Home কলাম হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৬১

হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৬১

ইউসুফ কামাল : (বুলার চিঠি)
তোমাকে কি বলে সম্বোধন করবো? আজ চিঠি লিখতে যেয়ে এক বিড়ম্বনার মুখামুখি হলাম, ভিন্ন কোনো নামে যে তোমাকে ডাকতে হবে এটা তো কখনো মনেই আসেনি। তা ছাড়া সবাইকে ডাকতে কি ভিন্ন সম্বোধন লাগে? বিশেষ কোনো নামে ডাকলেই যে তাতে সত্যিকারের মূল্যায়ন হবে তা আমার মনে হয় না, গোলাপকে অন্য নামে ডাকলেই বা কি, সে তো গোলাপই রয়ে যায়। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে হয়তো আমিই তোমাকে সেই পিকনিকের প্রথম দিন থেকেই বেশি করে কাছে টেনেছি, পরিচয়ের পূর্বে ডিপার্টমেন্টে কয়েকদিন দেখেছি তোমাকে বন্ধুদের সাথে। তখন বুঝেছিলাম বন্ধুদের সাথে হই হুল্লোড়ই পছন্দ তোমার। পরে দেখলাম সত্যিই একদম ভিন্ন মানসিকতার মানুষ তুমি। ভালো যে তখন লেগেছিলো সেটা এখন স্বীকার না করলে তো সত্যের অপলাপ করা হবে। পিকনিকের দিনের ঘটনার পরদিন ডিপার্টমেন্টের করিডোরে ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে আমার নাম ধরে খুঁজছিলে। বুঝেছিলাম তখনও আমার চেহারা তোমার মনে ছিলো না। কিন্তু তোমার মনের সেই চাওয়াটা কতটা প্রবল হয়েছিলো ঐ দিনের ঘটনাতেই আমি বুঝেছিলাম। সবাই বুঝে ফেলাতে আমি নিজেও বেশ কিছুটা লজ্বাই পেয়েছিলাম। সে স্মৃতি এখনো মনে পড়লে হেসে ফেলি মনের অজান্তেই।

তোমাকে নিয়ে প্রথমদিকে ভুল ধারণা করতাম হয়তো আমাকে তেমন পছন্দ করো না, পরে বুঝলাম তুমি আবেগ প্রকাশে যথেষ্ট সংযত, কখনোই অতিরঞ্জিত কিছু কর না। তখন কতই বা বয়স আমাদের মধ্যে তখন তো বাধ ভাঙ্গা আবেগেরই কাজ করার কথা, কই তা কিন্তু কখনোই হয়নি। যথেষ্ট সংযত হওয়ার কারণে আবেগকে তুমি কখনোই মাত্রারিক্ত প্রশ্রয় দাওনি। তোমার প্রতি আমার সন্মানবোধ প্রথম বেড়ে গিয়েছিলো সে দিন, যে দিন আমার মা’য়ের অসুস্থতার খবর নেওয়ার পর রমনা টেলিফোন অফিস থেকে ফিরে আসছিলাম। মনে আছে ফেরার সময় রিকশার মধ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তোমার হাত ধরে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। অসুস্থ মায়ের সাথে কথা বলতে পেরে আমি নিজেও অনেক খানি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। তোমার মনে আছে? তুমি ধন্যবাদ জানিয়েছিলে, ব্যাস ঐ পর্যন্তই। সেদিন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের নিয়মনীতির একচুল পরিমাণ মাত্রাও তুমি অতিক্রম করোনি। সেদিন দৃঢ়ভাবে বুঝলাম তুমি সত্যিই ভালো মনের মানুষ, আর সবার থেকেও একটু ভিন্ন ধর্মী।

