ভজন সরকার : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনক বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমেই বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থান। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই ঘটেছিল ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ড। আর এই হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষ ফসলই হলো বিএনপি নামক দলটি।
জানা যায়, ১৫ আগস্টে তৎকালীন সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জিয়াউর রহমান যদি সম্মত না হতেন তবে সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু কর্মকর্তা কিছুতেই সাহসী হতো না এই হত্যাকান্ড ঘটাতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে যত অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থান ঘটেছে সব কিছুর পেছনেই কলকাঠি নেড়েছেন জিয়াউর রহমান। কখনো পরিস্থিতি জিয়ার অনুক‚লে গিয়েছে, কখনো গিয়েছে প্রতিক‚লে। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে জিয়াউর রহমানের কুটকৌশলই তখন জয়ী হয়েছে।
আর জিয়ার এই আপাত সফলতার মূল্য দিতে হয়েছে সদ্য-স্বাধীন একটি দেশকে; প্রাণ দিতে হয়েছে অসংখ্য দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের; রক্ত ঝরেছে অসংখ্য দেশপ্রেমিক সৈনিকের। শুধু কি রক্তের পথ বেয়েই জিয়া ক্ষমতার মসনদে পৌঁছেছিলেন তখন?
জিয়া ক্ষত-বিক্ষত করেছিলেন ত্রিশ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে পাওয়া একটি স্বাধীন দেশের সংবিধানকে। জিয়া তার ভয়ঙ্কর ক্ষমতালিপ্সা দিয়ে ভ‚লুন্ঠিত করেছিলেন দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমকে। জিয়া তখন বেঈমানী করেছিলেন জাতির সাথে, জাতীয় চেতনার সাথে এবং সর্বোপরি সেনাবাহিনীর মতো একটি সুশৃংখল বাহিনীর পেশাদারীত্বের সাথেও।
জিয়াউর রহমানের সকল ষড়যন্ত্রের “ফাইনাল প্রডাক্ট” হলো বিএনপি নামক দলটি। যে দলটিকে অনেকেই একটি রাজনৈতিক দল না ব’লে অসংখ্য প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বর্ণনা করতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের পরাজিত শক্তিকে পূনরায় সংঘবদ্ধ ক’রে জিয়া মূলত বাংলাদেশের বিপক্ষেই কাজ করেছিলেন তখন। যে কোন গনতান্ত্রিক সভ্য সমাজে জিয়াউর রহমানের বিচার সাংবিধানিক ভাবেই হতো। যদিও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে জিয়াউর রহমান তার নিজের অধিনস্থ সেনাবাহিনীর হাতেই প্রাণ দেন। অথচ এই সেনাবাহিনীকে নিয়েই তিনি অসংখ্যবার রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির সফলতায় পিছিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ঠিক ২১ বছর পরে জাতির জনক বংগবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথ ফিরে পায়।
কিন্ত ২০০১ সালে আবার ষড়যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় আসে স্বাধীনতাবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি বিএনপি-জামায়াত। বাংলাদেশ আবার ফিরে যায় পেছনে; হত্যা-নির্যাতন-দুর্ণীতিতে মেতে ওঠে বিএনপি -জামায়াতের একটি অংশ। আর এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়েছিল জিয়াউর রহমানের পুত্র তারেক রহমান।
ক্ষমতালিপ্সু ও পাকিস্তানপন্থি তারেক রহমান তার পিতার দেখানো পথেই নিজের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে সকল নৃশংস কার্যকলাপ শুরু করেন। পিতার মতোই মেতে ওঠেন রক্তের হোলি খেলায়। দেশের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দী নেতৃত্বকে জঙ্গীদের মদদ দিয়ে একে একে হত্যা করতে থাকেন। তবুও তার সন্দেহ থেকেই যায়। তারেক একেবারে সমূলে প্রধান প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে মনঃস্থির করেন।
তারেক রহমানের এই হত্যাকান্ড মিশনের শেষ প্রচেষ্টা ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। পিতা জিয়াউর রহমানের মতোই পূর্বপরিকল্পনা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে সেদিন যুদ্ধে ব্যবহ্নত গ্রেনেড দিয়ে হামলা চলে আওয়ামী লীগের জনসভা মঞ্চে। কিন্ত একেবারে অলৌকিকভাবেই সেদিন প্রাণে বেঁচে যান আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। ব্যর্থ হয় বিএনপির ২১ আগস্ট ষড়যন্ত্র এবং সেদিনই পরাজয়ের কালের-লিখন আঁকা হয়ে যায় বিএনপি নামক দলটির কপালে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ছিল বিএনপি-জামায়াতসহ সকল স্বাধীনতাবিরোধীদের ভাগ্য নির্ধারণের দিন। জাতির সৌভাগ্য বিএনপি -জামায়াত ২১ আগস্ট সফল হতে পারেনি। ২১ আগস্ট যদি বিএনপি-জামায়াত সফল হতো তবে বাংলাদেশ নামক ভ‚খন্ডটি আবার পাকিস্তানপন্থী এবং ৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধীদের দখলে চলে যেত; যেমনটি গিয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। আর এই অপশক্তির দখল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে লেগেছে দীর্ঘ ২১ বছর।
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে দ্বিতীয়বার পরাজিত ও ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি-জামায়াতসহ সকল স্বাধীনতাবিরোধীরা। আর সেদিনই হয়ত নির্ধারিত হয়ে গেছে আগামীর বাংলাদেশে রাজনীতি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেই।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)