বাচনে ১১টা রাইডিং এর দিকে বিশেষ নজর ছিল সবার। প্রথমটা ছিল ইয়র্ক রিজিওনের ভন-উডব্রিজ যেখানে লিবারেল নেতা স্টিভেন ডেল ডুকা প্রার্থী ছিলেন। ডেল ডুকাই একমাত্র দলনেতা যিনি গতবার কুইন্স পার্কের প্রতিনিধি ছিলেন না। গতবারের পরাজয় কাটিয়ে আসন পাবার প্রত্যাশী ছিলেন এবার। কিন্তু এবারও গতবারের পিসি দলের জয়ী পার্থী মাইকেল টিবোলোর কাছে পরাজিত হন তিনি।

দ্বিতীয়টি ছিল প্যারি সাউন্ড-মাসকোকা রাইডিং। গুয়েল্ফ ছাড়া এটি একমাত্র রাইডিং যেখানে গ্রিন পার্টির পার্থী ম্যাট রিখটারের জেতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কারণ এই আসনে গতবারের নির্বাচিত এমপিপি কনজারভেটিভ দলের নর্ম মিলার এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি এবং লিবারেল পার্টি হোমোফোবিক কন্টেন্টের বই লেখার কারণে তাদের প্রার্থীর প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কিন্তু গ্রিন পার্টির ম্যাট (৪১%) ভালোরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও পরাজিত হন কনজারভেটিভ প্রার্থী ব্রেইসব্রিজের মেয়র গ্রেডন স্মিথের (৪৫%) কাছে। শ্রেইনার অনেকবার গেছেন এই এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণায়। তিনি বলেছেন, ‘গ্রিন প্রার্থীর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা আভাস দেয় ব্লু এর বদলে গ্রিন মোমেন্টামের, গ্রিন ওয়েভের।’

তৃতীয়টি ছিল ডন ভ্যালি ওয়েস্ট রাইডিং। এই আসনে ২০০৩ থেকে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন লিবারেল প্রার্থী ও সাবেক অন্টারিও প্রিমিয়ার ক্যাথলিন উইন। এবারে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। এবারে পার্থী ছিলেন লিবারেলের স্টেফানি বৌমেন। আর কনজারভেটিভ দলের হয়ে লড়াই করেন সাবেক টরন্টো পুলিস চিফ মার্ক সন্ডার্স। সন্ডার্স হেভিওয়েট প্রার্থী হয়েও পরাজিত হন স্টেফানির কাছে।

চতুর্থটি ছিল হ্যামিল্টন-স্টোনি ক্রিক রাইডিং। এই আসনে ২০০৭ সাল থেকে একটানা বিজয়ী এনডিপির পল মিলারকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় ও প্রার্থীতা প্রত্যাহার করা হয় ফেসবুকে ইসলামফোবিক গ্রুপের সদস্য হবার কারণে? তিনি এবারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন। কনজারভেটিভ প্রার্থী ছিলেন ফুটবল তারকা নেইল লামসডেন। লিবারেল প্রার্থী ছিলেন ১২ বছরের সিটি কাউন্সিলর জ্যাসন ফার। শেষ পর্যন্ত জয়ী হন পিসি প্রার্থী নেইল লামসডেন। এনডিপি পার্থী যাইগাম বাট ২য় ও লিবারেল প্রার্থী ফার ৩য় স্থান দখল করেন।

পঞ্চমটি ছিল ইয়র্ক সাউথ-ওয়েস্টন রাইডিং। এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ডাগ ফোর্ডের ভাগ্নে টরন্টো সিটি কাউন্সিলর মাইকেল ফোর্ড। তার প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন এনডিপির গতবারের নির্বাচিত এমপিপি ফায়সাল হাসান। জয়ী হন মাইকেল ফোর্ড।

৬ষ্ঠটি ছিল পিল রিজিওনের ব্র্যাম্পটন নর্থ রাইডিং। এই আসনে গতবারের নির্বাচিত এনডিপির এমপিপি শেষ মুহূর্তে দলের মনোনয়ন পাননি। পেয়েছেন স›দ্বীপ সিং। লিবারেলের প্রার্থী ছিলেন ২০১৪ সালে নির্বাচিত এমপিপি হরিন্দর মালহি ও কনজারভেটিভ প্রার্থী ছিলেন গ্রাহাম ম্যাকগ্রেগর। গত নির্বাচনে জোর লড়াই হয়েছিল এনডিপি ও লিবারেল প্রার্থীর মধ্যে। অথচ এবার এই দুই দলের পার্থীকে অনেক বড়ো ব্যবধানে পরাজিত করেছেন কনজারভেটিভ প্রার্থী গ্রাহাম ম্যাকগ্রেগর।

