ফরিদ আহমেদ : অসীমের ধারণা খুব জটিল একটা ধারণা। একে সহজে অনুধাবন করা যায় না। এ জন্য অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না কাউকে। কারণ, আমাদের জীবন সসীম, আমাদের মস্তিষ্ক সসীম, আমাদের ঘরবাড়ি সমীম, আমাদের খেলার মাঠ সসীম, আমাদের চারপাশে আমরা যা কিছু দেখি, তার প্রায় সবই সসীম। তবে, এর মাঝেও যে অসীমের ঝিলিক আমরা দেখি না, তা নয়। অনেক কিছুই আছে, যার মাধ্যমে আমরা অসীমের অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারি।

ধরুন, আপনি একটা বৃত্তাকার পথে দৌড়াচ্ছেন। কোনো নির্দিষ্ট চিহ্ন এই বৃত্তাকার পথে না থাকলে, এই পথটা একটা অসীম পথে পরিণত হবে। আপনার যদি অফুরন্ত শক্তি থাকে, এই পথ ধরে আপনি আজীবন চলতে পারবেন। আবার সংখ্যার কথা ধরেন। শেষ সংখ্য বলে কিছু আসলে নেই। কারণ, আপনি সবসময়ই শেষ সংখ্যার সাথে কিছু না কিছু যোগ করতে পারবেন, ফলে সেটা আরও বড় সংখ্যায় পরিণত হবে।

বিশ্বজগতের ক্ষেত্রেও আমরা অসীমের অস্তিত্বের কিছুটা ধারণা পাই। এটা এতো বিশাল যে আমাদের সাধারণ চোখ থেকে শুরু করে বিশাল শক্তির টেলিস্কোপও আমাদের ধারণা দিতে অক্ষম এর সীমা সম্পর্কে। যে কারণে, বিশ্বজগত সসীম না, অসীম, সেই বিষয়েও আমরা আসলে নিশ্চিত নই। এর বিপুল বিশালত্ব আমাদের অসীমের ধারণা দেয়, কিন্তু, সেই ধারণা সঠিক কিনা, সেটা আমরা জানি না।

বিশালত্বের বাইরে ক্ষুদ্রত্বে গিয়েও কিন্তু আমরা অসীমের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। ধরুন, একটা কেক আছে। নিয়ম করা হলো যে প্রতিজন ব্যক্তি শুধুমাত্র এ থেকে অর্ধেক কেক তুলে নিতে পারবে, বাকি অর্ধেক টেবিলে থাকবে। এ ক্ষেত্রে অসীম সংখ্যক লোকের পক্ষেও টেবিলে পড়ে থাকা কেকের অর্ধেক অংশ ভাগ হিসাবে পাবার সুযোগ থাকছে। সেই ভাগ ক্রমে ক্ষুদ্র থেকে আরও ক্ষুদ্র হচ্ছে, কিন্তু, নিঃশেষ হচ্ছে না কিছুতেই।

সংখ্যা হিসাবে অসীমের কথাই ধরুন। এর সঙ্গে এক যোগ করলেও এটা অসীম থাকবে, এক বিয়োগ করলেও সেটা অসীমই হবে। একে যে কোনো কিছু দিয়ে ভাগ করলেও অসীম পাবো আমরা, আবার গুণ করলেও সেটা অসীমই থাকবে। সমীকরণে অসীমকে বসালে উদ্ভট বিষয় ঘটে। আপনি ইচ্ছা করলে এক সমান শূন্যও বানিয়ে ফেলতে পারবেন সেই সমীকরণকে সমাধান করে। দুই সমান এক, কিংবা এর চেয়েও উদ্ভট কিছুও পেতে পারেন সেই সমীকরণ থেকে।

আবার সব অসীম কিন্তু সমান নয়। একে অন্যের থেকে আলাদা। অসীমগুলো যে অন্য অসীম থেকে আলাদা এরকম প্রস্তাবনা প্রথম দেন জর্জ ক্যান্টর নামের এক ভদ্রলোক। তিনি সেট তত্তে¡র জনক। অসীমগুলো যে সমান নয়, এরা আলাদা এটাকে বোঝানোর জন্য যে প্রস্তাবনা তিনি দেন সেটা The Continuum Hypothesis নামে পরিচিত।

এই তত্তে¡ বলা হয় যে, প্রত্যেক অসীম অন্য অসীম থেকে আলাদা ধরনের। এক অসীম অন্য অসীম থেকে ছোট কিংবা বড় হতে পারে। এই প্রস্তাবনাটা একটু উদ্ভট ধরনের। যেখানে আমরা বলছি যে অসীম মানেই হচ্ছে যার কোনো শেষ নেই, সীমা নেই। আবার, জর্জ ক্যান্টর এসে বলছেন যে এর আবার ছোট-বড়ও আছে। ডেভিড হিলবার্টের মতে, গণিতে এই তত্ত¡টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অপ্রমাণিত সমস্যা। অপ্রমাণিত কেন? কারণ, কার্ল গোডেল প্রমাণ করেছেন, এই তত্ত¡কে কখনও মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না। অন্যদিকে পল কোহেন প্রমাণ করেছেন যে, একে সত্য প্রমাণ করাও সম্ভব নয় কখনো! ফলে, এটাকে সত্য বলেও মেনে নেওয়া যায়, আবার মিথ্যা বলেও মেনে নেওয়া যায়। যাচাই করে এক পক্ষে যাবার সুযোগ এখানে নেই।

অসীমের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের কারণে ডেভিড হিলবার্ট ১৯২৪ সালে হোটেল সংক্রান্ত একটা প্যারাডক্স তৈরি করেছিলেন। সেটা হিলবার্ট’স প্যারাডক্স অব দ্য গ্র্যান্ড হোটেল নামে পরিচিত।

ধরা যাক একটা হোটেল আছে যার রুম সংখ্যা হচ্ছে অসীম। তবে, রুমগুলোকে এক, দুই, তিন এই সিরিয়ালেই চিহ্নিত করা হয়েছে। ধরা যাক, সেই হোটেলের প্রতিটা রুমেই গেস্ট রয়েছে। কোনো রুমই খালি নেই। এই অবস্থায় হোটেলে নতুন একজন অতিথি এলো। এখন কী হবে?

হোটেলতো পরিপূর্ণ। কোনো পরিপূর্ণ হোটেলে নতুন অতিথিতে রুম দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু, আমাদের এই হোটেল বিশেষ হোটেল। পরিপূর্ণ হলেও এটাতে অসীমসংখ্যক রুম রয়েছে। কাজেই নতুন অতিথিকেও জায়গা করে দেওয়া সম্ভব। শুধুমাত্র যে কাজটা করতে হবে, সেটা হচ্ছে হোটেলের প্রতিটা অতিথিকে, তার পরের রুমে সরে যেতে হবে। এক নম্বর রুমের অতিথি যাবেন দুই নম্বর রুমে, দুই নম্বর রুমের অতিথি যাবেন তিন নম্বর রুমে। যেহেতু অসীমসংখ্যক রুম রয়েছে, কাজেই পরিপূর্ণ হবার পরেও এই প্রক্রিয়াতে এক নম্বর রুম খালি হয়ে যাবে। তখন নতুন অতিথিকে সেই এক নম্বর রুম দেওয়া যাবে।

নতুন এই অতিথির পরেও যদি কেউ আসে? কোনো সমস্যা নেই। আগের মতো করেই এই নতুন অতিথিকেও আমরা জায়গা করে দিতে পারবো।

কিন্তু, যদি দুইজনই একসাথে আসে? তাহলে কী হবে? এখানেও সমস্যা নেই। যেটা করতে হবে, সেটা হচ্ছে, প্রতিটা অতিথিকে দুই ঘর করে সরে যেতে বলতে হবে। এক নম্বর রুমের অতিথি যাবেন তিন নম্বরে, দুই নম্বর অতিথি যাবেন চারে, আর তিন যাবেন পাঁচে।

এর মানে হচ্ছে যে কোনো সংখ্যক নতুন অতিথিকেই হিলবার্ট হোটেলে জায়গা দেওয়া যাবে এটা পরিপূর্ণ থাকার পরেও।

কিন্তু, এমন যদি হয় যে অসীম সংখ্যক গেস্ট এসে উপস্থিত হন এই অসীম সংখ্যক রুমের হোটেলে?

আগে আমরা সমাধান করেছি গেস্টদের সংখ্যা দিয়ে। একজন এলে প্রতিটা গেস্টকে সরে যেতে বলেছি এক রুম পরে, দুইজন এলে দুই রুম পরে। অসীম সংখ্যক অতিথি এলে সেই যুক্তিতে সবাইকে অসীম সংখ্যক রুমের পরে সরে যেতে হবে। এটা সম্ভব নয়। ধরুন যে এক নম্বর রুমে আছে, তাকে বলা হলো যে অসীম সংখ্যক রুমে সরে যান, দুই, তিন, চার, পাঁচকেও একই কথা বলা হচ্ছে। এতে করে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়ে যাবে।

এই জটিল সমস্যারও সমাধান আছে। সবাইকে তাদের রুম নাম্বারকে দ্বিগুণ করে ফেলতে বলতে পারি আমরা। এক নম্বর রুমের গেস্ট সেক্ষেত্রে যাবে দুই নম্বর রুমে, দুই নম্বর রুমের গেস্ট যাবেন চার নম্বরে, তিন নম্বর রুমের গেস্ট ছয় নম্বরে। এতে করে দেখুন এক, তিন, পাঁচ এই রুমগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে। সেখানেই এই অসীম সংখ্যক অতিথিদের জায়গা করে দিতে পারবো আমরা।

কী মজা! তাই না?