মোহাম্মদ এয়াকুব : ১৯৭১-এর ১৫-১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধার জীবনে বাঁচা-মরার শেষ অপারেশন পাকিস্তানি আর্মির সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ। একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনে শেষ কোথায়, তা খুঁজতে গিয়ে নিজেকে কিভাবে দিন-রাত পর্দার আড়ালে রেখে পাক সেনা, রাজাকার, আলবদর এবং বাংলার মীরজাফরকে খুঁজতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর একটি স্পট চেক আর্মি ক্যাম্প খুঁজে পেলাম। আমরা নীরবে নানাভাবে, নানা বেসে রেকী করতে শুরু করলাম। রাতের শেষে কমান্ডারকে বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করলাম। পাকিস্তানি আর্মি চট্টগ্রাম মাঝিরঘাট রোড সদরঘাট বার্মা অয়েল কোম্পানী (নতুন নাম পদ্মা অয়েল কোম্পানী) একটু সামনে রাস্তার দক্ষিণে কর্ণফুলী নদীর নৌকার ঘাটের পাশে একটি আর্মি ক্যাম্প করেছিলো পাক সেনারা। নৌ পথ কন্ট্রোল করার জন্য আমাদের টার্গেট ছিলো আর্মি ক্যাম্প অ্যাটাক করা। কিন্তু কিছুতেই সাহস হলো না। পাকিস্তানি আর্মি সব সময় চোখ-কান খোলা রেখে এই দিক-ঐদিক পাঁয়তারা করতে থাকে। যদি আর্মি কাউকে সন্দেহ করে তাহলে তাকে নানাভাবে শারীরিক অত্যাচার করে। আমরা নানাভাবে সব খবরাখবর পেতাম। ১৪ই ডিসেম্বর সন্ধ্যার সময় নিজ নিজ কমান্ডার আমাদেরকে বললো অপারেশনের জন্য তৈরি থাকতে। তিনটি গ্রুপ কমান্ডার এক সাথে ১৫ই ডিসেম্বর সিদ্ধান্ত নিয়ে রাতের অন্ধকারে কর্ণফুলী নদীর বড় নর্দমা-নালা দিয়ে প্রবেশ করে ছুমালুম রাস্তা ধরে (সাহেব পাড়া) পতিতালয়ের পেছনের রাস্তা গেছে মাঝিরঘাট রোড পার হয়ে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সেদিন ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ শেষ রাতের দিকে তিন গ্রুপের কাছে হেভি অস্ত্র ছিলো। আমরা মাঝিরঘাট রোড এবং সদরঘাট রোড সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করি, যাতে করে পাকিস্তানি আর্মিরা পালাতে না পারে।
আমরা গ্রুপ কমান্ডারের নির্দেশে সবাই নিজ নিজ পজিশনে চলে গেলাম।
প্রথম গ্রুপ পজিশন নিয়েছে চট্টগ্রাম, বরিশাল লঞ্চঘাটের খুব নিকটে নদীর পাশে, বড় বড় গাছের পাশে। ২য় গ্রুপ পজিশন নিয়েছে পদ্মা অয়েল কোম্পানীর ভেতর বড় দীঘির (পুকুরের) পাশে এবং ছাদের উপরে ৩য় গ্রুপ পজিশন নিয়েছে মাঝিরঘাট রোডের উভয় পাশে সাহেব পাড়া (পতিতালয়)-এর খুব নিকটে কর্ণফুলী নদীর পানির বড় ড্রেন ব্রিজের পাশে। আমরা জীবনের শেষ বাজি রেখে সবাই একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়লাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর। প্রথম গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হলো পর পর ফায়ার শুরু করা মাত্র পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্প থেকে পাল্টা ফায়ারিং শুরু করলো। অনেকক্ষন ফায়ার হওয়ার পর এইভাবে চলতে লাগলো, মাঝে মাঝে হঠাত গ্রেনেডের আওয়াজ এবং ফায়ারিংয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। রাস্তাঘাট থমথমে। জনশূন্যতা। ফজরের নামাজের আজান শোনা যাচ্ছিল। সকালের আলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধার জীবনকে আরো বেশি সাহসী করে তুলেছে। আমরা সকাল ১১টা পর্যন্ত নিজ নিজ পজিশনে ছিলাম। হঠাত করে কে বা কারা চিত্কার করে বলতে লাগলো জহুর আহমদ (আমার বড় ভাই) উপর শরীরে গুলি লেগেছে। দুপুর ১২টার সময় হঠাত ফায়ারিংয়ের শব্দ এইভাবে থেমে থেমে ফাইয়ারিং হচ্ছে। ভেবেছি এই হয়তো জীবনের শেষ যুদ্ধ। কারো সাথে আর দেখা হবে কিনা জানি না। আমরা খুব সাবধানতা অবলম্বন করছিলাম। হঠাত হঠাত ফায়ারিং