শাহ আহমদ : স্বপ্নবাজ তরুণ, মাত্র ৩০ বছর বয়সে মিলিয়নারের খাতায় নাম লেখালেন। সেই মিলিয়ন ডলার ‘ম্যান’ ৩৩ বছর বয়সে হয়ে গেলেন প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলারের মালিক। নিজের কর্মদক্ষতা ও মানুষের কল্যাণে উজ্জীবিত তরুণ ব্যবসার শুরুতে কিছুটা হোঁচট খেলেও এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
স্বপ্নবাজ এই তরুণ বাংলাদেশি আমেরিকানের নাম ফাহিম সালেহ। বাংলাদেশে অ্যাপ রাইড শেয়ারিং পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা। পরে নাইজেরিয়াতে ‘গোকাডা’ রাইড শেয়ারিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও তিনি। ১৪ জুলাই বিকেলে নিউইয়র্ক নগরের ম্যানহাটনে নিজ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পুলিশ তাঁর খণ্ডবিখণ্ড মরদেহ উদ্ধার করেছে।
বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে ফাহিমের দেহ কয়েক টুকরা করা হয়েছে বলে নিউইয়র্কের পুলিশ জানায়। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার হরিসপুরের সন্তান নিউইয়র্ক সিটি সংলগ্ন পোকিপস্পিতে বসবাসরত আইবিএমের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সালেহ আহমেদের একমাত্র ছেলে ফাহিমকে নির্দয়ভাবে হত্যার সংবাদ গভীর বেদনার সঙ্গে
শীর্ষস্থানীয় মার্কিন গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশিত হচ্ছে। ফাহিমের এমন হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষ স্তম্ভিত, শোকের ছায়া নেমে এসেছে কমিউনিটিতে।
বাংলাদেশ থেকে সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যতের সন্ধানে আমেরিকায় এসে বসতি গড়া পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী, উদ্যমী ও সফল তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে মার্কিন ধারাতে বিশেষ স্থান করে নিয়েছিলেন ফাহিম। কীভাবে একটি সুন্দর জীবনের মৃত্যু এভাবে ঘটল, এমন আক্ষেপে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ফাহিমের ছবি ও নিউজ শেয়ার করে হতাশার কথাও বলছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
এক মাস ধরে নিউইয়র্কে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটায় এমনিতে আতঙ্কে আছেন বাংলাদেশিরা। এর মধ্যে ফাহিমের হত্যাকাণ্ড আরও আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও অনেকে এই প্রতিবেদককে জানান ।
পুলিশ জানায়, ঘাতকের সন্ধানে ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সুপরিকল্পিতভাবে তাঁকে করাত দিয়ে টুকরা টুকরা করার পর হত্যাকারী অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরেই খণ্ডিত অংশগুলো একটি থলিতে ভরছিল। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, গত বছর সোয়া দুই মিলিয়ন ডলারে অ্যাপার্টমেন্টটি কিনেছেন ফাহিম।
করোনা মহামারির পুরো সময় ফাহিম ছিলেন মা-বাবার সঙ্গে পোকিস্পিতে। কয়েক দিন আগে এসেছেন অভিজাতশ্রেণির বিলাসবহুল এই অ্যাপার্টমেন্টে। স্বল্পভাষী ফাহিম এই অল্প বয়সেই প্রচুর সম্পদের মালিক। তবুও কোন অহমিকা ছিল না তাঁর। সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ফাহিম ছিলেন অবিবাহিত। তার এই হত্যাকাণ্ডে কে বা কারা জড়িত, তা উদ্ঘাটনের দাবি উঠেছে কমিউনিটি ও তরুণ উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে।
ম্যানহাটনের লোয়ার ইস্টসাইডে লাক্সারি এই অ্যাপার্টমেন্টের প্রবেশ পথের ভিডিও ফুটেজের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউইয়র্ক পুলিশের মুখপাত্র সার্জেন্ট কার্লোস নিয়েভেস বলেন, ফাহিমের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা, বুক, দুই হাত ও দুই পা পাওয়া গেছে অ্যাপার্টমেন্টের কক্ষেই।