সপ্তমটি ছিল স্কারবরোর এগলিনটন-লরেন্স রাইডিং। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই আসন ছিল লিবারেলদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। লিবারেল প্রার্থী মাইক কোল ১৯৯৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একটানা জয়ী হয়েছেন এই আসনে। গত নির্বাচনে খুব অল্প ব্যবধানে তিনি পরাজিত হন কনজারভেটিভ প্রার্থী রবিন মার্টিনের কাছে। এবার এখানে লিবারেল প্রার্থী ছিলেন আর্লেনা হেবার্ট। কিন্তু এবারে তিনিও খুব অল্প ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন গতবারের নির্বাচিত এমপিপি কনজারভেটিভ দলের রবিন মার্টিনের কাছে।

অষ্টমটি ছিল সিমকো কাউন্টির ব্যারি-স্প্রিংওয়াটার-ওরো মেদন্তে রাইডিং। এ আসনে দীর্ঘদিনের ব্যারির মেয়র জেফ লেম্যান লিবারেলের হয়ে লড়েছেন গত প্রাদেশিক নির্বাচনে বিজয়ী কনজারভেটিভ প্রার্থী অ্যাটর্নি জেনারেল ডাগ ডাউনির বিপক্ষে। ডাউনি গত নির্বাচনে অনায়াসে জিতলেও ঐ নির্বাচনী এলাকায় লেম্যান খুব জনপ্রিয়। শেষ পর্যন্ত এবারের নির্বাচনে লেম্যান ৪০.৮% ভোট পেয়ে অল্প ব্যবধানে পরাজিত হন ডাউনির কাছে। ডাউনি পান ৪২.৫% ভোট।

নবমটি ছিল অটোয়া ওয়েস্ট-নেপিয়ান রাইডিং। এই আসনে কনজারভেটিভ প্রার্থী জেরেমি রবার্টস এর কাছে এনডিপির চন্দ্রা পাজমা ৪২তম অন্টারিও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মাত্র ১৭৫ ভোটে হেরে যান। এবার মধুর প্রতিশোধ নেন তিনি। ফলাফলটা ছিল কিছুটা বিস্ময়েরও। ৪৩তম নির্বাচনে একই প্রার্থীকে তিনি ৯০০ ভোটে পরাজিত করেছেন।
দশমটি ছিল অটোয়ার পূর্বে গ্লেনগ্যারি-প্রেসকট-রাসেল রাইডিং। এ আসনে গত নির্বাচনে পিসির প্রার্থী আমান্ডা সিমার্ড জয়ী হন। পিসির ফ্রাঙ্কোফোন এডুকেশনে কাটের প্রতিবাদে তিনি দল ছাড়েন ও ২০২০ এ যোগ দেন লিবারেলে। এ আসনে ৪২.৫% ভোট পেয়ে জয়ী হন কনজারভেটিভ প্রার্থী স্টেফানি সারাযিন। আর লিবারেল প্রার্থী আমান্ডা ৩৯% ভোট পেয়ে ২য় স্থান দখল করেন।

এগারোতমটি ছিল নর্দার্ন অন্টারিওর থান্ডার বে-অ্যাটিকোকান রাইডিং। এই আসনে ২০১৮ সালে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে লিবারেল প্রার্থীকে মাত্র ৮১ ভোটে হারিয়ে জয়ী হন এনডিপি প্রার্থী জুডিথ মন্টেইথ-ফারেল। এবারও তিনি নির্বাচন করেন। এই আসন ১৯৯০ থেকে গতবারের নির্বাচন পর্যন্ত ছিল লিবারেলদের ঘাঁটি। কিন্তু এবার সব হিসাব নিকাশ উলটে দিয়ে এ আসন জিতে নেন কনজারভেটিভ প্রার্থী কেভিন হল্যান্ড। তিনি পান ৩৬.৩% ভোট। জুডিথ ৩২.৯% ভোট পেয়ে ২য় ও লিবারেল প্রার্থী রব ব্যারেট ২৪.৪% ভোট পেয়ে ৩য় স্থান দখল করেন।

