ইউসুফ কামাল : ঢাকা থেকে বাড়িতে আসার পর পুরনো বন্ধুদের সাথে লম্বা কথার গল্পে সময় যে কোনদিক দিয়ে চলে যায় বোঝাই যায় না। আমার বর্তমান মানসিক পরিস্থিতিটা সম্পর্কে পুনু সম্পূর্ণ ওয়াকেবহাল, বিশেষ করে সেদিন রাতে আমার ঢাকার বাসার আলোচনাটা সে খুব সিরিয়াসলিই নিয়েছে। ওর বিশেষ গুন সে যখন কোনো সমস্যার মুখামুখি হয়, যতক্ষন সেটার সুষ্ঠু সমাধান না হয় ততক্ষন বিষয়টা তার মাথার ভিতরেই কাজ করতে থাকে। তৃতীয় দিন সকালে আমার বাসার টেলিফোনটা বেজে উঠলো। ট্রান্ক কল, অপারেটর বল্লো বরিশাল থেকে। তখনও ডাইরেক্ট কল করা যেতো না জেলা থেকে জেলায়, ট্রাংক কল করতে হতো। ওপার থেকে বুলার শীতল কন্ঠ ভেসে এলো। ‘তুমি বাড়িতে কত দিন থাকবে’? আচমকা প্রশ্নে আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। বল্লাম, ‘সব কিছু ঠিক ঠাক আছে তো!! নতুন কোনো সমস্যা’?

‘এই কয়েকদিন বাড়ির সমগ্র পরিবেশ বদলে গেছে। আমার রুমের আলমারী, টেবিল সব কিছুর উপরই যেন আমার কর্তৃত্ব হারিয়ে গেছে। আমার এক মুহূর্ত এখানে ভালো লাগছে না। নিজ বাড়ির পরিবেশের যে এত পরিবর্তন হবে সেটা ক্ষুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি। আমি যে কোনদিন ঢাকায় ফিরে আসতে পারি, একটা দিন আর এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না। আমি আর আমার মা যে এই বাড়ির মানুষ ছিলাম সেটা প্রায় বোঝাই যাচ্ছে না’। কথাগুলো এক ভাবে বলে গেলো। একটা মানুষ তিলে তিলে নিজের হাতে গড়ে তোলা সংসার থেকে বিদায় নিয়েছেন অল্প কিছুদিন। যে সংসারের মায়ায় স্বামীর কথার অবাধ্য হয়েছেন, সংসার ছেড়ে স্বামীর কর্মস্থলে থাকেননি তার বিদায়ের সাথে সাথে তার শেষ চিহ্নটুকুও যেন অদৃশ্য করে দেওয়া হচ্ছে।

হায়রে পৃথিবীর মানুষ, এত নিষ্ঠুর মানুষ হতে পারে? কথার মধ্যে গভীর বেদনার বহি:প্রকাশ, বুঝতে দেরী হলো না মা হারানো শোকের সাথে পরিবারের আপনজনের এ হেন অনাকাংখিত আচরণে বুলা প্রচন্ডভাবে ক্ষুব্ধ। কিছুটা বিচলিতও মনে হলো। বল্লাম, তোমার বাবার সাথে কি কথা হয়েছে? আমার কথায় একটু ধাতস্থ হলো। বল্লো, হ্যাঁ, হয়েছে। আমার পাসপোর্টের ফটোকপি পাঠাতে বলেছেন তাড়াতাড়ি। ভিসার ব্যবস্থা করবেন যাতে পরীক্ষার পর উনার কাছে যেতে পারি। বল্লাম, আমার ঢাকা যেতে দু’দিন দেরী হবে, এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকতে হবে। তুমি দু’দিন পরে রওনা দাও। মাথা ঠান্ডা রাখো। আমি এসে পাসপোর্ট এনে দেবো, চিন্তা করো না।