পুলিশ আরও জানায়, ফাহিমের বোনের টেলিফোন পেয়ে ওই ভবনের সপ্তম তলায় ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্টে যায় পুলিশ অফিসাররা। আগের দিন থেকেই ফাহিমের কোন সন্ধান না পেয়ে তার ছোট বোন উদ্বিগ্ন হয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে যান সেখানে। ভেতরে ভাইয়ের মস্তকবিহীন দেহাবশেষ দেখেই ফোন করেছিলেন ৯১১–এ।
ভিডিও ফুটেজের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ জানায়, ১৩ জুলাই বিকেলে ফাহিম লিফটে করে ওই ভবনে ঢুকেছেন। লিফটে তাঁর সঙ্গে উঠেছিল স্যুট পরা এক ব্যক্তি, যার মাথায় ছিল টুপি, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস। হাতে ছিল একটি স্যুটকেস। ফাহিম যে ফ্লোরে নামে, ওই ব্যক্তিও তাঁর পেছন পেছন সেই ফ্লোরে নামেন।
পুলিশের ধারণা, ফাহিম বাসায় প্রবেশের সময়ে আক্রান্ত হতে পারেন। এরপরই তাকে হয়তো নিস্তেজ করা হতে পারে। ঘাতক খুবই চালাক। ফাহিমের খণ্ডিত দেহ প্লাস্টিকের ব্যাগে পাওয়া গেছে। করাতে তেমন রক্ত দেখেননি পুলিশ অফিসারেরা। মেধাবী ছাত্র ফাহিম নিউইয়র্কে একটি হাই স্কুলে পড়াশোনায় অবস্থায়ই ‘উইজ টিন’ নামক একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলেন। বেশ অর্থও আয় করতে সক্ষম হন।
এরপর ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বেন্টলি ইউনিভার্সিটি থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে কম্পিউটার ইনফরমেশন সিস্টেমে ব্যাচেলর করেন ফাহিম। উদ্ভাবনী মেধাসম্পন্ন ফাহিম আর পেছন ফিরে না তাকিয়ে কিংবা কোন কোম্পানিতে চাকরির চেষ্টা না করেই মা-বাবার জন্মস্থান বাংলাদেশে ছোটেন।
২০১৫ সালে ঢাকায় আরও দুই বন্ধুকে নিয়ে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাও প্রযুক্তির প্রচলন ঘটান। এর আগে ঢাকায় থাকাকালে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হ্যাকহাউজ নামক আরেকটি সংস্থা। বনানী ছিল তাদের অফিস।
পাঠাওয়ের প্রচলন রাজধানী ঢাকা ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন নগরে বিস্তৃত হয়। একপর্যায়ে তা নেপালেও সম্প্রসারিত হয়েছে। এমনি অবস্থায় ঢাকা ছাড়েন ফাহিম। নাইজেরিয়ায় পরিচিত একজন অংশীদারের সঙ্গে মোটরবাইকে শেয়ারিং সার্ভিস হিসেবে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে লাগোসে চালু করেন ‘গোকাডা’। সেই ব্যবসা জমে উঠলেও নানা কারণে তা বছরখানেক পরই বন্ধ হয়ে গেছে বলে ফাহিমের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। ফাহিম কলম্বিয়ায় এমন আরও দুটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপ কোম্পানির মালিক। ইন্দোনেশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশেও তিনি ব্যবসা বিস্তৃত করেছিলেন।
সর্বশেষ ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে একটি কোম্পানি করেন বলে ফাহিমের এক নিকটাত্মীয় জানান। সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়নি। বিনোদনমূলক অ্যাপারেটাস কোম্পানি কিকব্যাকেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফাহিম। এ ছাড়া তিনি প্রতিষ্ঠাতা পার্টনার ছিলেন অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটেলের।
ঠিক কী কারণে এই খুন—সেই রহস্য উদ্ঘাটনে নিউইয়র্ক পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। তবে পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে প্রায় নিশ্চিত, খুনি প্রথমে গুলি করে তারপর ফাহিমের লাশ করাত দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে। সিসি ক্যামেরায় মাস্ক পরা খুনির চেহারা অনুমান করে আশপাশের এলাকার সিসি ক্যামেরাগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে নিউইয়র্ক পুলিশ জানায়।
এদিকে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা অফিস ফাহিম সালের পরিবারের নিকটাত্মীয় আতাউর বাবুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ফোনের ওপার থেকে শুধু কান্নার আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। তবে অনেক কষ্টে বাবুল নিজেকে সামলে শুধু এটুকু বলেন, ‘ছেলে হারানোর শোকে তার মা পাগলপ্রায়।’