এবারে টরন্টোর সাবেক সিটি কাউন্সিলরদের মধ্যে ৩জন প্রাদেশিক নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন। ডাগ ফোর্ডের ভাগ্নে মাইকেল ফোর্ড কনজারভেটিভ দল থেকে ইয়র্ক সাউথ-ওয়েস্টন রাইডিং এ, লিবারেল প্রার্থী ম্যারি মার্গারেট ম্যাকমাহন বিচেস-ইস্ট ইয়র্ক রাইডিং এ ও এনডিপির ক্রিস্টিন ওয়াং ট্যাম টরন্টো সেন্টার রাইডিং এ জয়ী হন। টরন্টো সেন্টার রাইডিং এ আগেরবারের নির্বাচিত এনডিপির এমপিপি সুযে মরিসন স্বাস্থ্যগত কারণে এবারে প্রার্থী হননি।

প্রত্যেক নির্বাচনের আগে মূল দলগুলো খাতভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ঘোষণা করে, যা নাগরিকরা ভোট দেবার সিদ্ধান্তে বিবেচনায় নেন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবার নির্বাচনে স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনীতি, যাতায়াত ব্যবস্থা, পরিবেশ, শিক্ষা, বাসস্থান ও সিনিয়র কেয়ার এর ব্যাপারে মূল ৪টি দল প্ল্যাটফর্ম ঘোষণা করে।

প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভরা প্ল্যাটফর্ম রিলিজ না করলেও তাদের মেয়াদের শেষ দিকে বিভিন্ন ইস্যুতে কতগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং পুনঃনির্বাচিত হলে ২০২২ সালের বাজেটে বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে বলে জানিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণায় তারা হাইওয়ে, হাসপাতাল স্থাপন ও অটো সেক্টরে নতুন চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এনডিপির প্ল্যাটফর্মে ছিল মেন্টাল হেলথ কেয়ার, ডেন্টাল কেয়ার ও ফার্মাকেয়ারে বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ; কয়েক হাজার নার্সের চাকরি এবং অ্যাফোর্ডেবল ও সোশ্যাল হাউজিং তৈরির প্রতিশ্রুতি। এসব খাতে প্রদেশের ভঙ্গুর অবস্থা পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেন দলনেতা অ্যান্ড্রিয়া হোরওয়াথ।

লিবারেলদের প্রতিশ্রুতির মধ্যে আছে – ‘বাক এ রাইড’ ট্রাঞ্জিট, অপশনাল গ্রেড ১৩ ফিরিয়ে আনা, আগামী এক দশকের মধ্যে ১.৫ মিলিয়ন নতুন বাড়ি তৈরি ইত্যাদি। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও ১০০০০ নতুন ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রæতিও করে তারা।

গ্রিন পার্টির প্ল্যাটফর্মের মূল ফোকাস ক্লাইমেট ক্রাইসিস বা পরিবেশ বিপর্যয়, যার মধ্যে আছে ২০৪৫ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণের হার নেট-যিরো করে আনা এবং এ খাতে ৬৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ, গ্রিনহাউজ গ্যাসের মাত্রা কমানো ইত্যাদি।

লং টার্ম কেয়ার খাতে লিবারেল, এনডিপি ও গ্রিন পার্টি রিসোর্স বাড়ানোর পাশাপাশি ‘ফর প্রফিটে’র বদলে ‘নন প্রফিটের’ কথা বলেছে তাদের প্ল্যাটফর্মে। শুধু কনজারভেটিভরা এড়িয়ে গেছে নন প্রফিটের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা?

অ্যাফোর্ডেবিলিটি খাতে লিবারেলরা তৈরি খাবারে এইচএসটি প্রত্যাহার, ওল্ড এইজ সিকিউরিটি বাড়ানোর কথা বলেছে। কনজারভেটিভরা লাইসেন্স প্লেট নবায়নে রিবেট, গ্যাস ও জ্বালানির ট্যাক্সে ছয় মাসের কাটের কথা বলেছে। এনডিপি বলেছে ৪ বছর পর্যন্ত নি¤œ আয়ের পরিবারের জন্য ট্যাক্স ফ্রিজ করা, পোস্টাল কৌড বৈষম্য দূর কিরে অটো ইন্সুরেন্স সস্তা করার কথা। তবে লিবারেল, এনডিপি ও গ্রিন পার্টির প্ল্যাটফর্মে ওডিএসপি বাড়ানোর কথা আছে, যা কনজার্ভেটিভদের প্ল্যাটফর্মে নেই।

