সেরীন ফেরদৌস : প্রথমে তিনি একটি অবাস্তব রাজনৈতিক পরিবেশ, স্থান আর সময় বেছে নিলেন। তার ভেতরে কিছু চূড়ান্ত বাস্তব চরিত্র চড়িয়ে দিয়ে বাস্তব-অবাস্তব মিলিয়ে গল্প ফেঁদে বসলেন। চরিত্রেরা এমনই জীবন্ত, দাপুটে আর পোড়খাওয়া, আর উপন্যাসেও এমন ঠাসবুনন দিলেন যে, পড়তে গেলে হাঁসফাঁস লাগে প্রায়! একবার উপন্যাসের জালে পা দিয়েছ তো মরেছ! সে জাল ভেদ করে বাইরে আসার কোনো উপায় রাখেননি! এই যে রুদ্ধশ্বাস পাঠক বের হতে পারছেন না, তার কারণ কী! আমার মনে হয়েছে কারণ হলো, চরিত্রগুলো জলজ্যান্ত বাস্তব মানুষের চেয়েও কুশলী বাস্তব হয়ে পাঠককে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
মার্গারেট অ্যাটউডের ‘দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল’ লেখা হয়েছে ৩৫ বছর আগে। কিন্তু সময় ছাড়িয়ে উপন্যাসের সারবস্তুর উপযোগিতা, বিষয়বস্তুর ধার ও ভার আজও কিছুতেই পুরোনো হয়নি। বরং সা¤প্রতিক প্রকাশিত দ্বিতীয় খণ্ডটির, ‘দ্য টেস্টামেন্টস’, পুরস্কারপ্রাপ্তি যেন আবারও প্রথম খণ্ডটির চাহিদাকে দাউ দাউ করে উসকে দিয়েছে, পৃথিবীজুড়েই বলা চলে। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশ হয়েছে ১৯৮৫ সালে যা তিনি তার বছরখানেক আগে লেখা শুরু করেছিলেন। সে সময়ে তিনি বসবাস করছিলেন পশ্চিম বার্লিনে, যেটি বার্লিন দেয়াল দিয়ে তখনো ঘেরা এবং সোভিয়েত সাম্রাজ্য তার দাপুটে শাসন নিয়ে অবস্থান করছে। চেকোস্লোভাকিয়া ও পূর্ব জার্মানির বিভিন্ন স্থানে চলাচলের সময় তিনি বহুবারই যেসব ঘটনা ও অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, তার সরাসরি ছাপ আছে উপন্যাসে।
অ্যাডউডের চরিত্ররা চিন্তা করে, চিন্তার বিশ্লেষণ করে, কারণ উদঘাটন করে, পর্যবেক্ষণ করে আর সতর্কতার সঙ্গে উপন্যাসে অংশগ্রহণ করে। শুধুই অ্যাকশনের পরে অ্যাকশন নয়, অ্যাকশনের পেছনের ব্যাখ্যাসমেত চরিত্রের কথোপকথন বা ঘটনা আগাতে থাকে, যা পাঠকের কার্যকারণ কনফিক্ট বা চাহিদাকে অনেকটাই মসৃণভাবে তুষ্ট করে অথচ আগাম অনুমান করতে দেয় না পরের ঘটনা তী হতে পারে। একটা অধীর আগ্রহের টান তৈরি বরাবর বজায় রাখতে পেরেছেন তিনি। এবং কাহিনী হুবহু না মিললেও নিজের চিন্তার সঙ্গে চরিত্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের চিন্তার মিলকে পাঠক রোধও করতে পারে না। উপন্যাসের রাজনৈতিক বাস্তবতার ক্ষেত্রেও একই কথা। কম আর বেশি, সেটাও মিলেও যেতে থাকে, ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ অর্থে, পৃথিবীর বহু অংশের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে। আবার হুবহু ঠিক যেন মেলেও না! আবার মনে হতে থাকে, মিলতে কতক্ষণ! আমার ক্ষেত্রে তো, বারবারই বাংলাদেশেরই নানা সময়ের সেনাশাসন, ক্রসফায়ার, র্যাব, তনু হত্যা, সেল্ফ সেন্সরশিপ ইত্যাদির টুকরো টুকরো গল্প মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার! এই যে মেলা, না-মেলা, বাস্তব-অবাস্তবের ভেতরে ক্রমাগত খাবি খেতে থাকলাম, তার ভেতর দিয়ে ভয়াল উপন্যাসটি রুদ্ধশ্বাসে এগিয়ে চলল। স্থান বিবেচনায় আপাত মনে হয়েছে, না-থাকার মতোই, আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস এলাকা। সেটা নাম একটা বলতে হয় তাই বলা, নইলে নিতান্তই গৌণ।
