ইউসুফ কামাল : আট.
বিদ্যুত ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগের দিকে চলে গেল বাসাবোর উদ্দেশ্যে। দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতেই কেমন যেন একাকীত্ব অনুভব করলাম। নি:সীম একটা হাহাকার বোধ আমার উপর জেকে বসলো।
স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে মানুষের আত্মত্যাগের যে ধারা শুরু হয়েছে তাতে আর কত প্রাণ যে শেষ হয়ে যাবে সেটা কে বলতে পারে? দীর্ঘ ন’মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর যে স্বাধীনতার স্বাদ আমরা পেয়েছি সেটা কি এমনিভাবে রক্তপিপাসু হায়েনাদের হাতেই নি:শেষ হয়ে যাবে?
টিএসসি’র সামনের সড়ক দ্বীপে তখনও বঙ্গবন্ধুর বড় একটা পোট্রেট জ্বল জ্বল করছে। টিএসসি’তে নতুন করে রং করা প্রবেশ পথ থেকে ভবনের ঢোকার পথ পর্যন্ত লাল রং করা টবে নানা রকম ফুলের গাছ। অতিথি বরণ করার জন্য সব কিছু প্রস্তুত। প্রচন্ড এক টর্ণেডোর আঘাতে যেন সব কিছু তছনছ হয়ে গেলো।
উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলাম। কোন যানবাহন নাই ফাঁকা রাস্তা। রোকেয়া হল শামসুন্নাহার হল থেকে কিছু কিছু ছাত্রীরা ধীরে ধীরে বেরুচ্ছে- হয়তো তাদের আত্মীয় স্বজনদের বাসার উদ্দেশ্যে। চোখমুখে উত্কন্ঠার ছাপ। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো একটা সিগারেট পেলে ভালো হতো। পকেটে হাত দিয়েই মনে হলো প্যাকেটটা তো বিদ্যুত এর কাছে ছিলো। ভুলে ও নিয়ে চলে গেছে। বুয়েটের মাঠের উল্টো দিকের মেডিকেলের সেই ছোট্ট গেটটা এখন বন্ধ। ফাঁক দিয়ে দেখা গেল কয়েকজন পুলিশ প্রহরায়। লোকজন যেন মৃতদেহগুলো দেখতে না পারে। জীবিত মানুষের মতোই প্রাণহীন মানুষগুলোও এদের কাছে সমান ভয়ের! কাপুরুষ না হলে কি মানুষকে হত্যা করে কেউ সমাধান খোঁজে? ভীরু কাপুরুষের দল।
মেডিকেল হোস্টেলের মোড়ের পান সিগারেটের দোকানও বন্ধ। সিগারেটের নেশাটাও যেন দোকান বন্ধ দেখার সাথে সাথেই কমে আসলো। ঘড়ি দেখলাম প্রায় সোয়া বারো’টা বাজে। মনে হলো আজ শুক্রবার। জুম্মার নামাজ। বকশীবাজার মোড় পার হয়ে নবকুমার স্কুলের গেটটাও বন্ধ। বাম পাশে একটা ছোট্ট মসজিদ ভিতরে দু’একজন মানুষ। জুম্মার নামাজে মুসুল্লির সংখ্যাও কেন যেন কম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চল্লো সারা ঢাকা শহর যেন একটা ভৌতিক শহরে পরিণত হলো।
বিশ্বাসই হচ্ছিলো না এই শহরে কয়েক লক্ষ মানুষ বাস করে, কয়েক হাজার গাড়ি আর রিক্সা সারা শহরের রাস্তা দখল করে রাখে। এখন এই সমস্ত মানুষ আর রিক্সা-গাড়ি গেলো কোথায়? এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো, বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় একজন মানুষকে পরিবার পরিজনসহ সবাইকে হত্যা করা হলো কিন্তু কোনও জায়গা থেকে একটা প্রতিবাদের শব্দও উঠলো না। যার প্রত্যক্ষ ডাকে সারা দেশের মানুষ স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লো, তার এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সারা দেশের কোথাও থেকে একটা গুলির শব্দও শোনা গেল না। নি:শব্দে শুক্রবারের জুমার নামাজ শেষ হলো। কোথাও কোনো দোয়ার অনুষ্ঠানও হলো না। যেনো কিছুই হয়নি। সীমিত সংখ্যক মানুষ দম দেওয়া পুতুলের মতো মসজিদে ঢুকলো আর বেড়োলো।
