ইউসুফ কামাল : রমনা টেলিফোন অপিস থেকে ওর বাবার সাথে কথা সেরে বের হওয়ার পর বুলার প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। দু’জনের ফোনে কথা বলার সময় আমি নিজে থেকেই একটু সরে দাঁড়ালাম যাতে ও স্বাচ্ছন্দে কথা বলতে পারে। ওর চেহারায় তেমন ভাবান্তর নাই, মোটামুটি ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলছে। বাবা কি বলে সেটাই এখন জানতে চাইছে, কবে যেতে হবে। সারা পৃথিবীতে পিতা এবং কন্যার সম্পর্কের মধ্যে ভিন্ন একটা বৈশিষ্ট আছে, এটা এমনই একটা ভালোবাসা যা সরাসরি সৃষ্টিকর্তা মনে হয় নিজেই বিশেষভাবে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। রিক্সায় উঠে জিজ্ঞাস করলাম, তোমার বাবার শরীর কেমন?

শীতল কন্ঠে বল্লো, ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেছে, ব্যবসায় বেশি সময় দিতে নিষেধ করেছেন। আমাকে ষ্টোরের দিকে দেখার সাথে পড়াশুনাটা চালিয়ে যেতে হবে।
জিজ্ঞাস করলাম, কবে যেতে হবে?

বল্লো, ট্রাভেলিং এজেন্টের সাথে কথা বলে কবে টিকিট পাওয়া যাবে তার উপর নির্ভর করছে যাওয়া। আমি বলেছি ২০/২৫ দিন পরে তারিখ ফেলতে। সব কিছু গুছিয়ে নিতে আমার এই কয়েকদিন সময় লাগবে। অসুস্থ হওয়ার পর এখন ষ্টোরে সকালের দিকে বাবা বসেন, দুই বেলা আর বসতে পারেন না। তিন / চার জন কর্মচারীর মধ্যে একটা বাঙালি ছেলে পার্টটাইম বাবাকে সাহায্য করে, বাবার কথায় মনে হলো সে বিশ্বস্তও। অসুস্থতার সময় সে নানাভাবে সহায়তাও করে। আমার কথা হলো বাবার উপর চাপটা কমাতে হবে, না হলে সমস্যা কমবে না। দুপুর হয়ে গেছে রিক্সা নিয়ে টিএসসি’তে নামলাম, ভাবলাম দুপুরের খাওয়াটা সেরেই যাই। ঢুকে ক্যাফেটেরিয়ার ¯িøপ কেটে বুলাকে নিয়ে ভিতরে বসলাম। বল্লাম, বুলি তোমার আমার সম্পর্কটা কেমন হলো বলো তো? শুরুতেই লম্বা বিচ্ছেদ। আমার নতুন সম্বোধনটা শুনে ধীরে ধীরে ঘুরে আমার মুখের দিকে তাকালো। আমার কথাগুলো ওর আত্মস্ত করতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলো। সারাক্ষণ কথা বলেছে অথচ আমার এক কথায় যেন থমকে গেলো।

অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, কোন কথা বলতে পারলো না। মুখটা ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকালো, মনের ভিতরের ঝড়টাকে শান্ত হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় তো লাগবেই। মনের অশান্ত ঝড় না জানি কতক্ষনে থামবে, বেয়ারা টেবিলে খাবার দিয়ে গেলো সেদিকে তাকিয়েও দেখলো না।

