ইউসুফ কামাল : ‘জ্বরের ছলে সেদিন নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে ছিলে
তোমার আংগুলে মেশানো ছিলো হাস্নাহেনার সুবাস, আমি এখনো
সেই গন্ধ খুঁজছি আমার শরীরে।
নি:সংগ রাতে তোমাকে নিয়ে, আমি সেই বাগানে যাই।
আজ তোমাকে ভীষণ মনে পড়ছে’।
(কবি- বন্ধু শওকত আহ্সান ফারুক)
সুন্দর মুহূর্তগুলো যেন তাড়াতাড়িই চলে যায়, নিয়তির বিধানই যেন এমন। অসীমে হাতড়িয়ে বেড়ালেও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবনের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে কেউ জড়িয়ে গেলেও নিয়তির বিধানে তাকে ছেড়ে দিতে হয়।
কত যুগ আগের মুহূর্তগুলো, সেলুলুয়ডের ফিতার মতোই জড়িয়ে আছে অথচ কখনোই ঝাপসা বা অস্পষ্ট হয়নি। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা যেনো।
খুব সকালে বুলাকে নিয়ে পাসপোর্ট জমা দিতে গেলাম ব্রিটিশ হাইকমিশনে। এটা আমার কাছেও একটা নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা। গেটে পাসপোর্ট দেখিয়ে এ্য্যাপোয়েন্টমেন্টের কথা বলাতে ওরা বুলা’কে একা ঢুকিয়ে নিলো, যার ইন্টারভিউ শুধু সেই ভিতরে যেতে পারবে।
বল্লাম, আমি বাইরে আছি তুমি কাজ শেষ করে আসো। আমি বাইরে থাকবো তোমার জন্য অপেক্ষায়। এখনো ভাবি সেই দিন থেকেই মনে হয় ওর জন্য আমার অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু হয়েছিলো। আমি যে একা সেই একাই।
সেই প্রথম মনে হলো নিয়মের বেড়াজালে আমি যেন আলাদা হয়ে গেলাম। আর হবেই বা না কেনো, নিয়তির কাছে আমরা সবাই যে বন্দী। কেউই আমরা এর বাইরে বেরোতে পারি না।
পুরো সময়টা সামনের রাস্তায় পায়চারী করলাম, দূরে যাইনি যদি এসে আমাকে সামনে না দেখে ঘাবড়ে যায়। তাকিয়েই ছিলাম গেটের দিকে, ঘন্টা তিনেক পরে দেখি বুলা ধীর পায়ে গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালো।
এগিয়ে গেলাম ভাবলেশহীন চেহারা ওর, বল্লো পাসপোর্ট রেখে দিলো তিন দিন পর দুপুরে এসে পাসপোর্ট নিয়ে যেতে বলেছে। তার মানেই পাসপোর্টে যে ভিসা লাগিয়ে দেবে এটুকু বুঝেছিলাম। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বর্তমান ঘটনাগুলো যেন ওর মতের বিরুদ্ধেই হয়ে চলেছে।
পরের ঘটনাগুলো খুব তাড়াতাড়িই গড়াতে লাগলো- ভিসাসহ পাসপোর্ট সংগ্রহ করার পর রমনা টিএন্ডটি অফিসে গেলাম বুলার বাবাকে খবরটা দেওয়ার জন্য। ভালো সংবাদ দেওয়ার সাথেই আরো একটা দু:সংবাদ যেনো ওর জন্যে অপেক্ষা করছিলো। গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য গত কারণে ওর বাবাকে ইমার্জেন্সী হেলথ্ কেয়ারে যেতে হয়েছিলো, পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তার পনেরো দিন পর পর হেলথ্ কন্ডিশন মনিটরিং করতে বলেছে। সম্ভবত: মেন্টাল ডিপ্রেশন থেকে এক ধরনের নিউরোলজিক্যাল সমস্যা হয়েছে। দীর্ঘ দিন দু:শ্চিন্তা নিয়ে একাকী বাস করায় এক ধরনের মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বলে চিকিৎসকরা ধারণা করছে। সাথে এও বলে দিয়েছেন দীর্ঘ মেয়াদী সেবা সশ্রুষা ও দু:শ্চিন্তা মুক্ত পারিবারিক পরিবেশে থাকতে পারলে এর থেকে উত্তরণ সম্ভব।