একটা জটিল অংক মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, কেনো এই স্বার্থপরতা। কি লাভ হবে এতে, সামান্য কিছু স্বার্থ বৈ তো নয়। তবে এটুকু বুঝলাম পারিবারিক সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সম্পর্কটা হয়তো ভেংগে যাচ্ছে আর কেউ চাইছেই হয়তো বা সম্পর্কটা ভেংগে যাক। সামান্য লোভের জন্য মানুষ আপন পর ভুলে যায়। কত বিচিত্র এই দুনিয়া আর তারচেয়েও বিচিত্র মানুষের মন। দুপুরে পুনু’কে ঘটনাটা খুলে বল্লাম, ও শুনলো। বল্লো ঠিক আছে, পরশু দিন আমিও যাবো। এক সাথেই ঢাকা যাবো। বাড়ি থেকে ফেরার পর বুলার সাথে ডিপার্টমেন্টে দেখা। শান্ত শিষ্ট মানুষটাকে আরো চুপ চাপ মনে হলো। করিডোরে দেখলাম সাফায়েত ভাইয়ের সাথে কথা বলছে, পাশে যেয়ে দাঁড়াতেই বুঝলাম সব ঘটনাই বলা হয়ে গেছে। আমার দিকে মোটর সাইকেলের চাবী’টা এগিয়ে দিয়ে বল্লেন, তোমরা পাসপোর্ট অফিস থেকে বুলার পাসপোর্টটা এনে দাও, পাঠানোর ব্যবস্থা আমি করবো কাল। নীচে নেমে বল্লাম, মোটর সাইকেলে চড়তে পারবে তো? ঘাড় নেড়ে মৃদু হেসে বল্লো, পারবো। ভাইয়া মাঝে মাঝে বরিশালে আমাকে কলেজে দিয়ে আসতো। খুব শান্তভাবেই আমাকে ধরে বসে থাকলো, কোন রকম জড়তা ছাড়াই।

কাউন্টারে রিসিপ্ট দিতেই ওরা বুলার সইয়ের সাথে সই মিলিয়ে পাসপোর্ট দিয়ে দিলো। হাতে পেয়েও ওর মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখলাম না। শান্ত গলায় বল্লো, তোমার কাছে আমি অনেক ঋণী হয়ে গেলাম। এই মুহূর্তে তুমি আমার সব চেয়ে কাছের মানুষ। হেসে বল্লাম, তাই নাকি? তোমার মনটা আজ এত খারাপ হয়ে আছে কেনো? জানো আজকে আমার জন্মদিন অথচ আমার নিজের কেউ নাই আমার কাছে। শেষ কথাটায় ওর গলাটা কেঁপে উঠলো, মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম অনেক কষ্টে অশ্রু সম্বোরন করলো কিন্তু সারা মুখেই তার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়লো। নাক মুখ লাল হয়ে উঠলো।

এ হেন পরিস্থিতিতে কি বলে সান্তনা দেবো, ওকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য কিছুটা সময় দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বল্লাম, চলো ডিপার্টমেন্টে যাই, কাজ আছে। সোশিওলজী ডিপার্টমেন্টে যেয়ে পুনুকে খুঁজে বের করলাম। ওকে বল্লাম সন্ধ্যায় ৬টায় ‘বাংচিন’ আসতে, বুলার আজকে জন্মদিন – ৪/৫ জন থাকবো আমরা। তুমি সময়মত চলে এসো। বুলা আর সীমাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে আজ সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের বলতেই সীমা খুশীর চোটে লাফ দিয়ে উঠলো। ওর জন্মদিন আর আমি আনন্দ করবো না! তাই হয় নাকি? বল্লাম, দুইজন ৬টায় ‘বাংচিন’ এ চলে এসো। আমরা যার যার মতো ওখানে চলে যাবো। ওখানে সবাই একত্রিত হবো।

বুলা গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বল্লো, এতক্ষন তো আমাকে একবারও বল্লে না, প্রোগ্রাম ঠিক করলে কখন? ‘তুমি যে কি মাঝে মাঝে মনে হয় আমি তোমাকে চিনি না’। মনে মনে হয়তো খুশী হয়েছে কিছুক্ষন আগের সেই কষ্টের ছাপটা এখন আর চোখে মুখে নাই। পরিবেশটা ভালো করতে পেরেছি চিন্তা করে নিজেকে নিজেই ধন্যবাদ জানালাম। ততক্ষনে নাক মুখের লাল ভাবটা কেটে চেহারায় স্বাভাবিক ভাব ফিরে এসেছে। লাইব্রেরিতে সাফায়েত ভাইকে পেয়ে গেলাম, সাইকেলের চাবী দিতেই বল্লেন, কাল সকালে বুলার আব্বার ঢাকা অফিসে পাসপোর্টের কপি দিয়ে আসবো, তুমি থেকো আমার সাথে।

