ইউসুফ কামাল : প্রথম প্রথম বিষয়টা যত সহজ মনে করেছিলাম বাস্তবে তো সেটা হচ্ছে না বরং ধীরে ধীরে কেন যেন অক্টোপাসের মতো অভাববোধটা আমাকে জড়িয়ে ধরছে। যতই দিন পার হচ্ছে ততই যেন শূন্যতা চারিদিক থেকে গ্রাস করে ফেলছে। এত প্রকট হয়ে আসবে পরিস্থিতি তাতো বুঝতে পারিনি। একটা মানুষের অভাবে এত শূন্যতা ভর করবে কোন মতেই ভাবিনি। মূল সমস্যাটা সৃষ্টি হলোই ওর মা’র মারা যাওয়ার পর। না হলে সব কিছুই তো ঠিকঠাক ছিলো। বাবা বিদেশে থাকেন দীর্ঘদিন, দেশে এসে স্থিতি হবার কোন সম্ভাবনাও নাই। দেশে থাকা অভিভাবক বলতে একমাত্র বড় ভাই আর ভাবী। তাদের সা¤প্রতিক উদাসীন আচরণ আর তার সাথে নিষ্ঠুর স্বার্থপরতা, পাশাপাশি প্রবাসী পিতার অসুস্থতা নিয়ে বিষয়টা শুরু হলো। মা মারা যাওয়ার পর বুলা ওর পিতার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। ওর ভয় করছিলো মা চলে গেছে এখন বাবাও যদি একাকী বিদেশে মারা যান তাহলে সারাজীবনের জন্য ওর নিজেকে অপরাধী হিসাবে মেনে নিতে হবে। উপরন্ত নিজের পরিবারের সবার কর্মকান্ডে বুলা বাড়ির সবার সাথে সম্পর্কও রাখতে চাইলো না।
আমার দিক থেকে বুলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একমাত্র পথ ছিলো সামাজিকভাবে দু’জন পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, সেটার জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন ছিলো। আবেগ দিয়ে যে জীবন চলে না সেটা তৎকালীন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থির বুঝতে না পারার কথা নয়। আর যদিওবা সেই অর্গল ভাংগাও যায় তার প্রস্তুতির জন্যও তো একটু সময় দরকার ছিলো। তখন বয়স কতই বা হয়েছিলো হিসেব করে দেখলে বয়স তেইশ এর বেশি নয়, উপরন্ত পড়া শেষ হতে তখনও বছর খানেকের মতো বাকী। তারপরও সেই বয়সেই সমস্ত আবেগকে পর্যুদস্ত করেই বিষয়টায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পিতা-কন্যার স্নেহের বিষয়টা তো ছিলোই। পিতার সাথে কন্যার ভালোবাসা এক অর্থে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম একটা ভালোবাসার সম্পর্ক। এটাকে কোনভাবেই ব্যাহত করা সম্ভব নয়। পিতা চাইলেন তার অসুস্থতাকালীন সময়ে বুলা তার কাছে এসে থাকুক। আবেগের ফলে হয়তো ঘটনা কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলা যেতো, কিন্তু ওর পারিবারিক ইন্ধনে সেই মধুর সম্পর্কের মধ্যে ভবিষৎ এ যে প্রচন্ড বড় একটা ফাটলের সৃষ্টি হবে না সেটার নিশ্চয়তা ছিলো কি? সেটা কি কখনোই ভালো হতো?
সদ্য মা হারা কন্যার পক্ষে প্রবাসী অসুস্থ পিতার জন্য তার মনের হাহাকারটাই প্রকট হয়ে উঠলো। সবাই ভাবনা চিন্তা করে তাই সময়ের উপর সমস্যার সমাধান ছেড়ে দেওয়াটাই আমাদের সবার কাছে তখন অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিলো। কেন জানি বিষয়টা নিয়ে সবার নেওয়া সিদ্ধান্তটাকে সঠিকই মনে হয়েছিলো। উপস্থিত আমার সকল বন্ধুদের অভিমত ন্যূনপক্ষে এক দেড় বছরের একটা সময়ের প্রয়োজন ছিলো। আবেগের উর্ধে উঠে পিতা কন্যার সুমধুর সম্পর্ক আমি নষ্ট করতে চাইনি। বিশ্বাস করেছিলাম আমাদের দু’জনের সম্পর্কের টানটা যদি থাকেই সেখানে দূরত্বটা অলংঘ্যনীয়ও নয়। সম্পর্কের এই টানের কাছে অবশ্যই আমরা হারিয়ে যাবো না। মাত্র তো কয়েকটা মাস। ব্যাস্ততার মাঝেই কেটে যাবে। বার বার একজন অসুস্থ প্রবাসী পিতার ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো, একা একটা মানুষ পরিবার-পরিজন ছাড়া বিদেশ বিভূইয়ে পড়ে আছে। নিজের জীবনের অনেকটা সময় পরিবারের ভালোর জন্যই ত্যাগ করে গেছেন। একমাত্র কন্যা যার আংগুল ধরে শিশুকালে হাঁটতে শিখেছিলো সেই কন্যার কি অসুস্থ পিতার আহ্বানের প্রতি অবহেলা করা আদৌ যুক্তিযুক্ত হতো? আর সেটার কারণ যদি আমি হই, তা হলে সেটা তো আদৌ সম্ভব না। আমি নিজে সব সময়ই এই সমস্ত নৈতিকতার স্বপক্ষে অবস্থান নিই।
