Home কলাম হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৪০

হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৪০

ইউসুফ কামাল : কবে তুমি গেয়েছিলে আঁখির পানে চেয়েছিলে
ভুলে গিয়েছি শুধু মনের মাঝে জেগে আছে ঐ নয়নের তারা।
বোধ হয় এমনই হয়। কোনো পূর্ব চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই একটা অনুভূতির জন্ম হলো, যেটা নিয়ে ভাবলেই কিছুটা আশ্চর্যই হতে হয়। এমনি করেই বোধ হয় জীবনের নানা রকমের স্মরণীয় ঘটনাগুলো ঘটে যায়। যার কোনই পূর্ব প্রস্তুতিই থাকে না। এখন তো তারার মতোই মনের মধ্যে জেগে থাকা। সেই কবে কার কথা আসলে কি ভুলে গিয়েছি? ভুলে যাওয়া কি সম্ভব? মানুষ কিছু জিনিষ কখনোই ভুলতে পারে না, যেটা সারাজীবনই মনের মধ্যে অনুরণিত হয়। হৃদপিন্ডের ধুকধুকানির মতো সমস্ত সত্বাকে জীবন্ত করে রাখে, জানান দিয়ে যায় তার সরব উপস্থিতির কথা-হাজারো তারার ভীড়ে ঈশান কোণের ঐ উজ্জ্বল তারাটাই সারারাত জেগে থাকে, যেন সারা আকাশটাকে সেই-ই পাহারা দেয়। মানুষের জীবনটাও অমনি, কেউ না কেউ তো অলক্ষ্যে সারা জীবন ভর পাহাড়া দেয়ই। কতটুকুই বা মানুষের সময়, সারা জীবনে কতটুকুই বা সে একান্ত নিজের জন্য ব্যয় করতে পারে?

জীবনে প্রথম ভালোবাসতে শেখাটাও শিশুকালের হাঁটতে শেখার মতোই। এক পা দু’পা করে হাঁটতে শুরু করার পর, ধীরে ধীরে হাঁটাটা পুরোপুরি রপ্ত হয়ে যায়। তেমনি করেই ভালো লাগার বিষয়গুলোও তাই, ভালো লাগা মানুষটার প্রাত্যহিক চালচলন, সংবেদনশীলতা ভালো লাগার মুখ্য ভ‚মিকা পালন করে। পরবর্তিতে সমস্ত দ্বিধাদ্ব›দ্ব কাটিয়ে চরম সিদ্ধান্তে উপনিত হয়। বিষয়টা উভয় উভয়ের মধ্যে পরিপূরকের মতোই কাজ করে। কালো ডায়ালের ঘড়িটা যে এমন চমত্কারভাবে মানিয়ে যাবে সেটা প্রথমে বুঝিনি। অসাধারণ একটা খুশীতে ঝিলমিলিয়ে উঠলো ওর চোখ মুখ। খুব পছন্দ হয়েছে বোঝা গেলো। চোখটা একটু ভারী হয়ে এলো খুশীর আবেগে। যা অতি আনন্দেরই বহি:প্রকাশ।
তুমি মোর আনন্দ হয়েছিলে আমার খেলায়
আনন্দে তাই ভুলে ছিলেম কেটেছে দিন ফেলায়।

মনটা যখন ওর খুব ভালো থাকে, নিজের মুখ থেকেই বেরিয়ে যায় ভালো লাগা গানের কয়েকটা কলি। এটাও খেয়াল করেছি গানের ভাষাটাও তাত্ক্ষণিক মুহূর্তের সাথে যেন প্রতিবিম্বের মতোই কাজ করে। মনে হয় এটা যেন ওর বুকের গভীর থেকে ছলকে ওঠা সুখের একটা চিহ্ন। দীর্ঘ ছুটির পর মনে হলো এতো দিনের রুদ্ধদ্বার যেন খুলে গেলো। বল্লো, চিরপরিচিত সমস্ত পরিবেশ যেন কেমন একটা শ্বাসরুদ্ধ অপরিচিত মনে হতো। আমার এই হঠাত পরিবর্তনে পরিবারের অন্যান্য সবাই কেমন যেন বিব্রত বোধ করতে শুরু করেছিলো। চির পরিচিত মানুষগুলোকে আর আগের মতো কাছের মানুষ মনে হতো না, এমন তো হবার কথা ছিলো না। কিন্তু বাস্তবে হয়েছিলোও তাই। এ অবস্থায় সমস্ত চিন্তা চেতনা একজনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। খুব আস্তে বল্লো, আমার বেলায় সেটা কে, তুমি বলতে পারবে? হেসে বল্লাম, পারলেও বলা কি ঠিক হবে! কপট ভান করে বল্লো, পারবেই না জানি, পারলে তুমি বলতে। তোমাকে আমি চিনে ফেলেছি। বলেই জোরে হেসে উঠলো। সুন্দর মুহূর্তটা মনের খাচায় বাঁধা পড়ে রইলো। ক্ষণিকের জন্য হলেও ওর মনটা ভালো হয়ে উঠলো। ওর মন ভালো করতে পেরে ভালোই লাগলো। একটু থেমে বল্লো, মায়ের শরীরটাও একটু সমস্যা করছে, কারণে অকারণে অসুস্থতা বোধ করছে। বড় ভাই তার ব্যবসা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে, মায়ের দিকে কে খেয়াল রাখবে? এ সব ক্ষেত্রে মেয়েরাই মায়ের কাছের বন্ধুর মতো হয়ে যায়। মায়ের জন্য কষ্ট লাগে, বাবা বিদেশে পড়ে থাকেন ঠিক মতো যোগাযোগ হয় না। বল্লাম, উনি দেশে আসেন কত দিন পর পর? দীর্ঘশ্বাসসহ বুলার কন্ঠে যেন আবেগ ফুটে বেরুলো, প্রতি বছরে একবার, আগে আসতেন দুই বার।

সবাইকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন কিন্তু সেটা বাধাপ্রাপ্ত হলো মার জন্য। মা কখনোই বিদেশে যেতে চাইলেন না, তিনি চাইছিলেন বাবা দেশে চলে আসুক। মা কেন যেন জেদ ধরে বসে থাকলেন। বাড়ীঘড়, নিজের সাজানো ঘড় সংসার ছেড়ে কোথাও যেতে চাইলেন না। মানুষের জন্যই তো সংসার, সংসারের জন্য যে মানুষ না এটা আমার মা বুঝলেনই না। অথচ দেখো অদৃষ্টের কি পরিহাস, বড় ভাই নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যাস্ত এ দিকে আমি পড়াশুনার জন্য ঢাকা। মা তো সেই একাই হয়ে গেলেন। আমি আর একা কি করতে পারি! একে বারে টিপিক্যাল বাঙালির চরিত্র। বাবার যুক্তি দেশে যেয়ে আশানুরুপ চাকরী পাবেন না, দীর্ঘ দিন বিদেশে কাটানোর ফলে মন মানসিকতার ও একটা পরিবর্তন হয়েছে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। বুঝলাম পিতা-মাতার মানসিক টানাপোড়নে দূরত্বের প্রতিফলন পড়েছে মেয়ের উপর। বাবার প্রসঙ্গ উঠাতে একটু বিমর্ষ হয়ে গেলো বুলা। বাবার সাথে মেয়ের সম্পর্ক সব সময়ই খুব মধুর হয়, এত সুমধুর সম্পর্ক আর কোথাও পাওয়া যায় না। একটু থেমে আবার বল্লো, দীর্ঘ দিন দেখা হয় না বাবার সাথে। কথাটার সাথে সুন্দর ফর্সা মুখটা একটু বিষাদময় হয়ে উঠলো। পরিস্থিতি সহজ করার জন্য বল্লাম, চলো চা খেয়ে আসি। হাঁটতে হাঁটতে লাইব্রেরির সামনে চলে এলাম। বল্লাম, আজকে তুমি টায়ার্ড, চা খেয়ে হলে যাবে। গোসল খাওয়া দাওয়া সেরে একটা ঘুম দেবে। রাতে লঞ্চে ভালো ঘুম না হবারই কথা। কালকে চারুকলার প্রদর্শনী দেখতে যাবো, চারুকলার লিচুতলাটা ওর খুব পছন্দের একটা জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কাছের বলে মাঝে মাঝে হাঁটতে হাঁটতে ঐ জায়গাটায় দুইজন যেয়ে বসতাম।

ঢাকা শহরের এত ব্যাস্ততম একটা এলাকায় এমনি ঘুঘু ডাকা শান্ত পরিবেশ পাওয়াই যায় না। কথাবার্তায় বাবার কথা উঠলেই ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় পড়া একটা মেয়ে, পরিবারের ভালো-মন্দ দু:খ সবই বুঝতে পারে। মায়ের কষ্টটা ও খুব কাছের থেকে দেখেছে। সংসারের প্রধান পুরুষ যখন জীবিকার কারনে বাইরে থাকেন তখন গৃহকর্তীর উপরে নানাবিধ চাপ এসে চাপে আর তাতেই মানসিক ভারসম্য নষ্ট হয়। তাছাড়া ছেলে মেয়েরা বয়স হয়ে গেলে খুব স্বাভাবিক কারণেই মায়ের পক্ষাবলম্বন করে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু তবু দেখলাম বুলার টান’টা ওর বাবার জন্য আনুপাতিক হারে একটু বেশি। বাবার কথাই বেশি করে বলে আমাকে। পাক-ভারত স্বাধীনতার পরের বত্সর জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হকসহ মোট ছয়জন মিলে ইন্সষ্টিটিউট অব আর্ট এন্ড ক্রাফ্টস্ নামে জনসন রোডে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এটাই এতদ্বঅঞ্চলের প্রথম এই ধরনের কলেজ। তখন এটাকে আর্ট কলেজ বলা হতো। পরে সেগুন বাগিচায় আর সর্বশেষে শাহবাগের বর্তমান স্থানের নিজস্ব ভবনে এর কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ কলেজ অব আর্ট এন্ড ক্রাফ্টস নামে পরিচিত হয়। এখান থেকে পড়াশুনা করে দেশ বরেন্য অনেক শিল্পী এখন দেশ ও বিদেশে ছড়িয়ে আছেন । ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়রে অধীনে এটাকে ফ্যাকাল্টি অব আর্ট নামে ঘোষণা করা হয়। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউষ্টন, টেক্সাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

Exit mobile version