ইউসুফ কামাল : সাড়ে ন’টায় ক্লাস, তাড়াহুড়ো করে ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেই সিঁড়ির মাথায় দেখি বুলা দাঁড়িয়ে আছে, সাথে সীমা। আমাকে দেখে মনে হয় হাফছেড়ে বাঁচলো, বল্লো দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্য। বল্লাম এত সকালে কেনো, ডলার পাউন্ডের কারবার তো এগারোটার আগে শুরু হয় না। সাড়ে দশ’টায় এখান থেকে বেরুবো। এই ফাঁকে ড: রওশন আলীর ক্লাসটা করে নিই, তুমি লাইব্রেরির সামনে থেকো। হাসি দিয়ে বল্লো, আচ্ছা জনাব, তাই হবে।
ঘটনা সত্যি সকাল ১০/১১টার আগে ঢাকা শহরের দোকানপাট পুরোপুরি খোলে না কিন্তু ভেবে অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার হলো, আমি ক্লাসটা মিস করতে চাই না তাই পরে বেরোতে চাচ্ছি এ কথাটা মেনে নিলো আমার কথাটার গুরুত্ব দিয়ে। ক্লাস মিস্ করতে চাই না এটা যেমন সত্য তেমনি ১০/১১টার আগে বাস্তবিকই ঢাকা শহর কার্যত: শুরুই হয় না। ক্লাস শেষ করে বিদ্যুত্কে বল্লাম, বুলাকে নিয়ে মতিঝিলে যাচ্ছি কেউ খুঁজলে বলো। অনেক সময় সিরাজ- পুনুরা খুঁজতে আসে জরুরি কোন কাজে, আর ওরাও জানে বিদ্যুতই আমার সার্বক্ষণিক সাথী। ওর কাছেই আমার সঠিক খবরাখবর জানা যাবে। রিক্সায় উঠে জানতে চাইলাম পড়াশুনার কথা, পরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয় ইত্যাদি। দেখলাম মোটামুটি মানসিক ধকলটা কাটিয়ে উঠে পড়া শুনাটা শুরু করেছে, এতবড় একটা ধকল কাটতে একটু সময়তো লাগবেই। খেয়াল করলাম খুব সুন্দর একটা হাল্কা নীল রং এর সেলোয়ার কামিজ পড়েছে। কাপড়টা একটু ভারী কিন্তু চমত্কার মনে হয় ওর বাবা’ই সে দিন কিনে দিয়েছেন। বল্লাম তোমাকে কিন্তু ভারী সুন্দর লাগছে। পরিচিত সেই পারফিউমের গন্ধটাও নাকে লাগলো, একটা হাল্কা মিষ্টি গন্ধ। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার এ পারফিউমটা অসাধারণ, নাম কি। আমি তো মনে হয় তোমার পারফিউমের প্রেমেই পড়ে গেলাম। শব্দ করে হেসে উঠলো, তাই নাকি তাহলে পারফিউমের প্রেমে, আমার প্রেমে না? ভালোই তো আমি কিন্তু বুঝিনি যে তুমি এগুলো খেয়াল করো? আমি জানতাম না তো? গন্ধটা ভালো না? বল্লাম, হাল্কা কিন্তু ভারী মিষ্টি, অসাধারণ, নামটা কি? হেসে বলল, প্যারী এলিস নাইট।
বাবা একবার দুইটা নিয়ে এসেছিলেন মার জন্য। মা এগুলো ব্যবহার করেনি আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন আমি এ দিয়ে আর কি করবো, আমি তো কোথাও যাই না। আমি বিশেষ বিশেষ দিনে এটা অল্প ব্যবহার করি। যেনো তাড়াতাড়ি শেষ না হয়ে যায় এ ভয়ে। বলেই হেসে ফেল্লো। বল্লাম, আজকে কি সেই তেমনি একটা বিশেষ দিন? হেসে বল্লো, জ্বী জনাব। তোমার সাথে আছি যে। ওর সারল্যপনা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে, ভালো লাগে ওর এই দ্বিধাহীন স্বীকারাক্তি।
সোনালী ব্যাংক প্রধান শাখায় তখন ডলার পাউন্ড কেনাবেচার প্রধান স্থান। ফ্লোরে ঢুকতেই কয়েকজন এসে জিজ্ঞাস করলো, কিনবেন না বিক্রী করবেন? দূর থেকে আমাকে দেখে মুনির ভাই চলে এলেন, জহুরুল হক হলের একটু সিনিয়র ভাই। কিছু দরকার নাকি ভাই’ডি? হাসি খুশী নিয়েই থাকেন সবসময়। বরিশালের মানুষটা সত্যিই ভালো ছিলেন। বল্লাম, আপনার কাছেই এসেছি কিছু পাউন্ড বিক্রী করতে হবে। বল্লাম, আজকের দরে বিক্রী করে দেন। জানতে চাইলো কতো আছে? বুলার দিকে চাইলাম, ও আমাকে বল্লো, কতগুলো দেবো? হেসে ফেল্লাম, এক কাজ করো, শ’তিনেক বিক্রী করো, বাকীটা রেখে দাও পরে যখন লাগে দেখা যাবে। পার্স খুলে গুনে আমার হাতে দিলো। মিনিট দশেক পর মুনির ভাই পাউন্ড বদলিয়ে দেশী টাকা আর হিসাব লেখা একটা কাগজ দিয়ে গেলো। টাকাটা গুনে নিয়ে ওর হাতে দিয়ে বল্লাম, অনেক টাকা তো সাবধানে