Home কলাম হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র

হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র

ইউসুফ কামাল : পাঁচ.
সকাল সাড়ে আট’টার ক্লাশ অনেকেই সময় মতো উপস্থিত হতে পারতো না। যারা হলে থাকে বিষয়টা তাদের কাছে যতটা সহজ অতটাই কঠিন আমরা যারা বাসা থেকে ক্লাশে আসি। হল জীবনের সুবিধা এটাই।
বকশীবাজার থেকে কলা ভবনের দূরত্ব বেশি নয় কিন্তু সমস্যা অত সকালে বাসার নাস্তার অপেক্ষা করলে নির্ঘাত ক্লাস মিস্ হবে ভেবেই পপুলার হোটেলেই সকালের নাস্তা সারতে হতো।
তখনকার দিনে বুয়েট, মেডিকেল, ঢাবি ছাত্রদের কাছে খুবই প্রিয় ছিল এই হোটেল। এত সস্তা ছিলো যা এখন গল্প করলে সবাই পাগল বলে মনে করবে। যাই হোক নাস্তা করেই রিক্সা ধরতাম ভাড়াও যত সামান্য। চার আনা দিলে কলা ভবনে চলে আসা যেত পপুলার থেকে।

কলা ভবনের কাছে আসতেই কেমন যেন পরিবেশটা গোলমেলে মনে হলো। চারিদিকে ছোট ছোট জটলা আর চাপাস্বরে কথা বার্তা, কেমন করে হলো? কে করলো? কারা করালো?
এর কিছুদিন আগে সামসুন্নাহার হলের সামনে রাতে কাউকে এনে নির্জনে গুলি করে ফেলে রেখে গিয়েছিলো বিশেষ বাহিনীর লোকেরা। পরে জেনেছিলাম মতিঝিল কলোনীর এক সন্ত্রাসী, এলাকায় নানা বিঁধ অপরাধ করে বেড়াতো, জনৈক পিয়নের সন্তান। তখন এসপি মাহবুব ঢাকার এসপি। দোর্দণ্ড প্রতাপ। এমন ক্ষমতাধর পুলিশ কর্মকর্তা দেশে দ্বিতীয় ছিলো কিনা জানি না। বঙ্গবন্ধু তাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তা ছাড়া পারিবারিকভাবেও উনার খুব কাছের লোক ছিলেন।

তার উপর দায়িত্ব ছিলো ঢাকা শহরের সন্ত্রাস মুক্ত করার। বিশেষ ঐ কাজের জন্য তখন সার্জেন্ট কিবরিয়ার নেতৃত্বে একটা প্রশিক্ষিত দল কাজ করতো। এবং সত্যিকারেই তখন ঢাকা শহরের সন্ত্রাসী মূলক কাজ একদম বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো বলা চলে।
কলাভবনে ঢোকার মাথাতেই সিঁড়ির কাছে আলমের সাথে দেখা, খুবই বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সাথে দীর্ঘ দিনের সখ্যতা। দৌলতপুর বিএল কলেজে বিএসসি পড়েছি এক সাথে। উদ্বিঘ্ন হয়ে জিজ্ঞাস করলেই টেনে এক পাশে নিয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে।
মহসিন হলে রাতে কোহিনুরসহ ৭ জন ছাত্রকে বা কারা গুলি করে মেরেছে। চমকে উঠার মতোই খবর।