মুখ দিয়ে যেন শব্দ বেরোচ্ছে না, অস্ফুট স্বরে বল্লো, সম্পর্কটা বিশ্বাসের উপরে গড়ে ওঠে, আর এটাই ভালোবাসার মূল বন্ধন। তোমাকে যে প্রচন্ড বিশ্বাস করি তা তুমি বোঝ আমি জানি, আর তুমিও আমার বিকল্প ভাবতে পারো না সেটা মেয়ে হিসাবে আমিও কিন্তু বুঝি। দুজনের সম্পর্কের মধ্যে কোন আন্তরিকতার অভাব নাই। দুজন দুজনকে মনে প্রাণেই চাই এটা ঠিক। আজ তুমি নতুন সম্বোধন করে আমাকে আরো দুর্বল করে দিলে। তুমি তো এভাবে আমাকে কোন দিন ডাকোনি। বলো তো আমি একা কি ভাবে তোমাকে ছেড়ে ওখানে যেয়ে থাকবো? ভিন্ন নতুন এক পরিবেশে আমি নিরুপায় হয়ে যাচ্ছি, তুমি তো সবই জানো। জানি না কি লেখা আছে আমার জীবনে, জীবনটা এক নতুন পথে মোড় নিচ্ছে। এ পথে তোমার দেয়া সাহস খুবই প্রয়োজন, আর সেটা তুমি দিয়ে যাচ্ছো আন্তরিকভাবেই। এ সময়টা তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে। তাই তো তোমাকে আমার দরকার, তুমি পরীক্ষাটা দিয়ে চলে এসো আমার কাছে, আমি বাবাকে বলে সব কিছু ম্যানেজ করে ফেলবো এর মধ্যে। পরিবেশটা স্বাভাবিক হওয়া দরকার বল্লাম, খাওয়া শুরু করো। এখনো তো আছো আরো বেশ কয়েক দিন। তুমি তো আর হারিয়ে যাচ্ছো না, দেখা তো আমাদের হবেই।
খাওয়া শেষ করো। ডিপার্টমেন্টে একটা জরুরি কাজ আছে। সময়গুলো যেন দুরন্ত নদীর স্রোতের মতই ভাটিতে যেতে থাকলো। গোছ গাছ করতেই মোটামুটি সময় শেষ হয়ে যেতে থাকলো। মাঝে দুইদিন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হলের হিসাব নিকাশ হালনাগাদ করা, নিউমার্কেট গাউসিয়া থেকে টুকিটাকি জিনিষ পত্র কেনা সাথে প্রচুর ঘোরাঘুরিতে ব্যাস্ত থাকলো। ব্যংকের কাজের জন্য দুইদিন আমি সাথে থাকলেও অধিকাংশ সময় ওর রুমমেট সীমাই সংগ দিয়েছে। বিশেষ করে মেয়েলি জিনিষপত্র কিনতে সীমাই সঠিক মানুষ। ডিপার্টমেন্টের সবাই জেনে গেছে ওর চলে যাওয়ার সংবাদ। ক্লাসের ছেলে মেয়েরা মোটামুটি সবাই শুভেচ্ছা জানানো শুরু করে দিয়েছে।

এর মাঝে বন্ধু পুনু একদিন ‘বাংচিন’ এ খাওয়ালো। বুলা’কে ছোট একটা গিফট্ও দিয়েছিলো মনে আছে। বিদায়ের ঘন্টায় সবাই আবেগ আপ্লুত হয়ে থাকলো কয়েকটা দিন। অনেকে আড় চোখে আমার প্রতিক্রিয়া বোঝারও চেষ্টা করছিলো। সম্ভবত: কষ্ট কতটুকু পাচ্ছি তার একটা ছবি দেখতে চাইছিলো হয়তো। দিন দশেক পরে ‘ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে’ এর ঢাকা-লন্ডন রুটের কনফার্ম টিকিট চলে আসলো। অক্টোবর মাসের পাঁচ তারিখ, দুপুর ১১:৩০ মিনিটে ডিপার্চার। তখনো তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকেই বিমান চলাচল করতো। নিয়মানুযায়ী তিন ঘন্টা আগে এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করতে হবে। ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়ে সরাসরি হিথ্রো এয়ারপোর্টে নামতে হবে। ওখান থেকে ওর বাবা ওকে রিসিভ করে নেবেন। সর্বমোট নয় ঘন্টা একটানা ননস্টপ ফ্লাই।

হিথ্রও থেকে ওদের বাসা এসেক্স যেতে গাড়িতে আনুমানিক দেড় ঘণ্টা লাগবে। ওর জন্য ভালো হলো, একা একা তার উপর জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ তাও আবার বিমানে। ট্রানজিট না থাকায় ভ্রমণে অনেক দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকা যায়, ওঠা নামার ঝামেলা তো পোহাতে হয় না। অক্টোবর এর চার তারিখ সারাটা দিন বুলা আমার সাথে ঘুরলো যেন আমাদের পরিচিত স্থানগুলোকে শেষ বারের মতো দেখে নিচ্ছে।

নিউমার্কেট গাউসিয়া এলিফেন্ট রোড, আর্ট কলেজের বকুল তলা হয়ে শাহবাগের সিনোরিটা। সিনেরিটার বাসু দা’র কাছ থেকেও বিদায় নিলো। সেদিন বাসু’দা আমাদের খাওয়ার কোন টাকা নিলো না বল্লো, ছোট বোন চলে যাচ্ছে বিদেশে কবে আসবে কে জানে। ওর প্রতি সবার এই অকৃত্রিম স্নেহের পরশ সারাটা ক্ষন যেন ওকে স্থবির করে রাখলো। সিনোরিটার পাশের বাবুল ইলেকট্রনিক থেকে সাগর সেনের রবীন্দ্র সংগীতের দুইটা ক্যাসেটসহ কিছু বাংলা গানের ক্যাসেট পছন্দ করে দিলাম। দাম দিতে দিলো না বল্লো, তোমার কাছে তো অনেক ঋণী আমি। কখনো তো আমাকে সুযোগই দাওনি, নিজের প্রয়োজন না মিটিয়ে আমাকে অকাতরে দিয়ে গেছো। কেন যে এমনি করে মিশে গেলে আমার জীবনের সাথে, আর কত ঋণী করবে আমাকে, আর কিছু বলতে পারলো না…।

