ইউসুফ কামাল : এগারোটার দিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফকার বিমান পৌঁছে গেলো তেজগাঁও বিমানবন্দরে। ড্রাইভার করিম মিয়াকে আগেই বলা ছিলো ওঁকে দেখলাম গাড়ি নিয়ে হাজির। বিশ্ববিদ্যালয় হল ছুটির বন্ধ, তবু দু’এক জন অভাগা হলেই থেকে যায়। কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না তাই ঈদের দিনটাও ঘুমিয়েই পার করে দেয়। বিদ্যুৎ বাংলা মোটর থেকে বেবী ট্যাক্সি ধরলো বাসাবো যাবে বলে, আলম জহুরুল হক হলে আর সিকান্দর কে এস এম হলে নামিয়ে আমি বকশীবাজার বাসায় চলে এলাম। পরদিন আলম খুলনা আর সিকান্দর কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী চলে যাবে। গোসল করে দিলাম লম্বা ঘুম, ভাবলাম কাল সকালেই রাজবাড়ী যাবো।

রোজার দিন সকাল সকাল যাওয়াই ভালো হবে। ৫/৭ দিন পর ঈদ, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরে একটা সেমিষ্টার পরীক্ষা। কিছু খাতা বই ব্যাগে ভরে নিলাম। তখন ঢাকা কলেজের সামনে থেকে ভাড়ায় ট্যাক্সী চলতো আরিচা পর্যন্ত। গাদাগাদি করে যাত্রী তুলতো আর যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা ছিলো গুলিস্তান থেকে বি আর টি সির লোকাল বাস সার্ভিস। ওটা ছিলো খুবই কষ্ট কর তাই ওটা সব সময়ই পরিহার করতাম। আরিচা থেকে লঞ্চে পার হয়ে ওপার থেকে টেম্পু বা বেবী ট্যাক্সি। মোটামুটি ঘন্টা চারেকের পথ। ছোট্ট মহকুমা শহর, স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে সারা দেশের মতো এখানেও এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা কাজ করছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য জাসদ গণবাহিনী সৃষ্টি করে দেশের মধ্যে ক্রমাগত অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে। সরকারি দলের কর্মীরাও আতংকে দিন পার করে, বিশেষ করে রাতের বেলায় আমার অনেক বন্ধুই বিশেষ নিরাপত্তা নিয়ে ঘুমায়। যা কখনোই কারো কল্পনাতেই ছিলো না। সরকারি দলের মধ্যেও গ্রুপিং এর কারণে পাল্টাপাল্টিভাবে একে অন্যের শক্তি খর্ব করায় ব্যাস্ত। সবাই যার যার ক্ষমতা বাড়াতে ব্যাস্ত, কিন্তু ভিতরে ভিতরে এর জন্যে যে এরা কতো নি:স্ব হয়ে পড়ছে সেটা কখনোই বোঝে না। ঈদের ছুটিতে ধীরে ধীরে মানুষ দেশের বাড়িতে আসা শুরু করেছে। বন্ধুরা যারা অন্যান্য জায়গা চাকুরী করে তারাও আসা শুরু করলো, রাজশাহী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যরত বন্ধুদের অনেকদিন পর দেখা পেয়ে ভালোই লাগলো। ছেলেবেলার বন্ধুদের সাহচর্য সব সময়ই উপভোগ্য, সেটা বয়:বৃদ্ধির সাথে আরো বেশি করে বোঝা যায়। একটা নির্দিষ্ট বয়স হয়ে গেলে বয়স্ক মানুষেরা গল্প গুজবে সময় কাটাতে চায় আর তাতে মনের দিক থেকেও দুশ্চিন্তা মুক্ত হয় আর পাশাপাশি মনটাও হাল্কা হয়। দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন দীর্ঘায়ু জীবনের জন্য একটা অপরিহার্য বিষয়।

