ইউসুফ কামাল : পরদিন রবিবার, সকাল ৮:৪০ এর ক্লাসটা মিস করতে চাই না, উপস্থিত হতে একটু কষ্ট হলেও থাকি। ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ম্যান্জমেন্টের উপর খালেক স্যার কিছু মূল্যবান নোট দিলেন, আগামীকাল সকালে আবার বিশেষ ক্লাসের খবর জানালেন। রুম থেকে বেরিয়েই দেখি বুলা, নিশ্চয় কোনো জরুরি খবর আছে। কাছে যেতেই বল্লো, কাল দুপুরে ভাই বরিশাল থেকে হাউস টিউটরের অপিসে ফোন করেছিলেন আমাকে খুঁজতে, আমরা তো তখন সোনারগাঁও আমাকে না পেয়ে মেসেজ রেখেছে। জরুরিভাবে বরিশালের বাসায় ফোন করতে বলেছে জরুরি। চলো নিউমার্কেটে যেতে হবে, ফোনটা সেরে আসি। কথা হলো। ওর বাবার শরীর আবারো খারাপ হয়েছিলো।

যদিও তেমন মারাত্মক কিছু নয়, ‘ক্লোজ মনিটরিং’ এ থাকতে বলেছে। তবু কিছুটা চিন্তার ব্যাপার তো বটেই। বড় ভাইয়ের কথা, যেতে তো হবেই তাহলে তিন মাস দেরী না করে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াই ভালো। বাবার শরীর নিয়ে সবাই চিন্তা করছে। উনি ওখানে একা থাকেন এটাই সবার চিন্তা। ফোন সেরে বেরিয়ে বল্লাম, ঠান্ডা মাথায় ভাবো কি করা উচিত। তোমার সিদ্ধান্তই বড়, কারণ মুখ্য বিষয়টাই তোমাকে নিয়ে। ফোনে কথা বলার পর থেকে বুলা তেমন কোন কথাই বলছে না, একদম চুপ হয়ে গেছে।

সকালের নাস্তা তো অবশ্যই হয়নি? আমার প্রশ্নের উত্তরে কথা না বলে মাথা নেড়ে জানালো, করেনি। নিউমার্কেটের ভিতরের দিকের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম, সকাল বেলা এখনো তেমন লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়নি। এদিকটা এমনিতেও লোক সমাগম কম থাকে। ওর জন্য নাস্তা সাথে আমার জন্য চা’য়ের কথা বলে কেবিনে বসলাম। বল্লাম, তোমার কাছে তো এক নম্বর শত্রু তোমার খাবার, এটা কেন করো? সমস্যা হলে ভেবে চিন্তে সমস্যার সাথে মোকাবিলা করতে হবে, এর সাথে না খাওয়ার কি সম্পর্ক? আমার কথার ভংগিতে ও হেসে বল্লো , অন্য কোন কারণ নাই, আমার ইচ্ছা করে না। তুমি কি আমার চা’র কথা বলেছো? নাকি তুমি একলাই খাবে! বল্লাম, একটু চিন্তা করে ঠিক করো কবে যেতে পারবে আর সেটা তোমার বাবা’কে জানিয়ে দাও। ফিরে এলাম কলাভবনে। পর পর দুইটা ক্লাস ছিলো শেষ করে একটু ফ্রী হলাম। বিদ্যুৎকে সাথে করে টিএসসি’র উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির কাছে এসে ভাবলাম, অনেকদিন এখানে বসা হয় না একটু বসে কথা বলি। বিদ্যুৎ দেখেছে বুলাকে নিয়ে নিউমার্কেটে ফোন করতে যাওয়ার সময়। জিজ্ঞেস করলো, কোথায় গিয়েছিলে। আজকের পুরো ঘটনা খুলে বল্লাম। শুনে চুপ করে থাকলো জানতে চাইল বুলা কিছু বলেছে নাকি? না বলে থাকলে দু’একদিন দেখো ও কি বলে, সিদ্ধান্তটা ওর কাছ থেকে আসলেই বরং ভালো হয়।