সারসংক্ষেপ খানিকটা এরকম- কোনো এক দেশ, নাম রিপাবলিক অব জিলেড। কিছু বছর ধরে কঠিন সামরিক শাসন চলছে। নারী স্বাধীনতার কালটাল পার হয়েছে বেশ আগেই। এমনকি কাগুজে টাকার নোটও পুরনো যুগের ব্যাপার! নারী এখন ঘরে বন্দি। শুধু বন্দিই না, নারীর পেশা অনুযায়ী তাদের পোশাকের রং নির্ধারিত হয়েছে। তাদের কোনো আসল নাম নেই, ইচ্ছে নেই, দরকারভেদে তাদের নাম দেওয়া হচ্ছে। যেমন, শাসকদের স্ত্রীরা পরছেন নীলের নানা শেড, কাজের মেয়েরা সবুজের শেড আর ‘হ্যান্ডমেইড’ নামের বাচ্চা জন্মদানে নিয়োজিত নারীরা পরছে লাল রং। সমাজের নিচু শ্রেণির নারীরা পরবে স্ট্রাইপ প্রিন্টের পোশাক। রাস্তাঘাটে সহজেই যাতে বোঝা যায় কার ভূমিকা কী। হ্যান্ডমেইডদের পোষা প্রাণীর মতোই রাখা হয় প্রভুদের সন্তান জন্মদানের জন্য। পরিবেশ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রতিশোধের কারণেই হবে, পুরুষের স্পার্ম-এর ডিম্বাণু নিষিক্ত করার সক্ষমতা উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। হ্যান্ডমেইডদের সঠিক শিক্ষাদানের জন্য স্কুল কার্যক্রম চালু আছে। বাচ্চা জন্মানোর পরপরই বাচ্চা প্রভুকে দিয়ে হ্যান্ডমেইডকে অন্য এলাকায় নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয় পুনরায় গর্ভধারণের জন্য।
শুরুতেই দেখা গেল, কমান্ডারের স্ত্রী ‘অফরেড’ নামের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে হ্যান্ডমেইড হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন তার বাড়িতে। উপন্যাস শুরু হতে না হতেই চাপা একটা ভয়ের পরিবেশের ভেতরে যেন হুমড়ি খেয়ে পরতে হলো। গা কাঁটা দিয়ে ওঠা ঠা-া, নিরুত্তাপ কণ্ঠে উপন্যাসের মুখ্য বলিয়ে নিজের কাহিনী বলতে শুরু করে! নামটাও আসল নয়, হ্যান্ডমেইডদের কোনো আসল নাম থাকে না! এই নকল নামেই তার আপাত পরিচয়। অফরেড বুদ্ধিমান নারী, একদা সে লাইব্রেরিতে চাকরি করত এবং একটি শিশুসহ স্বামীও ছিল। ক্রমে সৈন্য-শাসন দখল করে নেয় দেশ ও সবকিছু। প্রতিদিন শহরের দেয়ালে কয়েকটি করে লাশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, অপরাধের দলিলসহ, শক্তির শাসন একচুল এদিক-ওদিক হওয়া চলবে না। অ্যাডউডের গল্প বলার ভঙ্গি অনেকটা বালুতটে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো। কাহিনী এসে সশব্দে আছড়ে পড়ছে আবার পানি ঘোলা করে দিয়ে মসৃণভাবে ফিরে যাচ্ছে! এই বর্তমান তো এই অতীত, আবার বর্তমান আবার অতীত। ব্যাপারটা তিনি এমন নিপুণভাবে ব্লেন্ড করেছেন যে হোঁচট খাওয়ার উপায় নেই, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একমুখী এগোনোর একঘেয়েমি থেকে উপন্যাস মুক্তি পেয়েছে! কোথাও কোথাও খুব বেশি বিস্তৃত বর্ণনা সময়ের একটি নির্দিষ্ট খণ্ডকে খামোকা দীর্ঘায়িত করেছে বলেও বোধ হয়েছে আবার।
উপন্যাসে কোথাও পরিষ্কার করে বলা নেই, কীভাবে কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছে অফরেডের স্বামী বা শিশুটি। কিন্তু কমান্ডারের শয্যায় নিয়মিত যাতায়াতেও গর্ভধারণ না-ঘটায় কমাণ্ডার গিন্নি ড্রাইভার নিককে গোপনে নিয়োজিত করেন অফরেডকে গর্ভবতী করার কাজে। ভীত, সংকুচিত নারীটি এই প্রথম প্রেমে পড়ে যায় নিকের!
