ইউসুফ কামাল : মোটামুটি কারোল বাগ আর আশে পাশের কিছু ঘুরে সবাই সিদ্ধান্তে আসলো কাল সকাল সকাল বের হতে পারলে কুতুব মিনার টা দেখা যেতে পারে। বিকালের দিকে কোলকাতা ফেরার ট্রেন, সকাল সকাল রওয়ানা দিলে ১২/টার দিকে ফিরে আসা যাবে। সিকান্দর যদি উঠতে পারে ভালো না হলে ওকে বাদ দিয়ে আমরা সাত’টার মধ্যে বের হবো। তাতে ওর খুব একটা আপত্তি মনে হলো না। এতো ঘুম কাতর মানুষ আর হয় না, ঘুম ছাড়া যেন সব কিছুতেই ওর অনীহা। তেওয়ারীকে একটা ট্যাক্সির কথা বল্লাম কাল সাত টায় কুতুব মিনারে যাওয়ার জন্য আর সাথে সকাল সাড়ে ছ’টায় রুমে ফোন দিয়ে আমাদের কে জাগিয়ে দিতে বল্লাম। দেখলাম ভদ্রলোক ঠিকই নোট সীটে লিখে রাখলেন, এটাই হলো উত্তম সেবার নমুনা। ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের আদেশেই কুতুব মিনারের কাজ শুরু হয়।

প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করার পর একতলা পর্যন্ত করার পর আইবেকের মৃত্যু হয় পরবর্তিতে চার তলা পর্যন্ত শেষ করেন ফিরোজ শাহ্ তুঘলক। ভারতীয় মুসলিম স্হাপত্যের গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হিসাবে কুতুব মিনার গুরুত্বপূর্ণ। মোট উচ্চতা ২৩৮ ফুট। মিনার ক্রমশ: মোটা থেকে সরু হওয়ার প্রধান কারন তার ভারসাম্য রক্ষা করা। মিনার লাল বেলে পাথরে তৈরী, যার গায়ে পবিত্র কোরআন শরীফের আয়াত খোদাই করা । কামরাংগার ভাঁজের মতো করে নিপুন ভাবে তৈরী করা হয়েছে যার মাঝে মাঝে বারান্দা আছে। জনশ্রুতি আছে ওখান থেকে সম্রাট ও তাদের নিকটস্থ স্বজনেরা সূর্যাস্ত ও সূর্যদয় দেখতেন। ভিতর দিয়ে ওপরে উঠার সিঁড়ি ছিলো, সেটা এখন বন্ধ করে দিয়েছে নিরাপত্তার কারনে। কয়েকবার বজ্রপাতের কারনে এটার ভিতরের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কাউকেই আর এখন ঢুকতে দেয় না।

কারোল বাগ থেকে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌছে গেলাম। পথের মধ্যে রাস্তার পাশের ছোট দোকান থেকে চা খেলাম, সিকান্দরের ঘুম ভাংগানোর জন্যেই মূলত: চা পর্ব। সকালের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। দিল্লীর আবহাওয়া সাধারনত: শুকনো প্রকৃতির বেশী হাঁটলেই ক্লান্ত হয়ে যেতে হয়। মোটামুটি ঘুরে একটা গাছের নীচে দাড়িয়ে কথা বলছিলাম রোদ থেকে দুরে সরে থাকার জন্যে। পাশ দিয়ে একটা অল্প বয়স্ক মহিলা হাটছিলেন সাথে ছোট বছর সাতেকের মেয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন, পরিস্কার বাংলায় বল্লেন, ভাইয়েরা কি বাংলাদেশের? সবাই ঘুরে তাকালাম। আলাপে জানলাম কুষ্টিয়ায় আদি বাড়ী। পিতা ওখানের আওয়ামীলীগের বড় নেতা। বিয়ের পর থেকেই দিল্লিতে থাকেন। স্বামী ভদ্রলোকও এগিয়ে এলেন পরিচয় হলো, এখানে ব্যাবসা করেন। কথার মধ্যে একটা বিষয় পরিস্কার বল্লেন, বাংগালির সাথে এখানকার স্হানীয়দের বৈষম্যের কথাটা। দেশী বলে বলেই ফেল্লেন, এখানকার লোকেরা পারত: পক্ষে আমাদের সাথে কথা বলেন না। ভাবলাম এটা কি তবে সারা দুনিয়ার স্হানীয় অস্হানীয়দের চির দিনের সমস্যা? চলে যাওয়ার সময় ছোট মেয়েটার হাত নেড়ে বিদায় জানানোর দৃশ্য টা এখনো চোখে ভাসে, বার বার ঘুরে ঘুরে হাত নেড়ে বিদায় জানানোর দৃশ্যটা। ও কি বুঝতে পেরেছিলো ওর মাতৃভূমির মানুষের হ্রদয়ের উষ্মতা কে। নাকি ছোট্ট মেয়েটা নিজেকে ও তার মূল শিকড়ের মানুষদের সাথে নিজের অস্তিত্বকে মিলিয়ে নিলো।