সারাজীবন যার মানুষের জন্য কেটে গেল তার জন্য একটা মানুষও কি রাস্তায় নামার সাহস পেলো না? হাজার হাজার রক্ষীবাহিনী, পুলিশ, পেটোয়া বাহিনী উট পাখীর মতো বালুতে মুখ গুঁজে বসে থাকলো। কত স্বার্থপর হতে পারে মানুষ। ডান পাশে আইজি প্রিজন এর সরকারি বাড়ি যেখানে সব সময় পুলিশ পাহারায় থাকে। আজ কোন পুলিশও প্রহরায় নাই। সমস্ত শহরটাই যেন একটা ভয়ার্তপুরী হয়ে গেলো।
বাসায় ঢুকলাম। বড় বোনের উত্কন্ঠিত প্রশ্ন, কোথায় ছিলাম? কড়া নির্দেশ বাইরে কোথাও যেন না যাই। হঠাত মনে হলো আমাদের রাজনীতির নেতাকে ফোন দিই। আমাদের এমপি, নেতা, এক সাথে রাজনীতি করি।
পকেট থেকে ছোট্ট ফোনবুক বের করলাম। এলিফ্যান্ট রোডে বাসা। ফোন করলাম এমপি সাহেবই ধরলেন। বল্লাম লিডার এখন কি করবো? দেখা করতে চাইলাম। মনে হলো উনি চমকে উঠলেন, ভয়ার্ত কন্ঠে বল্লেন, কামাল এখন কথা বলা যাবে না। বলেই লাইন কেটে দিলেন। হতভম্ব হয়ে রইলাম কতক্ষণ সময়। আস্তে আস্তে ঘড়ে চলে এলাম। কেমন যেন নিজের উপর একটা ঘৃণা হলো। এই মানুষটার উপর আমরা সবাই কত ভরসাই না করতাম। এই আমাদের নেতা!
সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় আবার ভোরের আলো ফোটে প্রকৃতির নিয়মেই। মানুষের জীবনের চাকা সচল রাখতে হলে সব কিছুকেই মানিয়ে নিতে হয়। মানুষের ভয়ার্ত চেহারাগুলোও ক্যালেন্ডারের পাতার মতই পরিবর্তিত হতে থাকে।
দিন পনেরো পর থেকেই আবারো ধীরে ধীরে ক্লাশ শুরু হতে লাগলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরগুলো আবারও ছাত্র ছাত্রীদের কলরবে যেন সচল হতে শুরু করলো। খালি হয়ে যাওয়া হলগুলোতে কঠোর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আবাসিক ছাত্রদেরকে ঢুকানো শুরু হলো। কড়া নির্দেশ কোনো বহিরাগত যেন না ঢুকতে পারে।
জীবনের অপর নামই মনে হয় সব কিছুকেই মানিয়ে নেওয়া। সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা বাধ্য হয়েই হোক। লম্বা ঝুলওয়ালা পাঞ্জাবীর সংখ্যা নাই হয়ে গেল, তাত্তি¡ক নেতাদের আগমনও কমে গেলো কলাভবনে বিশেষ করে মধুর কেন্টিনে।
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি আমার নামে ঢাকার বকশীবাজার বাসায় একটা পোষ্ট কার্ড এলো কোলকাতা থেকে।
প্রেরক প্রণবেশ বড়ুয়া (ছদ্ম নাম), চিঠিতে একটা ফোন নাম্বার দেওয়া। আর এই নাম্বারে এক ব্যক্তিকে ডেকে এনে কিছু কথা বলতে হবে। আগষ্টের ভয়াবহ ঘটনার পর বেশ কিছু দলীয় কর্মির সাথে সেপ্টম্বরের ২৭ তারিখে সে ভারতে চলে যায় কিছু একটা করার ইচ্ছা নিয়ে। চলে যাওয়ার আগে আমাকে তার জীবনের একান্ত গোপন কিছু কথা বলে গিয়েছিলো একজনকে বলার জন্য। যা শুধুমাত্র তাদের দেশে ফেরা অনিশ্চিত হলেই তা আমাকে বলার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। বুঝে ফেল্লাম একটি সাংঘাতিক কঠিন কাজ। দুটো জীবনের বিচ্ছেদের মহরতের ঘন্টাটা আমাকেই বাজাতে হবে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, আমেরিকা