আর কলাভবনে ঢোকা হলো না, চোখের সামনে ভেসে উঠলো কোহিনূরের চেহারা, লম্বা, মাথায় চুল একটু কম। কলাভবনের একতালায় অনেক সময় দেখেছি ওঁকে। সক্রিয় রাজনীতি করতো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সাথে। অন্যান্যদের তেমন চিনতাম না কোহিনুর ছাড়া।
আলমকে নিয়ে মহসিন হলের দিকে সোজা পথ ধরলাম, মলের ভিতর দিয়ে আড়াআড়িভাবে। সূর্যসেন হল ডানে রেখে মহসিন হলের গেটে চলে এলাম। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে কেউ ঢুকছে আবার কেউ কেউ বিমর্ষ চেহারা নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে।
কলাপসিবল গেট দিয়ে ঢুকতেই লিফ্টের সামনে চাপ চাপ রক্ত তখনো জমাট বেধে আছে। মৃতদেহ পুলিশ নিয়ে গেছে। হল কর্তৃপক্ষ রক্ত পরিস্কার করার ব্যবস্থা করছে। রক্তহিম করার মতো ঘটনা। জলজ্ব্যান্ত সাতজন ছাত্রকে অস্ত্রের মুখে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে সামনা সামনি গুলি করে মারা। কত মর্মান্তিক ঘটনা। কি ভাবে পারলো একজন ছাত্র নেতা হয়ে জলজ্যান্ত সাতটা ছাত্রকে মেরে ফেলতে, এরা কি মানুষ?

কে যেন একজন বলল, বিদ্যুত তো রাতে মহসিন হলে সোহেলের রুমে ছিলো। খুঁজলাম সারা এলাকা, ডিপার্টমেন্ট কোথাও নেই। কিন্তু ওঁকে তো দরকার। সোহেলও নাই। কে যেন বলল, কারা যেন রাতে সোহেলকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো। তাহলে সে আবার নিহতদের লিষ্টে নেই তো?
আলমের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলাম দুপুরে বিদ্যুত এর বাসায় যাবো। দুপুরে জহুরুল হক হলে আলমের সাথে কোন মতো একটু খেয়ে রিক্সায় বাসাবোর পথে রওনা দিলাম বিদ্যুত এর বাসায়।
ধীরে ধীরে উন্মোচিত হলো সব কিছুই। ক্ষমতাসীন দলের দুই উচ্চ স্তরের নেতার প্রভাব বিস্তারের যুবকাষ্ঠে বলি হলো তরতাজা সাতটা প্রাণ, হারিয়ে গেলো পৃথিবীর বুক থেকে।
আসামীরা কিছুদিন বন্দী হবার পর পুলিশ হাসপাতালের রুমে কয়েক মাস কাটিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। কয়েকদিন সোহেলের সাথে দেখা করতে হাসপাতালে যেয়ে ঘটনার অদ্যপান্ত শুনে স্তম্ভিত হয়ে যেতাম। এই হলো আমাদের রাজনীতি আর বরেণ্য নেতারা।
পরবর্তিতে এরা সবাই খালাস পেয়ে গেলো। সাতটা তরতাজা প্রাণের মূল্য এদের কাছে কি কিছুই না?

এরাই মহান দেশের মহান নেতা, ক্ষমতার জন্য এরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই। যে নেতা নিজ হাতে ষ্টেনগানের ব্রাশফায়ারে সাতটা তরতাজা প্রাণের জীবনের আলো নিভিয়ে দিলো সেই তিনিই পরবর্তিতে জাতীয় সংসদের সদস্য হয়ে এলাকার মুখ উজ্জ্বল(!) করেছিল। হায়রে ক্ষমতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড তখন আবর্তিত হতো টিএসসিকে কেন্দ্র করে। অবসরে প্রায়ই দোতলায় এসে ফিরোজ সাঁই, ফকীর আলমগীরের গান শুনতাম গানের আসরে।
স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে সংগীত জগতে ঢেউ তোলে পপ্ গানের বিশেষ কয়েকজন তরুণ আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফকীর আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ আরো বেশ কিছু তরুণ। এক ধরনের সখ্যতা হয়ে গিয়েছিলো এদের সাথে। প্রায় রোজই দুপুরের পর ওখানে গান শুনতে যেতাম।

একদিন একটু দেরী হয়ে গিয়েছিলো আমার ওখানে যেতে, জানি বিদ্যুত আলমকে পাবো ওখানে। ধীরে ধীরে সিঁড়ির মাথার ডানের রুমে যেয়ে ঢুকলাম। কেমন যেন একটু খটকা লাগলো বিদ্যুতকে দেখে। কেমন যেন শূন্য দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাচ্ছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে, কিন্তু মনে হচ্ছে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছে না। বুঝে ফেললাম আসরে বসে যা হবার তাই হয়েছে। তবে একটু বেশি হয়ে গেছে।

