Home কলাম হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৪২

হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৪২

ইউসুফ কামাল: বুলার মার মৃত্যুর সংবাদ জানার পর ওর সাথে কথা বলাটা আমার কাছে অবশ্য করণীয় হয়ে দাঁড়ালো। চিন্তা করলাম ওর বাড়িতে এখন বিভিন্ন রকমের মানুষে ভরা থাকার কথা। আলমকে বল্লাম রোজীকে দিয়ে ফোন করিয়ে পরে আমি কথা বল্লে বোধহয় কেউ কোন রকম সন্দেহই করবে না, আর আমিও চাই না ও এই মুহূর্তে কোন রকম অপ্রিয় প্রশ্নের সম্মুখীন হোক। রোজী এক কথায় রাজী হয়ে গেলো, কারণ বুলাকে সেও যথেষ্ট পছন্দ করে। কথা মতো নিউমার্কেট পোষ্ট অফিসে গেলাম তিনজন। সন্দেহই সত্য হলো বুলার বাবাই প্রথম ফোন ধরলেন, রোজী বুলাকে চাইতেই উনি ওঁকে ডেকে দিলেন। রোজীর গলা শুনেই বুলা কেঁদে ফেল্লো। আপনজনের কাছে মানুষ সব সময়ই আশ্রয় খোঁজে, শান্তি খোঁজে একটু নিরাপত্তার আশায়। কিছুদিনের মধ্যে রোজী ওর অনেক কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র ওর সহজ সুন্দর ব্যবহারের জন্য। রোজী কিছুক্ষণ সান্তনা দিলো, সবাই জানে এ কান্নার শেষ নাই, মা’হারা সন্তানের কান্না তো কোন দিন শেষ হয় না। আর এজন্য কি সান্তনাই বা দেওয়া যায়, কোন সান্তনাতেই তো আর সে ফিরে আসে না তবু মনকে একটু বুঝ দেওয়া এই টুকুই।

ফোনটা আমাকে ধরিয়ে দেওয়ার পর আমার গলা শুনে আবার ও হুহু করে কেঁদে ফেল্লো। বল্লো, মা চলে গেলো, বলো এখন আমি কোথায় কার কাছে থাকবো? আমার দু:খী মা’টা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনেক কষ্ট নিয়ে বেঁচে ছিলো। ছুটিতে বাড়ি এসেই মাকে পেতাম এখন তো তাও পাবো না, এখন কি করি? বাবা মা’র মৃত্যুতে সান্তনা দিতে নতুন করে বস্তুত বলার মতো কিছুই থাকে না। তবু বল্লাম, নামাজ পড়ে আল্লাহ্র কাছে দোয়া করো, আল্লাহ্ যেন উনাকে শান্তিতে রাখেন। বল্লো, আমি ঢাকা থেকে আসার পর হাসপাতালে কিছুক্ষণ পর পরই আমাকে জিজ্ঞেস করতো, তোর বাবা কবে আসবে? আসবে তো? নাকি এখনো রেগে আছে আমার উপর? তার কথা শুনিনি তার জন্য আমার শেষ সময়েও একবার আসবে না? এই সমস্ত কথা বলে সব সময়ই কাঁদতো। ওর বাবা পরিবারকে বিদেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, সেটা বুলা আমাকে বলেছিলো কিন্তু ওর মা এই ঘর সংসার রেখে কোথাও যেতে চাননি। সেই থেকে বাবা মা’র মধ্যে একটা মান অভিমান চলছিলো যা থেকে যোগাযোগের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিলো। যদিও প্রয়োজনীয় অর্থ দেওয়াসহ অন্যান্য যোগাযোগ তিনি ঠিকই রাখতেন।
অথচ মানুষ বোঝে না মানুষ ছাড়া সহায় সম্পত্তির কোনো মূল্যই নাই। বাবা আসবার পর দুই দিন মা বেঁচে ছিলেন, তখন মা বেঁচে থাকার জন্য কতো আকুতি করতেন। বার বার বলতেন, তোমার কথা শুনিনি তাই আমার এই শাস্তি। তুমি মাফ করে দিলেই দেখো আমি ভালো হয়ে যাবো। আমি ভুল করেছি, ভুল করেছি। বার বার একই কথা বলতেন। বাবার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতেন আর চোখের পানি ফেলতেন। বাবা ও মা’কে অসম্ভব ভালোবাসতেন, ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন দু’জনে। কিন্তু কেনো যে মা এতো জেদ করে বসে রইলেন, কেউই তাকে বুঝিয়ে রাজী করাতেই পারলো না। সত্যিকারেই নিয়তির লেখা কেউই আমরা যেমন ফেলতে পারি না। তবে বাবার হাতে হাত রেখেই মা আমার চলে গেলেন। বুলার ক্রমাগত কান্নায় আমার মনটাও ভারী হয়ে এলো। একটু চুপ করে থাকলাম বল্লাম, দুই মাস পর তো তোমার ফাইনাল পরীক্ষা, মিলাদের পর চলে এসো। পরীক্ষা তো দিতে হবে। আমার ঢাকা বাসার ফোন নাম্বার দিয়ে বল্লাম, কোন জরুরি সংবাদ থাকলে জানাবে।

