সাজ্জাদ আলী : তার জন্মের বছর ৭১, মাস ডিসেম্বর, দিন ১৬। সে ভ‚মিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে শুনছে যে আসছে জন্মদিনে তার বাবা ফিরবেন। কথাটা শুধু তার মা বলে। আর তা একেবারে অন্তর থেকেই বলে। এ বছর ডিসেম্বর আসতেই মা দিনে অন্তত ১০ বার ফোন করছেন। বাড়ি যাবার তাগাদা। অবশ্য তাড়া না দিলেও বিজয়া যেতো। বাবাকে দেখবার আজন্ম আকুতি তার। ওদিকেরেবতীও তো মেয়েকে দেখেনি কখনও। আশাপূর্ণা যেন বাবা ও মেয়ের দুহাত মিলিয়ে দেওয়ার জন্যই আজও বেঁচে আছেন।
বিজয়ারস্যুটকেস গোছানো শুরু। নিজের ব্যবহার্য তেমন কিছুই না। দুই একটা শাড়ি-বøাউজ, পেষ্ট-ব্রাশ, ল্যাপটপ, স্যান্ডেল-শ্যাম্পু, দরকারি দুই চারটা ফাইলইত্যাদি সাথে নেবে। তবে স্যুটকেসটাভরে যাবে মায়ের পছন্দের উপকরণে। টাঙ্গাইলের পোড়াবড়ি থেকে চমচম আনিয়েছে। চাটগাঁ থেকে এসে পৌঁছেছে লইট্যা মাছের শুটকি। মিরপুরের জামদানী পল্লিতে বিজয়া নিজে গিয়েছিলো। স্পেশাল অর্ডার দিয়ে সাদা জমিনের ওপরে হালকা রঙের কারুকাজে শাড়ি বুনিয়েছে। ২/১ দিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে শান্তিপুরি জর্দ্দা এসে পড়বে। আর যাওয়ার দিন ফেরি থেকে এক কাঁদি মধুচম্পা কলা কিনে নিয়ে যাবে। চাঁপা কলা মায়ের ভারি পছন্দ।
বিজয়া চার্টার্ড একাউন্টেন্ট। ঢাকার গুলশানে তার বিশাল একাউন্টিং ফার্ম। বেশ কয়েকটি বিদেশী সাহায্য সংস্থার হিসাব কিতাব দেখভাল করে সে। মেয়েকে দেশে বিদেশে পড়িয়ে এনেছেন বটে। কিন্তু আশাপূর্ণা কোনোদিন ঢাকায় আসেননি। আসবেনও না। শুধু ঢাকা বলে কথা না।গত ৫০ বছরে তিনি একটি দিনের জন্যও বাড়ি থেকে বের হননি। দাওয়ায় বসে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেছেন। ধরুন হঠাৎ কোনো একদিন রেবতী বাড়িতে ফিরলো, আর ঠিক সেদিনই আশাপূর্ণা বাড়িতে নেই! তাতো হতে পারে না!