সারাটা সময়ই খুব ইমোশোনাল ছিলো, রিক্সায় ক্ষনিকের জন্য আমার ঘাড়ে মাথাটা রেখেছিল। হয়তো চাইছিলো মনের থেকে, সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে ও কোন দিনও এমন কিছুই চায়নি। দুপুরের খাওয়ার সময় টিএসসি’তে পুনু, সেকান্দর, বিদ্যুত, আলমকে দেখলাম, ওরা সবাই এসে বসে আছে বুলার সাথে কথা বলার জন্য। সবার মন খারাপ, কেউই যেন ওকে যেতে দিতে চাচ্ছে না। খাওয়ার পর লনে বসে কথা বলার সুযোগটাও যেন বুলা হারাতে চাইলো না। সবাই যেন চাইছে কিছুক্ষন বসে কথা বলি। নিয়তির বিধানকে অস্বীকার করার ক্ষমতাতো কারোই নাই তবু কেউ আমরা সেটা মানতেও চাই না। পাঁচ তারিখ বাসার গাড়ি নিয়ে সকাল পৌণে আটটায় চলে গেলাম বুলার হলের সামনে। আটটায় ওকে হলের গেটের সামনে থেকে তুলে নেব এমনই কথা। দোতালার বারান্দা থেকে গাড়ি দেখে নেমে এলো। একটা লাগেজ সাথে হ্যান্ড ব্যাগ। সীমা সাথে নেমে এলো, দুজনের চোখই লাল, কতক্ষন কেঁদেছে কে জানে। করিম মিয়া নেমে ওর লাগেজ গাড়িতে তুলে ফেল্লো। গাড়ি ছাড়তেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো, হয়তো বুঝেছে আর কোনদিন ফেরা হবে না চিরপরিচিত এই ভূবনে। পিছনে পড়ে রইলো পদচারণায় মুখর কত স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হওয়া ভার্সিটির চির সুন্দর পরিবেশ, সীমার মতো অকৃত্রিম বান্ধবী, হাজারো স্মৃতি সমৃদ্ধ হলের পুরনো পরিবেশ আর স্বপ্নের মতো কেটে যাওয়া টিএসসি’র আনন্দমুখর স্বর্ণালী দিনগুলো। মনে মনে বলছে, বিদায় দাও আমাকে। সবাই তোমরা ভালো থেকো। যদি আসি ফিরে কোনদিন দেখা হবে আর না হলে এটাই চির বিদায়।

সারাটা পথ আমার হাতটা ধরে বসে রইলো, চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে শ্রাবণের বাধ ভাংগা জলের ধারা। বল্লাম, ‘টেলিফোনে ওখানে পৌঁছার সংবাদ দিও। বিশদ বিষয় জানিয়ে চিঠি দিও বাসার ঠিকানায়’। কাগজে বাসার ঠিকানাটা লিখে ওর ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলাম। কিছু বলতে চেয়েও পরিস্কার করে কিছু বলতে পারছে না। মিনিট বিশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম তেজগাঁও বিমানবন্দর। বোর্ডিং পাশ নিয়ে ঢোকার সময় মনে হলো শক্ত করে হাতটা জড়িয়ে ধরলো, বলে উঠলো, ‘কেন আমাকে তুমি যেতে দিলে, ধরে রাখতে কি পারতে না? সত্যিই আমি যেতে চাইনি’। এ মুহূর্তে কি বলবো, নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কিইবা করতে পারি? পকেটে হাত দিয়ে হয়তো রুমাল খুঁজলাম। ইমিগ্রেশনে ঢোকার মুহূর্তে একবার পিছন ফিরে তাকালো, হয়তো সেটাই শেষ দেখা। সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারেন। আবার দেখা হবে কিনা। পরিবেশ পরিস্থিতিতির কাছে আমার হাত পা বাঁধা, বড় অসময়ে সব কিছু ঘটে গেল। বড় অনিচ্ছা সত্বে মনের বিরুদ্ধে। ধীরে ধীরে বুলা চলে গেল আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে। কিছুক্ষন মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বের হয়ে এলাম তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে। কোথায় গন্তব্য আর কোথায় যাবো? কেমন একটা শূন্যতা যেন চারিদিকে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