বিবেকের কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি। জানি না আমার মনোভাব বুলা বুঝেছিলো কিনা? নিজের জন্য অন্ধভাবে পক্ষপাতমূলক আচরণ আমার দ্বারা সম্ভব ছিলো না, তাই তো ওর যেটায় ভালো হবে সেটাই আমি চেয়েছিলাম। বিষয়টা বুলা বুঝেছিলো বলেই সম্পর্কের জের ধরেই সে আমাকে ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ওর কাছে চলে যেতে বলছিলো। কথা ছিলো এই সময়ের মধ্যে ওর ডিপ্লেমা কোর্স শেষে একটা চাকুরির ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। আর ততদিনে ও বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরিবেশটা ওর অনুকুলে নিয়ে আসতে পারবে। ঘটনার শুরুর দিকে বুলা নিজের মনকে বোঝাতে যেয়ে ব্যার্থ হয়ে দুইবার বাবার কাছে যাবার সমস্ত পরিকল্পনা ও বাতিল করে দিয়েছিলো। প্রকাশ্যে আমার কাছে বলেও ফেলেছিলো ‘তোমাকে রেখে একা যাবো না, পারবো না তোমাকে ছেড়ে ওখানে একলা থাকতে’। প্রথমবার পাসপোর্ট হওয়ার পর অফিস থেকে পাসপোর্ট না আনার সিদ্ধান্ত আর দ্বিতীয় বার প্রকাশ্যে সবার সামনে বিদেশে না যাওয়ার কথা বলা।
তখন সামগ্রিক পরিস্থিতি চিন্তা করে আমার বন্ধুদের কথাতেই ও মত পাল্টাতে বাধ্য হয়। আমার বন্ধুদের মধ্যে কার্যকরী ও শক্ত ভ‚মিকা রেখেছিল আমার পরলোকগত অকৃত্রিম বন্ধু পুনু, ও জোড়ে সোরে অঙ্গীকার করেছিলো পরীক্ষার পরে আমাকে পাঠিয়ে দেবে বুলার কাছে। দৌড়াদৌড়ি করে পাসপোর্ট ভিসা সংগ্রহ করা ওর একার পক্ষে করা আদৌ সম্ভব হতো না। পরিবারের আপনজনরাও কেউই এগিয়ে আসেনি। কেমন যেন একজন দুঃখী চেহারার মানুষের ছবি আমার সামনে ভেসে উঠেছিলো। ওর সহজ আন্তরিক ব্যবহারে মনে হতো কি করলে মানুষটা একটু খুশী হয়, একটু বেশি ভালো থাকবে আন্তরিকভাবে আমি সেটাই চাইতাম। উপরন্ত ওর কোন কাজই আমার কাছে কখনই অযৌক্তিক মনে হয়নি, মনে হতো ছায়ার মতো একজন মায়াবী মানুষ যেন ছায়া সংগীর মতো সার্বক্ষণিকভাবে আমার পাশে পাশে হেঁটে চলেছে। মন ভালো থাকলে আপন মনে গান গেয়ে গেয়ে মনকে ভরিয়ে দিতো। বুলা চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর থেকেই প্রচন্ডভাবে ওর অভাব বোধ করতে থাকলাম, কত দিন দেখা হয় না, কথা হয় না। কষ্টই লাগছে , কেন যে এমন হলো? এ কষ্টের যেন কোন শেষ নেই ….
তুমি যদি না দেখা দাও করো আমায় হেলা
কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা
দূরের পানে মেলে আখি কেবল আমি চেয়ে থাকি
পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দূরন্ত বাতাসে।
মেঘের পরে মেঘ জমেছে আধার করে আসে
আমায় কেন বসিয়ে রাখো একা দ্বারের পাশে।।
সেদিনের বুলার গাওয়া রবি ঠাকুরের গানটি যে আমার জন্য বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে সেদিন আমি কি বুঝতে পেরেছিলাম? নিজের কষ্টের পাশাপাশি মনকে সান্তনা দিই, তাহলে একাকী বিদেশ বিভুইয়ে বুলারই বা কেমন লাগছে? কেমন করে কাটছেই বা ওর দিন রাত্রি? ওর এই সব চিন্তা করে মনটা আরো বিষন্ন হতে শুরু করলো।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে সীমার মাধ্যমে বুলার টিউশান ফিসসহ আনুষাংগিক খরচাদি হিসাব নিকাশ করে জমা দিয়ে দিলাম। সীমা সার্বক্ষনিকভাবে লেগে থেকে রেজিষ্টার অফিস থেকে বুলার সার্টিফিকেটটা এনে আমার হাতে তুলে দিল। বান্ধবীর অবর্তমানে সীমা যথেষ্ট কষ্ট করলো, আর ও নিজেও যেন এটুকু উপকার করতে পেরে খুশিই হলো।
অপেক্ষা করতে থাকলাম বুলার চিঠির, বলেছিলো চিঠির মধ্যেই ঠিকানা দিয়ে দেবে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ ,ভার্জিনিয়া, ইউএসএ