তোফায়েল বাংচিন-এর ম্যানেজার আমার পাশের থানার মানুষ। বয়সে একটু বড় হবে কিন্তু উল্টো আমাকেই ভাই বলে। ওখানে ঢোকার আগে নিউ মার্কেটে গেলাম বিদ্যুৎকে নিয়ে। আমি ছোট্ট মুক্তো বসানো একটা আংটি কিনলাম আর বিদ্যুৎ নিলো একটা ‘ভি পাইলট’ কলম। নিউ মার্কেটের গেটের সামনে থেকে কয়েকটা লাল গোলাপ নিয়ে বাংচিন এ পৌঁছতেই ছ’টা বেজে গেলো। ঢুকে কাউন্টারে তোফায়েলকে বল্লাম পাঁচ জনের খাবার দিতে সম্ভব হলে …কথা শেষ করার আগেই তোফায়েল হেসে দিলো। বল্লো, আপনার ‘মেইন গেষ্ট’সহ সবাই চলে এসেছে । আমি ওনাদেরকে বসিয়েছি। আজকের অনুষ্ঠানের জন্য আমি নিজে আমার তরফ থেকে কিছু ব্যবস্থা করছি, আমার পক্ষ থেকে কমপ্লিমেন্টারী।

বুলাকে ও চেনে, আগেও আমার সাথে দেখেছে এখানে। একটু আলো আঁধারের কারণে কোণার দিকে খেয়াল করিনি, দেখি পুনুসহ ওরা তিনজন বসে আছে। বুলার জন্য অনুষ্ঠান আর এই পরিবেশে সব নিজেদের মানুষ। বিশেষ করে পুনু আর বিদ্যুৎ ওকে অতিরিক্ত স্নেহ করে, আপন বোনের মতই। তোফায়েল নিজে থেকে একটা কেক এনে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে চলে গেল। সবাই আনন্দ মুখর, অসম্ভব রকমের খুশী। সীমা ফু’দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে ‘হ্যাপী বার্থ ডে’গেয়ে উঠলো, সবাই সুর মিলালো। ছোটদের মতই বুলা সীমার সাথে আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠলো। পাঁচজনের একটা পরিবারের সবাই যেন একত্রে আনন্দে মেতে উঠলো।

ঘন্টা খানেক সময় যেন সবার মনের মণি কোঠায় ফ্রেমে বন্দী স্মৃতির মতোই সমুজ্জল হয়ে রইলো। পুনু বুলার জন্য আনা মাইশোর সিল্কের শাড়ির প্যাকেটটা ওর হাতে তুলে দিলো, বিদ্যুৎ কলমটা দিয়ে শুভ কামনা করে আমাকে বল্লো এবার তোমার পালা। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে, ধীরে পকেট থেকে আংটির বাক্সটা বের করে বুলার হাতে দিলাম। সীমা বাক্সটা খুলে খুশী মুখে বুলার হাতে ধরিয়ে দিলো। চোখে মুখে সবারই সন্তষ্টির ছাপ। মনে মনে যে বুলা প্রচন্ড আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছে তো বোঝা গেলো।

আলো আঁধারি পরিবেশেও ওর মুখটা যেন আরো উজ্জল হয়ে উঠলো। লজ্জা মেশানো সন্তষ্টির স্বরে বল্লো, তোমরা সবাই আমাকে এত আপন ভাবো আগে বুঝিনি। তোমরা সবাই খুব ভালো। আমার বড় কষ্টটাকে সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাদের সবার সম্মিলিত চেষ্টাকে আমি শ্রদ্ধা ভরে মেনে নিলাম। সবাই যে আমাকে তোমরা এতো ভালোবাসো তা আবারো বুঝলাম। তোমরা সবাই ভালো মানুষ, তোমাদেরকে জীবনে কোন দিনই ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সবাই আত্মার আত্মীয় হয়ে গেলে।

আমার আজকের জন্ম দিনে আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ এখানে নেই কিন্তু রক্তের সম্পর্কের চেয়েও কোন কোন সম্পর্ক যে আরো সুদৃঢ় হয়, সহানুভূতিশীল হয় তার প্রমাণ তোমরা। পুনু ভাই আর বিদ্যুৎদাকে আমি আমার ভাইয়ের স্থানে বসিয়েছি আর এখন সবচেয়ে যার প্রতি আমার নির্ভরতা বেশী সে হলো তুমি বলে ডান হাত দিয়ে আমার হাতটা ছুয়ে দিলো। খেয়াল করলাম ওর চোখে তখন আনন্দাশ্রু।
(Truth is mightier than fiction)
ইউসুফ কামাল : লেখক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র