পরিবারের বয়স্ক মানুষকে সাধারণত: সবাই এমনকি পরিবারের মানুষও একটু এড়িয়ে চলতে চায়, যাতে বয়স্ক মানুষেরা স্বাভাবিক কারণেই একটু হীনমন্যতায় ভোগে। ‘ওল্ড হোম’ এর মূল চিন্তা ধারাটা মনে হয় এখান থেকেই শুরু হয়েছে। পশ্চিমা দেশে বয়স্ক মানুষের অনেকে ইচ্ছা করেই সিনিয়র সিটিজেন হাউসে চলে যায়। যে খানে স্বাস্থ্য ও খাদ্যের সাথে নানা রকম মন ভালো করার প্রোগ্রামের ব্যবস্থাও তাঁরাই করে দেয় যাতে কেউ একাকীত্বে না ভোগে। এটা ‘সোশাল সিকিউরিটি’ ডিপার্টমেন্টের কাজের মধ্যেই পড়ে। দীর্ঘ দিন বাস করে দেখেছি আমেরিকার নাগরিকদের প্রত্যেকের একটা করে সোশ্যাল সিকিউরিটি নাম্বার আছে, আর ঐ নাম্বারে ঢুকলে তার আদ্যপান্ত সব কিছুই জানা যায় অর্থাৎ পরিচয়, ঠিকানা, ব্যক্তিগত কর্মকান্ড এক কথায় সব কিছু। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও সিনিয়র সিটিজেন হাউসে সপ্তাহান্তে এসে দেখা করে যায়, এটা সবাই সহজ ভাবেই মেনে নেন। কিন্তু আমরা এগুলো মানিয়ে নিতে পারি না, আমরা বড় বেশি অনুভূতি ও আবেগ প্রবণ মানুষ। সব সময় সবাইকে বুকের মধ্যে আগলে রাখতে চাই।

জাতি হিসাবে তাই আমরা বড়ই দুর্বল চিত্তের ও ভালোবাসার কাঙাল। মনে আছে প্রায় সতেরো বছর আগে যখন প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসি একদিন ভোর বেলায় হাঁটার সময় পরিচয় হয়েছিলো মিসেস এলিজাবেথ এর সাথে। নি:সঙ্গ এলিজাবেথ ভোরে একা হাঁটেন, আমার আবাসস্থলের পাশেই থাকেন। স্বামী মারা যাওয়ার পরও ভেঙ্গে পড়েননি। একদিন হাঁটার সময় দেখি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন, মনে হলো অসুস্থ বোধ করছেন। এগিয়ে গেলাম জিজ্ঞেস করলাম কোন সাহায্য লাগবে কি না, উনি হেসে বল্লেন ঠিক আছেন। পরে আলাপে জানলাম বৃদ্ধা মহিলা একাই থাকেন সঙ্গী একমাত্র কুকুর। এখানে কুকুরের সাহচর্যে অনেকেই নিজেকে নিরাপদ মনে করে।

স্বামীর মৃত্যুর পর বড় বাড়ি ছেড়ে কন্ডোমোনিয়াম নিয়ে একাই থাকেন। বড় বাড়ি রক্ষনাবেক্ষন করা কষ্টকর ও ব্যায়বহুল ব্যাপার। ছোট্ট বাড়িতেই অনেক সুবিধা তাই বড় বাড়ি বিক্রী করে দিয়েছেন। একমাত্র পুত্র টেক্সাস থাকে, বছরে একবার এসে দেখা করে যায়। রবিবার একাই গাড়ি চালিয়ে চার্চে যান, লাইব্রেরিতে বই আনতে যান আবার প্রয়োজন মতো মার্কেটে যান গ্রোসারী কিনতে। জীবনটাকে এভাবেই এরা মানিয়ে নিয়েছেন।