হওয়া, এটা ভালো লক্ষণ নয়। আমরা কোন সিগনাল পাচ্ছিলাম না। অনেকক্ষন এইভাবে চলার পর পাকিস্তানি আর্মি জানতে পেরেছে, পাকিস্তানি সেনাপ্রধান নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেছে। সবাই নিজ নিজ অস্ত্রসহ স্যারেন্ডার করছে। আমাদের তিন কমান্ডার উচ্চ পদস্থ মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করে এর কিছুক্ষন পরে দেখতে পেলাম বাংলাদেশী আর্মি এবং ইন্ডিয়ান আর্মি যৌথভাবে এসে পাকিস্তানি আর্মিদেরকে উদ্দেশ্য করে মাইক দিয়ে বলতে লাগলো স্যারেন্ডার করার জন্য। অনুরোধ করলো মাটিতে অস্ত্র রেখে মাথায় হাত দিয়ে ক্যাম্প থেকে বাহির হওয়ার জন্য বললো। শেষ পর্যন্ত স্যারেন্ডার করলো কিন্তু পাকিস্তানি আর্মিরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে স্যারেন্ডার করবে না। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে মেরে ফেলবে। সেদিনও ভাবতে পারিনি শত্রæমুক্ত বাংলাদেশ ১৬ই ডিসেম্বর কে বা কারা আমার বড় ভাই জহুর আহম্মদকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গেছে। পরে সব মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে হাজির। আমার ভাইকে সাথে সাথে অপারেশন রুমে নিয়ে যাই। অপারেশন করে গুলি বের করে অনেক দিন হাসপাতালে ছিলো। আমার শেষ অস্ত্র জমা দিয়ে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলে আবার ফিরে যাই। তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের ছাত্র এবং শিক্ষক আমাকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যে সম্মান দিয়েছেন, আজও আমি তাদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু আজও আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। ১৯৭১ ভারতে যাওয়ার পথে তুমি হঠাত করে ফেরেস্তোর মত রাতের অন্ধকারে এক বেলা ভাত দিয়ে ভোর সকাল বেলা পাহাড়িয়ার লোকের হাতে তুলে দিয়ে আমাদেরকে ভারতে পৌঁছে দেয়ার জন্য যে উপকার করেছ, আও তোমাকে ভুলি নাই। অনেক দিন পর ২০২০-এ সে লোকের সন্ধান পেয়েছি। সে ভদ্রলোক হিন্দু ছিলো, পাক বাহিনী তাদের সব কিছু লুটে আগুন দিয়ে শেষ করে দিয়েছে। তাদের অপরাধ মুক্তি বাহিনীকে সহযোগিতা করা। তার নাম অরুন কান্তি দাশ, গ্রাম-কচুয়ার পাড়া। দক্ষিণ রাঙামাটিয়া/ফটিকছড়ি (৪৩৫০), চট্টগ্রাম।
আমি বাংলাদেশে গিয়ে সে ভদ্রলোককে একটি বারের মত হলেও দেখতে যাই। তার জন্য একটি উপহার নিয়ে যাই। তাদের এই প্রতিদান আমরা কখনো ভুলতে পারবো না। তাদের প্রতি আমাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রইলো। চট্টগ্রাম শহরে নানা অপারেশনে কত মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাথে কাজ করেছে, রাতের অন্ধকারে চলাফেরা করেছি, আজ অনেকেই এই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছে। তাদের রক্ত মাখা স্বপ্ন আজ বাংলার মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে। আমরা কোন দিন তোমাদেরকে ভুলবো না। আবার দেখা হবে কোন একদিন। কিন্তু বাংলার মাটি থেকে মীর জাফরের বংশধর এখনও চির বিদায় নেয়নি। দোয়া করি সবার জন্য।
১. মোজাফফর আহম্মদ (ভাই), (চট্টগ্রাম মহানগর কমান্ডার, ২১৬ পূর্বমাদার বাড়ী, ১ নং সেক্টর)
২. সোলতান আহম্মদ (ভাই), (২১৬ পূর্বমাদার বাড়ী, মাঝিরঘাট রোড, চট্টগ্রাম, ১ নং সেক্টর)
৩. জহুর আহম্মদ (ভাই), (২১৬ পূর্বমাদার বাড়ী, মাঝিরঘাট রোড, চট্টগ্রাম, ১ নং সেক্টর)
৪. আবদুর হাফিজ (খালাতো ভাই), (২১৬ পূর্বমাদার বাড়ী, মাঝিরঘাট রোড, চট্টগ্রাম, ১ নং সেক্টর)
বীর মুক্তিযোদ্ধা
মোহাম্মদ এয়াকুব
১ নং সেক্টর, চট্টগ্রাম মহানগর
২১৬ পুটিমাদার বাড়ি, রাবেয়া ওয়ার্কসপ
মাঝিরঘাট রোড