হাউজিং খাতে প্রতিটি দলের প্ল্যাটফর্মেই আছে ১.৫ মিলিয়ন পর্যন্ত অ্যাফোর্ডেবল বাড়ি তৈরির কথা। তবে আরো কয়েকটি খাতের মতো এখানেও কনজারভেটিভদের সঙ্গে বাকি ৩টি দলের মৌলিক পার্থক্য দেখা যায়। লিবারেল, এনডিপি ও গ্রিন পার্টি তাদের প্ল্যাটফর্মে ইনক্লুশনারি যোনিং এর পক্ষে বলেছে কিন্তু কনজারভেটিভরা বলেছে এক্সক্লুশনারি যোনিং এর পক্ষে।

স্বাস্থ্যসেবা খাতে প্রতিটি দল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও রিসোর্স বাড়ানো, নতুন স্বাস্থ্যসেবা কর্মী নিয়োগ ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মজুরি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। লিবারেল ও গ্রিন পার্টি বিল ১২৪ প্রত্যাহারের কথা বলেছে। ৩টি দলই পাবলিকলি ফান্ডেড স্বাস্থ্যসেবার পক্ষে কিন্তু কনজারভেটিভরা স্বাস্থ্যসেবা ব্যায়ে প্রদেশের কভারেজের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেনি তাদের প্ল্যাটফর্মে।

যাতায়াত খাতে লিবারেলরা সবচেয়ে বড়ো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত সব ট্রাঞ্জিটে চলাচলের খরচ ১ ডলারে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি তার মধ্যে একটি। সবকটি দলই যাতায়াতের ইনফ্রাস্ট্রাকচার বাড়ানো ও বরাদ্দের কথা বলেছে। তবে হাইওয়ে ৪১৩ নির্মাণের পক্ষে শুধু কনজারভেটিভরা, বাকি দলগুলোর অবস্থান এর বিপক্ষে।

চাকরি খাতে লিবারেল, এনডিপি ও গ্রিন পার্টি নূন্যতম মজুরি বাড়ানোর পাশাপাশি পেইড সিক ডেইজের কথা প্ল্যাটফর্মে উল্লেখ করলেও কনজারভেটিভরা এই ব্যাপারে কোনো কিছু বলেনি।

চাইল্ডকেয়ার ও এডুকেশন খাতে ৪টি দলই ১০ ডলার ডে কেয়ার, ইনফ্রাস্ট্রাকচার বাড়ানো, আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেটর নিয়োগের কথা বললেও, এডুকেটরদের মজুরি বাড়ানো ও ক্লাস সাইজ নিয়ে বলেছে ৩টি দল, কনজারভেটিভরা ছাড়া।

ক্লাইমেট খাতে সবচেয়ে কার্যকর ও অর্থবহ প্ল্যাটফর্ম গ্রিন পার্টির, যাকে বলা হয়েছে ‘নিউ ক্লাইমেট ইকোনমি।’ তবে লিবারেল ও এনডিপিও ২০৫০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণের মাত্রা নেট-যিরো করার কথা বলেছে। লিবারেলরা আগামী ৮ বছরের মধ্যে নতুন ৫টি প্রভিন্সিয়াল পার্ক সহ ১০০ মিলিয়ন গাছ লাগানোর কথা বলেছে। এনডিপি বলেছে ২০৩০ সাল নাগাদ বিলিয়ন সংখ্যক গাছ লাগানো, গ্রিনবেল্ট বাড়ানোর কথা। গ্রিনরা বলেছে গ্রিনবেল্ট দ্বিগুণ করার কথা। তারা ২০৩০ সাল নাগাদ “ফিফটিন মিনিট নেইবারহুড” তৈরি করার কথা বলেছে, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের ১০/১৫ মিনিট হাঁটার দূরত্বে ঘন সবুজ ও রিক্রিয়েশনের এক্সেস থাকবে।