তোমাকে ছেড়ে আসতে আমার যে কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছিল তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না। বিশ্বাস করো প্লেনের ভিতরের নয়’টা ঘন্টার মধ্যে তোমার কথা যখনই মনে হয়েছে তখনই আমি কেঁদেছি। আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় তোমার যে কষ্টময় চেহারা আমি দেখেছি হয়তো কোনদিনই সেটা ভুলবো না। সে ছবি তো আমার বুকের ভিতরে ভাবে গেথে আছে চিরদিনের জন্য। নিজের সমস্যাগুলো কত অবলীলায় বুকে চেপে রেখে আমাকে সাহস যুগিয়ে গেছো। পদে পদে আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেছো আমার মঙ্গল চিন্তা করে অথচ দুঃখের বিষয় হলো তখন আমার আপনজনেরা কেউই বিন্দুমাত্র এগিয়ে এলো না। তখনই বুঝেছিলাম আমার মা’র মৃত্যুর পর তুমি না থাকলে আমি হয়তো পথ হারিয়ে কোন সমুদ্রে তলিয়ে যেতাম। এ অবস্থায় তোমার একক প্রচেষ্টায় আমি বাবার কাছে পৌঁছতে পেরেছি। যেন পরম যত্নে হাত ধরে ডুবন্ত কোন যাত্রীকে তীরে পৌঁছিয়ে দিলো।

পাসপোর্ট করে দেওয়া থেকে প্লেনে তুলে দেওয়া পর্যন্ত ছায়ার মতো আমার পাশে পাশে থেকেছো। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনের সীমানায় ঢুকিয়ে দিয়ে চেকিং হওয়া পর্যন্ত যতক্ষন আমাকে দেখা গেছে, তুমি কাঁচের দেওয়ালের ওপারে দাঁড়িয়ে ছিলে। একটুও সরে যাওনি, আমার দিক থেকে চোখ ফেরাওনি। আমি দেখেছি তুমি নিস্পলক দৃষ্টিতে শুধু আমাকেই দেখছিলে। সে চাহনি আমি কেমন করে ভুলবো বলতে পারো! আমার মন বলছিলো কাঁচের বেষ্টনী ভেংগে দৌড়ে তোমার কাছে চলে যাই। এও জানি আমার প্লেনের ভিতরে ঢুকে যাওয়ার পর তুমি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারোনি। আমি যেন কল্পনাতেও দেখতে পেরেছিলাম তোমার সেই কষ্টের চেহারাটা। তোমার সম্মন্ধে আমি যতটুকু জেনেছি যতটুকু বুঝতে পেরেছি মনের কষ্ট তুমি কখনোই প্রকাশ করো না। নিজের কষ্টগুলো নীলকন্ঠের মতো হজম করে হাসি মুখে অবলীলায় ঘুরে বেড়াও। এক আশ্চর্য মানুষ তুমি। বাবার দেওয়া পাউন্ড ভাংগানো টাকাগুলো যাতে বেহিসেবে খরচ না করি সেদিকেও কত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিলো তোমার, মূল লক্ষ্য ছিলো পরে যাতে কষ্টে না পড়ি। আমার সুরক্ষার জন্য কত প্রাণান্তকর চেষ্টাই না তুমি করেছো? বলিষ্ঠ একজন অভিভাবকের মতো বুক দিয়ে আগলে রাখতে সব সময়।
জানি না আমার মতো অতি সাধারণ একটা মেয়েকে তুমি কেন এতো উচ্চাসনে বসিয়েছিলে? কিন্তু আমি যে পারলাম না তোমার দেয়া সেই অবদানের যথাযত মূল্য দিতে। তোমার দেওয়া সেই আসনের যোগ্যতা তো আমি রাখতে পারলাম না। আমার স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে গেল, বাস্তবের মুখ আর দেখলো না। এমন সহমর্মিতা পূর্ণ সহযোগীতার নাম যদি হয় ‘ভালোবাসা’ তবে হ্যা, আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলবো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। অনেক খানি ভালোবাসি। এটাও ঠিক যতদিন বাঁচবো তোমায় ভালোবেসেই যাবো। তোমার আমার ভালোবাসা যে আমার কাছে সকালের সূর্যের মতো পুতপবিত্র। তুমি যে আমার কত বড় শক্তির উত্স সেটা কেউই কোন দিন বুঝবে না। মুখে কোনদিন ‘ভালোবাসি’ বলোনি তাতে কি হয়েছে? আমি কি তোমার সেই মুখের না বলা শব্দটা বুঝিনি? এটা মুখের ভাষা দিয়ে বল্লেই হয় না, মন দিয়ে বুঝে নিতে হয়। আমার সমস্ত অস্তিত্ব্রের সাথেই যে তুমি মিশে আছো। তোমাকে তো কখনই ভুলতে পারবো না।
দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি
তাই চমকিত মন চকিত শ্রবন তৃষিত আকুল আখি …

