Home কলাম হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৪৬

হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৪৬

ইউসুফ কামাল : মনটা অশান্ত হয়ে গেলো। রোজী, বুলাদেরকে হলে পৌছে দিয়ে বাসার পথে রিক্সায় উঠলাম, আলম ওর হলে ফিরে গেলো। সন্ধ্যার সাথে সাথে অনেক দিনই বাসায় ফিরি নাই। আজকে মনটা ভালো না। একটু আগেই সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, চারিদিকে আলো জ্বলে উঠলো ঝলমল করে, গলির মোড়ের চা’র দোকানে খদ্দেরের প্রচুর ভীড়। বাসায় ঢুকলাম, সবাই কেমন যেন অবাক দৃষ্টিতে তাকালো, বড় আপা তো জিজ্ঞেসই করে বসলেন, শরীর খারাপ নাকি রে? দেখি। হেসে বল্লাম না, এমনিই চলে আসলাম, দুপুরে ঠিকমতো খাওয়া হয়নি, খাওয়া দরকার। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি। আপাকে দ্বিতীয় প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে আমার রুমে চলে আসলাম। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস সকালে গোসল করে বেড়োনোর তবু কেনো যেন মনে হলো আবার গোসল করে নিই। শাওয়ারের ঠান্ডা পানিতে শরীরটা হয়তো ঠান্ডা হলো, কিন্তু মনটা? আপা খেতে ডাকলো, টেবিলে খাবার দেওয়া হয়ে গেছে। খাওয়ার শেষে সবাই টেলিভিশনে বসে যায়, আমার এই অভ্যাসটা কেনো যেনো হলোই না। বিটিভি’র এই বস্তা পচা অনুষ্ঠান আমি দেখতেই পারি না, শুধুমাত্র ‘ম্যাকগাইভার’ আর হাল্ক ছাড়া। ঘড়ে এসে ফ্যানটা চালু করে শুয়ে পড়লাম, ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজে চোখটা একটু বন্ধ হয়ে এলো। গোসলের কল্যাণেই মনে হলো শরীরটা নিস্তেজ হয়ে এলো। দোতালার লম্বা টানা বারান্দার কোনার শেষ রুম, জানালা দিয়ে এমনিতেই বাতাসে ঘড় ঠান্ডা হয়ে থাকে। দরজার খট্ খট্ শব্দে উঠে বসলাম, ধীর পায়ে দরজা খুলে দেখি দরজায় পুনু দাঁড়িয়ে আছে। ছয় ফুট লম্বা আকৃতির মানুষটা যার বুক ভরা সাহস আর বন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় ভরা। হঠাৎ করেই যেনো একটা ভরসার জায়গাটা হাতের নাগালের ভিতরে চলে এলো। বসতে দিয়ে জিলুকে পুনুর কথা বলতেই ও যেনো ভেতর থেকে দৌড়ে চলে এলো। ওর দারুন পছন্দের মানুষ, বুঝে ফেল্লো আজকে রাতে ঘুম আসতে অনেক দেরী হবে। চট্ করে এক্সট্রা তোষক বালিশ দিয়ে ফ্লোরে বিছানা পেতে ফেল্লো।

কষ্ট লাগে এই দুইজন মানুষই আজ স্মৃতি হয়ে গেছে আমার মনের ঘড়ে, দু:খ লাগে কখনই আর ছুটে আসবে না বন্ধুর কোনো খারাপ সংবাদে। রাতের খাওয়া হলে সেরেই আমার সাথে কথা বলতে চলে এসেছে, পকেট থেকে দু’প্যাকেট ব্রিস্টল আর ৪/৫টা কাগজে প্যাচানো পানের খিলি বের করে রাখলো বিছানার উপরে। ব্রিস্টল তখন ও আমাদের প্রিয় ব্রান্ডের সিগারেট। জিলুকে বল্লো, ওস্তাদ চা হবে নাকি? ইচ্ছে করে ও এমনি করেই সম্মোধন করতো, জিলু খালি স্প্রাইটের বোতলটা নিয়ে বের হয়ে গেলো গেটের কাছের চায়ের দোকানে। জিলুও ওকে গুরুদেব বলে ডাকতো। পুনু’র চোখমুখের চাহনি দেখেই কেমন যেনো সন্দেহ লাগছিলো, অনুমান সত্যিই হলো। বিকালের রেসকোর্সের ঘটনা হলে ফিরে আলম ওকে বলাতেই ও আর স্থির থাকতে পারেনি। সহমর্মিতার মোড়কে মোড়া বন্ধুর মনটা নিশ্চয়ই চঞ্চল হয়ে উঠেছে আর তাইতো ছুটে এসেছে, কি হয়েছে জানতে। দেয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরের বিছানায় বসলাম। চা মুখে দিয়ে বল্লো, কি হয়েছে তোমাদের? বুলাকে আবার ও নিজের বোনের মতই আদর করে। বল্লো, আমার ‘বুন্ডি’র কি হয়েছে? তোমাদের কি হয়েছে? বলো। সব বল্লাম, বুলার মা’য়ের মৃত্যুর পরই বর্তমানের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এটাও বল্লাম। সামনে পরীক্ষা, মায়ের মৃত্যুর পর ওর অভিভাবকত্ব্রের সমস্যা, ওর বাবার কথা, সবই আলোচনায় উঠে আসলো। বুলা এখন কোথায় থাকবে কার অভিভাবকত্বে? নিস্তব্ধ পরিবেশে সিলিংয়ের পাখার শব্দের সাথে মনে হলো যেন সবার মস্তিস্কের ভিতরের নিউরনের দৌড়াদৌড়ির অদ্ভুত একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গেলো। কত নির্মল আনন্দময় ও সহানুভূতিশীল ছিলো তখন কার বন্ধুদের সম্পর্কগুলো। কারো জন্য কারো ছুটে যাওয়া, প্রাণের টানে পাশে এসে দাঁড়ানো কি এখনো বন্ধুদের মধ্যে আছে? হয়তো আছে অথবা নাই তবে এখন পারস্পরিক স্বার্থের ঘেড়টোপেই তো আমরা সবাই বন্দী।