বুলার সাথে কথাতে উনি খুশী হয়েছেন, বলেছেন এক মাসের মধ্যে সব কিছু গোছ গাছ করে ফেলতে, তবু কত তারিখে যেতে পারবে সেটা উনাকে জানালে ঐ ভাবে টিকিট পাঠাবেন।
এতগুলো ভালো খবর ওর জন্য তবু একটি বারের জন্যও হাসি দেখলাম না মুখে। মা’য়ের মৃত্যু, তার উপর ভাই ভাবীর পক্ষপাতপূর্ণ আচরনে ও কেমন যেন পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বিকালে দেখা করতে আসার কথা বলে বুলাকে হলে নামিয়ে দিলাম।
মনে হলো পুনু’র সাথে দেখা করে সব কিছু বলা দরকার, আদ্যোপান্ত সবই তো ওর জানা। পুনুকে ওর রুমেই পেলাম, ডাইনিং এ যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। খাওয়া হয়নি শুনে বল্লো, খেয়ে আসি চলো।
একটা দিলখোলা মানুষ, সারাটা জীবনই কাটিয়ে গেছে বন্ধুদের সাহচর্যে তাদের সুখ দু:খের সাথী হয়ে। খাওয়ার পর ওর রুমে এসে বর্তমান অবস্থার সবটাই খুলে বল্লাম। শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে পরে বল্লো, ঠিক আছে বিকালে বুলার সাথে কথা বলবো। এখন একটু রেষ্ট নাও, বেশি স্ট্রেস নিও না। সিচুয়েশনটা আগে স্বাভাবিক করা দরকার।
বুলার হলের সামনে আসতেই দেখি সেই একই ভংগিতে দোতলার বারান্দায় গেটের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত ইশারায় দাঁড়াতে বলে নীচে নেমে এলো। সকালের সেই পোষাকটা এখনো বদলায়নি, দুপুরের সেই চেহারা এখনও একই অবস্থায়, বোঝা যাচ্ছে মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সেটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে চোখে মুখের ভাবে।
পুনু হাসি দিয়ে জিজ্ঞাস করলো, কেমন আছো বুন্ডি?
বুলার নিরুত্তাপ উত্তর, ভাই সবই তো শুনেছেন, আমার জীবনটাই এখন পুরোপুরি অনিশ্চিত, কি হবে আল্লাহ্ই বলতে পারেন।
হাঁটতে হাঁটতে তিনজন চলে এলাম কেসকোর্সের সেই কোণার টিএসসি লাগোয়া স্থানটায়। ঢুকার সময় গেট থেকে বাদাম নিয়ে বুলার হাতে দিয়ে যেয়ে বসলাম। বুলার মতো সবার অবস্থা একই রকম। সবাই চিন্তা করছে এর পর কি হতে যাচ্ছে?
মৌণতা ভেংগে পুনু বল্লো, মন খারাপের কি হলো, এতো ভালো সংবাদ। তুমি আগে চলে যাও পরে মাষ্টার্সের ফাইনাল দিয়ে আমার বন্ধু চলে যাবে। মাঝের কয়েকটা মাস দেখা হবে না, কিন্তু কথা তো হবেই। তোমার বাবাকেও তো তোমার দেখা দরকার, উনার তো একটা মেন্টাল সাপোর্ট দরকার তার উপর বয়সও হয়ে গেছে উনার। তুমি কাছে থাকলে উনি অনেক জোর পাবেন, তোমাকে এই মুহূর্তে কাছে পেলে উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। চিন্তা করো না আমি আমার বন্ধু কে পাঠিয়ে দেবো। ওখানে যেয়ে পছন্দমত বিষয়ে একটা কোর্স করে নিও, ও যাওয়ার আগের মধ্যবর্তি সময়টা পড়াশুনার মধ্যে থাকলে তোমার সময়টাও কেটে যাবে উপরন্ত চাকুরী পেতেও সুবিধা হবে।
পুনু’র কথায় মনে হলো কিছুটা কাজ হলো, বুলা প্যাকেট থেকে বাদাম বের করে খোসা ছড়িয়ে আগের মতোই আমার হাতে দিতে লাগলো।
