কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
মনিস রফিক
এক.
আমার জীবনের গল্প শুরু করতে হলে আমাকে প্রথমেই ফিরে যেতে হবে এক’শ বছর পূর্বের ব্যানফ শহরে। স্কটল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব উপক‚লের এবারডিনশায়ারে হালকা জনবসতি অঞ্চলে ছিল শহরটি। তখন ১৯১১ সাল। জেমস জর্জ সিনক্লেয়ার নামে এক স্কুল শিক্ষক বাস করতেন সেই শহরে। মাছ ধরা ছিল তার একমাত্র নেশা। সেই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা এক ছোট্ট নদীতে একদিন তিনি কয়েকজন বন্ধু নিয়ে কেবল ছিপ ফেলেছেন। সেই সময় এক সামন্ত-রক্ষী এসে তাকে জানালো, সেখানে তারা মাছ ধরতে পারবে না, কারণ ঐ এলাকার জমিদার ওটার মালিক। রক্ষী সেদিন এটাও জানিয়ে গিয়েছিল, তারা যদি আর কখনো সেখানে ছিপ ফেলে তবে তাদের জেলে যেতে হবে। ইউরোপের অন্য জায়গার মত স্কটল্যান্ডেও তখন সামন্ততান্ত্রিক সময়।
অপমানিত নিরীহ স্কুল শিক্ষক জেমস আর তার বন্ধুরা মাছ ধরার জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে কিছুটা রাগে ফেটে পড়েছিলেন। রক্ষীকে উদ্দেশ্য করে জেমস প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠেছিলেন, ‘এমন সব জায়গা কখনও ব্যক্তি মালিকানাধীন হতে পারে না, এটা হবে জনগণের।’ তিনি এটা জানতেন, তার কথা আর প্রতিবাদের কানাকড়ি মূল্য নেই অত্যাচারী সামন্ততান্ত্রিক শাসকদের কাছে। তখন তিনি কিছুটা খেদের সাথেই বন্ধুদের বলেছিলেন, ‘যেখানে তিনি স্বাধীনভাবে নদীতে মাছ ধরতে পারবেন না, সেখানে তিনি তার জীবনের বাকী সময় কাটাতেও চান না।’ জেমসের এক বন্ধু তখন বলে উঠেছিলেন, তিনি বইয়ে এক অদ্ভুত জায়গার নাম পড়েছেন যেখানে ছোট ছোট ঘন বনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট ছোট নদী আর যেখানে রয়েছে টলটলে পানির ছোট ছোট অসংখ্য লেক। অবাধে মাছ ধরা যায় সেখানে। সেই নদী বা লেকগুলোর মালিক জনগণ। স্কটল্যান্ডের মত সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের কোনো রাজত্ব নেই সেখানে। বন্ধুটি সবাইকে জানিয়েছিলেন, ব্যানফ শহর থেকে প্রায় চার হাজার মাইল দূরে আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পারে ঐ জায়গাটার নাম ব্রিটিশ কলম্বিয়া।
কয়েক মাস পর জেমস জর্জ সিনক্লেয়ার তার স্ত্রী বেটসী এবং তাদের তিন বছরের ছেলে জিমিকে নিয়ে নতুন বসতির সন্ধানে পাড়ি জমান কানাডার দিকে, তারপর তারা বসতি গড়েন সেই বন্ধুর বর্ণনার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায়। ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় এসে জেমস শুধু তার মাছ ধরার নেশায় পূরণ করতে পারেননি, বরং নতুন জায়গা তার সামনে এনে দেয় এক অফুরন্ত সুযোগের হাতছানি। তিনি দেখলেন, এখানে সামন্তপ্রভূদের দাপট নেই আর নেই কোনো সাধারণ মানুষের বঞ্চনার কোনো পরিবেশ। পূর্ব পুরুষের ভিটে মাটির মায়া নিমিষেই ভুলে গিয়ে নতুন জায়গাকে নিজের আপন স্থান ভেবে তিনি শুরু করলেন জীবনের নতুন পথ চলা।
যে তিন বছরের জিমি বাবা মায়ের সাথে এই নতুন প্রাণের জায়গাই এসেছিলেন, পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তিনি হয়ে উঠেন এক পরিপূর্ণ সফল মানুষ। এই সময়ের মধ্যে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন, একজন রোডস স্কলার হন আর দ্বিতীয় বিশযুদ্ধে রয়েল কানাডিয়ান এয়ার ফোর্সের একজন সদস্য হয়ে যুদ্ধ করেন। এলাকার পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরবর্তীতে তিনি কেবিনেট মন্ত্রী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শেষ জীবনে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে তার জীবন কাটান। তিনি এবং তার স্ত্রী ক্যাথলিন তাদের পাঁচ মেয়ের চার নম্বরের নাম রাখেন মার্গারেট। বর্তমানে মার্গারেট এখন মন্ট্রিয়লে বাস করেন। এই মার্গারেট’ই আমার মা।