এই তো জীবন, নি:সঙ্গ জীবনে অনেকে মারা যাওয়ার ৩/৪ দিন পর ঘরের দরোজা ভেঙ্গে পুলিশকে মৃতদেহ বের করার অনেক ঘটনা শোনা যায়। কারো উপর বোঝা না হওয়ার মতো মানসিক দৃঢ়তা সবার থাকে না, আর্থিক স্বচ্ছলতা যথেষ্ট থাকার পরও পারে না। এটা একটা ব্যক্তিত্বের ব্যাপারও বটে। দুই দিন পার হয়ে গেলো একটা ফোন করা হলো না ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো, ইনডেক্স বুক থেকে নাম্বারটা নিয়ে ১৭ এ কল বুক করলাম বুলার বাসায়। আমার দীর্ঘ দিনের পরিচিত এক্সচেঞ্জ অপারেটর মিজান ভাই পাঁচ মিনিটেই লাইন দিয়ে দিলেন। সম্ভবত ওর মা ফোন ধরলেন বুলার কথা বলতে একটু ধরতে বল্লেন। একটু আশ্চর্যই হলাম, নাম পরিচয় কিছুই জানতে চাইলেন না। তবে কি বুলা আমার কথা ওর মা’কে বলে দিয়েছে? হতেও পারে। ওপার থেকে গলা শুনে বুঝলাম, ঘুম থেকে উঠে এসে ফোন ধরেছে। একটু অবাক কন্ঠে জানতে চাইলো, কবে এসেছো, তুমি কি ঢাকা? এত সকালে? মনে হলো রোজা রাখার জন্য হয়তো রাতে সেহরী খেয়ে ঘুমিয়ে ছিলো, মা’র ডাকে তড়িঘড়ি করে এসে ফোন ধরেছে। বল্লাম, আমি তো বাড়িতে, কেমন আছো তুমি? দুই দিন হলো রাজবাড়ী এসেছি। ও একটু ক্ষোভের স্বরে বল্লো, দুই দিন হলো এসেছো আমার এত কাছে, না হয় দেখা হবে না তাই বলে আমাকে জানালেও না। সত্যিই তো এতো কাছে তবু তো দেখা হচ্ছে না, তা হলে কাছে এসে বা কি লাভ হলো!

ভারতে থাকার সময় মনে হতো কত দূরে আছে, এখন অনেক কাছে তবু তো দুরত্ব ঘুচলো না। তবে কি পথের দূরত্ব কমলেও মনের দূরত্ব থেকেই যায়, যেটা ইচ্ছা করলেও বিধি নিষেধের কারণে ঘুচানো যায় না? বল্লাম, তুমি সত্যিই ভালো আছো তো নাকি শুধু মুখেই বলছো, সত্যি করে বলো তো!

বল্লো, তুমি সামনে থাকলে হয়তো দেখে বুঝতে, কিন্তু না দেখেও কি তোমার মন দিয়ে বুঝতে পারছো না আমি কেমন আছি! আমি কি এমতাবস্থায় ভালো থাকতে পারি?
কথাটা বলা হয়তো সঠিক হলো না একটু চিন্তা করে বল্লাম, বুঝেছি।

আমি প্রশ্ন করার জন্যই হয়তো প্রশ্ন করেছি, কথা বলার জন্যই হয়তো বলেছি – এটা বলা কি আমার ঠিক হয়েছে, নিজের কাছেই প্রশ্ন করলাম। বল্লো, বিশ্ববিদ্যালয় ঈদের চার দিন পর খুলবে, তুমি ঈদের তিন দিন পর চলে যেও। আমিও তিনদিন পর চলে যাবো। ঈদের দিন দুই পর হল খুলে যাবে। চলে আসবে কিন্তু। আর শোনো, একদিন পর পর ফোন করবে না হলে আমি কিন্তু সত্যিই তোমার বাসায় ফোন করবো। ভাবলাম, সত্যিই বুলা ভালো নেই।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউষ্টন, টেক্সাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র