তুমি যে আমার ছোট বেলায় মায়ের মুখে শোনা রুপকথার ‘ঘোড়ায় চড়ে আসা রাজকুমার’। সত্যিই আমার জীবনের রাজকুমার তুমিই। দু:খের মাঝে তোমাকেই আলোর ঝলকানীর মত পেয়েছিলাম, রাতভর সমস্ত আকাশ জুড়ে পাহাড়া দেওয়া এক ধ্রুবতারা যে নিজে না ঘুমিয়ে অন্যকে ঘুমাতে দেয়। তুমি আমার গান শুনে বলতে, আমি এত দু:খের গান কেন গাই? সত্যিই তো আনন্দের গান কেন আসে না আমার গলায়, ভেবেছিও বিষয়টা। ছোটবেলা থেকে মা’কে কখনো হাসতে দেখিনি। মায়ের সাথে এক বিছানায় ঘুমাতাম, মাকে দেখেছি প্রায় সারা রাত জেগে থাকতেন। তার কষ্টের কারনটা আগে না বুঝলেও বয়স হওয়ার পর বুঝেছিলাম। প্রবাসী পিতার শারিরীক অনুপস্থিতি আমার মা’র মুখ থেকে যে হাসি কেড়ে নিয়েছিলো সেটা যেন আমার নিজের মধ্যেও চিরস্থায়ী বাসা বেধে ফেলেছিলো। মায়ের দুঃখের ছায়াটা হয়তো আমার মনের ভিতরেও রেখাপাত করেছিল।

সেই যে কবে একদিন আদর করে আমাকে ‘বুলি’ বলে ডেকেছিলে, তোমার কি সেটা মনে আছে? আমি সেদিনের সেই রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি। ভাবনা আর কল্পনায় সারারাত তুমি যেন আমার পাশে বসেছিলে। অপেক্ষা করে ছিলাম কবে অমনি করে আবার ডাকবে! আর কোনোদিনই কিন্তু ডাকোনি। হয়তো ভুলেই গেছো, অথচ আমি কিন্তু আজো মোটেই ভুলিনি, আর কোনদিন ভুলবও না। এখন রোজ সকাল আট’টা থেকে দুপুর দু’টো পর্য্যন্ত ক্লাস করে বিকেল চার’টা থেকে ষ্টোরে বসি। কলেজ না থাকলে সকালে বাসায় বাবার জন্য রান্না করি। স্টোর থেকে রাত নটায় বাসায় ফিরে বাবার সাথে ডিনার সারি। সারাদিন ব্যাস্ততার মাঝে থেকেও কিন্তু তোমার কথা একটুও মন থেকে দূরে যায় না। কারণ তুমি যে স্থায়ীভাবেই বসে আছো আমার মনের ভিতরে। সন্তানের কর্তব্য অসহায়, অসুস্থ পিতার কপালে হাত রেখে দু:সময়ে পাশে দাঁড়ানো। তুমি যে ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে আমাকে আমার বাবার মঙ্গল চিন্তা করে এখানে পাঠিয়েছো, সেটা আমি এখানে পৌঁছার পর বাবার পরিতৃপ্ত হাসি দেখে বুঝেছি যে সেটা কতটা সঠিক ছিলো। মনে হয়েছে বাবা যেন আবার নব জীবন ফিরে পেয়েছেন।

পিতৃঋণ যদিও কখনোই শোধ হয় না, তাই তো অসুস্থ পিতাকে সুস্থ করে তোলা একটা বড় পূণ্যের ব্যাপার। আমার বেলায় যেমন এটার ব্যাত্যয় ঘটতে দাওনি সেটা তোমার বাবার বেলাতেও যেন তেমনিই হয় এটাই আমি চাই।
তুমি তোমার কর্তব্যও সঠিক ভাবে সম্পন্ন করো, আমি তোমার বাবার সুস্থতার সংবাদের অপেক্ষায় রইলাম। প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকবো দিন, মাস, বছর তোমার উপস্থিতির আশায়। অনেক ভাল থেকো প্রিয়…
তোমারই
বুলি
……northwood ct| essex, london
(সমাপ্ত)

Exit mobile version