মোটামুটি সিদ্ধান্ত হলো পরীক্ষার সামনে একটু চুপচাপ থাকতে হবে পরে সময় বুঝে সিদ্ধান্তে আসবো। বেশি অশান্তি হলে পরীক্ষার উপর প্রভাব পড়বে। সকালের ক্লাশে যেতে ইচ্ছে করলো না, দশ’টার দিকে ডিপার্টমেন্টের কড়িডোরেই পেয়ে গেলাম বিদ্যুৎকে, অভিযোগ করলো সকালের ক্লাশ করলে না যে? কিছু হয়েছে নাকি? সবাই এদিকে ও দিকে ঘোড়াঘুড়ি করছে। বুঝলাম ও কি বোঝাতে চাচ্ছে। বল্লাম, চলো চা খেতে হবে মাথা ধরেছে। দক্ষিণের সিড়ির বাম পাশে ল্যাবরেটরী রুম, বুলার রুমমেট সীমা’র সাথে দরজার সামনেই দেখা, ভিতরে ওদের ক্লাশ হচ্ছে মনে হলো। মধুর কেন্টিনে জমজমাট ভীড়, বিদ্যুৎ সিংগারা চা নিয়ে এলো। মধুদা’র মেয়ে প্রতিভা বসে আছে কাউন্টারের ভিতরে নির্বিকার ভংগিতে, ব্যবসার হাল ধরে রেখেছে পিতার মৃত্যুর পর থেকে। মাঝে মাঝে ওর ছোট ভাইটাকেও দেখেছি বোনের সাথে। মধু’র কেন্টিন শুধু একটা রেস্তোরাই নয় এর সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ জন্মের অনেক স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস। এখানে বসে বাংলাদেশ সৃষ্টির অনেক বড় নায়কের উত্থান হয়েছে, কত বড় বড় আমলা এখানে বসে তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি যে কতো বড় করেছেন তার কোনো হিসাব করা যাবে না। সবই ইতিহাসের অংশ। ১৯৩৯ সালের পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির আঁতুড় ঘড় এই মধুর কেন্টিন। ১৯৫২ ‘র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন থেকে ১৯৭১ এর স্মরণীয় মুক্তিযুদ্ধ সব ক্ষেত্রেই মধুর কেন্টিন জড়িয়ে আছে। সব রকমের মিটিং এ খানেই হতো।

বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির তৎকালীন মুখ্য যোগাযোগের স্থান বলতে এই মধুর কেন্টিনই ছিলো মূল কেন্দ্রবিন্দু। লোহার চেয়ার লোহার টেবিলগুলো সব রং চটা কিন্তু মোটামুটি পরিস্কারই থাকতো, মনে পড়লো কয়েকদিন আগেই এই খানে দেখেছিলাম পুনু’র বোন কে হঠাৎ করে। সিরাজ আমাকে ডেকে এনে ওঁকে দেখিয়ছিলো, আশ্চর্য্য হয়ে গিয়েছিলাম এখানে এই পরিবেশে হাবিবাকে দেখে, হায় সেও আজ কালের অতলে লেকান্তরিত। সাড়ে বারোটার ক্লাশ করতে হবে, খালেক স্যারের ক্লাশ খুব একটা ভালো লাগতো না। তবু পরীক্ষার আগে বলে করলাম, ক্লাশ শেষ করে বেরোলাম। কড়িডোরে দেখি বুলা দাঁড়িয়ে আছে একা উদ্বিগ্ন চেহারা, একটু সাহসী ভংগিতে এগিয়ে এলো কাছে বল্লো, তোমার সাথে কথা আছে। ওর কথা বলা দেখে বিদ্যুৎ আলম সরে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়ালো। ওদের সরে যাওয়া দেখে বল্লাম, সামনে চলো। সবাই কি ভাববে। আত্মপ্রত্যয়ের সুর গলায় বল্লো, যে যা ভাবে ভাবুক। এখন আমার ভাবনা আমাকে ভাবতে দাও। একটু নিরিবিলি হতেই বল্লো, আমি সিদ্ধান্তে এসেছি তোমাকে দেশে একা রেখে আমি বিদেশে যাবো না। গেলে দু’জন এক সাথেই যাবো। আমার পাসপোর্ট লাগবে না, ওটা আনার দরকার নাই। এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে মুখটা ঘুরিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। উত্তেজনায় কথাগুলো বলে মনে হলো মৃদু হাপাচ্ছে।

কালকে বিকেলে তোমাকে দেখেই আমি বুঝেছি। একটু আগে পুনু ভাই তোমাকে খুঁজতে এসেছিলো, রাতে বাসায় তোমার সাথে ছিলো বলেছে। তোমাদের সবার মনের অবস্থা আমি বুঝেছি কিন্তু তোমরা আমার মনের অবস্থাটা ও বুঝছো না। আমি কি মানুষ না? কয়েকদিনে আমি অনেক কিছু হারিয়েছি আর নতুন করে কিছু হারাতে চাই না। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে প্রচন্ড উত্তেজনায়। নরম ও শান্ত প্রকৃতির মানুষরা জানি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আবার প্রচন্ড জেদী হয়। বুঝলাম পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারন করার আগেই ঠান্ডা করতে হবে, পরে কি হবে সেটা পরে বোঝা যাবে। বিদ্যুৎকে ডেকে বল্লাম, চলো টিএসসিতে যাই। একটু আগে আগেই গেলাম, বিদ্যুৎ যথারীতি আগে যেয়ে স্লিপ কেটে কাউন্টারে জমা দিতে গেলো। বুলাকে বল্লাম, শান্ত হয়ে বসো তুমি যা বলো তাই হবে। খাওয়ার ভাবে মনে হলো সকালে আজকেও হয়তো ঠিক মতো নাস্তাই করে নাই বল্লাম, সকালে তো নাস্তা করো নাই! ত্বরিত পাল্টা প্রশ্ন করলো, সীমা বলেছে তোমাকে? ওঁকে কি আমি তোমাকে বলতে বলেছি, ভালো লাগে নাই তাই খাইনি। বোঝা গেলো ও মন খারাপের প্রতিশোধ নেয় খাবারের উপরে। হেসে বল্লাম, বেচারা খাবারের কি দোষ? কালকে যে বলেছিলে বিকেলে কোথায় যাবে? বল্লো, যাওয়া তো দরকার, কি করবো, যাবো? হেসে বল্লাম, দরকার তোমার আমি কি করে বলবো! কোথায় যাবে? হঠাৎ করে বল্লো, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, বাবা চিঠি লিখেছেন কালকে পেয়েছি, আমার একটা ব্যাংক একাউন্ট খুলে নাম্বার পাঠাতে বলেছেন। বল্লাম, ভালো কথা চলো এখনই যটি এস সির নীচ তলায় জনতা ব্যাংকের একটা শাখা আছে, সেকেন্ড অফিসার আমার এলাকার। ওখান থেকে ফর্ম নিয়ে একটা এ্যাকাউন্ট খুলে নাম্বার পাঠিয়ে দাও, সরাসরি এখানে তোমাকে টাকা পাঠাতে পারবেন। আর তোমার হাতে খরচের সামান্য টাকা রেখে বাকী অতগুলো টাকা হাতে না রেখে ব্যাংকে জমা রেখে দাও, যখন যা লাগবে তুল্লেই চলবে। কথা মতো ফর্ম ফিলাপ করে কিছু টাকা অফিসার এর কাছে দিয়ে ব্যাংক থেকে বেড়িয়ে এলাম। সকালে ওরা চেক বই দিয়ে দেবে । বুলাকে বললাম সকালে চেক বই নিয়ে যেও। ব্যাংক থেকে বেড় হওয়ার সময় আমার কানের কাছে মুখ এনে আস্তে আস্তে বলল, এই জন্যেই তো তোমাকে আমি ছাড়তে চাই না, কথাগুলো বলেই মনে হলো যেন অসাবধানবশত: হাতটা ছুয়ে দিলো। (চলবে)
ইউসুফ কালাম : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

Exit mobile version