সেই যুদ্ধের বছরে রেবতি চাটুয্যে বিএ ক্লাসের ছাত্র। ছাত্র না ছাই! আসলে ছাত্রলীগের পান্ডা। বিয়ের পর থেকেই আশাপূর্ণা দেখছে বইপত্রের সাথে রেবতীরকোনো সম্বন্ধনেই। মিটিং-মিছিল, স্লোগান, ভোট -এগুলোই তার জীবন। দিন নাই রাত নাই, খাওয়া নাই নাওয়া নাই, বাড়ি নাই ঘর নাই, আছে শুধু দেশ। দেশটা এবার স্বাধীন করাই চাই।
কোনো কোনো দিন রেবতী বেলা ্ওঠার আগেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। চাকরবাকরেরা জমিজিরাত দেখেশুনে রাখছে বলেই ঠাকুরদার রেখে যাওয়াজোতদারিটা টিকে আছে। বালিকা বঁধু আশাপূর্ণা বাড়িতে একা। সারাদিন স্বামীর দলবলের জন্য পোস্টার লেখে। নিউজ প্রিন্টের বড় বড় কাগজ আর দোয়াত ভর্তি কালি মজুদ আছে। কুঞ্চির আগায় ত্যানা পেচিয়ে আশাপূর্ণা পোস্টার লেখার কলম বানিয়েছে। সে কলমের প্রতিটি শব্দ থেকে যুদ্ধ যেন ঠিকরে পড়ে! জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু,তোমার আমার ঠিকানা -পদ্মা. মেঘনা, যমুনা। অথবাবীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।তোমার নেতা আমার নেতা,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আরো কত সব শ্লোগান! আশাপূর্ণা লিখেই চলেছে।
সে বছর মার্চে আরো উতলা হলো দেশ। গাঁয়ে প্রতিদিন উড়ো খবর আসে। মিলিটারিরা খুলনায় ৪ জনকে গুলি করে মেরেছে। চট্টগ্রামে মিছিলে গুলি!মারা গেছে ৮ জন। আরগুলি খেয়েছেগণনার অতীত। শেখের ব্যটার হুকুমে দেশ অচল। কলকারখানা বন্ধ, গাড়িঘোড়া চলে না।পাকিস্তানিদেরআর খাজনা ট্যাক্স দেওয়া লাগবে না। দাও, কাঁচি, ঢাল,সড়কি, লাঠিসোটা নিয়েসাড়ে সাত কোটি মানুষ রাস্তায়।দেশ স্বাধীন না করে বাঙালি ঘরে ফিরবে না।
একদিন পোষ্টার লিখতে লিখতে আশাপূর্ণার পেট গুলিয়ে বমি হলো। পাশের খলটের জবা পিসি কইলো, তোর প্যাটেতোবাইচ্চা। কথাটা মাসি রেবতীরেও বললো। ভারি খুশি সে। তার সন্তান তাইলে স্বাধীন দ্যাশেই জন্মাবে মনে হয়।
ক’দিন বাদেই আবার খবর এলো, ২৫ তারিখ রাতেমিলিটারিরা নাকি ঢাকায় ‘ডান্ডা মেরে সব ঠান্ডা’ করে দিয়েছে। বাঙালির লাস রাস্তায় শিয়াল কুকুরে খাচ্ছে।এরও ক’দিন পরেশোনা গেল, মাত্র চার ক্রোশ দূরের ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস স্টেশনেমিলিটারিরা ক্যাম্পবসিয়েছে। তা প্রায় মাসখানেক হলো গাঁ-গ্রামের সব চুপচাপ, কেউ আর উঁচু গলায় কথা বলে না। মিটিং নাই মিসিল নাই, সব শুনশান! ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্প থেকে মিলিটারিরা একেকদিন এক এক গ্রামে ঢোকে। বাড়িঘর জ্বালায়, মানুষ মারে, যুবতীদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়।
রেবতী গোলাঘরে কুপি জ্বালায়ে রাতে রাতে দলবলের সাথে কী সব যেন শলাপরামর্শ করে। চারদিকে ঘুসঘাস ফুসফাস। দুচার দিনের মধ্যেই কথাটা আশাপূর্ণার কানেও এলো। লক্ষী বৌদি কইলো, রেবতী যুদ্ধ শিখতি ইন্ডিয়া যাবি! কথাটা আশার বিশ্বাস হলো না। তাকে গর্ভবতী অবস্থায় একা রেখে রেবতী দেশান্তরী হবে? না, তা হতেই পারে না!
সে রাতে স্বামীকে জড়িয়ে শুয়ে একগাদা প্রশ্ন করলো আশাপূর্ণা, কী শুনি গো? তুমি নাকি ভারতে যাইবা? আমারে নিবা না? প্যাটে বাইচ্চা, কখন কী হয়? দেখার কিডা আছে কওতো?
