ইউসুফ কামাল : গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দু:খ সুখের গানে
সুর দিয়েছো তুমি আমি তোমার গান তো গাইনি
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে তোমায় দেখতে আমি পাইনি।

কারো সুরের মাঝে হারিয়ে যাওয়াতে একটা নতুন উপলদ্ধি আসে যা সহজে পাওয়া যায় না। এ উপলদ্ধি ভিন্নতর, হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো বিষয়। একের প্রতি অন্যের মমত্ববোধকে জাগ্রত করে, ভালোবাসাকে জিঁইয়ে রাখে। বিশ্বাসের জায়গায় একবার পৌঁছে গেলে সে জায়গাটা ধরে রাখাটা একটা শক্ত কাজ। তারপরও যখন সেটা ঘটেই যায় তখন সেটা একটা হৃদয়ভিত্তিক সম্পর্ক হিসাবে ধরা যায় যেখানে থাকে শুধুই পারস্পরিক বিশ্বাস। তখন ইন্দিরা রোডে পাসপোর্ট-এর অফিস। ঢাকা জিপিওতে ফিস্ জমা দিয়ে বুলাকে নিয়ে পাসপোর্টের ফর্ম পূরণ করে জমা দিয়ে আসলাম। ওর স্থায়ী ঠিকানা বরিশাল হওয়ায় ওকে বল্লাম, তোমার ভাইকে বলে দিও পুলিশ ভেরিফিকেশনটা করিয়ে দিতে। তাতে কাজটা সহজ হবে। পরদিন বিকেলে ফোনে ভাইকে বরিশালে বলে দিলো। মোটামুটি তিন সপ্তাহের মধ্যেই পাসপোর্ট হয়ে গেলো। বুলার মা’র মৃত্যুর পর বৈষয়িক সমস্ত কাজ কর্ম শেষ করে লন্ডন ফিরে যাবার সময় ওর বাবা ঢাকা আসলেন দুই দিনের জন্য। ইচ্ছে মেয়ের সাথে দুই দিন কাটানো। হলে এসে মেয়েকে নিয়ে সারা ঢাকা শহর, তার পুরনো কর্মস্থলসহ আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ঘুরে বেড়ালেন।

দুই দিন পর দেখা হলো খেয়াল করলাম বাবার প্রতি ওর মনটা একটা ভিন্ন রকমে দুর্বল- যেটা পিতা কন্যার ক্ষেত্রে প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়। মেয়েকে সাথে নিয়ে নিউমার্কেট, গাউসিয়া ঘুরে ঘুরে ভালো কয়েকটা পোষাক, জুতা কিনে দিয়ে গেলেন। খরচ করার পর নগদ কিছু পাউন্ড বেচে ছিলো প্রায় সবটাই বুলা’কে দিয়ে গেছেন। সামগ্রিকভাবেই দেখলাম বুলার মনটা বেশ ভালো হয়ে গিয়েছে।

বাবা একা একা বিদেশে থাকে এটাও ওর জন্য একটা মনোকষ্টের কারণ। আপন একজন কাছে থাকলে তারও একটু একাকীত্ব ঘুচতো, এটাও আমাকে বল্লো। মা বাবার কথা শোনেন নাই, শুনলে জীবনটা হয়তো অন্য রকম হয়ে যেতো। এমনি করে একেক জন একেক দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তো না। এমনি পারিবারিক অনেক কথা নিজে নিজেই বলে ফেল্লো আপন ভেবে। বুলার কথায় বোঝা গেলো বাবা পাসপোর্ট করার কথায় খুশী হয়েছেন, বল্লেন ভালো করেছো আমিও তো ওখানে একাই থাকি তুমি যদি আসো আমাকেও দেখা শোনা করতে পারবে আর আমিও এই দিকে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো। তা ছাড়া তোমার মাও চলে গেলেন এখন তোমার সরাসরি দেখভালের দায়িত্বটা অনেক বেড়ে গেলো, আগে তোমার মা’ই এটা সামলাতেন। তবে তার আগে পরীক্ষাটা শেষ করো, আমি যেয়ে তোমাকে নেওয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিক করা যায় কিনা দেখি। বুলার কথায় পরিস্থিতির উপর একটা ধারণা হোলো। এক দিকে কন্যার প্রতি পিতার আপত্য স্নেহ অন্য দিকে বাবার প্রতি কন্যার ভালোবাসা, দু’টার কোনোটাকেই খাটো করে দেখার উপায় নাই। বিশেষ করে মায়ের মৃত্যুর পর ওর নিজের একান্ত ভরসার একটা স্থান চলে গেলো। আগে ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার প্রধান আকর্ষণ ও নিরাপত্তার স্থান ছিলো মা। সেটা চলে গেলো, এখন বাড়ি যাওয়ার ঐ রকম চিন্তাও থাকবে না, যেয়ে শান্তিও পাবে না স্বস্তিও পাবে না তাহলে কি হবে? ভাবনাটা আমার মাথার জাকিয়ে বসলো, তাহলে কি হবে? ওর সার্বিক ভালোমন্দের ব্যাপারটা এখন কে দেখবে? ভাইয়ের বিয়ে ও সন্তানাদি হওয়ার পর স্বাভাবিক কারণেই ভাইবোনের মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ইচ্ছে থাকলেই কি স্নেহের জায়গাটা আগের মতো খোলা থাকে? নাকি পারে? কেউই পারিপার্শিকতার কারণেই পারে না। এটাই বাস্তবতা আর এই বাস্তবতা মানতেই হয়, অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই।