শেষপাতা শেষ হওয়ার পর থম মেরে বসে রইলাম! শিরদাঁড়া বেয়ে ঠা-া হিম গ্রোত বয়ে গেল! কী হলো এটা! কী করে হতে পারল! হতভাগী অফরেডের জন্য আফসোস হতে থাকে, কোন কুক্ষণে বিশ্বাস করেছিল নিককে! গলার কাছে শ্বাস আটকে রেখে পড়ে যাই, কমান্ডারের বাড়িতে সেদিন গভীর রাত। চূড়ান্ত বড় ঘটনা ঘটার চাপা উদ্বেগ সবার মনে! অফরেডও বুঝে যায়, তার সময় আসন্ন, অন্য হ্যান্ডমেইডদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগের খবর ফাঁস হয়ে গেছে, ধরা পরে যাবে হয়তো আজ রাতেই! খুব দ্রুত ভাবছে আত্মহত্যা করার কী কী উপায় হাতের নাগালে আছে এই মুহূর্তে! রহস্যময় সেই কালো ভ্যান, যে ভ্যান কিনা যাকে তুলে নেয়, আর কেউ কোনোদিন তার খোঁজ পায় না, সেই ভ্যান এসে তাকে তুলে নেওয়ার আগেই ভাবনা সেরে ফেলতে হবে, নিজেকে শেষ করে ফেলতে হবে! তার চেনাজানা অনেক ‘হ্যান্ডমেইড’ আত্মহত্যা করে রেহাই পেয়ে গেছে এই কালো ভ্যানের হাত থেকে। যারা রেহাই পায়নি, তাদের কারও কারও লাশ অবশ্য শহরের দেয়ালে ইতিমধ্যেই টানিয়ে দেওয়া হয়েছে জনসাধারণের দেখার জন্য! তাকে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে হবে! শেষবারের মতো ছুটে নিকের কাছে গিয়ে আশ্রয় চাইবে কি না তাও ভাবছে! যদিও ড্রাইভার নিকের কোনো সাধ্য নেই তাকে রক্ষা করার! শেষ রাতের দিকে বাড়ির গেটে ভ্যান থামার শব্দ পায়। সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসছে ওরা! বিস্ফারিত চোখে অফরেড আবিষ্কার করে, ওদেরকে নিয়ে আসছে প্রেমিক নিক! নিকই তাহলে সেই বিশ্বাসঘাতক, যাকে আদর করে, রাতের পর রাত শরীর দিতে দিতে মনের লুকোনো কথাগুলো উগড়ে দিয়েছিল! অফরেড এই প্রথম আবিষ্কার করে, নিকই এ বাড়িতে আন্ডারকাভার পোস্টিং পাওয়া সরকারি স্পাই! উপন্যাস পাশে রেখে জীবনই পানসে মনে হতে থাকে! ভাল্লাগে না কিছু! দীর্ঘ নিঃশ্বাসে বুক ভরে অক্সিজেন টানি, ওহ খোদা, আমি তো সত্যিই অফরেডের দেশে বন্দি কেউ নই! অমন দেশই তো পৃথিবীতে নেই! নেই? আবারও জিজ্ঞেস করি নিজেকে, সত্যি কি নেই অমন পরিবেশ! আছে আছে, অফরেডের দেশ ‘জিলেড’ খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে আছে বহু জায়গায়- কাশ্মীরে, নাইজেরিয়ায়, সিরিয়ায়, সৌদি আরবে, রাশিয়ায়, চায়নায়, বাংলাদেশে অথবা অন্য কোথাও অন্য কোনো খানে!
বই : দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল
লেখক : মার্গারেট অ্যাটউড