মনটা অশান্ত হয়ে পড়ছে, কেন যেন সিগারেট খেতে ইচ্ছে করলো। শরীফ মিয়াকে বল্লাম, পাঁচটা ফাইভ ফাইভ দেন। সাথে ম্যাচ দিয়েন। আবার ধরলা নাকি? বিদ্যুৎ এর প্রশ্নে বল্লাম, ভালো লাগছে না, দেখি ভালো লাগে নাকি। না লাগলে আবার ছেড়ে দেব। পেড্রু প্যাকেটে সিগারেট আর ম্যাচ নিয়ে এলো। বিদ্যুৎকে একটা দিয়ে আমিও একটা ধরালাম। অনেকদিন পর, একটু কেমন যেন লাগলো। পেড্রু বল্লো, স্যার আজকে ভালো খাসীর তেহারী আছে, দেবো? অরিজিনাল খাসীরই হবে, না হলে ও বলতো না, বিদ্যুৎ এর দিকে তাকাতেই ও বল্লো, পেড্রু ভালো করে দুই প্লেট নিয়ে আয় তো দেখি। বিদ্যুৎ এর অর্ডার পেয়ে ও দৌড় দিলো তেহারী আনতে। পেড্রু বিদ্যুৎ এর খুব পছন্দের, মাঝে মাঝে সিকি আধুলিটা এমনি এমনিতেই ও দিয়ে যায়। সিগারেট শেষ করে ফেলতে যেয়ে পাশ ফিরতেই দেখি পাশে বুলা এসে দাঁড়িয়েছে। লাইব্রেরির বারান্দায় হঠাৎ বসা দেখে ও দাঁড়িয়ে গেছে। এখন তো টিএসসি’তে থাকার কথা। উপরন্ত হাতে সিগারেট দেখে একটু আশ্চর্যই হয়েছে, দেখেনি তো কখনো। বল্লো, নতুন করে ধরলে নাকি? আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। যা হোক আর খেয়ো না। বল্লাম, বসো। ২/১ দিন একটু খাই পরে ছেড়ে দেবো। বুলা আর কথা বাড়ালো না। বল্লাম, আগে বসো আমাদের সাথে শরীক হও। ওকে দেখেই বিদ্যুৎ ইশারায় শরীফ মিয়াকে আরো এক প্লেট তেহারী পাঠাতে বল্লো। বিদ্যুৎ জিজ্ঞেস করলো সকালের ফোনের কথা। সব ঘটনা শুনে বল্লো, তোমার সিদ্ধান্তই বড়, চিন্তা করে ঠিক করো।

পেড্রæ তেহারী দিয়ে গেল। বল্লাম, খাও। ওর প্রিয় খাবার, হাত বাড়িতে প্লেটটা নিলো। আমার পাশে বসে পড়লো। সকালের থেকে এখন মুখটা একটু শান্ত। প্লেটটা হাতে করে বসে থাকলো কিছুক্ষণ, শুরু করছে না। আমরা দু’জন ও শুরু করতে পারছি না। অস্বস্তিকর মুহূর্তটা কাটাতে বল্লাম, শুরু করো। হাতে চামচটা ধরেই আছে বল্লো, মা চলে গেছে এখন আমি একা, এখন বাবাও যদি চলে যায় আমি তো আরো একা হয়ে যাবো। মাঝখানে তুমি আমার জীবনের আরেকটা ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়ে আছো, এক পাশে বাবা অন্য পাশে তুমি। বিদেশ বিভূইয়ে মা’র মতো বাবা’ও যদি চলে যায়, সারা জীবন নিজেকে অপরাধী মনে হবে। কালকে বাবাকে ফোন করতে হবে, তুমি আমাকে নিয়ে যেও। বল্লাম, আচ্ছা কাল রমনায় যাবো, তুমি খাওয়া শুরু করো। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