১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উত্তর ভ্যাংকুভার থেকে নির্বাচিত এমপি জিমি সিনক্লেয়ার যখন তার কাজের জন্য আর উত্তর আফ্রিকায় রয়্যাল কানাডিয়ান এয়ার ফোর্সের একটি দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা পাচ্ছিলেন, সে সময়ই একদল ফরাসি-কানাডিয়ান ছাত্র নৌকায় মন্ট্রিয়ল থেকে জেমস বে পর্যন্ত ১৬শ কিলোমিটারের এক দুঃসাহসিক অভিযান শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দীতে হাডসন’স বে কোম্পানী যাদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সব লাইসেন্সবিহীন লোমশ পশু চামড়ার ব্যবসায়ীরা এই পথেই তাদের কারবার চালাতেন। সেই ছাত্র দলটি মূলত সেই কারবারীদের পথ ধরেই এই নৌকা-যাত্রার অভিযান চালায়। তাদের এই ভ্রমণ সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা পায়। একটা সংবাদপত্রে ছয় জন অভিযানকারীর নাম বিশেষ গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়েছিল, এই ছয় জনের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন আমার বাবা, পিয়েরে ই. ট্রুডো।
আমার বাবার অভিযানটি সত্যি খুবই কঠিন ছিল। তাদের খাদ্য ফুরিয়ে গিয়েছিল। আবহাওয়া তাদের অনুক‚লে ছিল না, কিন্তু সব বৈরিতার পরও বাবা উপভোগ করেছিলেন তাঁর অভিযান। এই উপভোগের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, এই অভিযানের মাধ্যমে তিনি তাঁর জন্মস্থান কুইবেক’কে এক অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পেয়েছিলেন। কুইবেকের গহীন এলাকার সৌন্দর্য আর মানুষ ও সংস্কৃতির অনাবিল ভালোবাসা তাঁর মনকে এক অন্যরকম আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছিল।
আমাদের পরিবারে পানির প্রভাবটা ছিল অন্যরকম। সত্যি কথা বলতে কি, আমার জীবনের প্রথম যে ঘটনাটা আমি স্মরণ করতে পারি তার সাথে পানির একটা সংযোগ রয়েছে। তখন আমি দু’বছরেও পা দিইনি। ঘটনাটা ঘটেছিল হ্যারিংটন লেকে। সেটা হচ্ছে গতিনিউ পার্কে। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের পেছনেই সেই লেকটি। জায়গাটা ছিল বাবার খুব ভালোবাসার। উনি সময় সুযোগ পেলেই সেখানে সবাইকে নিয়ে সময় কাটাতে চাইতেন। আমি ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা বলছি। লেকের পানি তখনো পরিপূর্ণভাবে বরফে জমাট বাঁধেনি। আমাকে স্নো শ্যুট পরানো হয়েছে। বাবা আমাকে নিয়ে স্লাইডিং করে সেই জমাট বাঁধা পানির কাছে এসে পড়ছেন। বাবা আমাকে নিয়ে বেশ কয়েকবার এমন উঠা নামা করলেন। জীবনের প্রথম এমন রোমাঞ্চিত এক ঘটনায় আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠছিলাম। একটু দূরে একটা টিলায় দাঁড়িয়ে মা আমাদের আনন্দ উপভোগ করছিলেন। মার পেট তখন ফুলে ছিল। কারণ আর কিছুদিন পরই আমার ছোটভাই শাসা’র পৃথিবীতে আসার সময় হয়ে গিয়েছিল। বাবার সাথে কয়েকবার স্লাইডিং করার পর আমি যখন প্রচুর আনন্দ পাচ্ছিলাম, তখন বাবার মনে হয়েছিল আমি নিজে নিজেই ওপর থেকে নিচে নেমে পড়তে পারবো। বাবা এমন ভেবেই আমাকে স্লাইডিং এর ওপর থেকে নীচে গড়িয়ে দিলেন। আমি আনন্দে চিৎকার করেই নীচে নামছিলাম, হঠাৎ আমার কানে আসলো মায়ের চিৎকার। ‘আমার বাচ্চা, আমার বাচ্চা!’ বলে মা চিৎকার করছিলেন।
আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি আছড়ে পড়েছিলাম বালুর ওপর এবং আমার শরীরের কিছু অংশ গিয়ে পড়েছিল বরফ-পানির ওপর। আমার শরীর জুড়ে তখন বাচ্চা বিড়াল সাজের স্নো-শ্যুট। তখন আমার মাথায় একটায় চিন্তা আমার সাধের স্নো-শ্যুটটা পানিতে ভিজে যাবে নাতো। বাবা এসে আমাকে যখন উদ্ধার করছিলেন তখন আমার কিছুটা পানিতে ভেজা হয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে মুহূর্তটার একটা বিশেষ তাৎপর্যতা আছে, কারণ আমি মনে করি, ওভাবেই আমি ঘরের বাইরে প্রথম ‘ব্যাপ্টাইজড’ হয়েছিলাম আমার জীবনের এই প্রথম স্মরণীয় ঘটনার পূর্বে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল। সেটা ছিল আমার জন্ম মুহূর্তে। স্যার এ. ম্যাকডোনাল্ড ছিলেন কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি ২৪ সাসেক্স এর সরকারি বাসভবনে থাকা অবস্থায় সন্তানের বাবা হয়েছিলেন। আমার বাবা এবং মা দু’জনেই সেই সময়ের পিতা-মাতার ভূমিকা নিয়ে বৈপ্লবিক নারীবাদী আন্দোলনের যে ঢেউ উঠেছিল, তাকে স্বাগত জানিয়ছিলেন। যাহোক, তারা তিন দশকের আগে জন্মেছিলেন। ফলে সেই সময়ের যে সামাজিক পরিস্থিতি ছিল তা জয় করা খুব সহজ একটা ব্যাপার ছিল না। সেই সময়ের পরিস্থিতিটা একটু তুলে ধরতে শুধু বলতে পারি, আমার বাবা যখন ১৯১৯ সালে জন্মেছিলেন, সেই সময়ই প্রথম নারীরা কানাডার ফেডারেল অফিসে কাজের অধিকার লাভ করে।
১৯৭১ সালে আমার যখন জন্ম হয় তখন আমার বাবাও কানাডার প্রধানমন্ত্রী। আমার জন্ম হয়েছিল অটোয়ার সিভিক হাসপাতালে। সেসময় প্রসবকক্ষে স্ত্রীর পাশে স্বামীর থাকার নিয়ম ছিল না। আমার জন্মের সময় আমার বাবা আমার মায়ের পাশে থাকবেন না এ বিষয়টি আমার মা কোনভাবেই মানতে চাননি। তিনি এই নিয়মের প্রতিবাদ করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার সন্তান জন্ম দেবার সময় যদি তার স্বামীকে তার পাশে থাকতে না দেয়া হয় তবে তিনি হাসপাতালে সন্তান জন্ম দিবেন না, তিনি তার ঘরে সন্তান জন্ম দিবেন। নিজ ঘর বলতে তখন ২৪ সাসেক্স এর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। মায়ের এই প্রতিবাদ যখন হাসপাতালের বোর্ড অব ডিরেক্টরদের কানে পৌঁছলো, তখন তারা তাড়াহুড়া করে দীর্ঘদিনের প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে আমার জন্ম মুহূর্তে বাবাকে মায়ের পাশে থাকতে দিয়েছিল। অটোয়ার সিভিক হাসপাতালের এই ঘটনার পর পরই অটোয়ার অন্যান্য হাসপাতাল এবং ধীরে ধীরে কানাডার সব হাসপাতাল থেকে পূর্বের নিয়মটি বাতিল হতে থাকে। আমি জন্মেছিলাম বড়দিনে অর্থাৎ যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিনে। আমার ভাবতেই ভালো লাগে আমার জন্মদিনে পৃথিবীর খ্রীষ্টান ধর্মের মানুষেরা আনন্দ-উৎসবে মেতে ছিল। আর আমি ছিলাম কানাডার হাসপাতালে জন্ম নেয়া প্রথম সেই ভাগ্যবান শিশু, যে মাতৃগর্ভ থেকে বের হবার পর যার প্রথম শব্দ মধুর আনন্দ ধ্বনি হয়ে বেজেছিল একসাথে বাবা ও মায়ের কানে। আমার এটাও ভাবতে আনন্দ লাগে, আমার জন্মের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কানাডার এক ঘুণে ধরা পচা নিয়মের অবসান ঘটাতে আমার মা যে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটা বাস্তবায়নে নবজাতক শিশু হিসেবে আমি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
(চলবে)
মনিস রফিক : চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা