ইউসুফ কামাল : নয়.
৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট পরবর্তিতে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার বিশাল একটা পরিবর্তন হয়ে গেল। মূলত: ১৫ই আগষ্টের পর রক্ষী বাহিনীকে অবলুপ্ত করা হয় এবং কিছু সদস্য ছাড়া তাদেরকে সেনাবাহিনীর সাথে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী আত্মীকরণ করা হয়। আওয়ামী লীগেরই একটা অংশ ক্ষমতা লিপ্সু কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যদের সহায়তায় দেশের রাষ্ট্রপতিসহ তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিজেরা স্বপ্ররণোদিত হয়ে গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৫ই আগষ্ট থেকে ৬ই নভেম্বর নভেম্বর পর্যন্ত চলে মোশতাকের শাসনামল। পরবর্তিতে ক্যু-পাল্টা ক্যুর মাধ্যমে খালেদ মোশারফের মৃত্যু হয়। পরে ৭ই নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের শাসন ব্যবস্থার আবার পরিবর্তন হয়।
বেশ কয়েক দিন পর দুপুরের দিকে বন্ধুদের সাথে কলা ভবনের উত্তরের সিড়িতে বসে গল্প করছিলাম। বন্ধু সিরাজ এসে হাজির খুব উত্তেজিত মনে হলো। চোখ মুখে কিছুটা রাগের ছাপ। এমনিতেই ও একটু রাগী টাইপের মানুষ। বুঝলাম সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটনা হয়তো আছে। বল্লো কথা আছে। চলো মধুর কেন্টিনের দিকে যাই। হাঁটতে হাঁটতে বল্লো, তুমি হাবিবাকে তো চিনতে? কোন হাবিবা বুঝতে চেষ্টা করতেই ও আমার মনের কথা বুঝে ফেল্লো। কেনো পুনুর ছোট বোন হাবিবার কথা মনে নাই?
মনে হলো তাইতো এই তো মাস ৪/৫ মাস আগের কথা, ভালোবেসে জাসদের (পাংশা) রফিক উল্লাহ্ কামালের সাথে ঘড় ছেড়েছে। পরিস্কার মনে হলো, তাইতো। সে নিয়ে ওদের পরিবারে কি যে অবস্থা। জাসদ রাজনীতির মোহজালে পড়ে সহকর্মীর হাত ধরে ঘড় ছাড়লো ও। পরিবারের ভিতরে তখন একটা যাচ্ছে তাই অবস্থা। আমরা সবাই বন্ধু পুনুকে বুঝালাম, যা হবার হয়ে গেছে। ওর বাবা প্রচন্ড রাগী মানুষ ছিলেন। সবাইকে বলে দিলেন ও কে তোমরা সবাই ভুলে যাও। এ আর আমার কেউ না।
তখন জাসদ মোটামুটি নতুন দল। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া নতুন প্রজন্মের টগবগে রক্তের ধারা সমৃদ্ধ দল। আ স ম আব্দুর রব, মেজর জলিল, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, হাসানুল হক ইনুদের নেতৃত্বে হাজার হাজার তরুণ ও মেধাবী ছাত্র ছাত্রী এক প্লাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশ উদ্ধারের শপথ নিয়ে তারা তখন তেজদ্বীপ্ত বলিয়ান।
মূলত: আওয়ামী শাসনের বিরুদ্ধে একটি বিকল্প প্লাটফর্ম হিসাবেই তখন জাসদ জনসাধারণের কাছে হাজির হয়।
রাজবাড়ী বাজারের একটা ঔষধের দোকানে সব বন্ধুরা সকাল বিকেল একসাথে বসি। স্বাধীনতার আগে থেকেই আমরা ওখানেই বসতাম। মূলত: রাজবাড়ীতে জাসদের সূত্রপাত ঐ দোকান থেকেই। প্রথম জাসদ ছাত্রলীগের কমিটি এখানেই গঠিত হয়। প্রথম কমিটিতে আব্দুল মতিন সভাপতি, সিরাজ আহমেদ সেক্রেটারী ও আবুল কালাম আজাদ (পাংশা) কে সাংগঠনিক সম্পাদক করে গঠন করা একটা কমিটি হয়েছিলো। ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠাই আমাদের মূলমন্ত্র’ এই ছিল তৎকালীন জাসদপন্থী ছাত্রলীগের বক্তব্য।
একদিন বিকেলে নেতার নির্দেশ এলো রাতে কিছু কিছু জায়গায় চিকা মারতে হবে। তখন আলকাতরা দিয়ে দেওয়ালে লেখাকে চিকা মারা বলা হতো। রাত দশ’টায় শুরু হলো সরকারি কলেজ থেকে। আমি, সিরাজ, পনু, আওলাদ, মাসুদুজ্জামান।
হাল্কা বৃষ্টিতে ভিজে সরকারি কলেজ, রেল স্টেশান, সরকারি স্কুল, গার্লস স্কুলে ঘুরে ঘুরে চিকা মারা শেষ করতেই ভোর হয়ে এলো। ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ লেখা চিকা সেদিনই প্রথম রাজবাড়ীর মানুষ ঘুম ভেংগে প্রথম দেখতে পেলো।
মূলত: মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করেই এই দলের প্লাটফর্ম গঠন হয়েছিলো। সারা জীবনের জন্য আমার মনের প্রশ্নই ছিলো, সমাজতন্ত্রের আবার বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হলো কেন?
এটা বৈজ্ঞানিক নামকরণের হেতু কি ছিলো এর সঠিক উত্তর সম্ভবত একজনই দিতে পারতেন তিনি হলেন সিরাজুল আলম খান। যাকে জাসদ এর রূপকার হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। হাঁটতে হাঁটতে সিরাজকে নিয়ে চলে এলাম মধুর কেন্টিনের দিকে। কেন্টিনে ঢোকার মুখে সিরাজ আমার কানে কানে বল্লো কাউন্টারের সামনের টেবিলে ৩/৪ জনের সাথে বসে আছে, পাশে কামালও আছে। তুমি তো ওঁকে চেনো। পুরো বিষয়টা পানির মতো পরিস্কার হয়ে এলো। দম নিয়ে বললাম, কি করতে হবে? ডেকে নিয়ে আসবো?
চোখ নামিয়ে একটু কি যেনো চিন্তা করলো, ওঁকে আমি চিনি আবার সেও আমার সম্মন্ধে জানে। সিরাজকে বল্লাম, শোনো ডেকে বাইরে আনতে গেলে একটা উটকো ঝামেলা বাঁধতে পারে। প্রথমত: সে সহজে যদি আসতে না চায়, দ্বিতীয়ত: সাথে কামাল তো আমাকে ভালো চেনে। তার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে। দেশের এই পরিস্থিতিতে সবার কাছেই হাল্কা অস্ত্র থাকে। নিমিষেই যা বোঝার সিরাজ বুঝে নিলো। লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বল্লো, তাহলে দেখে আসো তো হাবিবাই কি না?
ধীর পায়ে ঢুকলাম সোজা হেঁটে গেলাম কাউন্টারে, আড়চোখে তাকালাম হাবিবার দিকে। আমাকে দূর থেকেই ও দেখেছে, চোখে চোখ পরতেই চোখ নামিয়ে নিলো। ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। বড় ভাইয়ের বন্ধু। পাশের কামাল আমার গতিবিধি খেয়াল করছে। ওরাও হয়তো কিছু একটা সন্দেহ করছে। ভাবলাম এখানে না থাকাই ভালো।
পাশের টেবিল থেকে আ ফ ম মাহবুবল্লাহ্ ভাই ডাকলেন, আরে সাইক্লোজিষ্ট যে! কি খবর! আসো চা খাই। মাহবুল্লাহ ভাই আমার পছন্দের মানুষ, তখন মোটামুটি বড় মাপের ছাত্র নেতা। হেসে বল্লাম, ভাই সাথে বেশি লোক আছে পরে খাবো। আপনারা চা খান, আসি ভাই। খেয়াল করলাম পাশের টেবিল থেকে কামালরা সব শুনলো। ওদের সবার চোখই আমার উপর। মাহবুবুল্লাহ ভাই আবার ওদের নেতা, দেখে ওরা চুপ করে গেল।
চারটে সিংগারা নিয়ে দাম দিয়ে চলে এলাম। বেড়িয়ে এসে সিরাজকে বল্লাম চলো। সিরাজকে দেখলাম একটু চিন্তান্বিত। ও মন খারাপ করে জহুরুল হক হলের দিকে চলে গেলো ধীর পায়ে। আবার চলে এলাম আবার কলাভবনের সিঁড়িতে। আলম, রোজী, লিটন, বিদ্যুৎ বসে আছে। সিংগারাগুলো ওদের হাতে দিয়ে বল্লাম, খেয়ে চলো কোথাও যাই। মনে হলো ওদেরও দুপুরের খাওয়া হয়নি। আলম বল্লো চলো আমার হলে যাই। রোজী বিদায় নিয়ে শামসুন্নাহার হলের দিকে হাঁটা দিলো।
আলম জহুরুল হক হলের ছোট খাটো নেতা উপরন্ত গোপালগঞ্জ বাড়ি, আওয়ামী লীগের এক মন্ত্রীর নিকটাত্মীয়। সরাসরি ডাইনিং হলে যেয়ে সবাই বসে গেলাম। হলে তার অবস্থান যে ভালো সেটা আগেও জানতাম আর আজকে আবারও তার প্রমাণ পেলাম। তা ছাড়া আমিও এই হলের অনাবাসিক ছাত্র। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, আমেরিকা