ফরিদ আহমেদ : প্রখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনী ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’-তে বলেছিলেন, ‘হেমন্ত ইজ বর্ন, মান্না দে ইজ মেড।’

বাংলা আধুনিক গানের এই দুই দিকপাল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং মান্না দে-কে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তাঁর লেখা গান এই দুইজনই গেয়েছেন। খুব কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি তাঁর বইতে এঁদের সম্পর্কে অমন মতামত দিয়েছেন। তাঁর এই মতামতের মূল্য আছে।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ এবং সংগীত প্রতিভা প্রকৃতি প্রদত্ত। তাঁদের পরিবারে কেউ গান-বাজনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ফলে, সংগীত ঐতিহ্য বলে কিছু তাঁর ছিলো না। নিজস্ব একটা অসাধারণ কণ্ঠ আর গান বোঝার সহজাত সক্ষমতা দিয়ে তিনি দারুণ সব শ্রোতাপ্রিয় গান গেয়েছেন। গানে সুর দিয়েছেন। আর সেই গান মানুষকে মাতিয়েছে, গেঁথে গিয়েছে মানুষের মনোরাজ্যে। অন্যদিকে, মান্না দে-র অবস্থাটা এমন ছিলো না। তাঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন সেই সময়কার অন্যতম সেরা গায়ক এবং সংগীত পরিচালক। কাকার সহকারী হিসাবে সংগীতের জগতে এসেছিলেন মান্না দে। প্রথাসিদ্ধভাবে গান শেখার সুযোগ তাঁর হয়েছিলো। শুধু গান শেখার এই সুযোগ পেয়েই থেমে থাকেননি তিনি, নিরন্তর পরিশ্রম করে নিজের কণ্ঠ এবং সংগীতজ্ঞানকে পরিশীলিত করে তুলেছিলেন তিনি। এই বিষয়ে তাঁর চর্চাটা কেমন আন্তরিক আর পরিশ্রমসাধ্য ছিলো, সেটা তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘর’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন।

প্রকৃতিপ্রদত্ত কণ্ঠ এবং সংগীত প্রতিভা নিয়ে অনেকেই জন্মায়। তাঁদের সবাই অবশ্য সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছায় না। শুধু প্রতিভা দিয়ে শীর্ষে যাওয়া যায় না, প্রয়োজন পড়ে সেই প্রতিভাকে বিকশিত করা প্রাণপণ প্রচেষ্টা। আর, কিছুটা ভাগ্য। এগুলোর সু-সমন্বয় না হলে সেই প্রতিভা অকালে ঝড়ে পড়ে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও সে’রকমটাই ঘটছে যাচ্ছিলো।

তিনি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে পড়েন। অফ পিরিয়ডে অন্য সব সহপাঠীদের সাথে হইচই করে গান গাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই ক্লাসে এসে পড়েছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। ছাত্রদের গান গাওয়াটাকে সহজভাবে নিতে পারেন নাই তিনি। কে বা কারা গান করছিলো, সেটা জানতে চান তিনি। সবাই চুপ করে থাকলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় উঠে দাঁড়ান। জানান যে তিনি গান গাইছিলেন। তাঁর এই সততা কোনো কাজে আসে নাই। অফিসে নিয়ে গিয়ে স্কুলের খাতা থেকে তাঁর নাম কেটে দিলেন। ছাত্রত্ব বেঁচে যায় তাঁর বাবার কারণে। তিনি স্কুলে গিয়ে ছেলের জন্য মাফ চেয়ে নেন। অনেক অনুনয় বিনয়ের পরে ছাত্রত্ব ফিরে পান তিনি।

এই রকম একটা অ-সহায়ক পরিবেশের পরে গান থেমে যাবার কথা ছিলো তাঁর। সেটা থামে নাই তাঁর বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কারণে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর সহপাঠী বন্ধু ছিলেন। তাঁরা কয়েক বন্ধু মিলে তখন সাহিত্যচর্চা করতেন। হেমন্ত নিজেও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেশ পত্রিকাতে তাঁর ছোট গল্পও প্রকাশিত হয়েছে স্কুলে পড়ার সময়ে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে যান রেডিওতে অডিশন দেবার জন্য। রেডিও-র অডিশনে টিকে যান তিনি। একই সঙ্গে টিকে যায় তাঁর সঙ্গীত জীবন। রেডিও-তে গান করা আর নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে গান করাই ছিলো তাঁর একমাত্র কাজ তখন। এর মধ্যে তাঁর বাবাও সুযোগ করে দেন গানের রেকর্ড বের করার। সেই সব রেকর্ড তিনি নিজেই মানুষের বাড়িতে নিয়ে যেতেন হাতে করে। কেউ জিজ্ঞেস করলে লাজুক কণ্ঠে বলতেন, ‘এটা আমার গানের রেকর্ড।’ এই কথা শোনার পরেই সেই রেকর্ড শোনার আগ্রহ দেখাতো মানুষ। তিনি তখন মহানন্দে সেই রেকর্ড তাদেরকে শোনাতেন।

স্কুল পাশ করার পরে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু গানের নেশার কারণে সেই পড়ালেখাটাও ছেড়ে দেন তিনি। পুরোপুরি আত্ম-নিবেশ করেন গানের জগতে। তবে, সেই যাত্রাটা সুখকর যাত্রা ছিলো না। গানের দুই চারটে টুইশন করে বেশ কষ্টেই সংসার চালাতে হতো তাঁকে। একই সাথে একদিন বিখ্যাত গায়ক হবেন, সেই স্বপ্নটাকেও টিকিয়ে রাখতে হতো কষ্ট করেই।

সেই কষ্ট সফল হয়েছিলো। তিনি কোলকাতা এবং বোম্বের ফিল্ম জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। শুরুটা হয়েছিলো ধাপে ধাপে। প্রথমদিকে অনেক ব্যর্থ কাজ করেছেন। ব্যর্থতার কারণে বদ্ধ দুয়ারের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে তিনি ফেলেন নাই, বরং আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সেই ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসার। সেই চেষ্টাটা কাজে লেগেছে। তিনি একদিন সফল হয়েছেন। আজ তাঁকে আমরা এক নামে চিনি।

আধুনিক বাংলা গানের যে ধারা কয়েক দশক ধরে বাঙালির চিত্তকে জয় করে নিয়েছে, সেই ধারার অন্যতম প্রধান ধারক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গতানুগতিক ধারায় গেলে, এ রকম সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হওয়া যায় না। নিশ্চিতভাবেই তিনি ব্যতিক্রম একজন ছিলন। তিনি কোন জায়গাতে ব্যতিক্রম ছিলেন, সেটা জানা যায় তাঁর বইয়ের প্রকাশক অভীক চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। তিনি লিখেছেন,
“সেই সময়ের সাঙ্গীতিক পরিমণ্ডলের দিকে যদি তাকানো যায় তবে একথা স্পষ্ট হয়, তখন সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত বিভাগের প্রায় সব শিল্পীই উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে শিক্ষিত ছিলেন।
রীতিমতো তালিম সহযোগে দীর্ঘদিন নেওয়া প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষায় শিক্ষিত। শুধু বিখ্যাতরাই নন, তখনকার সময়ে ঘরেদোরে যারাই গান করতেন তাদের শুরু হত উচ্চাঙ্গসঙ্গীত তালিমের মাধ্যমে। এহেন পরিবেশে তাবড় তাবড় সঙ্গীতব্যক্তিত্বদের মধ্যে প্রায় কোনোরকম প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা ছাড়াই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই এক নতুন কণ্ঠ প্রক্ষেপণের ধারা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে অন্যতম মুখ্যভূমিকা নিলেন বলা যায়। হেমন্ত-র কণ্ঠকে বলা হয় ‘স্বর্ণকণ্ঠ’। একেবারেই একশোভাগ খাঁটি কথা। প্রকৃতিদত্ত অসম্ভব সাঙ্গীতিক প্রতিভা এবং সোনার কণ্ঠটি তিনি জন্মগতভাবেই পেয়েছিলেন। কথা এখানেই শেষ করে দিলে হবে না। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজের সাঙ্গীতিক প্রতিভাটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিনতেন এবং তাকে সবসময় মাথায় নিয়ে চলতেন। সর্বক্ষণ ভেবে যেতেন কীভাবে নিজেকে সকলের থেকে আলাদাভাবে চেনানো যায়। সেই সময়ের পুরুষ শিল্পীদের গাব রেকর্ডে শুনলে সকলেই মানবেন তখন এঁদের গান পরিবেশনার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত নাকিসুরের ব্যবহার থাকত তাঁদের কণ্ঠপ্রক্ষেপণে। হেমন্তর ১৯৩৭ সালের প্রথম রেকর্ডেও একই জিনিস শোনা গেছে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে তিনি নাকিসুরের পরিমিত ব্যবহার সহযোগে একটি স্বাভাবিক কণ্ঠপ্রক্ষেপণের ধরন নিয়ে এলেন।”

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর জীবনের এই গল্প লিখেছেন ‘আনন্দধারা’ নামের আত্মজীবনীতে। মান্না দে-র ‘জীবনের জলসাঘর’ অনুলিখন। অর্থাৎ, তাঁর কথা শুনে অন্য একজন লিখেছেন। কিন্তু, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আনন্দধারা তা নয়। এটা তিনি নিজেই লিখেছেন। আগেই বলেছি, জীবনের প্রথম দিকে তিনি সাহিত্য চর্চা করেছেন। ফলে, ভাষার উপরে তাঁর অত্যন্ত ভালো দখল ছিলো। যে কারণে, তাঁর বই ‘আনন্দধারা’ পাঠ করাটা আনন্দের উপকরণ পাঠকের জন্য। প্রাঞ্জল গদ্যে লেখা হয়েছে বইটা। হাতে নিলে শেষ না করে ওঠা যায় না। শুধু যে পাঠেই আনন্দ রয়েছে তা নয়, এই বইটা বাংলা আধুনিক আগের একটা যুগকে তুলে এনেছে। পাঠক গান বিষয়ক অনেক ইতিহাসই জানতে পারবেন, যেটা এই বই না পড়লে জানা সম্ভব ছিলো না।