আলম আমাকে দেখে উঠে এলো, ওর কথা শুনে ওঁকে বিদ্যুত এর কাছে বসিয়ে রেখে ছুটলাম মধুর কেন্টিনে ‘লেবু’র সন্ধানে। শুনেছি লেবু খেলে নাকি একটু পর ভালো হয়ে যাবে। লেবু চা’র জন্য ওরা লেবু রাখতো।
তখন তরুণ সমাজের মধ্যে নেশার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। ড্রাগসের হাতছানি এড়ানোর মতো ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমন কারো ছিলো না। সেডেক্সেন ৫ এর পর সবচেয়ে মারাত্মক একটা ছোট্ট লাল রংয়ের ক্যাপসুল পাওয়া যেতো। যেটা খেলে টানা দুই দিন যে কেউ ঘুমিয়ে থাকবে। ভয়ঙ্কর সেকনেল সোডিয়াম এর থাবাতে সবাই ভীতও।

এক সিনিয়র বন্ধু (বর্তমানে আমাদের জেলার প্রখাত আইনজীবি) বিষয়টা বিশ্বাস করলেন না, পরীক্ষামুলকভাবে খেয়ে তাকে নিয়ে পরে কি ঝামেলাতেই যে পরতে হয়েছিল দুদিন। চতুর্থ দিন দেখা উনার সাথে শাহবাগে।
বন্ধু সামাদ তো ব্রিটিশ কাউন্সিলের ভিতরের লনে ঘুমিয়েই পড়লো । পরে বিকেলে সবাই ধরে নিয়ে আবু সাঈদ হলে ওর রুমে রেখে এলাম। পরে এই বন্ধুটি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে চাকুরী শেষে এখন অবসরে আছে।
স্বাধীনতার কয়েক বছরের মাথায় পাকিস্তান থেকে ঢাকায় চলে আসেন সংগীত শিল্পী রুনা লায়লা। আসাদ গেট পার হলে বাম পার্শেই তাদের পৈতৃক দোতলা বাড়ি। রুনা লায়লার বাবা সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সারা সময়টা সে পাকিস্তানেই ছিলো, দেশে আসার পর কোনো গানের অনুষ্ঠানে তাকে কেউই ডাকছিলো না। একটা অস্ততিকর সময় তখন তার সংগীত জীবনে। স্বাধীনতার পক্ষের শিল্পীদের ভিতরে একটা চাপা গুঞ্জন কাজ করছিলো। তাকে নেওয়া যাবে না কোন গানের আসরে।

এমনি একটা অস্থস্তি অবস্থার অবসান ঘটালো শেখ কামাল। সারা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক অংগনে তার একটা শক্ত অবস্থান ছিলো। ভালো ক্রিকেট খেলোয়ার ছাড়াও নাটকেও সে সমান পারদর্শি ছিলো। সব মানুষেরই ভালো ও মন্দ গুন থাকে। তবে যার যেটা ভালো সেটা সবসময়ই স্বীকার করা উচিত বলে আমি মনে করি।
টিএসসির এক অনুষ্ঠানে রুনা লায়লাকে নিজে গাড়ি করে এনে গান গাওয়ান।
সবাই যখন রুনার গান গাওয়ার ব্যাপারে অলিখিত বাঁধা সৃষ্টি করেছিলো এ ঘটনার পর আর কেউই কোনো কথা বলতে পারলো না। সেই প্রথম টিএসসির অডিটোরিয়ামে রুনা লায়লার বাংলাদেশে প্রথম সংগীতানুষ্ঠান।
শেখ কামালের সাথে বিভাগীয় নির্বাচন নিয়ে আমাদের মধ্য একটা বিরাট ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলাম সে যাত্রায়। (এর অনেক ঘটনা জানতো আমার বন্ধু পুনু।) অঘটনটা হয়নি আমাদের বন্ধু মুস্তাফিজের কারণে।
সেটা না হয় অন্য দিন বলবো। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, আমেরিকা

Exit mobile version