একটি প্রশ্নেরও জবাব মিললো না। চোখ বন্ধ রেখে সারা রাত রেবতী শুধু বৌয়ের চুলে আঙুল বোলালো। ঘরের বাতি নেভানো বলে বৌটি রেবতীর চোখের জলের ধারা দেখতেও পেলো না।
সেদিন কাক ডাকা ভোরেই আশাপূর্ণার ঘুম ভাঙলো। ভাঁড়ার ঘরের চাবি কুটি পিসির হাতে তুলে দিয়ে সে হাঁস-মুরগীর খোপের দরজা খুলে দিলো। আজ গরুর দুধে আলা চালের জাউ রান্না হবে। সেটাই সকালের খাবার। সেদিন আর রেবতী বাড়ি থেকে বের হলো না। গোমস্তাদের থেকে সাংসারের খোঁজ খবরনিয়েই কাটালো। গোলাঘরে ধানপাটের মজুতের খবর নিলো। হালের গরুগুলোর কী অবস্থা, বিলের কোন পুকুরে কেমন মাছ পড়েছে, হাওড়ের ধানি জমিগুলো জেগে উঠলো কিনা, ইত্যাদি সব খবর।
সন্ধ্যায় বাড়ির বয়স্কদের দুচারজনকে খবর পাঠালো রেবতী। অমূল্য জ্যাঠা, সুনীল খুড়ো, জবা মাসি, মোক্ষদা বৌদি একে একে সবাই এলো। তামাক সাজিয়ে গোমস্তা অমূল্য চাটুয্যের হাতে দিলো। হুক্কায় টান দিয়ে জ্যাঠা বললো, কি শুনতাছি রে রেবতী? তুই নাকি ভারত যাইতাছিস?
মাথা নিচু করে বসে রইলো রেবতী। কোনো কথা বলছে না। খানিকক্ষণ নিরবতার পরে অমূল্য জ্যাঠা আবারো বললেন, দ্যাশ স্বাধীন করতি যাবি সে তো ভাল কথা। তয় আমাগো কার কাছে রাইখা যাইতাছিস? আমরা কী করবো?
জ্যাঠা, শুনছি শরণার্থী হইয়া অনেকেই ভারতে যাইত্যাছে। চেষ্টা কইরেন মাটি কামড়াইয়া কয়েকটা মাস ভিটায় থাকতি। তার মইধ্যে ভগবান চায় তো আমরা দ্যাশ স্বাধীন কইরা ফালাইবো।
আশা বৌমার কথা কি ভাবছোস? সে তো পোয়াতি?
বিরক্ত হয়ে রেবতী বললো, আইচ্যা জ্যাঠা এইডা কি কন? আমি যদি দ্যাশেও থাকি তাও কি আশার জন্যি আমি কিছু করতি পারবো? সবই তো জ্যাঠাইমা, খুড়িমা আর বৌদিরাই করবি। সত্যিকিনা কন?
এ কথায় সুনীল খুড়ো ক্ষেপে গেল। বললো, তোর সাথে কথা কওয়া যায় না রেবতী। তুই খালি আকথা কুকথা কইস! অ্যাই চ্যাংড়া ক’তো, শরণার্থী হইয়া আমাগো যদি দ্যাশ ছাড়া লাগে, বৌবেটিরে নিয়া আমরা তখন কী করবো?
ঘোমটা টেনে এতক্ষণ আশাপূর্ণা বারান্দার খুঁটি আঁকড়ে বসেছিলো। বয়োজেষ্ঠদের সামনে সে কখনও কথা বলে না। আজ হঠাৎ যেন অভিমানে ফুসে উঠলো সে! বললো, আমি শাশুড়ির ভিটা ছাইড়া কোত্থাও যাবো না। আপনাগো ছাওয়াল যুদ্ধ শিখতি যাইতেছে, তারে যাতি দ্যান। এই ভিটায় আমি তার জন্যি অপেক্ষা করবো। তার ফিরতি দেরি হলি আমারসন্তান বাবার জন্যিদিন গুনবি।
সেই থেকে দিনগুনছেন আশাপূর্ণা। বছর ফুরিয়েছে, দশক গড়িয়েছে, যুগের পরে যুগ পেরিয়েছে।নিজে বুড়িয়েছেন, তবু রেবতীর জন্য তার অপেক্ষা ফুরোয়নি। কিন্তু তা নিয়ে তার মনে কোনো খেদ নেই। রেবতী ফেরেনি বটে। কিন্তু সেতো দেশটা স্বাধীন করেছে। আর বিজয়াতো তারই দেওয়া উপহার!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)