খেয়াল করলাম ধীরে ধীরে পুনু ওর মনের কষ্টটা লাঘবের চেষ্টা করছে। মনের গুমোট ভাবটা আপাতত: কাটানো দরকার আর পুনু যথাযতভাবে সেটাই করতে সহায়তা করছে।
কষ্টটা আমিও বুঝছি, পরিস্থিতি কখন কি হবে সেটা কি আগে থেকে বলা যায়? তবু পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হওয়াতে ভালোই লাগলো। আবেগ সবারই আছে, আমি নিজেও আবেগ তাড়িত মানুষ আর সবার মতই। কষ্ট আমারও লাগছে আর সেটা আমি বুলার সামনে প্রকাশ করছি না তার কারণ তাতে ও আরো ভেংগে পরবে। এমনি তেই মা’য়ের মৃত্যু, ভাই-ভাবীর কুট কৌশলী চরিত্রের কারণে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত, কাছের মানুষ হিসাবে একমাত্র আমিই বর্তমানে ওর সুহ্রদ ব্যাক্তি। নীতিগতভাবে আমার মনে হচ্ছে এখন সাহস দেওয়া এবং সার্বিকভাবে সংগ দেওয়াটাই আমার একমাত্র নৈতিক দায়িত্ব।
আমি এ ছাড়া কি-ই বা করতে পারি। এই মুহূর্তে ওর বাবার পাশেই দাঁড়ানো বেশি প্রয়োজন, অভিভাবক বলতে এখন তিনি একক ব্যাক্তি। বিকল্প চিন্তা থাকলেও যেহেতু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এখন বরং তার পাশে দাঁড়ানোটাই যুক্তিসংগত বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। ওর মা যিনি শেষ পর্যন্ত বুক দিয়ে ওকে আগলে রেখেছিলেন তার বিদায়ে বুলা বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে। উপরন্ত এখন বাবার অসুস্থতার খবরে তার পাশে থাকা রীতিমত ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্তায় আমার নিজের ভালোমন্দের চিন্তা করার সময় এখন নয়, ওটা পরেও করা যাবে।
পরীক্ষার পর আবার ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। চলে যাওয়ার আগে আছে যে কয়েক দিন দেশে আছে বল্লাম, ক্লাশ করো। দুপুরে লাঞ্চের পর টিএসসি’র লনে যেয়ে বসলাম। কেন যেন ও আর আগের উচ্ছল হতে পারছে না। মুখ দেখে মনে হয় গভীর চিন্তার ছাপ। পাশাপাশি বসলো, অন্যদিনের চেয়ে একটু কাছে।
অনেক দূর থেকে ভেসে আসা কন্ঠের মত বল্লো, তুমি তো আমায় কিছু বল্লে না আমি কি করবো? তোমার মুখ থেকে না শুনে আমি আশ্বস্ত হতে পারছি না। তুমি বলো কিছু হঠাৎ করেই ওর গলাটা যেন ধরে এলো। চমকে উঠলাম ওর কন্ঠে। মুহূর্তের মধ্যে কি যেন হয়ে গেলো, বল্লো তোমার কি মনে আছে সেই প্রথম দিনের কথা? আমিই এগিয়েছিলাম অনেক চিন্তা ভাবনা করে, আর সত্যিই তোমাকে নিয়েই জীবনের প্রথম স্বপ্ন দেখেছি আর সেই আমি এখন কত দূরে চলে যাচ্ছি। অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম তোমাকে নিয়ে। মা’কে সব বলেছিলাম আর উনিও রাজী হয়ে গিয়ে ছিলেন কিন্তু কি দিয়ে যে কি হয়ে গেল, মা’টাও আমার হারিয়ে গেলো আমার সাথে কথা শেষ না করেই …. কথা শেষ করতে পারলো না, ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেলো, দুচোখের কুল বেয়ে যেন নেমে এলো শ্রাবণের ধারার মতো কয়েক ফোটা নোনা জল। হতবিহ্বল আমি, কি দিয়ে কি হয়ে গেলো। নিজেকে কি শেষ রক্ষা করতে পারবো? কয়েকদিনের সংযমের বাধ কি আমার ভেংগে যাবে? দিশেহারার মতো স্তম্ভিত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র