রাখো। তখন সোনালী ব্যাংকের ডলার পাউন্ড ব্যবসার নগদ বেচা কেনার সবচেয়ে বড় ব্যবসাটা নিয়ন্ত্রণ করতো প্রখ্যাত ছাত্র নেতা নুরে আলম সিদ্দিকী। নিজে এসে ফ্লোরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। বুলাকে দেখালাম, ও তো দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলো। উনি এখানে কেনো? বল্লাম, সমস্যা কি নিজের ব্যবসা নিজেই করছেন ভালো তো! আইনগত সিদ্ধ ব্যবসা করছেন, কোন অনৈতিক কাজ করছেন না। তখনকার ছাত্র নেতাদের রাজনৈতিক চরিত্র অনুকরন করার মতো ছিলো। এখন কার মতো অনৈতিক কাজে অত অভ্যস্ত ছিলো না।
রিক্সায় কলাভবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম দেখি বুলা খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে। হাতে অনেকগুলো টাকা বল্লাম, টাকা দিয়ে কি করবে, খুব জরুরি মনে হলো। কোনো বিশেষ কিছু কেনাকাটা আছে নাকি? বিজ্ঞের রহস্যে ভরা একটা হাসি দিয়ে বল্লো, তোমাকে বলা যাবে না, গোপন। আচ্ছা, বলো না। আমার শোনারও দরকার নাই। বলার সাথে সাথে আবার বলে উঠলো, তোমাকে বলবো না তো কারে বলবো? পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আপনজনকে হারিয়েছি, এখন তুমি ছাড়া দেশে আমার আর আপন কয়জন আছে? তোমার উপর কতটুকু বিশ্বাস করি তা বুঝবে না, কথাটা বলে কেমন যেনো একটু সিরিয়াস হয়ে গেলো। প্রসংগটা ঘুরানোর জন্য বল্লাম, আগে তোমার মা ছিলেন মাসে মাসে সময়মতো টাকা পাঠাতেন এখন তোমাকে নিজের হিসাব নিজেকেই করতে হবে। টাকা সাবধানে রাখবে, বেহিসাবী কিন্তু হওয়া যাবে না। কথাগুলো মনে হয় ওর পছন্দ হয়েছে, আমার দিকে তাকিয়ে কপট ভঙ্গিতে বল্লো, ওরে বাবা তুমি দেখি অভিভাবকের মতো কথা বলছো। বল্লাম, ঠিক আছে তা হলে কিছু বলবো না যাও। টাকা খরচ করে পরে হলে না খেয়ে শুয়ে থাকলে কেউ কিন্তু তোমার খবর নেবে না। হেসে বল্লো, তুমি ও খবর নেবে না? বল্লাম, খবর নেবো-ঠিক আছে, আমি তো এখন তোমার লিগ্যাল না হলেও লোকাল গার্জিয়ান তো বটেই। তাই নাকি? লিগ্যাল গার্জিয়ান হতে চাও নাকি? কানের কাছে মুখ এনে আস্তে করে বলে ফেলে নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। কথাটা বলেই একটু চুপ হয়ে গেলো। বল্লাম, সে যাই হোক এগুলো পরে দেখা যাবে, তুমি কিন্তু দুপুরে টিএসসিতে এসো, এক সাথে খাবো।
কলাভবনে চলে এসেছি, একটা’য় আশরাফ স্যারের একটা ক্লাশ, রুমে ঢুকে দেখি স্যার এখনো আসেননি। সেকেন্ড বেঞ্চে বিদ্যুত এর পাশে যেয়ে বসলাম। পাশের বেঞ্চে সায়মা আর লাকী বসে আছে পিছনের বেঞ্চে নাসিম, ও বেচারা স্বল্পভাষী কিন্তু সায়মার সাথে প্রেম করার সময় কি এতো কথা বলে, মাঝে মাঝে মনে হয় একদিন ডেকে জিজ্ঞাস করবো, এত কথার উত্সটা কি? কোথা থেকে আসে এতো কথা। ক্লাস শেষ করে টিএসসি’র দিকে হাঁটা দিলাম, বিদ্যুত্কে বল্লাম, ঘটনা যে দিকে মোড় নিচ্ছে তুমি কিছু ধারণা করতে পারছো? কি হতে যাচ্ছে? বিদ্যুত বল্লো আমিও চিন্তা করেছি, তোমাদের দু’জনের সম্পর্কটা খুব ভালো, এখন দু’জনে নিজেরা একটু নিরিবিলি বসে আলাপ আলোচনা করে নিও তাতে দু’জনেরই ভালো হবে। বিশেষ করে বুলা কিছু ভাবছে কিনা এটা আগে বোঝা দরকার। একা দেশেই বা কি ভাবে এখন থাকবে। আগে মা’র কাছে চলে যেতো ছুটি হলে এখন সেই অবস্থা তো আর থাকলো না। বেচারার জন্য কষ্টই লাগছে। সরাসরি আলাপ আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারো কিনা দেখো। বিষয়টা একটা পরিণতির দিকে মোড় নিচ্ছে, এখন প্রয়োজন সেটাকে সামাল দেয়া। তবে এখনই এটা নিয়ে ওঁকে বেশি করে চিন্তার মধ্যে ফেলে দিলে সামনের পরীক্ষার জন্য সেটা শুভ হবে না। একটু ধীরস্থিরভাবেই এটাকে সামাল দিতে হবে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, আমেরিকা