অনলাইন ডেস্ক : আসছে শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। পরীক্ষার নানান স্তর পেরিয়ে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কবে নাগাদ আলোর মুখ দেখবে সেটা বলা যাচ্ছে না এখনই। অনিশ্চয়তার দোলাচলে বিশেষজ্ঞদের কথা একটাই—ভ্যাকসিনের আশায় বসে থাকা চলবে না। কোভিড-১৯ থেকে বাঁচতে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। তারা বলছেন, দেশের ১৭ কোটি মানুষকে একসঙ্গে টিকা দেওয়া অসম্ভব, কিন্তু ১৭ কোটি মানুষকে মাস্ক পরানো সম্ভব।

বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানায় সরকার। ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে সরকারি হিসাবে কোভিড আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন তিন লাখ ৮৪ হাজার ৫৫৯ জন। ১৮ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন পাঁচ হাজার ৬০৮ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘জোর দিতে হবে নন-ফার্মাসিউটিক্যাল ইনটারভেশনের দিকে। এরমধ্যে রয়েছে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, বারবার হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি। এগুলো জনগণকে মেনে চলার ব্যবস্থা করা না গেলে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় কোনোভাবেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ মাস্ক পরে না, সামাজিক দূরত্ব মানে না বলে সাধারণ মানুষের ওপর দায় চাপালে চলবে না। এ দায় স্বাস্থ্য বিভাগকে নিতে হবে। একইসঙ্গে টেস্ট-ট্রেসিং-অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি পরীক্ষা চালু করা, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, এগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে।’

উল্লেখ্য, বস্তিতে সংক্রমণ হচ্ছে না বলে স্বাস্থ্য বিভাগ যে ধারণা দিয়ে আসছিল, সেটা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)-এর যৌথ গবেষণায় ভুল প্রমাণ হয়েছে।

ডা. বে-নজির আরও জানালেন, ‘চীন, ভুটান, ভিয়েতনাম সফল হতে পারলে আমরা কেন পারবো না? বাংলাদেশে যারা স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বে আছেন তারা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ ফেল করেছে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু বলেন, ‘বাংলাদেশের গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যানকোভিড বের হলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। কিন্তু নিজেরা করলেও বছরে তিন কোটির বেশি ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারবো না। ঝুঁকির্পূণ জনগোষ্ঠী ও সামনের সারির করোনাযোদ্ধাদের সেটা আগে দেওয়া হবে।’

ডা. সায়েদুর রহমান আরও বলেন, ‘আমার ধারণা ২০২২ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ বিনামূল্যে ভ্যাকসিন পেতে পারে বড়জোর দুই-তিন কোটি, কিনতে পারবে এক কোটি। অন্যদিকে তিন লেয়ার মাস্ক কোভিড ভাইরাস ঠেকাতে সক্ষম। আমরা সবাই মাস্ক পরলে ভ্যাকসিনের জন্য হা-হুতাশ না করলেও চলবে।’

‘দেশের ১৭ কোটি মানুষকে একসঙ্গে ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে না, কিন্তু ১৭ কোটি মানুষকে মাস্ক পরানো সম্ভব। সেজন্য জনসচেতনতায় জোর দেওয়া দরকার। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ ধরনের কার্যক্রম চালাতে হবে। কমিউনিটি অংশগ্রহণ ছাড়া কিছু অর্জন করা যাবে না’—বললেন অধ্যাপক সায়েদুর রহমান।

একই পরামর্শ দিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি জানান, ‘কারও উপসর্গ থাকলে তাকেই শনাক্ত করে আমরা আইসোলেশনে নিচ্ছি। কিন্তু যার উপসর্গ নেই তাকে আক্রান্ত বলে ধরছি না। তাই কে আক্রান্ত আর কে আক্রান্ত নন, সেটা না ধরে প্রত্যেকের মাস্ক পরা উচিত এবং সঠিকভাবেই পরা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘এখনও শতভাগ কার্যকর ভ্যাকসিন কোথাও তৈরি হয়নি। কোথাও তৃতীয় ধাপে রয়েছে। সেগুলো ভ্যাকসিন হিসেবে আসতে আরও সময় লাগবে। তাই নিজেকে রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মাস্ক ও সামাজিক দূরত্ব। গবেষণায় পাওয়া গেছে, যারা পজিটিভ হয়েছেন, তাদের শতকরা ৮০ ভাগেরই উপসর্গ নেই। কে আক্রান্ত আর কে সুস্থ সেটা খালি চোখে জানার উপায় নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ আসবে কী আসবে না, সেটার জন্য বসে না থেকে আগেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি জোর দিতে হবে।’

‘জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কখনোই কোনও মহামারি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কার্যক্রম নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে কোভিড নিয়ন্ত্রণ আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য’—যোগ করলেন ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।

এদিকে, হার্ড ইমিউনিটির মাধ্যমে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমর্থন নেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামিনাথন বলেছেন, ‘অনেকে হার্ড ইমিউনিটির কথা বলছেন। এতে বড়মাপের প্রাণহানির আশঙ্কা থেকেই যায়। প্রতিষেধকের মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছানোর কথা বলা উচিত। অন্তত ৭০ শতাংশের মধ্যে প্রতিষেধক দিয়ে সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙার কথা ভাবতে হবে।’