আলম রোজীর সাথে চলে এলাম লাইব্রেরির সামনে। শরীফ মিয়াকে চা’র কথা বলে কেন্টিনের সামনে লাইব্রেরির বারান্দায় বসলাম। সবাই একই চিন্তা করছে বুঝলাম আলমের কথায়, এখন কি হবে? কয়েকটা দিন যাক্ একটা সিদ্ধান্তে সবাই আসবে, রোজীর কথাটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হলো সবার কাছেই কারণ বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় কারোরই নাই। পরের সপ্তাহে বুলা চলে এলো ঢাকায়, সকালে ডিপার্টমেন্টে দেখা হলো। চেহারাটা বিবর্ণ হয়ে গেছে, দেখেই মায়া লাগলো। বিদ্যুৎ আলমসহ যারা বিষয়টা জানে সবাই সহানুভূতি জানালো, তাতে আরো এক প্রস্ত চোখটা ভিজে গেলো ওর। বল্লাম ক্লাশ করো, এক’টা চল্লিশে ক্লাশ শেষে টিএসসি’তে যাবো, তুমিও যাবে। নীচে নামার জন্য সিঁড়ির কাছে আসতেই দেখি ও একা দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির মাথায়, আমার জন্যেই অপেক্ষা করছে বুঝলাম। পিছন পিছন নেমে এলো, কেমন যেন নিস্প্রাণ হয়ে গেছে মানুষটা। পিছিয়ে পড়েছিলো দাঁড়ালাম ও পাশে আসা পর্যন্ত। ভাবলাম একটু সহজ করা দরকার, কষ্ট বোধটা হাল্কা করা দরকার না হলে সমস্যা বেড়েই যাবে। বল্লাম, সকালের লঞ্চে এসেছো, কিছু খেয়েছিলে? তাকালো আমার দিকে কথা বল্লো না, বুঝলাম খায়নি। মুখটা শুকিয়ে গেছে কয়েকদিনের অনিয়মিত যতেœর জন্য। বল্লো, খেতে ইচ্ছে করে না, ভালো লাগে না।

ক্যাফেটেরিয়ায় পাশে বসে বল্লাম, না খেলে তো চলবে না। যে যাবার সে তো চলেই গেছেন তার জন্য দোয়া করো, আল্লাহ্র কাছে বলো তাকে যেন শান্তিতে রাখেন। মনে হলো অনেক দিন ভালো মতো খায়নি। মা’য়ের মৃত্যুর পর ওর দিকে কেউ খেয়ালও করেনি হয়তো। আর নিজেও নিজের দিকে তাকানোর প্রয়োজনও মনে করেনি। আমাকে বল্লো, তুমি খাবে না? আমি ওর খাওয়া দেখছিলাম আর ভাবছিলাম ওর খবর নেবার আসল মানুষটাই চলে গেলো। বল্লাম, খাবো, তুমি আগে খাও। মৃদু হাসি দিয়ে বল্লো, তুমি ছাড়া এভাবে আমাকে জোড় করে খাওয়ানোর মানুষ এখন আর নাই। একজনই ছিলো তাও চলে গেলো। আবারো চোখটা ভারী হয়ে আসলো। কথাটা মনে খুব লাগলো, পৃথিবী থেকে কারো মা যখন চলে যায় তখনই বোঝা যায় আল্লাহ্র কত বড় নিয়ামত সে হারালো। খাওয়া শেষ করে লনে যেয়ে বসলাম। বুলা অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে ধীরে ধীরে মুখ থেকে দু:খের ছাপটা একটু একটু করে সরে যেতে শুরু করেছে। এক নাগাড়ে কয়েকদিন একটা দম বন্ধ পরিবেশে থাকার কারণে এমনিতেই মনটা আরো খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। সময় দেখতে যেয়ে ঘড়ির দিকে নজর পরতেই বলে উঠলো, প্রথম যে দিন তুমি ফোন করেছিলে সেদিন ফোনটা মা’ই ধরেছিলো। গতবারের এই কথাটা ভেবেছিলাম পরে তোমাকে বলবো কিন্তু বলা হয় নাই। বল্লাম, হ্যাঁ, আমার মনে আছে।

কথা শেষ হওয়ার পর মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো তোমার সম্মন্ধে। আমি তোমার কথা বলে দিয়েছিলাম, তুমি এই ঘড়িটা আমাকে দিয়েছো তাও বলেছিলাম শুনে উনি হেসে শুধু বলেছিলেন, বুঝে সুঝে এগোবে তোমার পছন্দই আমার পছন্দ। আমি বলেছি, তুমি খুব ভালো মানুষ। বস্তুত পক্ষে মেয়েরা বড় হয়ে গেলে মা’য়ের সাথে তাদের সম্পর্কটা সহজ হয়ে বন্ধুর পর্যায়ে চলে যায়। জিজ্ঞাস করলাম, তোমার বাবা কি ফিরে গেছেন লন্ডন? উনি কি কোনো সিদ্ধান্ত দিয়েছেন? বাবা আরো এক সপ্তাহ থাকবেন, আমার উপর তার নিজের কোনো মতামত চাপিয়ে দেন নাই বলেছেন, তুমি বড় হয়েছো নিজের ভালো মন্দ তুমি বুঝতে পারো। কি করবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানাবে। দেশে থাকতে চাইলে থাকবে আর আমার কাছে যেতে চাইলে যাবে, আমি তোমাকে সব স্বাধীনতা দিলাম। তবে ঢাকা যেয়ে পাসপোর্টটা করে ফেলো। সব অপশান তোমার সামনে খোলা থাকলো। বুঝলাম বুদ্ধিমান মানুষ উপরন্ত বিদেশে থাকেন, কারো স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী নন। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

Exit mobile version