প্রতিবারের নির্বাচনের সাধারণ খাতের বাইরে এবারই প্রথমবারের মতো প্রতিটি দলের (কনজারভেটিভ ছাড়া) প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয় প্যান্ডেমিক খাত। এবং লিবারেল, এনডিপি ও গ্রিন পার্টি কোভিড ১৯ প্যান্ডেমিকের পাবলিক ইনকোয়ারির কথা প্ল্যাটফর্মে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করলেও এ ব্যাপারে প্যান্ডেমিক সময়ে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভরা সঙ্গতকারণেই নীরব।
প্যান্ডেমিক শাপে বর হয়েছিল ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ নেতা ও প্রিমিয়ার ডাগ ফোর্ডের জন্য। দুই বছর তিনি মিডিয়ায় অনেক বেশি আসতে পেরেছেন ও অন্টারিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগও বেশি পেয়েছেন তিনি। তবে নির্বাচনী প্ল্যাটফর্ম ও মূলধারার মিডিয়ার পাশাপাশি প্রধান ৪ দলের দলনেতারা সক্রিয় ছিলেন ফেসবুক, টুইটার সহ আরো নানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ডাগ ফোর্ডের টুইটারে ফলোয়ার ৬ লাখের মতো, অ্যান্ড্রিয়া হোরওয়াথের ফলোয়ার দেড় লাখ, ডেল ডুকার ৬৫০০০ আর শ্রেইনারের ফলোয়ার সংখ্যা ৬০০০০ এর কাছাকাছি। ডাগ ফোর্ড মূলত টুইটারেই ধারাবাহিকভাবে সরব থাকলেও, ডেল ডুকা পডকাস্টিং করেছেন, আর অ্যান্ড্রিয়া টিকটক মাধ্যমেও ছিলেন। সনাতন নির্বাচনী প্রচারণার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ভূমিকা রেখেছে দল ও দলনেতাদের প্রচারণায়।

নির্বাচনী প্রচারণাকালেই অন্টারিও বড়রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গেলেও এবং সবশেষ ফেডারেল নির্বাচনের অন্যতম ইস্যু পরিবেশ বিষয়ক হলেও এবং পরিবেশ বিষয়ে কনজারভেটিভদের সামগ্রিক নীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এবারের নির্বাচনে পরিবেশ বড়ো ইস্যু হয়নি।

এমনকি এবারের নির্বাচনের অনেকটাই প্যান্ডেমিক ঘিরে হবার কথা থাকলেও তা হয়নি। মানুষ আসলে টানা দুই বছর যে অস্থিতি ও আশঙ্কার মধ্য দিয়ে গেছে, তা থেকে যেন উত্তরন চেয়েছে এবারের নির্বাচনে, চেয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিও। পেছনে না তাকিয়ে বরং ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে অন্টারিয়ানরা। ওদিকে প্যান্ডেমিক ব্যবস্থাপনায় ফোর্ড সরকারের সমালোচনা থাকলেও, আমেরিকা সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ফোর্ড সরকারের ব্যবস্থাপনা গ্রহণযোগ্যই মনে করেছেন অন্টারিওবাসী।

প্রধান দলগুলোর নেতাদের ব্যক্তিত্ব নিয়ে নাগরিকদের যে নির্মাণ, সেটিও বরাবরই কিছুটা প্রভাবে ফেলে নির্বাচনে। এবারের প্রাদেশিক নির্বাচন তার ব্যতিক্রম ছিল না।

করোনা উত্তর বিশ্বজুড়ে এবং কানাডার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ে এফোর্ডেবিলিটি, হাউজিং, স্বাস্থ্যসেবা এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিষয়ে কনজারভেটিভদের চেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এনডিপি ও লিবারেলদের কর্মসূচী বেশি অর্থবহ, প্রয়োজনীয় ও আকর্ষণীয় হলেও সামগ্রিকভাবে কনজারভেটিভদের কর্মসূচীতে অন্টারিয়ানরা নিজেদের চাওয়ার কম-বেশি প্রতিফলন পেয়েছেন। তাই সামগ্রিক বিবেচনায় তারা কনজারভেটিভদের পরিবর্তনের কথা না ভেবে পুনঃনির্বাচনের পক্ষেই রায় দিয়েছেন।

অভিনন্দন জানাই নব নির্বাচিত কুইন্স পার্কের প্রতিনিধিদের। অভিবাদন জানাই ডলি বেগমকে, যিনি কুইন্স পার্কে শুধু অন্টারিওবাসীর প্রতিনিধি নন, তিনি সেখানে এথনিক ভয়েস-বাংলাদেশিদের কন্ঠও।