সাধারনত: শুক্রবার চার’টার দিকে বুলা চলে আসতো ওর হল থেকে। এটা মোটামুটি একটা নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছিলো। টি এস সির সীমানা দেয়ালের ভেতরের মেইন গেটের পাশের পাকা ফ্লোরে বসতাম। আঁশে পাশে অনেকেই বসতো, আবার সন্ধ্যে হলেই যে যার মতো হলে চলে যেতো। আড্ডার প্রধান উপকরন ছিলো টিনের কৌটোর ঝাল মুড়ি, আর চা খেতে হলে শরীফ মিয়া। হাটতে হাটতে শরীফ মিয়ার দোকানের সামনের বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি র বারান্দার বসলাম হাতের ইশারায় দু’কাপ চায়ের কথা বল্লাম। চেহারা দেখে মনে হলো দুপুরে একটা লম্বা ঘুম দিয়েছে, চোখে তখনো ঘুমের চিহ্ন বোঝা যাচ্ছে। অসাধারন লাগছে। গুন গুন করে অস্পষ্ট স্বরে গান গাইছে, হেসে বল্লাম ,একটু ভলিউম বাড়ানো যায়? মুখটা ঘুরিয়ে তাকালো বল্লো, শুনবে? বল্লাম, আস্তে আস্তে গাও, ভালোই লাগছে। ভলিউম বেশী হলে কিন্তু লোক জমে যাবে। বুঝলো কি বলতে চাইলাম, অপূর্ব একটা হাসির ঝিলিক চোখে মুখে। অদ্ভুত একটা বিষয় লক্ষ্য করতাম আমার কাছে কখনোই ওর জড়তা কাজ করতো না। কতো সহজ ভাবে কথা বলতো সেটা সত্যিই অসাধারন। গুন গুন করা গানটাই গাইলো নরম স্বরে …

হয়তো অনেক কথা দিয়ে যাও আমার মনের কথা নিয়ে যাও
দুটি হ্রদয়ের কথামালা হ্রদয়ে গাথা থাকে পড়ি না পড়াতে পারি না।
তুমি কি যে বলো বুঝি না তোমার মুখের পানে চাহিলে আমি কিছু শুনি না
তার চেয়ে চোখে না হয় রাখো চোখ এ ভাবেই দু’জনার কথা হোক
শুধু বুক ভরা ভালোবাসা যে খানে পাঠাই ভাষা সে ভাষায় এসো বলি না।
চুপ করে শুনছিলাম। গান শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।

বল্লাম, অসাধারন।তুমি কেমন করে এত সুন্দর করে গাও বলো তো? বল্লো, তোমার ভালো লেগেছে, সত্যি? একটা প্রশান্তিতে ভরে গেলো চেহারাটা। বল্লো, এমনি করে তোমার পাশে সারা জীবন বসে থাকতে পারবো তো? ভাবলাম, কি হলো ওর? এমন কথা তো কখনই বলেনি এতো দিনে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের কথা পড়ার চেষ্টা করলাম। মনের ভাষা কি সব সময় বোঝা যায়, তবে গুনমুগ্ধের মতো ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। অন্য সময় গুলো তে এমন পরিবেশ হলে লজ্জা পেয়ে যেতো। এ কথা ও কথা বলে প্রসংগ ঘুরিয়ে নিতো। যা অতীতে হয়েছে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো, কোনো কথা বল্লো না। হয়তো আমার ভিতরের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে চেষ্টা করছিলো। কি পেলো তাও বুঝলাম না। পাশা পাশি বসে আছে, মুখটা ডান দিকে ঘুরিয়ে কি যেন চিন্তা করছে। সেটা কি আমার কাছ থেকে কিছু আড়াল করার জন্যে? না কি কিছু একটা চিন্তা করছে গভীরভাবে? অসম্ভব ধীশক্তি সম্পন্ন মানুষ, মনের ভিতর কি হচ্ছে সেটা কোনো মতেই বুঝতে দেবে না, নিজেই নীলকন্ঠের মতো সব কিছু হজম করবে। একটা আলাদা ধাঁচের মানুষ, যার স্বাতন্ত্রতা সহজেই বোঝা যায়। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউষ্টন, টেক্সাস, আমেরিকা