পরিস্থিতি চিন্তা করে মনটা ধীরে ধীরে বিষাদময় হতে শুরু করলো। বুলা এখনো পরিস্থিতির চরম মুহূর্ত ভাবতে পারে নাই, সদ্য মা’র মৃত্যুর ধাক্কা এখনো সামলে উঠতে পারে নাই। খুব বেশি চিন্তা এখনো করতে পারছে না ধীরে ধীরে আমাকে নিয়ে যখন ভাবতে শুরু করবে তখন চরম একটা অসহায় পরিস্থিতিতে পড়ে যাবে। একদিকে আমি আর অন্যদিকে তার পরিবার ও বাবা। ধীরে ধীরে প্রচন্ড একটা মানসিক দোটানায় পড়ে যাবে, ঠিক তখন আমার কি ভূমিকা হবে সেটা নিয়েই নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। বাবার সাথে ঘুরে বেড়ানোতে দেখলাম মনটা অনেকটা ভালো হয়ে গেছে। বাবার সাথে দীর্ঘদিন পর একান্তে ঘোরাঘুরি করতে পেরে খুব খুশী, বড় হওয়ার পর থেকে এভাবে এত কাছ থেকে বাবার সান্নিধ্য পায়নি কখনো। কোনো কিছু না চাইতেই বাবা সেটা পূরণ করে দিয়েছেন আর সেই সাথে তার স্নেহের পুরো দুয়ারটাই যেন খুলে দিয়েছেন। তাইতো কথায় কথায় বাবার কথা বলে ফেলে।
ওর বাবার চলে যাবার পর বন্ধু পুনুর সাথে আমিও দুদিনের জন্য একটু বাড়িতে গেলাম। সেই ঈদের পর তো আর যাওয়া হয়নি, একটু যেতেও ইচ্ছে করছিলো। বাড়িতে গেলেই সেই পুরনো পরিবেশ, বন্ধু সব মিলিয়ে কোথা দিয়ে যে ৩/৪ দিন কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না। পুনুই বল্লো ক্লাশ বেশি দিন মিস করা ঠিক হবে না চলো কাল দুপুরে রওয়ানা দিই। ফিরে আসলাম আবার সেই নীলিমার নীলক্ষেতের আশ্রয়ে।

দুই মাস পর ওর অনার্স পরীক্ষা, একটু ব্যাস্ত হয়ে পরতে হলো। আমিও পড়াশুনা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম, সামনে আমারও পরীক্ষা।
ক্লাশ, লাইব্রেরি, নোট করা নিয়ে সময় পার করছি যদিও বুলার সাথে দেখা রোজই হচ্ছে, কথাও হচ্ছে। বৃহস্পতিবার ক্লাশ কম দুপুরে টিএসসিতে লাঞ্চের সময় বুলা যথারীতি আসলো, কাছে এসে ঘনিষ্ট হয়ে বল্লো, চলো আজকে আমি তোমাকে খাওয়াবো, রোজই তো তুমি খাওয়াও। হেসে বল্লাম, ঠিক আছে। শুনে খুশীতে মুখটা যেন বিজয়ীর হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।

দেখলাম মনটাও আগের চেয়ে অনেকখানি ভালো। বল্লাম, নোট করা শেষ তো? আরো বাকী আছে নাকি? মন দিয়ে পড়বে। অনেক ঝড় গেছে তোমার উপর দিয়ে। বল্লো, মোটামুটি প্রিপারেশন নিচ্ছি, বাকী আল্লাহ্ ভরসা। খুব ঝর ঝরে মুডে আছে মনে হলো। ছোট পার্স খুলে একটা এনভেলাপ আমার হাতে দিয়ে বল্লো, বাবা দিয়েছেন দেখো তো কত কি আছে? বুঝে ফেল্লাম কি আছে। বল্লাম, তুমি খোলো, গুনে দেখো কত আছে? একটু রেগেই বল্লো, আমি পারবো না, তোমাকে তাহলে কেনো দিলাম? মনে হলো একটু মন খারাপও করলো। বোলো কি করতে হবে? গুনে দেবো? বল্লো, গুনে দেখো তারপর এটা ভাংগিয়ে বাংলাদেশী টাকায় করে দেবে। দেখলাম ৫৭০ পাউন্ড আছে। বল্লাম, এতো টাকা ভাংগিয়ে কি করবে, কিছু ভাংগাও কিছু এ ভাবেই রেখে দাও, যখন লাগবে ভাংগাবে। যে কোনো দিন সকালের দিকে মতিঝিলের সোনালী ব্যাংকের হেড অফিসে গেলে বিক্রী করে নগদ টাকা আনা যাবে, এখন তোমার কাছেই রাখো, বলেই ওর হাতে এনভেলাপটা ফিরিয়ে দিলাম। বল্লো, কাল সকালে বেরুবো তাহলে তোমাকে নিয়েই। আমার টাকা লাগবে, কিছু বিশেষ কাজ আছে। ওকে আর কোন কথা জিজ্ঞাস করলাম না, কালকেই জানা যাবে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল: লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র